কবি নূরুল হক প্রণীত কবিতাস্তবক : ভূমিকা
প্রয়াণের অব্যবহিত পরেই চিরকাল কবির প্রকৃত উত্থান ও পাঠ-উদ্ঘাটন ঘটে এই বাংলায়। কিংবা মারা যাবার পরে স্রেফ একটা বিশেষণ-অভিধায় আটকা পড়েন কবিরা। কেউ পল্লিসম্রাট, কেউ নগরকুতুব, কেউ প্রধান কেউ গুরুত্বপূর্ণ ইত্যাদি বিশেষণে একেকজন কবির কনফাইনমেন্ট ঘটতে দেখি আমরা সবসময়। মৃত্যুর পরে সপ্রেম পঠিত হবার ভাগ্য কয়জনের জোটে? কবি নূরুল হকের জুটেছে এবং জুটবে আরও।
পত্রস্থ কবিতাবলি ‘নিরন্তর’ পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যা ফাল্গুন ১৪০৬ বসন্ত সংকলনে এর আগে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকার সম্পাদক নাঈম হাসান এবং এইটা ঢাকা থেকে বেরোত। নূরুল হকের কবিতা ‘সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক পত্রিকা’ (লিটলম্যাগ ধাঁচের বড়-কলেবর সুদৃশ্য পত্রিকাটি) ‘নিরন্তর’-এ ছাপা হয়েছে একাধিকবার। কোনো সংখ্যায় প্রবন্ধও। চতুর্থ সংখ্যায় যেমন দেখব ‘শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় : কবিতার দিকে একজন’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধটি লিখেছেন নূরুল হক। ও আচ্ছা, আরেকটা তথ্য, প্রবন্ধ-ছাপানো সংখ্যায় নূরুল হক কবিতা লিখেছেন বলে দেখি নাই কখনো।
‘নিরন্তর’ যে-সংখ্যা থেকে এই কবিতাগুলো চয়ন করা হয়েছে, সেই সংখ্যা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিবেদিত এবং যেখানে ইলিয়াসের ডায়েরি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় শাহাদুজ্জামানের সংগ্রহ ও সম্পাদনায়। ইলিয়াসের ডায়েরিগুলা শাহাদুজ্জামানের সম্পাদনায় নিরন্তর পত্রিকায় ছাপা হয়া পাঠকসমক্ষে আসবার বছরেই চোরের খপ্পরে পড়ে এবং পত্রিকায়-ছাপা ডায়েরিগুলার টাইপো সহ ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে তড়িঘড়ি বই-আকারে বের করে সেই চোর এবং ধিক্কৃত হয় পাঠকসমাজে ধরা খাবার পরে। অ্যানিওয়ে। এইগুলা আলগ স্মৃতি।
এইখানে ‘নিরন্তর’ থেকে কবিতাগুলা ছাপা যাচ্ছে পুনরায়। এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য কবিতাগুলা পড়া, আরেকটা কারণ কবিতাগুলা কবির ছাপানো বইগুলার লগে মিলায়া পাঠ করা আদৌ কোনো কবিতা গ্রন্থের বাইরে রয়ে গেল কি না। টাইপ করার সময় ঝটিতি খেয়াল করলাম অন্তত ৩/৪টা কবিতা ২০০৭ সালে ছাপা-হওয়া কবির অভিষেক-কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ আছে। এই বইতেই কিংবা অন্য বইতে বা ২০২০ ফেব্রুয়ারিতে ছাপা-হওয়া তাঁর কবিতাসমগ্রতেও খুঁজে দেখা যাবে এর সবগুলা অ্যাকোমোডেটেড কি না।
আরেকটা কথা। ‘নিরন্তর’ মূলত গদ্যেরই প্রাধান্যবহ পত্রিকা। তারপরও অল্প তিন-চারজনের কবিতা ছাপা হতো। কবিদের সূচিটাও মোটের ওপর কমনই ছিল। কয়েকজনেরই ঘুরেফিরে কবিতা ছাপা হতো। প্রত্যেকেরই একাধিক/একগুচ্ছ কবিতা। প্রেজেন্টেশন খুবই দৃষ্টিনন্দন হতো। ‘কবিতাস্তবক’ উপবিভাগেই কবিরা পাতভুক্ত হতেন। এই রিপ্রিন্ট সংকলনের নাম তাই ‘নিরন্তর কবি নূরুল হক : কবিতাস্তবক’।
অলরাইট। আপাতত কবিতাগুলা পড়ি। মৃত কিংবা জীবিত কবির সৎকার তার কবিতাপাঠেই সম্ভব, অন্য কোনো উপায়ে এতটা বোধহয় সম্ভব নয়। — জাহেদ আহমদ
বৃত্তান্ত
ঘন-নিদ্রা ছিঁড়ে সারারাত
এখানে এসেছি।
এখন সেই কথা বলি,
বুকের দুধ মুখে তুলে দিত যে মায়েরা
. তাদের স্বপ্নের মধ্যে আমাদের বাস ছিল
কত দূরের খেলার ধুলো এখনও পায়ে লেগে আছে
আমরা কুঁড়েঘরের দক্ষিণে হাওয়া খেতাম
আমাদের গালে এসে ঠেকত টিয়েপাখির রোদ
আর
দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ত সুন্দরী মেয়েদের জীবন
যাদের হৃৎপিণ্ডে পড়ে থাকত দীর্ঘশ্বাস
শুকনো পাতার মতো উড়িয়ে দিত দূরে
আমরা বুকের হাহাকার দিয়ে জলে ঢেউ দিতাম
এইসব, মনে রবে এইসব
মনে রবে চিরুনি-আঁকা দিন।
একদিন
একদিন তুমিও বুঝবে
. বুঝবে পৃথিবী
আকাশ ঘোলাটে হবে গোলকমণ্ডলে
বুঝবে তিব্বতী হাওয়া
. উত্তরপশ্চিম থেকে এসে
. ল্যাপল্যান্ডীয় মেঘ জমবে আকাশে
জীবনের ক্ষণতিকালের চিহ্ন এঁকে দিয়ে বইবে জীবন
এ জন্মের আদিহীনতার কথা
নীলিমার নক্ষত্র ছড়াবে
একদিন তুমিও বুঝবে।
বারণপঙক্তি
নদীতে না যাইও রে বৈদ নদীতে না যাইও
নদীর ঘাটে ঘোলা রে ঘোলা পানি — লোকগীতি
নদীতীরে যেয়োনাকো হাওয়া
নদীতীরে শৈশবের ঘাস
কার প্রেম শুকায় গোলাপ
নাকে লাগে দূরের নিশ্বাস
পার হলে ঘুঘুর দুয়ার
ঘরে ঘরে সীতা বনবাস।
স্বদেশ
গাছের ছায়ার নিচে
. সন্ধ্যা ফেলে এসে
. ডালপালা
পাতার উপর ফেলে চাঁদ
. আমি আর একটি নক্ষত্র মিলে
. প্রতীক্ষা করেছি
কত হাওয়া পার হয়ে
. এখানে এসেছি, স্বাধীনতা,
ভোরের আস্বাদ।
অন্যদিন
আমার আপন ভাষার আত্মীয়জন কাছাকাছি থাকবে কোথাও
যখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব নদীর কূলে
হাটফেরতা লোকেরা লবণওয়ালাকে ঠকিয়ে আসার কাহিনী
বলাবলি করতে করতে ঝুঁকে পড়বে সামনে
. আর হৈ হৈ হাসবে
যখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব নদীর কূলে
পুবের সূর্য একটু একটু করে এগিয়ে যাবে পশ্চিমে
আর ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় করতে করতে
. ডালিমদানার মতো ছড়িয়ে পড়বে কোথাও
যখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব নদীর কূলে
প্রকৃতি
অরণ্য-আত্মাও বোঝে সে-মুহূর্ত, নৈঃশব্দ্যের ছোঁয়া পেয়ে
. অকস্মাৎ চাঙ্গা হয়ে ওঠে
রৌদ্রের মূল্যের দিকে নিভৃত কবাট খুলে
. ছেঁকে নেয় আহূত নির্যাস
রৌদ্র যেন শূঁড়
. ঢেলে দেয় কত যে গরিমা
নদীর পদবিরিক্ত বালুচরে
. স্থগিত স্রোতের রেখা এঁকে
প্রকৃতির অবনত ঘুম।
দাড়িমছায়া নদীর তীরে
দাড়িমছায়া নদীর তীরে
. আমরা বাস করেছি অনেকদিন
খেলার মাঠের পথঘেঁষে শুনেছি
. নাকছাবি পাখির গান
আমাদের কুঁড়েঘরে এসে হেলে পড়ত উত্তরদেশের হাওয়া
. যেন দূর কোনও পাহাড়ি নাগরিকের ফলের গাছ
. নুইয়ে দিয়ে এখানে এসেছে।
সর্ষেখেতের মাঝখানে দেখা যেত সুন্দর সুন্দর পা
আমাদের পদক্ষেপে নদীর তীর হত
. ফুলে ঝলমল,
. ঢেউয়ে ঢেউয়ে বিস্তৃত
দূরে
. দক্ষিণের দেশে লোকেরা খুঁজে ফিরত সমুদ্র-মোহর
যার কিনারা আমরা কোনওদিন করতে পারতাম না।
দ্বীপের অভিজ্ঞতা
গাঙ্গেয় দ্বীপাঞ্চল ভোলা।
. এর সন্ধ্যাকালীন এক ঝোপের কিনারে গিয়ে
. আমি শুনে ফেলেছি চুড়ির শব্দ।
নিশ্বাসে হলুদ বালির ঘ্রাণ
. দূরে দিগন্তের রক্তক্ষরণ
চরের পাখির বুকের মতো তুলতুলে সেই সন্ধ্যা।
পালহীন এক অধীর জীবনারোহী আমি
. গাঙ্গেয় দ্বীপের অচিন গভীর স্রোতে
মনে হল, লতাপাতার দাঁড় আমি আর বাইতে পারব না।
কাক
ঘনসংবদ্ধ ঝরনার পানি
তরতর করছে কবুতরের মতো
আমার হৃদয়ে
. এক নিঝুম ডালে
কাকপক্ষীর মতো নামল তোমার নাম
এত লতাপাতা আর অরণ্যের গহনা
এক ভুতুড়ে নির্জনতায়
. আমি আর সেই পথহারা
. কাক।
না
এখানে আসব না আমি
. কাক, সূর্য, হরিণের ধূপ
. হৃৎপিণ্ডে ভরে নিতে
কোনও হীরেবতী নারী
. নিভৃতের
. অবিশ্বাসী সুখ
ফুরাতে কোকিলসন্ধ্যা চন্দ্রস্নানে ভেসে
. গানভাঙা রাতে
দিগন্ত নেব না কোলে আদিগন্ত শুয়ে ঢালুজলে।
সারাজীবন
পৃথিবীর
সব দ্বারে আঘাত করেছি জেনে
একদিন তৃপ্ত হব
. কাঁটার ভেতর।
বেলা-বুনন
নষ্ট শহরের মাকড়শা, তুমি
. জালে এ কোন অন্ধকার বুনছ?
তৈলাক্ত দিনের খেলায় চারদিক ঘুলিয়ে দিচ্ছ
আর
. এলমেল জীবনের নকশা
. জড়ো করছ এক উদ্ভ্রান্ত আয়নায়।
দুরাশা,
. হাতে ধরিয়ে দিচ্ছ মৃতদের রোমশ দুরাশা
ভাঙা কাচের মতো ঝরে পড়ছে
দেবদূতদের দিন।
এ বেলায়
জীবনের প্রতিপক্ষ যেন টাকার ঝনৎকার
শহরের প্রতিপক্ষ ঐ চাঁদ
ধাতব রাস্তার বিপরীতে দাঁড়ানো শান্ত ভোর
. আর হাঁসের ডানা
কে জিতবে কে জানে
কবি নূরুল হক প্রয়াণ ও স্মরণ : কয়েক রচনা
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS