সাক্ষাৎকারে বাউল আবদুর রহমান || মেকদাদ মেঘ

সাক্ষাৎকারে বাউল আবদুর রহমান || মেকদাদ মেঘ

[রোগশয্যায় শায়িত বাউলকে দেখতে ভিড় জমিয়েছেন শহরের কুতুবেরা, আশ্রাফ-আত্রাফ সবার সনেই বাউলের সুরসম্পর্ক, বাউল সলজ্জ বিস্ময়ে দেখছেন মানুষের ভালোবাসা। তার মতো অকেজোকে এতটা ভালোবাসতে পারে মানুষ, এইটা বাউলের দূরকল্পনাতেও ছিল না। বাউল নিজেকে কেবল দীনহীন মনে করেন তা নয়, নিজের জীবনযাত্রা আদ্যোপান্ত দীনহীনের মতো প্রতিনিয়ত বজায় রেখেছেন, বাউল শান্তিতেই আছেন বলিয়া কায়মনে জানেন এবং বাক্যে সেই শান্তির কথাই বলেন।

শত মানুষের আনাগোনা হাসপাতালে এবং সকলেই কিছু-না-কিছু পথ্য হাতে নিয়া বাউলেরই শিয়রে এসে কুশল জিগাইতেসে, এইসব দেখে বাউল বাষ্পরুদ্ধ হয়ে থাকেন সারাক্ষণ, এসবের অভিঘাতে বাউলের অন্তর্চক্ষু উদ্ভাসিত হয় কৃতজ্ঞতার আলোয়, বাউলের আঁখি ছলছল করে কাজলদিঘির বাঁশকালো জলের মতো স্বচ্ছ ও সাবলীল। ভিড় একটু কমে এলে বাউল তার শিয়রস্থ দুই-চাইরজন সুরসখার কাছে ব্যক্ত করেন সারাদিনান্তের প্রতিক্রিয়া। বলেন,

“অত মাইনষে আমারে দেখতা আইসইন, অত জ্ঞানীগুণী নামীদামী মানুষ তারা, আমি তো অখন ভালা অইয়া চলতে অইব-বা। আমি যুদি ভালা না অইয়া চলি, তে তারারে অসম্মান করা অইব। আমি যুদি আরবার বেমার পড়ি, তে তো তারারে আরবার কষ্ট দেওয়া অইব-বা, আমারে দেখার লাগি তারা আরবার আইবা। না না, ইকটা ভালা কথা নায়। আমি আর এখন থাকি চুরুট খাইতাম নায়-বা। আমি চুরুট খাওয়া ছাড়ি দিমু। অত নামীদামী মাইনষর সম্মান রাখবার লাগিয়া আমি অখন থাকি ভালা অইয়া চলমু।”

লোকটার সরল কথাবার্তা, চালচলন, বেশভূষা আকৃষ্ট করবে আপনারে; এবং আপনি যদি কিছুটা গানবাজনামুখো হন, তাইলে তো পোয়াবারো। মঞ্চে, কিংবা আটপৌরে আড্ডায়, ঘরোয়া আসরে, এই লোকের টান-দেয়া গান আপনারে দেশান্তরী করে ফেলবে হ্যাঁচকা টান দিয়া। হাসপাতালে বেডে-শোয়া বাউলের মাথায় গানের চিন্তা নাই অবশ্য, উনার মাথায় একটাই চিন্তা, অতগুলা মানুষ তারে দেখতে আসতেছেন, মানুষগুলা তারে এত উপদেশ-পরামর্শ দিয়া যাইতেসেন, উনাদের কথার মর্যাদা দিতে অইব, কথামতো চলতে অইব, বাকি-জিন্দেগি অসুইখ্যা অইলে চইলত নায়।

বাউলের নাম আবদুর রহমান। হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামে তার দৌলতখানা। চার দশক ধরে গেয়ে চলেছেন বাউলা ধারার গান। করিমের গান সবচেয়ে বেশি করলেও অন্যান্য মহাজনদের গানও করিয়া থাকেন।

“মইধ্যে মইধ্যে নিজের দুইয়েকটা গানও সুযোগ পাইলে গাই, কিন্তুক উস্তাদ করিম শা-র গানই গাইতে বেশি ভালা লাগে”

— যে-কোনো অন্তরঙ্গ আলাপে এই কথাটা আবদুর রহমান বলিয়া থাকেন। গুরুভক্তি বিনে এই রাস্তায় মানুষের সান্নিধ্য কুড়াইবার সোজা পন্থা নাই।

স্ত্রী-কন্যা নিয়া আবদুর রহমান ঝড়েঝাপ্টায় বিঘ্নে-বিপদে বেশ আছেন। সৎ রোজগার, অল্প কিন্তু উপাদেয়, সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু নিচুশির একমুহূর্তও নয়, শির উঁচা করিয়াই আছেন সবার সঙ্গে সমভাগী হয়ে। মেয়েটাকে এত ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও পড়িয়েছেন। সম্প্রতি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে মেয়ে। এইবার সংসারে শ্রী ফিরবে বলিয়া আবদুর রহমান জোর গলায় নিজেরে শোনান। অবশ্য লক্ষ্মীমন্ত সহধর্মিণী জীবনে পেয়েছিলেন বলেই তিনি এই-পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন বলে মনে করেন। কথাটা আদৌ অতিকথা না বলিয়াই বিশ্বাস হয়।

বাউল শাহ আবদুল করিম দেহ রাখবার পরে যে-কয়জন করিমশিষ্য যথাযোগ্য আদবের সঙ্গে করিমগান গাইছেন লোকালয়ে, বাউল আবদুর রহমান তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সরাসরি তিরিশ বছর করিমের সঙ্গ করেছেন, করিমের গানের খসড়া খাতায় টুকিয়া রাখবার দায়িত্ব ছিল রহমানের উপর ন্যস্ত। রহমান তা পালন করে গেছেন যথাসাধ্যি নিষ্ঠার সঙ্গেই। ইদানীং যা-কিছু সমাদর ও সম্মান পাচ্ছেন লোকালয়ে, সে-সব উস্তাদের কালামের গুণে — এই বিনয় বাউল আবদুর রহমানের একদম অন্তরোৎসারিত। যদিও রহমানের নিজের গানগুলো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, সম্পন্ন বৈভবে বিভাময়, মঞ্চে কিংবা আসরে সেগুলো কম গাইবার পিছনে স্রেফ গুরুপদনিষ্ঠা ছাড়া আর-কিছু থাকতে পারে না বলেই রহমান-অনুরাগীরা হামেশা ভাবেন। রহমান এইসব খুচরো কথায় নিরুত্তর থাকেন আর মুচকি হেসে গুরুর পদ কণ্ঠমুবারকে তুলিয়া নেন।

বাউল আবদুর রহমান রোগশয্যায় ছিলেন, সিলেটের হাসপাতালবিছানায় শিয়রে পেশাধর্মবর্ণগোষ্ঠী নির্বিশেষে এত মানুষের আকুল অবস্থান দেখতে দেখতে সেরে উঠেছেন আপাতত, সুসম্পর্ক নয় বরঞ্চ সুরসম্পর্কে বিশ্বাসী বাউল আবদুর রহমানের জীবনে এই অসুখ যেন নিজেকে চেনার এবং দয়ালকে চেনার এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল বলিয়া বাউল মনে করেন।

সোজাসাপ্টা হার্দ্য ও ঋজু মনোভঙ্গির এই মানুষটার সঙ্গে কথা বলেছেন মেকদাদ মেঘ। কবি, চিত্রশিল্পী, গানপ্রেমী, সংস্কৃতিকর্মক মেকদাদ মেঘের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপে বাউল আবদুর রহমান অকপট খুলেছেন নিজের অন্তর। — গানপার]

abdur rahman

________________________________________

“গানশ্রোতা গানসমঝদার নয়, এখন আছে খালি গানদর্শক”

অন্তরঙ্গ আলাপচক্রে বাউল আবদুর রহমান

আলাপ সঞ্চালনায় মেকদাদ মেঘ
________________

 

কেন বাউলগান করেন এবং কখন থেকে?

বাউলগানে আত্মশুদ্ধি, মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, মানুষে-মানুষে প্রেমপ্রীতি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি একনিষ্ঠভাব, সহজ-সরল হওয়া ইত্যাদির কথা বলে। আমি তো ছেলেবেলা থেকেই পল্লিগীতি, বাউল, ভাটিয়ালি গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছি। বলতে গেলে, গান আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। গান আমাকে ছাড়ল না

 

কিভাবে শাহ আবদুল করিমের সন্ধান পেলেন এবং তার কাছ থেকে কতটুকু মায়া পেয়েছেন এই জীবনে?

আমার জন্ম জলসুখা গ্রামে। শাহ আবদুল করিম এসেছিলেন আমার গ্রামের গানপিপাসী মানুষের আমন্ত্রণে। রাত্রে, গানের আসরে গিয়ে, দূরে বসে গান শুনে আমার মনে আশা জেগেছিল যে আমিও একদিন এইভাবে বেহালা বাজাইয়া গান গাইমু। এরপর থেকেই শাহ আবদুল করিম প্রায় নিয়মিতই জলসুখা গ্রামে আসা-যাওয়া করতেন। কারণ, শাহ আবদুল করিমের গান শুনে আমার গ্রামের কয়েকজন তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। উল্লেখ করতেই হয়, আমার জলসুখা গ্রামে সমাজতন্ত্রের দুইজন উল্লেখযোগ্য কর্মী বা নেতা ছিলেন। একজনের নাম মইনুদ্দিন (মইন মিয়া), আরেকজনের নাম তৈয়ব আলী (ডা. টি আলী, এমবিবিএস)। মইন মিয়া বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকতেন। এবং ডা. টি আলী পাকিস্তান আমলে ডাক্তারি পাশ করে ঢাকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। পাকিস্তান আমলে ঢাকায় ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি জন্মস্থান জলসুখায় বর্ষাকালে প্রতিবছর একবার আসতেন। ১৫-২০ দিন থাকতেন। এলাকার মানুষের সেবা করতেন। তিনি আসা মাত্র রোগীরা ভিড় জমাইত। গরিব-দুঃখী রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট (ফি) নিতেন না। শাহ আবদুল করিম আসা মাত্রই ডা. টি আলী ও মইন মিয়া এই তিনজন নীরবে বসতেন, সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকা নিয়ে আলোচনা করতেন। শাহ আবদুল করিম জলসুখা আসার এটাও একটা কারণ ছিল। দেখতে দেখতে আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত উঠলাম। কিন্তু গানের টানে আমার আর মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়া হলো না। একদিন এক ঘরোয়া গানের বৈঠকে শাহ আবদুল করিম আমার গান শুনে আমার জীবনবৃত্তান্ত শুনে বললেন, তুমি গান গাইতায় ফারবায়। তোমার লেখাপড়া আছে, তুমি তোমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তোমার বাবা নাই, তোমার মা যদি আদেশ দেন, তাহলে তুমি আমার শরণাপন্ন হইয়ো।


বাউলগানের মূলধারাগুলো কি কি
?

বাউলগানে প্রধানত দুইটি ধারা রয়েছে। বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদ।

২০১৫ সালের করিম উসব কি-রকম হলো?

এবার শাহ আবদুল করিম লোক-উৎসব ভালোই হয়েছে। প্রকৃতি এবার শাহ আবদুল করিম লোক-উৎসবের পক্ষেই ছিল।

হাওরের রূপবৈচিত্র্য এবং ভাটিবাংলার পরিবেশ আপনার গানে কি-রকম ভূমিকা রেখেছে?

একটি গানে সংক্ষেপে আমি এ-ব্যাপারে বলেছি :

আমার হাওর এলাকায় বাড়ি
ঝড়বাদলে খরা-বর্ষায়
কত কষ্ট করি।।

ফসল ঘরে উঠিলে ভাই
পুরাতন দুঃখ ভুলে যাই
মিলেমিশে সময় কাটাই
গেয়ে জারি-সারি।।

বিকালবেলায় সবুজ ঘাসে
বসি আমরা কাজের শেষে
ছেলেরা মুক্ত বাতাসে
উড়ায় সাধের ঘুড়ি।।

হাওরের বৈচিত্র্যের টানে
কয় বাউল আবদুর রহমানে
মন মিশেছে বাউল গানে
ভুলিতে না পারি।।

 

‘ভাটির সুরআপনার গানের বই। বিষয়বৈচিত্র্যের বিবেচনায় এই বইয়ের গানগুলোতে কি কি বিষয় স্থান পেয়েছে?

ভাটিবাংলায় আমার জন্ম। ভাটির আলোবাতাসে বেড়ে উঠেছি। ভাটির পরিবেশ চিন্তাচেতনায় আমার মধ্যে কাজ করে। তাই আমার গানের প্রথম বইয়ের নাম দিয়েছি ‘ভাটির সুর’। ‘ভাটির সুর’ বইটিতে যে যে বিষয়গুলি স্থান পেয়েছে সেগুলি হলো আল্লাস্মরণ, নবিতত্ত্ব, ওলিস্মরণ, মুর্শিদী, মনশিক্ষা, দেহতত্ত্ব, মায়ের স্মরণ, কারবালা স্মরণ, বিচ্ছেদ, সাক্ষাৎগান, পুরুষের উক্তি, ঘাটুগান, দেশের গান, গণসংগীত, ও বিষয়ভক্তি ইত্যাদি ধারায় গান উল্লেখযোগ্য। আমি গানের ভেতরে বাংলার লোকায়ত বৈচিত্র্যকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি।


পরিবার-পরিজন নিয়ে কিভাবে আছেন
? জন্মস্থান জলসুখাকে কেন ভালো লাগে?

পরিবার-পরিজন নিয়ে অজস্র সংকটের মধ্যেও আমি ভালো আছি। আমার সহধর্মিণী সাজেদা আক্তার সুখে-দুঃখে আমার সঙ্গে জীবনযাপনে অংশগ্রহণ করে চলেছে। আমি গান গাই, গান ছাড়া অন্য কোনো কাজে আমার মন বসে না। পরিজনের মধ্যে কিংবা গ্রাম ও গ্রামের বাহিরে কোনো মানুষের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নাই। আমাকে সবাই ভালোবাসে। আমিও মানুষের ভালোবাসা চাই। আমার জলসুখা গ্রামে কামার, কুমার, জেলে, ঋষি, মালি, তেলি, তাঁতী, মুচি সহ বিভিন্ন পেশার মানুষের বসবাস ছিল বলেই জলসুখা গ্রামকে নবসনা গ্রাম বলা হয়। আমার রচিত কয়েকটা গানে আমি নিজের গ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছি।


শাহ আব
দুল করিমের জীবনদর্শনটি ঠিক কি? মানে, ব্যাপারটা কি সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলা যাবে? এবং মানবজীবনে করিমের গানের গুরুত্ব কতটা? আপনি ঠিক কি কারণে তার গান হৃদয়ে লালন করেন?

আমি ছত্রিশ বছর শাহ আবদুল করিমের সঙ্গ করেছি। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল  করিমের জীবনদর্শন হলো, সাধনার মাধ্যমে দেহের আত্মাকে সচেতন রাখা। তিনি বলতেন : অল্প আহারে, উপবাসে, আত্মার বল বাড়ে। আত্মার বল না-থাকলে সত্য-সাহসী হওয়া কঠিন। আমি কি পেয়েছি সেটা বড় কথা নয়। আমি কি দিয়ে গেলাম সেটাই বড় কথা। মানুষের কাছে কিছু চাওয়া-পাওয়া নয়, আমি আমার দয়ালের দয়া চাই। আমি মানুষের ভালোবাসা চাই। গানে বলেছেন —

আপনাকে ভালোবাসি
বিশ্বাস করে হও সাহসী
আপন ঘরে মক্কা-কাশী আছে গোপনে।।

যেখানে অন্যায়-ব্যতিক্রম দেখেছেন সেখানে প্রতিবাদী গান ধরেছেন। অন্যের ভুল বা সমালোচনা নয় নিজের ভুল বা সমালোচনা করাই ছিল প্রাথমিক বিষয়। আমি যেমন গরিব আমার মতো আরও লক্ষ লক্ষ গরিব রয়েছে তারা বাঁচলেই আমি বাঁচব। এই লক্ষ্যেই কাজ করে যাব। গানের মাধ্যমে আপোসহীন সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকতে চাই। এ-রকমই সহজ-সরল ভাষায় জীবনাদর্শ তুলে ধরতেন শিষ্যদের সম্মুখে শাহ আবদুল করিম। তার গানের মর্মার্থভেদ গুরুত্বের কথা বলতে হলে বলা যায় যে, শাহ আবদুল করিমের গানের কথা অতীব সহজ থেকে আরো সহজতর। যা একেবারে উচ্চশিক্ষিত থেকে আরম্ভ করে একেবারে ভাটিবাংলার সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। লালন, হাছন, রাধারমণ, আরকুম শাহ, ফকির শিতালং শাহ, শেখ ভাণু, দীনহীন, সৈয়দ শাহ নূর — এদের খাঁটি উত্তরসুরি আমার ওস্তাদ ও মুর্শিদ শাহ আবদুল করিম। তিনি আমার দুইকূলের পথপ্রদর্শক। তিনি বলেছিলেন, আমি টাকাপয়সা চাই না, আমার গানগুলো যেন মানুষের মাঝে স্থান পায়। শাহ আবদুল করিমের গান প্রচার করা আমার দায়িত্ব বলে মনে করি। তার সকল গানের পাণ্ডুলিপি আমারই হাতে লেখা। সৃষ্টিকর্তা থেকে শুরু করে এমন কোনো দিক নাই যেদিকে শাহ আবদুল করিমের গানরচনা নাই। এইটা শাহ আবদুল করিমের গানের বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য পুরো বাঙালিকে সাহস দিয়ে যাবে যুগযুগান্তর।


বর্তমান বাউলরা কি কি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে
?

শুধু বর্তমান বাউলরা নয়, মনের কথা গানে প্রকাশ করার আরম্ভ থেকেই মৌলবাদীরা ফতোয়া দিয়ে এসেছে। গান গাওয়াকে লা শরা, বেদাত, হারাম, গুনার কাজ বলে আখ্যায়িত করে থাকে তারা। তারপরও গানের শুরু থেকে এই পর্যন্ত গান থেমে থাকে নাই। শত বাধা পেরিয়ে গাওয়া হচ্ছে। তা চলবেও মাটির মানুষ, মাটির সুর দিয়ে। লাউয়া, ডপকি, একতারা, দোতারা, বেহালা, মন্দিরা সহ অন্যান্য যন্ত্র বাজিয়ে গান তথা ছন্দে অথবা মনের ছন্দে, সুরের ছন্দে, অন্তরের কথা প্রকাশ করে বাউল। বর্তমানে বাউলরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হইতেছে। ব্যান্ডবাজনা, যে বাজনায় মাটির সুর দেয়া সম্ভব নয় — তাও বাধা প্রদান করছে। আগে বলা হতো গানের আসর, এখন বলা হয় কন্সার্টে যাই। গান যারা বুঝত, তাদের বলত শ্রোতা বা সমঝদার, এখন আছে শুধুই দর্শক। অর্থাৎ তারা দেখে নাচভঙ্গি, এবং বাজনার তালে তালে ওরা নাচে।  আর হইচই করে। এ-রকম বহুবিধ সমস্যা গানের জগতকে একটু এলোমেলো করে দিচ্ছে। তারপরও নিরাশ নই। এক-কথায় বলতে পারি, মন হতে সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে গান অনবদ্য হাতিয়ার। বর্তমান বাউলদের উপর যে আগ্রাসন চলছে, সেই আগ্রাসন দূরীকরণে ও মানবতাকে জীবিত রাখতে অসাম্প্রদায়িকতার গানই হলো মূল হাতিয়ার।


বাউলসম্রাট
রসের নাগর শাহ আবদুল করিমের কোন বাক্যটি আজও মনে পড়ে?

আমার পিতা ঘাটুগান, বাউলগানের সংগঠক হিসেবে কাজ করতেন। এক-দুইটা গানও গাইতেন। নিয়মিত পাঁচ-ওক্ত নামাজ পড়তেন। পুঁথিপড়া ছিল বাবার নেশা। পুঁথিপাঠ করার জন্য সেই সময় বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডাক আসত। তিনি যাইতেন। সেই রক্তে আমার জন্ম বলেই ছোটবেলা থেকেই আমি গানে মগ্ন থাকতাম। গান আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। আমি আমার ওস্তাদ ও মুর্শিদ শাহ আবদুল করিমকে একবার বললাম, আমি গান আর গাইতাম না, গান গাওয়া ছাড়িয়া দিমু। উত্তরে তিনি বললেন, গান তুমি ছাড়তায় পারো, গানে তোমারে ছাড়বে না। এই বাক্যটি আমার জীবনে চরম সত্যে রূপান্তরিত হলো।

… …

 

মেকদাদ মেঘ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you