নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী — এই মাটি ও জনপদকে বলা হয় বাংলার ভাটি বা হাওরাঞ্চল। এই অঞ্চলেই মালজোড়া গানের অমর সাধক বাউল রশিদ উদ্দিনের (১৮৮৯-১৯৬৪) জন্ম, বিকাশ ও বিচরণ। শোনা যায়, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বাউল রশিদ উদ্দিনের সংগীত সংকলন ‘স্বররাজ লহরী’ প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই বইয়ের ৫০০০ কপি বিক্রিও হয়েছিল সে-সময়। কৃষি ও জলজীবী মানুষের প্রকৃতি-জীবন-ধারণাকে আশ্রয় করেই তিনি এবং তাঁর সহচরেরা গানের ধারায় বিচরণ করেছেন। তাদের কাছে গানই জ্ঞান। এই জ্ঞান তারা প্রচার করেছেন। প্রচারের স্বার্থেই জ্ঞান ও কথাকে সুরে বেঁধেছেন। এই প্রচারের স্বার্থেই একজনের জ্ঞানের কথা সবাই মিলে গেয়েছেন। তর্কভিত্তিক গান, দেহতত্ত্বের গান, মুর্শিদতত্ত্বের গান গুরুশিষ্য পরম্পরায় তারা গেয়ে গেছেন। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে অবারিত প্রশ্ন নিয়ে গানের আসরে তারা হাজির হয়েছেন। গান দিয়ে গানকে মোকাবেলা করেছেন। বিতর্ক করেছেন, জ্ঞানচর্চা করছেন, তাদের কোনো সমস্যা হয়নি, সমস্যা হচ্ছে আমাদের।
‘মাগো মা ঝিগো ঝি’ এই গানটি সম্প্রতি কোক স্টুডিও প্রোডিউস করেছে। সময়ের মাধুর্যে র্যাপের লিরিক্স আর বলার ভাব থেকে শুরু থেকে ল্যান্ডিং পর্যন্ত এক-কথায় অসাধারণ! কিন্তু বলা হচ্ছে গানটি বাউল আব্দুল খালেক দেওয়ানের। ছোটবেলা থেকে এই গান শুনে বড় হয়েছি। বাড়ির কামলারা গেয়েছেন, ছাদ পিটানোর শ্রমিকদের মুখেও এই গান শুনেছি। ছোটোবেলায় মা-খালাদের মুখে এই গান অনেকবার শুনেছি। লোকসংগীত তো এভাবেই বাঁচে। এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকে গান ও জ্ঞান। আমার সন্তান, তার সন্তান হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই জ্ঞানকে ধারণ করে। হাজার হাজার গ্রামের খেটে-খাওয়া কৃষক, চাষীরা, মা-খালারা একত্রে, একই মঞ্চে, রাতভর বাউল পালাগানে, বিচার গানে, দেহতত্ত্ব/মারফতি পালাগানে এই গানটা শুনে আসছি!
আমাদের লোকমহাজনেরা একজন আরেকজনের গানের খাতা সংরক্ষণ করতেন। একজন আরেকজনের গানগুলোকে গেয়ে প্রচার করতেন কিংবা রক্ষা করতেন। এই সূত্র ধরে বলা যায়, হয়তো খালেক দেওয়ান সাহেব গানটা সবসময় গাইতেন। বাংলার ভাব মহাজনি ধারায় রশিদ উদ্দিন সাহেব অত্যন্ত মান্যজন। তিনি হয়তো গাইতেন। তাঁর কণ্ঠ থেকে শুনে কিংবা অনুলিপি দেখে বাউল খালেক দেওয়ানের উত্তরসূরী ও অনুসারীরা হয়তো ভেবেছিল গানটা তাদের ঘরানার।
একটা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রূপ ও জীবনাচারের ভেতরে একটা গানের জন্ম হয়। কথায়, স্বরে, বাচনিক ভঙ্গিতে প্রত্যেকটি অঞ্চল আলাদা। প্রত্যেক অঞ্চলের ভাব ও ভাবুকতা আলাদা। গান শোনা ও শোনানোর ভঙ্গিও আলাদা। মাটির স্বাতন্ত্রিক রূপ ও সুর নিয়ে জন্ম হয় একেকটি গান। গাতক যে-অঞ্চলে থাকেন সেই অঞ্চলই গাতকের মনন, ভাবুকতা ও কণ্ঠস্বর নির্মাণ করে। নদী ও হাওরের সম্মিলিত জলতরঙ্গের ভেতর থেকে উঠে এসেছে এই গান। জলতরঙ্গের প্রাকৃতিক রূপ-ঐশ্বর্য বাংলার ভাবুকতার দার্শনিক দরদে রশিদ উদ্দিনের মননজাত হয়ে জন্মেছে এই গান। এই গান কোনোভাবেই ঢাকা কিংবা বিক্রমপুর অঞ্চলের গান হতে পারে না।
গানের গীতিভাগে ব্যবহৃত শব্দাবলির চলন ও প্রবণতা খেয়াল করলেও সম্যক বোঝা যাবে গানটা কোথাকার, কার, কোন এলাকার। গীতিকায় ‘আইলাম’ শব্দটা দেখেন। এই বাগবিধি কোন অঞ্চলের? পুরো গানের ভেতরে যে সুর ও সংস্কৃতি আছে সেটা কোন অঞ্চলের? ভাবুকতা ও দার্শনিকতা একজন রচয়িতার আপন অঞ্চলের সুর ও স্বভাব নিয়েই আত্মপ্রকাশ করে। পুরো গানটির ভেতরে সুর ও যাপিত জীবনের যে পরিচর্যা আছে, সেটি পূর্ব ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলের। জলজ সংস্কৃতির ভাবুকতা থেকে উঠে এসেছে এই গান। এই গানে নদী ও হাওরকেন্দ্রিক মানুষের বোধ, বিশ্বাস ও সমর্পণ আছে। বাউল রশিদ উদ্দিনের গানের ভাষার সাথে, সুরের সাথে এই ভাষা একীভূত। জনপদ ও জনসংস্কৃতিকে না বুঝলে এই গানকে অন্যের নামে যে-কেউ চালিয়ে দিতে পারে।
আমাদের অঞ্চলের সবাই জানেন এই গান বাউল রশিদ উদ্দিনের। এই অঞ্চলের গাতকেরা এই গান বাউল রশিদ উদ্দিনের নামে গেয়েছেন। বারী সিদ্দিকী একাধিকবার টেলিভিশনেও এই গান রশিদ উদ্দিনের নামে গেয়েছেন। ইউটিউবে রশিদ উদ্দিনের নামেই এই গান আছে। আজ শুনছি এই গান বাউল আব্দুল খালেক দেওয়ান সাহেবের। গানের প্রকৃত রচয়িতা কে তার একটা মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। গানটা এই জনপদে মিশে গেছে। গানের রচয়িতার নামটা যেন হারিয়ে না-যায় কিংবা অন্যের নামে না চলে যায় — এ-ই আমার উদ্বেগ ও অভিপ্রায়। আমি রশিদ উদ্দিনের গানের সংকলন থেকে গানটি তুলে দিচ্ছি। সামান্য দু-একটি শব্দ কিংবা পঙক্তি এদিক-সেদিক করে একটি গানকে অন্যের নামে চালিয়ে দেয়া যায় না। গানের ভেতরে একটা জ্ঞান ও দার্শনিকতা থাকে সেটি সেই গানের মর্মার্থ।
মাগো মা ঝিগো ঝি করলে কি রঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে দিলে গাঙ্গে।।
গোমাই নদী নষ্ট করল ঐ না কোলাবেঙ্গে।।
ভাঙ্গা নৌকায় উঠে জল নদী করে কলকল
কলকলাকল পারি না তার সঙ্গে
নদীর নাম কামনাসাগর বাঁকে বাঁকে উঠে লহর গো …
কত সাধুর ভরাডিঙ্গা পার তার তরঙ্গে।।
ছিলাম শিশু ছিলাম ভালা
না ছিল সংসারের জ্বালা গো…
হাসিতাম খেলিতাম মায়ের সঙ্গে।।
এই দেহে আইল জোয়ানী
ঘাটে আইল নয়া পানি গো
কামকামিনী বসিল বাম অঙ্গে।।
ছিলাম জোয়ান অইলাম বুড়া
লইড়া গেছে বাঁকা জোড়া
গলই গোড়া সব গিয়াছে ভেঙ্গে।।
রশিদ উদ্দিন বলে গানে
ভেবে দেখ আপন মনে গো…
একদিন মিশতে হবে মাটির সঙ্গে।।
(বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন ও তাঁর গান, আবু দায়েন, পৃষ্ঠা ৮৯)
নেত্রকোনাবাসী ইতিহাসলেখক ও গবেষক রতীশ মজুমদার উজ্জ্বল এ-প্রসঙ্গে বলেন, “বারী সিদ্দিকীর জীবদ্দশায় দশদার বাজার থেকে সামান্য উত্তরে কাউট্টাচোরা বাজারে গোমাই নদীর পাড়ে বসে এই গানটি বারী আমাদের শুনিয়েছিল। মূলত গোমাই নদীর পাড়ে বসে রশিদ উদ্দিন সাহেবের এই গান বারী সিদ্দিকী গেয়েছিল। আজ নতুন করে শুনতে হলো এই গানটি অন্যজনের যা দুঃখজনক।”
কূটতর্কে এবং কৌশলে একটা গানকে নিজেদের করে নেয়া যায় না। এই গানটার ভাব, ভাষা ও সংস্কৃতির সর্বাংশে আছে কংস-মগরা-সোমেশ্বরীর জনজীবন। আছে ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা-সুরমার পললবাহিত জলভাটি জনপদের হাওরাঞ্চল। এই গানটার সর্বাংশে আছে পূর্ব-ময়মনসিংহের জলজ জীবনের ভাব ও ভাবুকতা। প্রায় ১০০ বছর ধরে লোকপরম্পরায় এই গানটা রশিদ উদ্দিনের নামে চলেছে। রশিদ উদ্দিনের সংকলনগুলোতেও এই গান আছে। এখন দেওয়ান সাহেবের মতো একজন মহৎ ব্যক্তির নামে এই গান চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মাটির সৌরভ ও সংস্কৃতি নিয়েই একটা গান সময় ও সমাজকে জাগ্রত রাখে। এই গান পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোনার গান, আমাদের মাটির গান। সাধক মহাজন কবি রশিদ উদ্দিন এই গানের রচয়িতা। অন্তত চার-পাঁচ প্রজন্মের মুখে মুখে প্রচলিত ও প্রচারিত এই গান। গানের ভেতরে যে গোমাই নদীর কথা আছে সেটিও নেত্রকোনার কলমাকান্দার পথে গুতুরা বাজারের কাছ দিয়ে বহমান। ‘নয়া পানি’ শব্দটা এই হাওরাঞ্চল ছাড়া আর কারা ব্যবহার করে? তাছাড়া ‘অইলাম বুড়া’, ‘গলই’, ‘গোড়া’ (জোড়া গলই গোড়া) শব্দগুলো ভাটিবাংলা ছাড়া আর কোথায় পাবেন? সম্বোধনে নারী-পুরুষের গার্হস্থ্য জীবনে ‘গো’ শব্দের ব্যবহার আছে। এখন ‘গো’-মধ্যে ‘লো’ শব্দ লাগাইয়া দিলেই কী গানের ভাব আর দার্শনিকতা পাল্টে যাবে?
আহা! রশিদ উদ্দিন কী জানতেন এই যুগে এসে কোক স্টুডিও নামের একটা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন চিরায়ত ধারার গানের নবরূপ দিবে? র্যাপের সুর ও চুমকি ঢেলে দিবে? তবে এই কথা অবশ্যই বলা যায় যে কোক স্টুডিও কোনো গানকে জাতে উঠাতে পারে না। কোক স্টুডিওর অগুনতি জনপ্রিয়তা আছে। তাদের কোটি কোটি দর্শক আছে। কিন্তু আমাদের লোকগান যে-দার্শনিকতা নিয়ে প্রচারিত হয় সেটা কোক স্টুডিও কখনোই করবে না কিংবা করতে পারবে না। কোনো লোকগানের দার্শনিকতাকে বাড়ানো-কমানোর ক্ষমতা তাদের নাই। আর যাদের ধারণ করার ক্ষমতা নাই, তাদের উঠানোর-নামানোর ক্ষমতাও নাই। লোকগান লোকসমাজে লোকধারণায় বাঁচে। যাপিত জীবনের অর্থ নিয়ে বাঁচে। অন্যের জোর ছাড়া একমাত্র মাটির গানই বেঁচে থাকে।
লোকগানে ভনিতা বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটা গানের দার্শনিকতা অনেকে মিলে প্রচার করেন সাধকেরা। মূল গানে ভনিতা থাকা সত্ত্বেও গাতক গাইতে গাইতে নিজের নামও যুক্ত করে দেন। দেখা যায়, নামটা নয় গানটা বেঁচে থাকুক — এটাই পদকর্তার একমাত্র উদ্দেশ্য। সুধীর চক্রবর্তী বলেছেন, লোকগানে এমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অনেক পদকর্তাও নিজের লেখা প্রখ্যাতদের নামে বা গুরুপদে বিলীন করে দিয়েছেন। যেন গানটাই বেঁচে থাকুক। দার্শনিতা বেঁচে থাকুক। কে কার নামে প্রচার করছে, এটা বড় কথা নয়; দর্শন প্রচার করাই বড় কথা। লোকগানে এমনটা হয়।
আমার মনে হয়, এই সূত্র ধরেই কিংবা দার্শনিকতা প্রচারের স্বার্থেই খালেক দেওয়ান সাহেব এই গানটা গেয়েছিলেন এবং ভনিতাতেও নিজের নাম যুক্ত করে দিয়েছেন। রশিদ উদ্দিনের তিনটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তিনটি সংকলনেই এই গানটি আছে। তাই ‘গো’-এর জায়গায় ‘লো’ শব্দ ব্যবহার করে কিংবা কয়েক পরিবর্তন করে এই গানের দর্শন এবং রচয়িতার নাম পাল্টে দেয়া যাবে না।
গানটা কার — রশিদ উদ্দিনের, না খালেক দেওয়ানের? এই বিচারের জন্য সহায়ক দুইটা লিঙ্ক ছাড়াও কোক স্টুডিও প্রযোজিত কম্পোজিশনটির লিঙ্ক নিচে রেখে দেয়া যাচ্ছে।
বারী সিদ্দিকীর স্টুডিয়োরেকর্ড
বারী সিদ্দিকীর প্রাসঙ্গিক আলাপ ও গাওয়া
কোক স্টুডিও প্রযোজিত কম্পোজিশন
গানপারে কোকস্টুডিয়ো
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
- অন লেখালেখি, ইনফর্ম্যাল (তিস্রা দাগ) - October 11, 2024
COMMENTS