ফিল্মের মধ্যে কবিতা || ইমরান ফিরদাউস

ফিল্মের মধ্যে কবিতা || ইমরান ফিরদাউস

শেয়ার করুন:
[ষাটের দশকের একেবারে শেষের কোঠায় নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্রে কবিতার অভিষেক। তারপর কয়েক দশক ধরে বাংলা ছবির দর্শক আগ্রহ নিয়ে তাঁর ছবি দেখেছে। শেষজীবনে এসে খুব একা হয়ে গেছিলেন। অবিশ্বাস্য শীতল ছিল তাঁর মৃত্যু। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি…]

‘বাতাস তোমার অঙ্গ ছুঁয়ে
সুবাস নিয়ে আসে,
বেঁচে আছি গন্ধে তারই
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে’

বহুত পেয়ারের নায়িকাদের বিবাহ সংবাদে গুণমুগ্ধ দর্শকদের কলিজার টুকরা থেকে বের হয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের দুঃখ থেকে রেহাই নেই এই বায়ুমন্ডলের। তাদের দুঃখ তাই আমাদেরও না ছুঁয়ে পারে না যেহেতু সবাই একই কোম্পানির বাতাস পান করি। নায়িকার রূপ-গুণ-লাস্যের অমানিষার ঘোরে আটকে পড়া দর্শকসুলভ শরণার্থীরা জানে ঐ চাঁদপানা মুখটা কখনোই (হয়তো) দু’হাতের আঁজলা ভরে পান করার নয় তারপরেও মন তো মানে না! নায়িকা যেবেলা অন্যের বাহুডোরে নিজেকে সঁপে দেয় সেইবেলা তারাও হয়তো একলা রাতে ভাবে ‘বনমালি তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা’। আহা! নায়িকা! ‘স্বপ্নের নায়িকা’!! দিগদার প্লাতোন কোনো এক সুপ্রভাতে বলছিলেন ‘দেহাতীত প্রেম, নিকষিত হেম—এরই নাম প্লাতোনিক প্রেম’। ছোঁয়াছুঁয়ির অপশনবিহীন এই প্রেম তাইলে কি প্লাতো সাহেবের প্রেম-জপ মাত্র! কেননা, কল্পনায় দর্শককুল নায়িকাকে লয়ে যতই কামনার দুর্গম গিরি, কান্তার মরু উৎরায় যান না কেন ফলতঃ তা বাসনার দুস্তর পারাবারের চোরাবালিতেই খাবি খায়। তবে জানেন তো, আপনি কিন্তু সুন্দরী নায়িকাকে শচীন কত্তার স্টাইলে অভিমানে কইতে পারবেন না ‘মন দিলো না বধূ, মন নিলো যে শুধু’ কারণ সে মন না দিলেও দিয়েছে সি-নে-মা…যে-সিনেমার অন্তরে-প্রান্তরে ছড়ানো থাকে সবুজ হিয়া; তাই আমরাও আর অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে পারি না ‘আমি কি নিয়ে থাকি’!

একটা বিষয় খেয়াল করছেন—নায়িকার প্রশ্নে সকল নায়িকাই ‘রাধা-ভাবে’ থাকেন আর নায়ক মাত্রই ‘কৃষ্ণ-ভাবে’! নজর-আন্দাজ করলে দেখা যায় যে, ফুর্তিবাজ কৃষ্ণ যা করে থাকে আমাদের পর্দার নায়করা ঠিক তাই তাই করে, যেমন ধরেন—কৃষ্ণ বাঁশি বাজায়, গান করে, রাত-বিরাতে অভিসারে যায়, এলাকায় কেউ রাধাকে ইভটিজিং করলে ঠিকঠাক ডোজ ঝেড়ে দেয়—আমাদের নায়করাও তো তাই করে, নাকি! আর ঐদিকে নায়িকা সিনেমার রূপালি পর্দায় আদতে রাধা-সংবাদই প্রচার করে—আমাদের নায়িকাও তো রাধার মতো কুশলী, গৃহকার্যা নিপুণা, অভিমানী, সামর্থা, রতিশিল্পী—পর্দায় এই সব গুণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নায়িকার উচ্ছ্বলতা, তাই কি না?! তাই বলে এই নায়িকাকে শুধু ননীর নারী-পুতুল ভাবলে কিন্তু ফিল্ম ঝিরঝির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ‘হান্টারওয়ালি থেকে ব্যান্ডিট কুইন’ পরিস্থিতির প্রয়োজনে যে-কোনো ভূমিকা পরিগ্রহ করতে তার দ্বিধা নেই। আপাতদৃষ্টিতে পর্দায় সে স্বতন্ত্র, স্বাধীন, সবল না হলেও, সে শক্তিময়ী! এইখানে মনে পড়তেছে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের রসমঞ্জরীর কথা; সেখানে তিনি নায়িকা সম্পর্কে আলাপ দিচ্ছেন—

নতি রতি গতি মতি           কেবল পতির প্রতি
ক্রোধ হইলে মৌন ভাব কেহ টের পায় না॥

কিন্তু, নায়িকারা আসে কোথা থেকে আবার হারিয়ে যায় কোথা…আমরা কী সেই হিসাব কষে দেখলাম কোন দিন…আসলে এইমতো ভাববার অবকাশটুকুনই কই আমাদের, যখন যোগানের মাত্রা হয় অসীম। যার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে রইলাম আজ, কাল দেখা যাবে আরেকজন এসে মাস্তানা করে দিচ্ছে। আর ডেডিকেটেড বা উৎসর্গিত প্রেমিক হলে তো বেঁচেই গেলেন কারণ অমুকে ছিল সে ই র ক ম—এই এক বিভ্রম যথেষ্ট সারাটাজীবন কাটিয়ে দেবার জন্য!

কিন্তু আজকে কি যেন হইছে বুঝছেন…কোনো বিভ্রম বা হারানো বিজ্ঞপ্তি নয় আজকে মনে আসছে পর্দা থেকে হারায় যাওয়া দুই একটা শ্রাবস্তীর কারুকার্য করা মুখ; ভোজবাজির মতন তারার নাচন দিয়ে তাহারা কোথায় মিলিয়ে গেল! এত এত জহরত-শহরতের ভিতরে বাস করেও কাউকে কিছু না বলে বাতাসের ন্যায় কোথায় হাওয়া হয়ে গেল…কীভাবে এটা সম্ভব হলো!!

রাবেয়া কি রুখসানা ঠিক তো মনে পড়ে না

শহর কলকাতায় মহীনের ঘোড়াগুলি  নামে একটা ব্যান্ড গান-বাজনা করতো ৭০-৮০’র দশকে। তাদের গানগুলি ছিল সুর/কথায়/গাঁথায় একদম নতুন, পিলে চমকানো! যাহোক, ঘোড়াগুলি  একটা গান বাঁধলো ‘সেই ফুলের দল’ নামে যেখানে তারা বলতে চাইলো সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে যাওয়া সেইসব ফুটফুটে কিশোরী/তরুণী/যুবতীদের কথা…সীমান্তের অন্য পারে এসে যাদের আর অতীত বলে কিছু থাকে না…মাসি/খালা তাদের সবার জন্য একটা করে নতুন নাম ঠিক করে দেয়। তারাও উপায়ন্ত না দেখে একবুক হতাশা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে থাকে যদি কোনোদিন বাপ-মায়ের আশীর্বাদে এই নরক থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। তো, মহীনের ঘোড়াগুলি বলছে—

“জানি সে কোথায়, এই শহের কোনো বাগানে সে হয়ে আছে ফুল
প্রতি সন্ধ্যায় পাঁপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল।” 

কিন্তু, আমরা তো বুঁদ আছিলাম সিনেমার নায়িকা নিয়ে তাহলে হঠাৎ এই গানের শানে নুযুল হাজির করা কেন? কারণ একটাই, সেইটা হলো নায়িকা বা নায়ক হতে ইচ্ছুকদের কেন সিনেমহল্লায় প্রবেশ করতেই নতুন নাম ধারণ করতে হয়? কি সমস্যা যদি তারা নিজ নামে মহীয়ান হইতে চায়? তাদের নতুন নাম ধারণের মধ্যে দিয়ে আসলে কি ঘটে…এমন ঘটে কী, যে তাদের নতুন ইগোর জামা পরায় দেয়া হয়!? যে-জামা গায়ে দিলেই কেবল গুলশান নামের মেয়েটি উর্মি নাম নিয়ে সুখের মুহূর্তে ছুটে যেতে পারে ফুলের কাছে, নাচতে পারে আলোর তালে। শুধু এই জামা গায়ে দিলেই খোলতাই ভাব সত্ত্বেও ভিলেনকে সে কখনো খল ছাড়া নায়ক ভাবতে পারে না!

আমার কাছে উত্তর নাই তবে প্রশ্নগুলি ছারপোকার মতো মাঝে মাঝে কুট্টুস করে কামড়ে চলে যায়। আচ্ছা, নগদ নগদ বলতে পারবেন বিএফডিসির এমন তিনজন নায়িকার নাম যাদের আসল নাম আমরা জানি না। আমি তিনজনের না পারলেও একজনের নাম নিতে চাই।

ষাটের দশকে এক সহ-অভিনেত্রী এফডিসিতে যমজ মেয়ের অভিনয় করে সমালোচকদের দৃষ্টি তাক লাগিয়ে দিলেন। সিনেমাটার নাম ছিল ধন্যি মেয়ে। সিনেমাতে তার অভিষেক হয় পাপিয়া নাম নিয়ে। প্রথম তিনি অভিনয় করেন ‘কাঞ্চন মালা’ ছবিতে। যদিও তার বাপ-মা শখ করে নাম দিয়েছিলো জোবায়দা খাতুন। কিন্তু, সিনেমাপাড়ায় ঢুকতে হয় সবকিছু পেছনে ফেলে। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, ‘বেবি পাপিয়া’ও একদিন বড় হয়। প্রযোজক-পরিচালকরা একদিন দেখলেন সিনেমার ধন্যি মেয়ে বেবি পাপিয়া আর ‘বেবি’ নাই। এখন তার যৌবনের উজানে তারুণ্যের টান। তাকে তাই আবার নতুন পরিচয়ে অভিষিক্ত হতে হয়। এবার তার নতুন নাম হয় ‘কবিতা’, পরিচিত হন নবাগতা ‘নায়িকা’ হিসেবে। ষাটের দশকে তিনি সহ-নায়িকা হিসেবে বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। কবিতা নামে ১৯৬৯ সনে মলুয়া  নামের সিনেমাতে নায়িকা হিসেবে মন কাড়েন। তবে একক নায়িকা হিসেবে তার একচেটিয়া দাপট লক্ষ করা যায় সত্তরের দশকে। সেই সময় তিনি নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন তাঁর অভিনয়ক্ষমতার জন্য। তখন বাংলাদেশের সিনেমায় বইছিলো লোককাহিনিনির্ভর সিনেমা করার হাওয়া। তবে সেসবের মাঝেও কবিতা নিজের জাত চেনাতে একটুও দেরি করেননি। স্বাধীন বাংলায় প্রথম দিকে যে-কয়টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা নির্মিত হয়েছিলো তার মধ্যে একটি ছিল আনন্দ পরিচালিত বাঘা বাঙ্গালী, যেখানে নায়িকা চরিত্রটি রূপায়ণ করেছিলেন কবিতা। কবিতা ঐসময় যে-ছবি করে সেইটাই হিট! যারা তাকে দেখেছেন তারা ঠিকঠাক জানেন কবিতা দেখতে সুদর্শনা, নৃত্যে কুশলী এবং অভিনয়ে দারুণ স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

কিন্তু কী দিয়ে কি হইলো ভগবান জানে!

কবিতা যখন নায়িকা হিসেবে খ্যাতির মধ্যগগনে তখন একজন ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে চলচ্চিত্রজগৎ থেকে বিদায় নেন।

হায় বনমালি! হায় কবিতা!

ভক্তদের নিধুয়া পাথারে ফেলে কবিতা স্বামীর হাত ধরে ঢাকা থেকে অভিবাসিত হলেন বন্দরনগরী চট্টলায়। স্বপ্নের নায়িকার এমন পরিণতির বেদন জানে কেবল তার অন্ধভক্তরা। কবিতাভক্ত বিশ্বজিৎ চৌধুরী স্মৃতি রোমন্থনের ছলে বলছেন—“চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে ‘বনানী কমপ্লেক্স’ নামের একটি সিনেমা হল ছিল।…। সিনেমা হলটি নেই, কিন্তু তাকে ঘিরে কৈশোরের একটি স্মৃতি মনে গেঁথে আছে। বহুকাল আগে একবার এই সিনেমা হলের সামনে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক নায়িকাকে দেখেছিলাম। কোনো একটি ছবির মুক্তি উপলক্ষে তিনি এসেছিলেন। ছবির নাম আজ মনে নেই, কিন্তু হলের সামনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি যে কোলাহলমুখর অগুনতি ভক্ত-দর্শকের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছিলেন, হেসেছিলেন—সেই রূপ, সেই লাস্য ভুলতে পারি না। রূপালি পর্দার মানবীকে বাস্তবের চর্মচক্ষে দেখার সেই অভিজ্ঞতার কথা ভেবে আজও রোমাঞ্চিত হই।

এই সিনেমা হলের মালিক, চিত্রপ্রযোজক ও চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোলাম কবিরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কবিতার।…শুনেছি গোলাম কবিরের সেই বাড়ির সামনের রাস্তায় কত তরুণ দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকেছে,কখন নায়িকাকে একনজর দেখা যাবে, কখন কবিতা কয়েক মুহূর্তের জন্য এসে দাঁড়াবেন ব্যালকনিতে, সেই প্রতীক্ষায়।”

বুদ্ধির পর থেকে কম-বেশি যা-ই বুঝি না কেন এইটা বুঝতে পারি না হিট নায়িকারা কোনো সহকর্মী নায়ক বা অন্য কোনো পেশাজীবীর চেয়ে চিত্রপ্রযোজক, ব্যবসায়ী গোত্রীয়দের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কেন?! এই তো সেই দিন দেখলাম বলিউডের বিদ্যা বালান বিয়ে করছেন বিরাট এক চিত্রপ্রযোজককে। কবিতা বা বিদ্যারা এইরকম চয়েস কেন করেন? মানে উইথ ডিউ রেস্পেক্ট…এই কারণে কী বিবাহিত নায়িকার ক্যারিয়ার খানিক চাপের মুখে থাকে সেক্ষেত্রে প্রযোজকের সাথে থাকাটা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ? এইটা নিয়ে আসলে আলাপ হওয়া দরকার।

তারারাও নাকি অভিমানী হয়

বিয়ে তো হয়ে গেল…এরপর কী! রূপকথার মতন তারা স্বামী-স্ত্রী সুখে শান্তিতে ঘর করতে লাগলেন আর নটে গাছটিও মুড়োলো…এমনটা ভাবলে আপনি ঠিক ভুল দরজাতে টোকা দিয়েছেন পাঠক-পাঠিকা। পিকচার এখনো খতম হয় নাই। মানে বলিউডের একটা ‘ডার্টি পিকচারের’ বদলে কবিতার জীবনে একটা রেগুলার হ্যাপি এন্ডিং হইলে আমি বা আমরা বরং খুশিই হইতাম।

তথাপি, কে বোঝে মওলার আলেকবাজি!

১৯৮২ সালে পারিবারিক বিপর্যয়ের মুখে তিনি ব্যবসায়ী স্বামীর সাথে সম্পর্কের পাট চুকিয়ে দেন। যেহেতু অ্যাকশন-কাটের ঝলমলে জীবনে এক সময় তার পাশে অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর আনাগোনা ছিল, ছিল বিত্ত-বৈভব, তাই পুনরায় চলচ্চিত্রের জগতে আসার চেষ্টা চালালেও এ-যাত্রায় আর সফল হননি। ততদিনে কবিতা তিন সন্তানের জননী। এরপর আরেকবার চেষ্টা করেন নতুন করে জীবন-সংসার সাজাতে কিন্তু সে-বিবাহেরও পরিণতি হয় বিচ্ছেদ। তারপর তো আর কোনো খবর নাই। ততদিনে ঢাকাই ছবিতে তামিল ফর্মুলা ঢুকতে শুরু করে দিয়েছে, হংকংয়ের ‘বি মুভি’-র দর্শক বাড়তেছে, নতুন মুখের সন্ধানে এফডিসির লোকজন দেওয়ালে দেওয়ালে চিকা মারতে খালি বাকি রাখছে…মানে ঘটনার পর ঘটনা ঘটছে দেশাল ইন্ডাস্ট্রিতে।

আর এইসব নিকট-দূর থেকে দেখতে দেখতে একটু একটু করে দূরে, আরো দূরে বহুদূরে সরে যেতে থাকলেন ফিল্মস্টার কবিতা…ছায়াছবির তারকা ফিল্মের আকাশ থেকে নিজের এই খসে পড়াটা সহ্য করতে পারেন নাই। পারবেন কিভাবে, তিনি তো জানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন এই জগতটাকে। কিন্তু, ঝাঁ চকচকে ঐ দুনিয়া সর্বদা এক হাশরের ময়দান! মার্কেটে আপনের ডিমান্ড থাকলে আপনার আগে-পিছে দাসী-বান্দী গার্ড অফ অনার দিবে। আর না থাকলে হাই-হ্যালো করারও টাইম নাই কারো! এই রূঢ় বাস্তবতা সংবেদী কবিতা হয়তো আত্মস্থ করতে পারেন নাই। মেজাজি, আত্মসচেতন কবিতার অনেক রাগ হয়, মনের দেরাজে জমা হয় একবুক অভিমান। অভিমানী কবিতা এই অভিলাষী লোকালয় ছেড়ে কই জানি চলে যায়। সে-খবর কেউ রাখে নাই।

প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় আমরা দুঃখিত

২০০৬ সনের এক আবছায়া সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর টিনশেড এলাকার ১৪ নম্বর গলিতে একজন বয়স্ক মহিলা ঘর খুঁজছেন। বেশ দুর্বল, বেশভূষায় মলিন ছাপ কিন্তু কথায়, আচরণে বেশ ঠাঁটবাট দেখা যাচ্ছে। উৎসুক এলাকাবাসীর ভিড় থেকে তাকে বের করে আনেন ঐ লেনের নির্মাণাধীন ৫২১ নাম্বার বাসার মালিক হানিফ বাবু। তারা তখন উলটা পাশের একটি বাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন আর বাড়ির তদারকি করছেন। ঠিক হয় বাড়িটা তৈরি হলে উনি সেখানে ভাড়া উঠবেন আর যতদিন না হচ্ছে সে-কয়টা দিন তাদের সাথে থাকবেন। এরপর কেটে গেছে দুই বছর। হানিফ বাবুর পরিবারে কন্যাসন্তান এসেছে, যাকে ঐ নিচতলার আপাত রহস্যময়ী নারী বেশ আদর করে, বাচ্চাটাও খালা বলতে পাগল। একবার ঐ মহিলা বেশ অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলে হঠাৎ করে একদিন একজন এসে ঐ ঠিকানায় যখন খোঁজ করে ‘চিত্রনায়িকা কবিতা’ কোন ঘরে থাকেন!! শুনে সবার চক্ষু চড়কগাছ! ‘এই ব্যাটায় কি কয়?! নায়িকা মানুষ এইখানে আইবো কইত্থেইকা’!! সেদিন প্রথম এলাকাবাসী তো বটেই খোদ হানিফ বাবুরা জানতে/চিনতে পারে নায়িকা কবিতাকে!!

কবিতা এমনই ছিলেন। নিজের ব্যাপারে মারাত্মক সংরক্ষণশীল। হানিফ বাবুর সহধর্মিনী গল্পে গল্পে জানালেন কবিতা যতই নিদারুণ অবস্থায় থাকুন না কেন তার মেজাজ ছিল একদম রাজা-রাণী টাইপ। কেউ যদি কখনো ভুলেভালে তাকে জিজ্ঞেস করছে কই যাতেছেন! ব্যস! একদম কড়া উত্তর দিতেন। বা হানিফ বাবু জিজ্ঞেস করলো ভাড়া দুই মাস বাকি হাতে টাকাপয়সা আছে কি নাই! হইছে কাজ! উনার সটান জবাব তুমি এত চিন্তা করো কেন…ভাড়া পাইলেই তো হইছে! ভাড়া পাবা! এখন যাও। কিন্তু, অবাক করার মতো বিষয় হইলো এই শহরে তিনি একা থাকতেন না! তার মা বেঁচে আছেন, ভাইবোন আছেন, পুত্র-কন্যা বর্তমান আছেন কিন্তু তিনি কারো সাথে নেই। তার কী যেন এক শঙ্কা ভর করেছিলো। কখনো ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতে চাইতেন না। সারাদিন বের হতেন না। ঠিক সন্ধ্যার ওয়াক্তে বের হতেন। কেমন যেন একটা রহস্যের চাদরে মোড়া ছিল তার অবয়ব। নায়িকা কবিতাকে জানার পর নতুন করে আবার মনে পড়ে ‘পৃথিবী এক রঙ্গমঞ্চ…কাকে যে কখন কোন ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে তা সময় নামের সবুজ ডাইনি ছাড়া কেউ জানে না’।

কবিতার শেষদিনগুলি কেমন ছিল সেসব নিয়ে আর কথা না বাড়াই, সেগুলি চাইলেই এখন জেনে নেওয়া সম্ভব অনায়াসে। পত্রপত্রিকায়, ইন্টারনেট একটু ঘাঁটলেই দেখবেন তার শেষ জীবনের মানবেতর, একলা, আসমানী ভয়ে জড়িয়ে থাকা জীবনের নামচা। কিন্তু কেউ এই প্রশ্নের অনুসন্ধানে একবারও তার পরিবারের কারো কাছে গেল না…কি সেই কারণ যার জন্য কবিতাকে এসে ঠাঁই নিতে হয়েছিলো রূপনগর টিনশেডের ১৪/৫২১-এর এককামরার জতুগৃহে।

জানেন তো, লেখক বা পাঠকের মৃত্যু হলেও কবিতার মরণ নাই। তাই কবিতা বরং আমাদের মাঝে ফিরে ফিরে আসু্ক ধন্যি মেয়ের পাপিয়া রূপে অথবা হৃদয়ে ঝড়-তোলা জংলী মেয়ের ভালোবাসা নিয়ে। কবিতার জন্য রইলো ভালোবাসা…এর বেশি আর কিইবা দিতে পারি আমরা।

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র

ধন্যি মেয়ে; কাঞ্চনমালা; মলুয়া; জংলী মেয়ে, সাইফুল মুলুক বদিউজ্জামাল; ছোটো সাহাব; স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা; বাহরাম বাদশাহ; বাঘা বাঙ্গালী; কে আসল কে নকল; নকল মানুষ; পিঞ্জর; জেহাদ; লড়াকু।

দোহাই
১. ‘তোমাকে দেখলে একবার’ মাকসুদের কণ্ঠে গীত ‘অঞ্জলি’ ছায়াছবির একটি বিখ্যাত গান।
২. আগ্রহীরা দেখতে পারেন ‘প্লেটনিক প্রেম’ প্লেটোর মতবাদ নয়! [http://tinyurl.com/pt7ssq9]
৩. চট্টপাধ্যায়, সোমা,হান্টারওয়ালি থেকে ব্যান্ডিট কুইন:ভারতীয় ছবিতে নারীর স্বতন্ত্র ইমেজ, পৃ. ৩৪৬, পালিত, দিবেন্দ্যু ও আচার্য্য, নির্মাল্য (সম্পা.), শতবর্ষে চলচ্চিত্র, ১৯৯৬, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা। ISBN 81-7215-498-4
৪. রসমঞ্জরী [http://tinyurl.com/p654sum]
৫. সেই ফুলের দল – মহীনের ঘোড়াগুলি [http://tinyurl.com/p77rv6h]
৬. নায়িকার মৃত্যু [http://tinyurl.com/na7kuq4]
৭. কবিতা (অভিনেত্রী) [http://tinyurl.com/opchoa8]

প্রথম প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০১৩


ইমরান ফিরদাউস রচনারাশি

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you