কয়েকজন সৈনিক যাহারা জঙ্গলে লুকাইয়াছিল তাহারা দূর হইতে দেখিল যে তিনি জলে নামিয়া অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া পুনরায় ফেলিয়া দিলেন। পান করিলেন না। তদনন্তর তীরে উঠিয়া সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র, অবশেষে অঙ্গের বসন পর্যন্ত দূরে নিক্ষেপ করিয়া শূন্যশির শূন্যশরীরে দণ্ডায়মান আছেন। স্থিরভাবে স্থিরনেত্রে ধনুর্ধারী শত্রুদিগকে দেখিতেছেন, মুখে কোনো কথা নাই। ক্ষণকাল পরে তিনি ফোরাতকূল হইতে অরণ্যাভিমুখে দুই-এক পদ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। শত্রুগণ চতুষ্পার্শ্বে দূরে দূরে তাঁহাকে ঘিরিয়া চলিল। যাইতে যাইতে জেয়াদ পশ্চাদ্দিক হইতে তাঁহার পৃষ্ঠ লক্ষ্য করিয়া এক বিষাক্ত লৌহশর নিক্ষেপ করিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে সে-শর তাঁহার বামপার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল। শব্দ হইল, সে-শব্দেও তাঁহার ধ্যানভঙ্গ হইল না। অতঃপর সিমারের শর। তির পৃষ্ঠে না লাগিয়া গ্রীবাদেশের এক পার্শ্ব ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। তাঁহার ভ্রূক্ষেপ নাই। যাইতে যাইতে অন্যমনস্কে একবার গ্রীবাদেশের বিদ্ধস্থান হস্ত দিয়া ঘর্ষণ করিলেন। জলের ন্যায় বোধ হইল, — করতলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, জল নহে, গ্রীবানিঃসৃত সদ্যোরক্ত।
কিছুদূর যাইয়া তিনি আকাশপানে দুই-তিনবার চাহিয়া ভূতলে পড়িয়া গেলেন। সিমার খঞ্জরহস্তে একলম্ফে তাঁহার বক্ষের উপরে গিয়া বসিল। তীক্ষ্ণধার খঞ্জর তাঁহার গলায় সজোরে চালাইতে লাগিল। কিছুতেই কিছু হইল না — তিলমাত্র চর্মও কাটিল না। অকস্মাৎ তাঁহার চক্ষু উন্মীলিত হইল। স্থির কণ্ঠে তিনি বলিলেন, “আমার অপরাধ, সিমার?” অট্টহাস্য করিয়া সিমার বলিল, “তুমি স্বৈরাচারী, উৎপীড়ক। তোমার কুশাসনে মদিনাবাসীদিগের শুধুমাত্র অশনবসনের সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে তাহা নহে, উপরন্তু মনোজগৎ এবং ধর্মাচরণের দ্বারও রুদ্ধ হইয়াছে। তোমার মাথা কাটিয়া লইলে মহাত্মা এজিদ আমায় পুরস্কৃত করিবেন; অতঃপর তাঁহার সুশাসনে মদিনায় লোকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হইবে।” তাঁহার চক্ষে উৎকীর্ণ অবিশ্বাস দেখিয়া সিমার পুনর্বার কহিল, “যে-মদিনা তুমি ছাড়িয়া আসিয়াছ, তাহা এক্ষণে এজিদের অনুগত। আমি তো নিমিত্তমাত্র, প্রজাগণই তোমার দণ্ড যাচনা করে।”
“হয়তো … হয়তো এমনই ঠিক” — তাঁহার ওষ্ঠ কাঁপিয়া উঠিল, “হয়তো এভাবেই আমি মৃত্যুর সন্ধান পাব।” কী আশায় তাঁহার গ্রীবা শিথিল হইল!
পাঠক, কী লিখিব! লেখনী সরে না। ইত্যবসরে যে-চমৎকার কাণ্ড ঘটিল তাহার অনুপুঙ্খ বর্ণনার সাধ্য আমার নাই। অবশেষে সিমারের খঞ্জর তাঁহার কণ্ঠে বসিল। তিনি চক্ষু নিমীলিত করিলেন। সর্বশক্তি দিয়া খঞ্জর বসাইয়া অবশেষে পাষণ্ড সিমার দেহ হইতে মস্তক বিভক্ত করিল। আকাশ, পাতাল, অরণ্য, সাগর, পর্বত, বায়ু ভেদ করিয়া চতুর্দিক হইতে রব হইতে লাগল — হায় হায়! হায় হায়!
চমৎকার ইহা নহে। রে সিমার, তুই কি ভাবিলি মস্তক বাস্তবিকই ছেদন হইয়াছে! হে পাঠক, সিমার যাহা লইয়া গেল বস্তুত তাহা মায়ামস্তক। সে দৃষ্টিপথে বিলীন হইতেই, ঐ দেখ, তাঁহার দেহ ও মস্তক পূর্ববৎ অভিন্ন হইল। তিনি উঠিয়া বসিলেন। অন্যমনস্কভাবে দুই-এক পদ করিয়া চলিলেন। মদিনা হইতে বহির্গমনকালে যে-কুক্কুর তাঁহার সমভিব্যাহারী হইয়াছিল, সে শুধু তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল।
কবিতাবই ‘জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়’ থেকে এই কবিতাংশটুকু উদ্ধার করে এইখানে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। এই অংশটুকু ‘সৌতিকথন’ শীর্ষক একটি দীর্ঘকবিতার অন্তর্গত। জয়দেব বসু প্রণীত কবিতাবই ‘জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়’ তিন-তিনটি দীর্ঘকায় কবিতার সমাহার। এর প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ১৯৯৩। বইয়ের প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত। জয়দেবের এটি ছিল চতুর্থ কবিতাবই। খ্রিস্টাব্দ ২০১১-য় এই কবির শরীরী জীবনের যবনিকা ঘটে। — গানপার
… …
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
- সিনেমার চিরকুট ৮ - January 19, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২ - January 17, 2025
COMMENTS