জয়ধরখালী ১০ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ১০ || শেখ লুৎফর

মফি মিয়া কাছু মড়লের পোলাপানের নানা হলেও সে জয়ধরখালীর সকলের নানা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল স্তরের চেংড়ারা তার ভক্ত। এই লম্বা দবদবা সাদা দাড়িসমেত ফর্সা মানুষটাকে দেখতে আউলিয়া গাওছকুতুব লাগলেও, আল্লা-খোদা বিষয়ে তার এলেম জটিল। পরনে সাদা পাঞ্জাবি হাতে একটা বেতের লাঠি নিয়ে মাঝেমাঝে বুড়া এসে তার ছোটমেয়ের বাড়িতে উদয় হয়। একজায়গায় বেশি দিন থাকা তার ধাতে নাই। বুড়াকালের অকর্মা দিনগুলো সে মেয়েদের বাড়িতে বাড়িতে বেড়ায়া কাটায়। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় সাড়ে-তিনটাকা পকেটে নিয়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। তারপর ঢাকা-কলকাতা, হিল্লিদিল্লি কত দেশ ঘুরেছে! দুনিয়ার হেন কোনো কর্ম নাই যা সে সেই মুসাফিরির জামানায় করেনি। বৃটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনদফায় পাঁচ বছর জেলও খেটেছে। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় টইটুম্বুর হয়ে যৌবনের শেষদিকে এসে বিয়েও করেছিল। কিন্তু মানুষটা সংসারী হলো না কোনোদিন।

কথায় কথায় শাস্ত্র-সিলুক কয়। জোশে থাকলে মাইকেল কিংবা রবিঠাকুরের দশহাত লম্বা লম্বা কবিতা মুখস্থ শুনিয়ে আইএ-বিএ ক্লাসের ছাত্রদেরকে ভড়কে দেয়। সুযোগমতো চেংড়া নাতিদের কাছে নারী বিজয়ের দুই-একটা কাহিনিও বয়ান করে হা হা হাসিতে আসর মাত করে ফেলে।

ইস্কুলের মাঠের জামতলায়, বেদেবহরের উত্তরের চাতালের কড়ুইতলায় কিংবা আখড়ার কাঁঠালতলায় জমে-ওঠা আড্ডায় সবসময় সে মধ্যমণি। গপ্পের ফাঁকে, মাঝেমাঝে হাতের লাঠিটা দিয়ে সামনের মাটিতে ছোট্ট একটা টোকা মারার ভঙ্গি দেখলেই মনে হবে, জয়ধরখালীর মফিনানা বহুদিন ধরে তার জীবনটাকে বাজাইতেছে।

আশপাশের গ্রামগুলো থেকে কেউ কেউ শুক্কুরবারে কংশেরকুলের বড় হুজুরের মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করে। মানুষের জীবনে কত মছিবত, কত যন্ত্রণা। এক আল্লা ছাড়া তার নিগাবান কে আছে? কেউ মানত করে যদি তার পেটের ব্যথাটা ভালো হয়ে যায় কিংবা যদি তার দুধের গাইটা লাথি মারা বন্ধ করে দেয় অথবা যদি তার বাঞ্জা বউটার পেটে একটা বাচ্চা আসে, তাহলে সে তিন শুক্কুরবার কংশেরকুলের হুজুরের পিছনে দাঁড়িয়ে জুম্মা আদায় করবে। এইসব পেরেশানি থেকে উদ্ধারের আশায় ফিরবার সময় হুজুরের কাছ থেকে কেউ শিশিবোতলে করে নিয়ে আসে পানিপড়া, কেউ কেউ আনে তাগা-তাবিজ। এইসব মানতকারীদের কেউ মফিনানার সামনে পড়ে গেলে সে হাতের লাঠিটা পথে ফেলে মানুষটাকে আটকায় : পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, কানের পাতার পরতে তুলায় মাখা সস্তা আতরের গন্ধ নিয়ে পথচারি থমকে দাঁড়ায়, — আসসালামু আলাইকুম।

বয়স, ব্যক্তিত্ব ও এক-ধরনের বুনো আভিজাত্যে-ঝাঁঝালো মফিনানা সালামের উত্তর না দিয়ে লোকটাকে জিগায়, কৈ যাও?
— কংশেরকুল।
ক্যালিগ্গ্যা?
— জুম্মা পড়তে।
কী যে কাণ্ড! তুমগর মরছিদে আল্লা আয়ে না?
হতভম্ব লোকটা ভ্যাবলাচোখে মফিনানার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় নিকট-শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল মফিনানার চোখের দিকে তাকিয়ে বেফানা মানুষটার জবান যেন নাই হয়ে গেছে।

মফিনানা লোকটার পায়ের কাছের মাটিতে হাতের লাঠিটা দিয়ে আস্তে আস্তে তাল ঠুকতে ঠুকতে জিগায়, — তুমগর জুম্মাঘরে যুদিন আল্লা না আয়ে তাইলে আমার কাছে আইয়ো যে, আমি কৈয়া দ্যামনে কৈ আল্লা আছে।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you