নব্বইয়ের যাত্রালগ্নে স্বকীয়তা-অভিলাষী কবির তালিকায় আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ বোধহয় ব্যতিক্রম যিনি ফররুখ আহমদ ও আল মাহমুদের কাফেলা বিগত তিন দশক ধরে কবিতার ভাষাঅঙ্গে ছায়ার মতো বহন করে চলেছেন। ওবায়দুল্লাহর নির্মিতি অবশ্য সময়ের পটপরিবর্তনে ফররুখ ও মাহমুদ থেকে স্বাভাবিক নিয়মে পৃথক। কবির ইমানি জোশ মরমে ফররুখবান্ধব মনে হলেও দীনী চেতনায় রঙিন ফররুখের স্বাপ্নিকতা সেখানে মহীয়ান হওয়ার পথ পায়নি। বিগত তিন দশকে ইসলামকে ঘিরে সাংঘর্ষিক বয়ান জনসমাজে জায়গা করে নিয়েছে, যদিও কবির ভাষাঅঙ্গে সেই বয়ানের ঘূর্ণি একরৈখিক লয়তালেই বহে! ইসলামি নবজাগরণের প্রশ্নে ফররুখের যুগবিশ্বে তিনি দাঁড়িয়ে নেই অথচ দল-উপদলে বিভক্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের অবক্ষয়ের কার্যকারণ ঘিরে প্রশ্ন, সংশয় এমনকি আত্মসমালোচনা ওবায়দুল্লাহর কবিতায় কেন যেন বহুস্বরিক হয়ে উঠতে আপত্তি জানায়। তাঁর কবিতাপাঠে পুনরায় ভ্রমণের ক্ষণে মনে প্রশ্নগুলো তাই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে :—
ইসলামি দীনের প্রকৃত স্বরূপ কোনটি?—ইসলাম ও মুসলমান শব্দে নিহিত অর্থকে কোরান যেভাবে নির্ধারণ করে সেটি? যদি তা-ই হয় তাহলে অনধিক হাজার বছর ধরে ইসলামি দীনের যে-স্বরূপ চোখে পড়ে সেটি কি কোরান-এ চিত্রিত স্বরূপের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে? ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ঘাত-প্রতিঘাতে সৃষ্ট ও ঐতিহ্যে পরিণত ইমানি চেতনায় মুসলমান সম্প্রদায়কে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে, প্রশ্ন হলো এই চেতনার সাহায্যে কোরান নির্ধারিত ইসলামের সারবত্তা কি উপলব্ধি করা সম্ভব? মসনদকেন্দ্রিক লক্ষ্য হাসিলে হাজারো সত্য-মিথ্যার ভিয়েন মিশিয়ে রচিত হাদিস-সুন্নাহ এবং কালের গতিতে অতিকায় আকার ধারণ করা ব্যাখ্যাবিজ্ঞানে (Hermeneutics) ভর দিয়ে দাঁড়ানো ইসলামের আলোকে ‘সরল দীন’ নামে কোরান যাকে চিহ্নিত করে তার নাগাল কি পাওয়া যায়? ইসলাম রক্ষা ও প্রসারের প্রয়োজনে হাজার বছর ধরে সংঘটিত জিহাদের সঙ্গে কোরান-এ সংজ্ঞায়িত জিহাদ কি অভিন্ন?
প্রশ্ন ওঠে, কোরান সংজ্ঞায়িত হাদিস-সুন্নাহর সঙ্গে সুন্নি-শিয়া-সালাফি-ওয়াহাবি ইত্যকায় দল-উপদলে বিভক্ত সম্প্রদায়ের হাদিস-সুন্নাহকেন্দ্রিক ধারণা ও অনুশীলন কি সমার্থক? ইসলামি দীনের ছায়াতলে সমবেত সম্প্রদায় মহানবির ওফাত লাভের অনধিক আড়াইশ’ বছর পর ঐতিহাসিক যেসব ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে মুসলমানির চর্চায় লিপ্ত, তার সঙ্গে কোরান বর্ণিত ইতিহাসচেতনায় দীক্ষিত মুসলমানকে একাত্ম ভাবার অবকাশ থাকে কি? ‘তোমরা ইব্রাহিমের মিল্লাত অনুসরণ করো।’ — এই বাক্যসূত্রে তাওহিদ, সালাত, সিয়াম, হজ, যাকাত, সদকা ও উত্তম আচরণের যেসব বিবরণ কোরান সুস্পষ্ট করে তার নিরিখে বিশ্বজুড়ে চর্চিত ইসলামি আচার-বিচারের যোগসূত্র কি নিবিড়? ওবায়দুল্লাহর ভাষাঅঙ্গে চুঁইয়ে-পড়া ইসলামের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান হালত ঘিরে বহমান আর্তির মধ্যে সেই মনোশুদ্ধি কি প্রতিফলিত প্রারম্ভিক সূরা ফাতিহা যাকে ক্লিয়ার করে যায় :—
স্মরি তাঁর নাম, করুণা ও ক্ষমার আধার
সকল প্রশংসা তাঁর, মালিক জাহানের।
অন্তিম দিবসের অধিপতি, তোমার সহায় মাগি,
সেজদায় বিনত সরল পথের খোঁজে।
তোমার আশিসে যারা পথ খুঁজে পায়
সেই পথে চলার নিশানা দেখাও,
তারা কভু নয়, অন্তর যাদের তুমি করেছো কঠিন।
(সূরা ফাতিহা; ভাব-ভাষান্তর : লেখককৃত)
ফাতিহায় ব্যক্ত সরল মনোশুদ্ধির যত উপমা যত উদাহরণ ও কাহিনি কোরান বর্ণনা করে যায় তার সঙ্গে ইসলামি দীনের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও দিশা প্রাপ্তির কবিসুলভ সংবেদি বয়ান ওবায়দুল্লাহর কবিতায় একপ্রকার গরহাজির থাকে! ইতিহাসের চোরাবালিতে খাবি-খাওয়া সম্প্রদায়কে ঘিরে বিদ্যমান হাজার বছরের কূটকচালের ঘূর্ণিস্রোতে দিশেহারা কবির বয়ানে কোরান-র সুবেদি নির্যাস থেকে ছেঁকে-তোলা আধ্যাত্মিক পক্ষপাত (Spiritual Favoritism) বিরল ঠেকে; যদিও এর সবিরাম উপস্থিতি হয়তো নব্বই-পরবর্তী সময়ে ইসলামি রেনেসাঁকে কবিতায় যোগ্য ভাষা দানের জন্য জরুরি ছিল। এই ভাষা হয়তো-বা কবিকে পৃথক স্বকীয়তা দান করতেও পারত!
ওবায়দুল্লাহর কবিতাপাঠে সে-রকম আবেশ পাঠকের মনে জাগে না। বিনয়ের সঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, ইসলামি নবজাগরণের স্বাপ্নিক ফররুখ আহমদ কোরান-এ বিচ্ছুরিত বাণীর আলোয় নবজাগরণের ভিত্তি যাচাই ও বি-নির্মাণের তাড়া বোধ করেননি। দ্বি-জাতি তত্ত্বের জটিল টানাপোড়েনের কালে নবজাগরণের মন্ত্রে দীক্ষিত কবির মনে প্রশ্ন ওঠেনি ইসলামি দীনে অটল সম্প্রদায়ের ধারাবাহিক অধঃপতন ও অবক্ষয়ের ইশারা কোরান কেন রেখে যায়! অন্তিম বিচার দিবসে উম্মতের হালত সম্পর্কে স্রষ্টা তাঁর প্রিয় রসুলকে সওয়াল পুঁছবেন আর রসুল তখন এই উত্তর দিতে বাধ্য হবেন,— ‘হে আমার রব, কোরানকে আমার উম্মতরা ত্যাগ করেছে।’ (দ্রষ্টব্য : সূরা ফুরকান; ২৫:৩০) কোরানকে মরুসাহারা বানানোর কর্ম নবিজির উম্মতরা কীভাবে ঘটিয়ে চলেছে তার অনুসন্ধান শত-হাজার অতিকাল্পনিক ইতিহাসের জাল গায়ে জড়িয়ে কোরানর মর্ম অনুধাবনে মগ্ন কবির চেতনায় তরঙ্গ তুলতে পারেনি। প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাসের গতিধারায় সৃষ্ট চেতনার গহ্বরে নিজের জিজ্ঞাসু মনকে তিনি কবর দিয়েছিলেন। সময় অবশ্য তাঁর সহায় ছিল না। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ আবর্তসঙ্কুল সেই পথে পুনরায় প্রশ্নহীন গমন করায় তাঁর কাব্যে সচল ইমান ও ইসলাম পাঠকের চেতনায় একরৈখিক তরঙ্গ বৈ অন্য কিছু বহাতে ব্যর্থ হয়। কবির স্বকীয়তা বুঝে নিতে একরৈখিক বয়ান অবশ্য বাধার কারণ হয়ে ওঠে না; কিন্তু ভেবে আফসোস হয়, ইসলামি দীনের ঐতিহাসিক গতি-পরিণতিকে কোরান-র আলোয় পাঠ ও কবিতার আধার করে নিলে নতুন ভাষাপৃথিবী জন্ম নিতেও পারত! ওবায়দুল্লাহ তাঁর পাঠককে সেই সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত রাখেন বলা যায়।
ওবায়দুল্লাহর বাংলা ও বাঙালিত্ব হতে পারে দীনী চেতনার ঘোরপ্যাঁচে খাবি-খাওয়া ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সরলীকরণ, কোরান-র আয়াতপ্রবাহের সঠিক পাঠে দৃশ্যমান আধ্যাত্মিক প্রভায় সে হয়তো ভাস্বর নয়, তবু বাংলা কবিতার আলোচনায় এই কবিকে প্রাসঙ্গিক রাখা প্রয়োজন। নিচে উদ্ধৃত কবিতা স্বকীয়তা সম্পর্কে কবির ভাবনার বনেদ চিনতে সাহায্য করে :—
রক্তপাত ছাড়া কোনো কবিতাই হয় না। অথচ তুমি পাখি লিখো।
লিখো নারীদের স্তন ও আঙুল। বিবাহদিনের ম্যাজিক আর
একটি গোপন চুম্বনের হারাকিরি।
আমি কোনো যুদ্ধকরবী ছাড়া কবিতা চিন্তাই করতে পারি না।
যেমন কাবিলের হাতে হাবিলের খুন
যেমন রোজ আইসবার্গ দিয়ে তরবারির নিচে
নেমে আসা নীল নম্র তিমি!
আমার খাতায় ভরা লাল ঘোড়াদের জিন।
দেখো দেখো কীভাবে আগুন ঝরছে
গোলাপের বাগান থেকে!
দেখো আমার প্রেমিকা শুধুই এক খণ্ড করাতকল!
আজ কোনো পথ ছাড়াই বসে পড়ছি সেয়ানাদের দূরবিনে
আর টের পাচ্ছি আমার কবিতার প্রচ্ছদ জুড়ে
নেমে আসছে এক দঙ্গল শিকারির সিনেমাঘর।
(কবিতা; উগ্রনাশকতার দিনে)
এই বনেদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকায় একরৈখিকতা সত্ত্বেও নব্বইয়ের ঘরানায় ব্যতিক্রম কবি প্রশংসার দাবিদার। তিনি প্রশংসার্হ কাব্যভাষায় সেইসব শাব্দিক অনুষঙ্গ যোজনার জন্য ফররুখ ও আল মাহমুদ পরবর্তী বাংলা কবিতায় যারা নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। মুসলমানের আত্মপরিচয় অন্বেষণের কাব্যিক প্রয়োগ বিবিধ কূটতর্কের পাল্লায় পড়ে একপ্রকার অস্তগামী বলা চলে। কাজটি উচিত হয়নি এবং সে-কারণে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ উপাধির ভার মস্তকে বহন করলেও ওবায়দুল্লাহর ভিন্নযাত্রা আলাওল থেকে ফররুখকে নতুন প্রাসঙ্গিকতায় অবারিত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ‘বাঙ্গালি মুসলমান যদি বাস করে — বাঙলা মুল্লকে / আমি কেন দোষী হই লেখালেখি — কবিতা-যাপনে? / আল্লাহ দিয়েছে ভাষা, বাংলা বাঁচে অনেক বচনে।’— কাব্যভাষা ও কাব্যাদর্শের বিচিত্র স্রোতে কবি তার নিজ পছন্দে সাঁতার কাটবেন এবং সেখানে দোষ ধরার কিছু নেই। ছুঁৎমার্গের বাতিকে ভোগা কবির জন্য নাজায়েজ। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর সনেট-পঙক্তি সত্যটিকে পুনরায় নগ্ন করে যায়।
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS