আব্বাসউদ্দীন : আমাদের বাল্যের দেবতা, কৈশোরের কৃষ্ণ || উৎপলকুমার বসু

আব্বাসউদ্দীন : আমাদের বাল্যের দেবতা, কৈশোরের কৃষ্ণ || উৎপলকুমার বসু

‘সার … সার … জগদীশ পালাচ্ছে, সার।’
তা অবশ্য ঠিক। জগদীশ পালাচ্ছে। সক্কলের চোখের সামনে দিয়ে।
টিফিনের পর সবে স্কুল বসেছে। গোপী মাস্টার ব্ল্যাকবোর্ডে একটা নারকীয় অ্যালজাব্রা তুলে দিয়ে চেয়ারে এই বসেছেন। গেলাসের ঢাকনা সরিয়ে জল খেয়েছেন দু-ঢোঁক। আর আমাদের জগদীশ বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে, ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে, সকলের চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার পরনে ময়লা শার্ট-পাজামা। ক্লাস এইটেই সে প্রায় প্রমাণ-সাইজের লম্বা। মুখে দাড়িগোঁফ গজিয়েছে। বহুবছর ফেল করার গ্লানি ও হতাশা তাকে স্পর্শ করেনি। কানাঘুষো শুনেছি তার নাকি বিয়ের সম্বন্ধ চলছে। জিজ্ঞেস করায় সে শুধু বলেছিল … ‘ধুর, শালা।’

অনেকদিন আগের কথা বলছি। তখনও শিক্ষাব্যবস্থায় অব্জেক্টিভ টেস্ট চালু হয়নি। বিরাট বিরাট ইকুয়েশনের উত্তর লঘুভাবে এক বা শূন্যে পর্যবসিত হতো। সে ছিল সারল্যের দিন। গোপী মাস্টার প্রকাশ্যেই জগদীশকে নরকের কীট বলে ডাকতেন। সে একগাল হাসত। হাসতে হাসতে কিল মারত আমাদের পিঠে।

নরক নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু একটা কথা নিশ্চিত জানতুম যে সেখানে গেলেও জগদীশ ভারা-ই বাঁধবে। এ-টাউনে মঞ্চ তৈরি করা, চেয়ার-টেবিল যোগাড় করা এবং রঙিন শালু দিয়ে বিশ্বজগতকে মুড়ে দেওয়ায় তার কোনো জুড়ি নেই। আর আমি কী করব? এই হাফপ্যান্ট-পরা ক্যাবলা ছেলেটির হাতে যমরাজা নিশ্চয়ই কলের গান চালানোর ভার দেবেন। কেননা তাতে আমার টাউনময় সুনাম কিছু কম নয়। বস্তুত, আমি আর জগদীশ একত্র হলে স্বর্গেই হোক, নরকেই হোক — এবং এই বিভ্রান্তকারী পৃথিবীতে তো অবশ্যই — খুলে বসতে পারি গানের আসর, নাচের স্টেজ আর অভিনয়ের মঞ্চ।

আমরা দু-জনে একাই একশ।

***
সেদিন আকাশে হাল্কা সিগারেটের ধোঁয়ার মতো মেঘ। পুজোর ছুটি এসে গেল। এবার বিরাট জলসার আয়োজন। বাজারের বারোয়ারী সরগরম। গোগিয়া পাশা (ম্যাজিশিয়্যান) আসবেন। কলকাতা থেকে আসবে ড্যান্স পার্টি। আর আসবেন আমাদের বাল্যের দেবতা, কৈশোরের কৃষ্ণ আব্বাসউদ্দীন।

আসলে তিনি এসেও গেছেন। কালই বিকেলে আমরা তাঁকে স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছি। এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন। আমরা ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে তাঁর হারমোনিয়াম মাথায় ধরে নামিয়েছি। আর লোহার ট্রাঙ্ক। আর একঝুড়ি ফল। পার্বতীপুর জংশনে কেউ তাকে বুঝি উপহার দিয়েছে। সে-বছর তাঁর রেকর্ড ওয়ার্ল্ডহিট। আজ্ঞে হ্যাঁ। সারাপৃথিবীতে এই একটি রেকর্ড সে-বছর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে — ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’। আজকের দিনে যাকে বলা হয় গোল্ড। মাইকেল জ্যাকসনের আগে। বিটলসদের পূর্বে।

আর সেই রেকর্ড সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে আমাদের টাউনের এক অখ্যাত রেডিয়োর দোকান। তাদের নামে বিলেত থেকে শিল্ড এসেছে। অতিকায় প্যাকিং বাকশে। যখন বাকশো খুলে বের করা হয় তখন আমি আর জগদীশ একঝলক দেখে নিয়েছি। আমাদের চক্ষুস্থির।
কিন্তু পরে আবার ভরে রাখা হয়েছে নিখুঁতভাবে। আব্বাসউদ্দীন সেই বাকশো খুলবেন আনুষ্ঠানিকভাবে।

সমীকরণের সেই ক্লাসরুম, সেই প্রাক-উৎসবের মুহূর্ত আজ হারিয়ে গেলেও আমি জানি পথের শেষে টাঙানো আছে এক ঝলমলে লাল শালুর আনন্দ-আক্রান্ত ফেস্টুন। জগদীশ শোলা কেটে লিখেছে — ‘সুস্বাগতম’। সংস্কৃতের মাস্টারমশায়ের শব্দটি সম্বন্ধে ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও।

আর দূরে যে আশ্চর্য সংগীত শুনছি তা নিশ্চয় আমারই দম-দেওয়া কলের গান থেকে। কেবল পিনটা পুরনো হয়ে গেল। বোধহয় পাল্টাতে হবে।

গানপারটীকা
গানপারে এই গদ্যটা আমরা কালেক্ট করছি লেখকের গদ্যসংগ্রহ-১ থেকে। এইখানে পুনর্মুদ্রণকালে কেবল গদ্যশিরোনামটা আমরা পাল্টে নিয়েছি। ছিল ‘দম-দেওয়া গ্রামোফোন’ গদ্যটার নাম, আদিতে, গদ্যসংগ্রহে এই নামেই পাওয়া যায়, পৃষ্ঠা ২১৬-২১৭; রচনাটা প্রাপ্তির স্থান : গদ্যসংগ্রহ ১, উৎপলকুমার বসু, নান্দীমুখ সংসদ কলকাতা ২০০৫।

… …

আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you