থেমে যেতে যেতে একবার কোনোমতে
জোর করে যদি একবার হেঁটে যেতে
বেঁচে নিতে যদি একবার বড় ভালো হতো।
একবার শুধু একবার কোনোমতে
চোখ মেলে যদি একবার দেখে নিতে
দেখে নিতে যদি একবার বড় ভালো হতো।
মেনে নিয়ে নিয়ে দিন গেল মেনে নিতে
সঞ্চয়গুলো গুনে গুনে বেঁধে নিতে
গেঁথে নিতে শুধু কৃপণের বড়শিতে এঁদোপুকুরের পুঁটিমাছ
ধান নিয়ে গেল বম্বেতে বর্গিতে
গানে গানে বুলবুলিটাকে দোষ দিতে
ফিরলে না তুমি কোনোদিন সম্বিতে নিভে গেল উনুনের আঁচ
মার খেতে খেতে বেধড়ক মার খেতে
মরে যেতে যেতে বেঁচে থেকে মরে যেতে
বেঁচে নিতে যদি একবার বড় ভালো হতো।
থেমে যেতে যেতে একবার জোর করে
নিতে যদি তুমি নিঃশ্বাস প্রাণভরে
বেঁচে নিতে যদি একবার বড় ভালো হতো।
[কবীর সুমন, ঘুমোও বাউন্ডুলে, ১৯৯৫]
কতটুকু করতে পারব জানি না, আহমদ সায়েম কর্তৃক রচিত ‘রুদ্ধজনের রাগ ও সম্বিৎ’ বইয়ের কবিতাগুলির স্পিরিটের সঙ্গে এপিগ্র্যাফে-লটকানো লিরিকটির অন্তর্গত স্পিরিটের একটা অ্যালাইনমেন্ট গোচরে আনার চেষ্টা থাকবে এই নিবন্ধে। কেননা পাঠের পরে এই বইয়ের টোটাল টোনটা ঠার করতে যেয়ে দেখি লিরিকটির অনুরণন উঠছে ভেতর থেকে। একটা আর্টোয়ার্ক কতভাবে যে তার চারপাশের সঙ্গে কানেক্ট করাতে পারে, একটা আর্টোয়ার্ক আরেকটা আর্টোয়ার্কের কাছে নিয়া যায়, এইটা তার এক উদাহরণ। কবীর সুমনের পার্টিকুলার এই বা আর কোনো গানের ছায়াপাতটাও ঘটে নাই, আলোচ্য বইটায়, কিন্তু বইয়ের কবিতাগুলার স্পিরিট উক্ত গানটারই কাছে টেনে নিয়া যায়। পাঠককে। গেছে নিয়ে, প্রেসাইসলি, আমাকে। টেক্সটের কারসাজি কিংবা আধ্যাত্মিকতা, যা-ই বলি, ব্যাপারটা প্রায় ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল। কবিতায় ছাড়া, গানে ছাড়া, আর কোথায় এমন অতীন্দ্রিয়তা আস্বাদ করা যায়?

২
বাকরুদ্ধ মানুষের রাগ যখন প্রকাশ পায় তখন তা থেকে যা উৎপন্ন হয় তার কোনো পূর্বনজির চটজলদি ডিটেক্ট করা প্রায় ডিফিকাল্ট হয়। যেমন সংগীতে দেখা যায় একটা রাগের আশ্রয়ে ম্যাজিকের মতো ক্রমে একটা গান পাখা মেলে এবং একসময় সেই রাগ মুছে যেয়ে থেকে যায় আকাশভরা নাক্ষত্রিক রঙ, অনেকটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ও অবলীল, হস্তগত বইয়ের কবিতামালায় তেমন অভিজ্ঞতা লাভ করা যাবে।
দেশে দেশে কালে কালে মানুষের ইতিহাসে এমন সময় আসে যখন দ্রষ্টা-বিবেচিত কবিরাও হয়ে পড়েন হতবাক, হতোদ্যম, হতচকিত, হতভম্ব; হয়ে পড়েন কিংকর্তব্যবিমূঢ়; অতঃপর কবিতাই ঠিক করে নেয় কর্তব্য তার, স্বয়ংচালিত, স্বয়ংপ্রকাশ ঘটে কবিতার অনুভূতিদেশের বেপরোয়া উৎসার; কবি তখন কবিতারই নিরুপায় আজ্ঞা বহন করেন মাত্র; কবি তখন অগত্যা, অনুপায়ান্তর, ধাবন করেন কবিতার পিছু। স্বতশ্চল এই কবিতাভাগে স্বদেশের সেই বীভৎস হননযজ্ঞ কবি ক্যাপচার করে গেছেন দূর থেকে, দৈবের বশে, প্রবাসের মর্মন্তুদ জীবনযাত্রার ফোকরে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের পরোয়া না-করে।
এবং, লক্ষণীয়, প্রযুক্তিকৃপায় সাতসমুদ্রদূরপার যেমন করে কবির সংসার ও জগৎ একইসঙ্গে নৈকট্য ও ব্যবধি দিয়ে লেপ্টালেপ্টি ঘিরে রেখেছে, এই কবিতামালায় সেই বিভা ও বৈভব ধরা পড়েছে সন্তর্পণে। কেবলই কী বীভৎসতা ধারণ করেছেন কবি বিরুদ্ধ ও বৈরী বিনাশকালের? না, আরও অগ্রসর হয়ে এই কবিতামালা ধরতে চেয়েছে এই সময়ের স্ফূর্ত গরিমা, গার্হস্থ্য গঞ্জনা, গোল গগনের গান; সর্বোপরি, পঙক্তিসমূহের ফাঁকাস্থানে, ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে সেই সম্বিৎ যা সর্বকালের সর্বধামের সর্বধারার কবির ও পাঠকের আরাধ্য।

৩
বইয়ের কবিতাগুলো, ‘রুদ্ধজনের রাগ ও সম্বিৎ’ বইয়ের, পড়তে পড়তে একটি জিনিশ মনে হয় যে এই কবি ইমোশন্যালি ইনভলবড হয়ে এক রকমের একটা চার্জড অবস্থায় লিখেছেন কবিতাগুলি। বইয়ের টাইটেল দেখে মনে হয় একেবারেই নিকটবর্তী ইতিহাসের কোনো-এক বছরে এই বইয়ের কবিতাগুলি নির্মিত। নয়, আংশিক হলেও পুরো সত্য নয়। প্যান্ডেমিকের টাইম থেকে দেশকে দেউলিয়া বানিয়ে শেখ হাসিনার সপরিবার পলায়নের অব্যবহিত পরবর্তী রিসেট বাটনওয়ালারা আসা অব্দি ইতিহাসের আঁটোসাঁটো সড়কে এই কবিতাগুলির টাইমফ্রেইম। চব্বিশের হাসিনাচণ্ডালী চলাকালীন চার্জড কবিতাগুলা চারায়া রাখা হয়েছে এর অগ্রপশ্চাৎ আরও অনুমান বছর তিনেকের কবিতার আগায়পাছায়। কাজেই, বিশেষ মুহূর্তের উৎসার নয়, নিঃসহায় দেখে দেখে যাওয়া অর্থে দার্শনিক একটা আধাদশকের উপলব্ধিমালা হাজির হয়েছে এই কবিতাগুলায়। তারপরও, অবাক ঘটনা, মনে হয় যেন কবিতাগুলা একই বছরের, মনে হয় কবিতাগুলা হাজারচব্বিশের! তার কারণ, রোম নগরী নিশ্চয় একদিনে পোড়ে নাই। সিচুয়েশন তৈরি হচ্ছিল বহু বহু দিন বহু বহু বছর ধরে। এবং, কবিই ডিটেক্ট করেন, কবিতাই ডিটেক্ট করতে পারে, ডিক্টেটও কখনোকখনো, সময়ের ট্র্যাক। সময়ের ফেনা। দায়দেনা। নৈতিক অনৈতিক বিবেচনা। রাগমালার পাতায় পাতায় হেন সম্বিতগুলি ফিরিয়া পাওয়া গেল।
কবিতাগুলি গীতল নয়; বা, সুরেলাও। মন্ময় কবিতা? তা বলা যেত, তবে ব্যারা থাকিয়া যায় একটা জায়গায়;—লিরিক পোয়েম মন্ময় কবিতার বাংলা ভাবলে এই বইয়ের কবিতাগুলা তা আদৌ নয়। লিরিক্যালিটি এর কন্সার্ন নয়। একটু প্রোজেয়িক, আনমিউজিক্যাল, আনইমোশন্যাল, হার্শ, ডিস্কোর্ড্যান্ট, ফ্যাকচুয়্যাল, অনেকটাই লিটেরাল কবিতাগুলার টেক্সচার। অর্থাৎ, কবিতাভান নাই। কিন্তু এরই ভিতর দিয়ে যে লেয়ার অফ রিয়্যালিটি তিনি ধরতে চেয়েছেন, গতের বাইরে বেরিয়ে তো অবশ্যই, অনেকাংশ সফল হয়েছেন। পপুলারিটির বিবেচনায় নয়, কাজেই, এই বইয়ের কবিতাগুলি সিদ্ধ হয় এর শৈলী ও বিষয়প্রয়োগগত অনুষঙ্গের সততায়।
একেবারেই রিসেন্ট হিস্ট্রি, রিসেন্ট হ্যাপেনিং, কারেন্ট ফেনোমেনা, বিশেষত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স নিয়া আর্টে ডিল করাটা সাহসের, হ্যাডমের, বহুবিধ সংগতি বিধানের ব্যাপার; একইসঙ্গে এর, অতিসাম্প্রতিকতা নিয়া আর্টকরণের, ঝুঁকি বিস্তর। কবিতা ব্যাহত হবার ঝুঁকি। কিন্তু কখনো কখনো কবি আর তার কবিতা ব্যাহত হবার পরোয়া করেন না। আর্টিস্ট ঝুঁকি নেয় অবলীলায়। মিডিয়োকাররা ভাবে, বেহুদা ব্যাখ্যাবিশ্লেষণের কিংখাবে বেবাক মুড়ায় আর গাওহাতপাও মুচড়ায় আর অ্যাআইনির্জীব ন্যারেটিভ বগরবগরবগরবগর উৎপন্ন করে। অ্যাআই। নিউ ইন টাউন। আগন্তুক। নতুন এসছে, শহরে। নেচে নেচে ন্যারেটিভ ধরে। মুহুর্মুহু উগরায়। বিশেষজ্ঞ, সর্ববিষয়। মৃত গত শতকের বইয়ের পাতার ভাষায় স্পেইসের পরে স্পেইস গিলে গিলে লিখে যায় ধাতব চেতনায়। পাকনামি আছে, প্রাণ নাই। বিশেষত রতিরিক্ত, রক্তশূন্য, রুখাশুখাই। নাম তার অ্যাআই। অ্যাআইসিঙ্গার অ্যাআইস্যঙরাইটার অ্যাআইকম্পোজার অ্যাআইপেইন্টার অ্যাআইফিকশনমেইকার অ্যাআইপোয়েট অ্যাআইঅ্যানালিস্টের এই বিফাই বড়াইয়ের সংসার। মনে হয়, বাংলাদেশে এসে অ্যাআই হয়েছে হতহিম্মৎ হাবাহাবড়াদের আত্মরতিক্রীড়ার উপচার। সহসা আহমদ সায়েমের এই সফর, সম্বিৎ ফিরিয়া পাওয়ার। অচিরাৎ পাই আমরা আশিটির বেশি কবিতার সমাহারে এই রিস্কি রাগ ও সম্বিতমালা।
আশার কথা, আর্টিফিশিয়্যাল নয়, এই পোয়েটিক সম্বিৎ ফিরিয়া পাবার সফর, বরং খুবই ন্যাচারাল খুবই ইন্ডিভিজুয়্যাল ইন্টেলিজেন্সের ঘটনা আহমদ সায়েম ঘটিয়েছেন এই বইটায়। সাধারণত কবিতালিখনের কলায় যে-সমস্ত অভ্যস্ততা বাংলাদেশের কবিদের কাজে দৃষ্ট, রুদ্ধজনের রাগ ও সম্বিৎ প্রকাশ করতে যেয়ে সেসবের অনেককিছুর মায়া কাটাতে পেরেছেন কবি। প্রিভিয়াস দুই বই ‘অনক্ষর ইশারার ঘোর’ ও ‘কয়েক পৃষ্ঠা ভোর’ মনে রেখে এই কথাটা ভাবতে পারলাম। অনেক মুক্ত, অনেক উদাত্ত, নতুন এক আহমদ সায়েম। ফলে, আগের দুই বই পড়া থাকলে যেমন নতুন এক বাঁকান্তর মনে হবে এই বই, না-থাকলে তো নতুন মনে হবেই।

৪
তৃতীয় তথা সাম্প্রতিক বই নিয়া আলাপ, সো, সম্প্রতিনিষ্ঠ রই। বিচ্ছিন্ন পঙক্তির উদ্ধৃতিনিচয় দিয়া রাগ ও সম্বিতমালা ঠাহর করা যাবে না। কারণ, কবিতাগুলির নির্মিতিতে, এদের গায়ে ব্যবহৃত মোটিফ ও ম্যাটেরিয়্যালে, একটি বিশেষ করণকৌশল কবিতাগুলিকে এত সংবদ্ধ করে রাখে যে এক পঙক্তি থেকে আরেক পঙক্তি ছিন্ন করা যায় না। করলে ক্যায়োস হয়। এই কবিতাগুলির মিনিং এক্সক্যাভ্যাইট করবার কালে একটি জিনিশ মাথায় রাখলে ভালো হয় যে এখানে প্রতীক বা রূপক বা চিত্রকল্প নয়, এই বইয়ের কবিতারা প্রায় প্রত্যেকেই পোলিফোনিক, নানান মুনির নানান মতের নানান মবের মুখনিঃসৃত কথাবার্তা হাউকাউহাঙ্গামা ম্যাটেরিয়্যাল হিশেবে এস্তেমাল করা হয়েছে এই কবিতাগুলির বাকবিগ্রহ প্রণয়নের সময়। নিরন্তর কনভার্স্যাশনের কাটাকাটির ভিতর দিয়া কবি তার কাব্যিক রিভিল্যাশন ঘটান। ফলে, একটামাত্র পঙক্তি ছিঁড়ে এনে এই সিচুয়েশন এই দৃশ্যায়ন এই মঞ্চায়ন বোঝানো কঠিন।
পোলিফোনি। মিখাইল বাখতিনের আখ্যানতত্ত্বের পোলিফোনি। ঠিক যেমন জ্যাজ বা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে শোনা যায়, একলগে একাধিক সুরের খেলা, মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেলোডির মিলনমিশন, আহমদ সায়েমের নয়া কাব্যকৌশলে এর প্রাচুর্য লক্ষ করব। বহুস্বরের প্রাচুর্য। স্বরের বাদি বিবাদি নির্বিচার নৈরাজ্য উজিয়ে শেষমেশ কবিতাটা পাঠকের হাওলা করেন কবি। ভীষণ পোস্টমডার্ন অ্যাপ্রোচ। কোলাজ ব্রিকোলাজ প্রক্রিয়ায় আগানো। প্রজ্ঞার সঙ্গে প্লেফ্যুলনেস প্রোপোর্শনেইটলি মিশ না খেলে কেঁচে যাবার সমূহ আশঙ্কা। আর মিসান্ডার্স্টুড হতে পারে কবির অভিপ্রায়। স্যাটায়ার টুলটার এই এক সমস্যা, বাচ্যার্থ ও লক্ষ্যার্থ পরিস্কার না হলে টেক্সটের রিড্যাবিলিটি বিঘ্নিত হয়। এই বইয়ে এইটা একটা সাধারণ অকারেন্সই বলতে হবে যে এর প্রণেতা বাচ্যার্থ ও লক্ষ্যার্থ উপর্যুপরি ইন্টার্পোল্যাশন ঘটায়া তার কাব্যাবয়ব গড়ে তুলতে চেয়েছেন আগাগোড়া। শাস্ত্রপড়া ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ রসজ্ঞ পণ্ডিতদের পোক্ত কর্ণে একটু কর্কশ তো শোনাবেই। কিন্তু কবির গস্পেল, কর্কশ হলেও, শোনে যত পামরে পুণ্যবানে।
এর ছন্দ? পর্যবেক্ষণ আছে আমার, যৎসামান্য, বলব। প্রথমত, পয়ার নয়। বাংলা কবিতার দুর্বার দুর্নিবার নিয়তি যেন পয়ার, রুদ্ধজনের রাগ ও সম্বিতে এই নিয়তি নস্যাৎ হয়। তাইলে, এইগুলারে কোন বৃত্তে ফেলবেন, স্বর, মাত্রা, না অক্ষর? কবিতার বিবেচনায় রাখতে হয় এরও অনেক পর, অসংখ্য অতঃপর। তা না রাখতে পারলে কবিতাকলার স্বয়ম্ভুত্ব খর্ব হয়। খাটো হয়। আঁটোসাঁটো হয়া যায় মানুষের চিন্তার কল্পনার ভাব প্রকাশনার বিজ্ঞান। কবি তা, আর্টিস্ট তা, হতে দেন না বলেই নতুন কবিতা নয়া আর্টের উদ্ভাবন সম্ভব হয়। স্পিচ, ডাইরেক্ট অ্যান্ড ইন্ডাইরেক্ট ন্যারেশন উয়িদাউট পুটিং অ্যানি প্যারেন্থেসিস, অজস্র জাক্সটাপোজিশন, ভিশ্যুয়্যাল অ্যাইড মারফতে পাওয়া হ্যাপেনিঙের আওয়াজ দিয়া প্রায় মোজ্যাইকড কবিতাগুলি। শীর্ষে, ক্যায়োটিক সাউন্ডস্কেপের একদম চূড়ায়, সেই রিলিফ, সেই নির্জন কোলাহলহীন পানিফেরির আওয়াজ!
উদাহরণসমেত আলোচনা? “তাহলে আর কী। / ফাঁকি ফাঁকি সবটাই ফাঁকি / সবাই কী আর একভাবে হাঁটে / কথা বলে?” সেইটাই। কীর্ণ কবিতাপঙক্তি চতুষ্টয় বাংলা ভাষার বহুল পরিচিত ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ বইয়ের একটি কবিতার অন্তিমাংশ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। কোনো অরিজিন্যাল কবির প্রযুক্ত ছন্দের ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি বলার দরকার আছে কি? ভিন্নভাবে যে হাঁটে, তার প্রতি পদক্ষেপেই রিদম, সেই রিদম প্রচলিত ম্যাট্রিক্সে ক্যাপচার করা না গেলেও রণন তার অগোচর থাকে না। আহমদ সায়েমের কবিতা বাংলা ভাষায় রেজিস্টার্ড রাইমপ্যাটার্নগুলার বাইরে থেকেই ক্রিয়াশীল মনে হয়।

৫
বিষয় বিস্তৃত হলেও প্রয়োজনে একলাইনে তা বলা যাবে না তা নয়। এই বই সবচেয়ে বেশি যা ধারণ করেছে তার নাম সময়। কিন্তু, আশ্চর্য, স্লোগ্যান নয়। তাতে পর্যবসিত হবার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও হয় নাই তা। গ্র্যাফিটি রিলস নিউজ ভিউজ সোশ্যাল কমার্শিয়্যাল মিডিয়া প্রভৃতি রিসোর্সেস থেকে এলিমেন্টস কালেক্ট করে কবি তার পপুলার কালচারবাহিত মনোভুবনেরও ছোঁয়া পাঠকেরে এগিয়ে দেন যাতে কবির অভিপ্রায় মিসিন্টার্প্রিটেড না হয়।
এই সমস্ত উপাত্ত তথ্য কথাচূর্ণ প্রভৃতির ভিত্তিতে এমন এক ভাবনাজগৎ উদ্ভাসিত হয়, যা অত্যন্ত স্বকীয়, যা অত্যন্ত কবিজনোচিত। কবিতাগুলি ইম্পালসিভ, বড্ড বেশি ইম্পালসিভ, বলবেন কেউ। তো? কবি ইম্পালসিভ হবে না তো কী ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ইম্পালসিভ হবে! যেদেশে যেমন আচার, কবিকে তার বিচার সারতে হয় সেই আচারেরই ছুঁতানাতায়। গিরস্তালি নিত্যকৃত্যের নানাবিধ ঘটনা নাট্যঘন উপস্থাপনার মাধ্যমে কবি তার পোয়েটিক রিভিল্যাশন ঘটান। অথচ তা আরোপিত মনে হয় না। আনুষ্ঠানিক মনে হয় না।
আচ্ছা, আসেন, আর না পারি কিছু কবিতার শুধু নামটুকু উচ্চারণে আনি। ‘একজোড়া রক্তাক্ত জুতা’, ‘প্রজন্ম’, ‘খোদাতায়ালা’, ‘তোমারও বিচার হবে’, ‘নারায় তকবির’, ‘যাদের হাতে লাঠি’, ‘দেশপ্রেম’, ‘শব্দের দেয়ালে শুধু রক্তের দাগ’, ‘পানি লাগবে পানি’, ‘বিচার’, ‘খুনি বলা যাবে না’, ‘৩৬ জুলাই’, ‘পুতুলের রক্তাক্ত দৃশ্য’, ‘বইটি নিষিদ্ধ করা হউক’, ‘শাসন’, ‘রিসেট বাটন’, ‘পলায়নের পথ’, ‘বিধান’, ‘হুজুরে মুহতারাম’। কতিপয় শিরোনাম শুধু। গনগনা আগ্নেয় সময় নামোচ্চারেই চিনে নেয়া সম্ভব হয়। আর সংস্কৃত বৈয়াকরণিকের অলঙ্কার ও প্রসাধনের শৈলী দিয়া রাগ ও সম্বিতের রুদ্ধশ্বাস যাত্রা কাভার করাও সম্ভব নয়। সেজন্যে আলগ শৈলীই ভাবতে হয়।
ছিন্ন পঙক্তির ডালা সাজায়া আর্টিকল ভারী ও ভীতিকর করব না ভাবলেও কয়েকটা লাইন শুধু দ্রুতরেখ করি। বিভাব কবিতায়, শিরোনামহীন শুরুতে যে-কবিতা পাওয়া যায়, এই বইয়ের লেখাগুলি নিয়ে একটা আগুয়ান আন্দাজা দিতে চেয়েছেন কবি। উদ্ধার করি, অংশবিশেষ : “শান্তির জন্য প্রার্থনা করি আর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি / প্রতিপক্ষকে না সরাতে পারলে তা অসম্ভব, তাই বাধ্য হয়ে / ফেবুতে ব্লক, আনফ্রেন্ড, সর্বশেষ হত্যাযজ্ঞে হাত বাড়াই / … / বইয়ের লেখাগুলো এই মহাশূন্যের কিছু রক্তদাগ নিয়ে, দাগগুলো / কী করে আমার হয়ে যায় বা হবে তা বোঝাপড়ার পর্যায়ে এই লেখাপত্র”। অনুমান করা যায় এই বইটায় লেখক এক রিলেন্টলেস রোলপ্লেয়ারের ভূমিকায় নামবেন। রোলপ্লে একটা কাব্যটেক্নিক হিশেবে এই বইয়ে অ্যাপ্লাই করা হয়েছে দেখতে পাবো।
“ভোরে আমাকে কাজে যেতে হবে, তাই কিছুক্ষণ / মোবাইল স্ক্রলিং করে ঘুমাতে যাই; অবসরে / ফের দেখে নেব — / রক্তে লাল হয়েছে আর কয়জোড়া জুতা…”। প্রাত্যহিকতার প্রবাসযাপনের খুঁটিনাটিগুলার পাশাপাশি দূর স্বদেশের ইথারচিত্র বয়ন করেন কবি নিঃস্পৃহ অসহায়তায়। বাংলা কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতায় বিবৃত ও সংবৃত — মোটা দাগে এই দ্বিপ্রকার কবিতা পাওয়া যায়। আহমদ সায়েম গ্রহণ করেছেন অর্ধবিবৃত-অর্ধসংবৃত করণকৌশলে কবিতাপঙক্তি নির্মাণের উপায়। যার ফলে অ্যাম্বিগ্যুয়িটি ও অবস্কিউরিটি লেগে থাকে কবিতার গায়। একটা কবিতা শুরু হচ্ছে, ‘জিব্রাইল (আ.)-এর একটা প্রশ্নের জবাবে নবি মোহাম্মদ (স.) বলেছিলেন —’ এই পঙক্তি দিয়া। গাদ্যিক লাইন। মনোটোনাস। বিবৃতিবাচক। ফলে লাইনে লাইনে লালাবাই নাই। বাংলাদেশের কবিতায় নব্বইয়ের ন্যাকামিভরা শান্তিনিকেতনী লিঙ্গুয়ায় মিস্টিক কাব্যিকতা নাই। কিন্তু কবিতা আছে। এক লেয়ারের কবিতা নয়, এইটা মাল্টিলেয়ার্ড কবিতার একটা বই। নিরাই নিরাজ বাংলাদেশের কবিতার পাশাপাশি আছে একেবারেই গৃহস্থ অদৃষ্টবাদী চিন্তাযাপনের কবিতাও। অতি তুচ্ছ নৈমিত্তিক উপপত্তিগুলির ভিত্তিতে এই কিসিমের কবিতায় এমন একটা আভা পাওয়া যায় যা আরোহ ও অবরোহ পদ্ধতিসিদ্ধ সুশীল বাকপ্রতিমায় সম্ভব নয়। এইভাবে ব্যক্তির কবিতা হয়।

৬
আমাকে যদি রিকোয়েস্ট করা হয় একটিমাত্র কবিতা টাইপ করে দিতে, বই থেকে নিয়ে, আমি ডিসাইড করেছি দিব ‘পোস্টাপিস’, শরীরসমেত —
প্রযুক্তির কল্যাণে কত ছোট হয়ে আসতেছে সবকিছু
এত এত ছোট যে বিস্ময় লাগে
আমাদের তো অনেক ছিল — গোয়াল ভরা গরু ছিল, ফড়িং ছিল —
নদী ছিল, বিল ছিল, ছিল ভাতের হোটেল সহ আরো অনেক…
সবচেয়ে কষ্ট লাগে পোস্টাপিসটা দেখলে —
আস্ত-একটা পোস্টাপিস! আহ্!
গিলে ফেললো সাধারণ একটা মোবাইল ফোন! —
সে যে খুব সাধারণ, সেই ভাবনাটাও ঠিক না, — সাধারণ হইলে
আমাদের এত এত স্বপ্ন আহ্লাদ সবকিছু
সে এভাবে গিলে ফেলতে পারত না
আরো যে কত কী সে রপ্তানীযোগ্য করে তুলেছে, কে জানে!
এক ঔর ওয়ান মৌর হাঁক দিলে হ্যাপিলি রিসাইট করব ‘সুগন্ধী’ —
গাছটি জানে ফুল আর ফল ছাড়া
তার কোনো মূল্য নেই
ফুল-ফল জানেই না তাদের সৌন্দর্যের মূল্যায়ন
কত অল্পতে শেষ হয়ে যায়
তবু বিলিয়ে দেয় সুগন্ধী;
এই সুগন্ধী কী করে ‘তার’ হয়ে গেল —
তার পরে আর ‘তার’, তার জানা নেই
জানা নেই কোনো সুর, মন্ত্র বা দেশের গান
ফল বা ফুলগুলো গাছ নয়, একে অন্যের বিপরীত
তবু যেন সবকিছুতে একটা নীরবতা
একটা বিন্দুবিসর্গের সঙ্গ, একটা আমি —
এই আমিটাও কিচ্ছু না, আমি ছাড়া।
মাল্টিলেয়ার্ড কবিতার একটা অ্যান্থোলোজি এই বই, কেন বলেছি তা আরও পরিস্কার হয় এই দুই কবিতার মতো চোরাগোপ্তা আরও অনেক উপস্থাপনায়।
আর একটি কবিতাই দিই, ক্রিটিক করব পরে, শিরোনাম ‘সক্ষমতা’ —
বাঁশঝাড়ের বাঁশ আর মানুষের মাঝে সামান্য-কিছু মিল আছে —
যেমন, একত্রে থাকার অভ্যাস, বাছবিচার ছাড়াই
একে অন্যের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভ্যাস
কিন্তু বাঁশের মতামত দেয়ার সামর্থ্য নেই
কোথায় ব্যবহৃত হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ারও সামর্থ্য নেই তার
অথচ মানুষ এখানে সক্ষম
আর এই সক্ষমতাই তার সফলতা অর্জনের একমাত্র মন্ত্র!
লক্ষ করুন, অন্তিমে এসে একটা জাজমেন্টাল টার্ন নিলো কবিতাটা। যার ফলে একটা কাব্যনাশ ঘটল, অথবা তা না, অন্তিমে একটা এক্সক্লামেশন যতি দ্বিধায় ফেলে দিলো, কবিতাটি সিদ্ধান্তবাচক সরাসরি সেই রায় দেয়া না গেলেও ঘটনা প্রায় সেদিকেই গড়াল। কনফিউশন, অর্থোদ্ঘাটনে নেসেসারি কিছু কমতিবিচ্যুতি, প্রভৃতি নিয়াই এই কবিতামালার সংলগ্ন হওয়া যায়।

৭
এইবার কিছু ওয়ানলাইনার কয়েকটি ট্রিপ্লেট আর কাপলপঙক্তির সমাহারে একটা কাব্যপ্রদর্শনী কিংবা কাব্যশোকেইস প্রেজেন্ট করতে চাই। আর টাইম নাই। কিন্তু, ওই যে, বেশ ডিফিকাল্ট, এইগুলি ইন্টারউভেন অতিমাত্রায়, তাঁতের মতো, সুতা আলগ করে এনে দেখানো সম্ভব নয় তাঁতের মহিমা। তারপরও কয়েকটা ট্রায়াল দিই।
* প্রকৃতি নিজেকে দীর্ঘায়ু করার জন্য / নিজেকেই চর্চা করে
*গতকাল যারা বিচারক ছিলেন আজ তারা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো!
*আগুন সবসময় পোড়ায় না / তারে স্বপ্ন বোনার কাজেও লাগানো যায়
*ধর্ম দ্বন্দ্ব নয় তা কে কাহারে বলিবে…
*সবার একবার দিন আসে; দিন যে আসে তা বোঝানোর জন্যই
*মিছিল দিতে দিতে এগিয়ে যাই… / সবাই যেন বুঝতে পারে আমাদের পরে আর কিচ্ছু নাই।
*মুগ্ধের পানি বিলিয়ে দেয়ার দৃশ্য পৃথিবীর কেউ ভুলবে না
*একজন সাঈদ বুক টানটান করে দেখিয়ে দিয়েছে / শত্রুর মোকাবেলায় কী করে দাঁড়াতে হয়…
*জীবন দেখতে হলে / অন্ধ করে তুলতে হবে নিজেকে
*যার কোনো বিচার নেই তিনিই বিচারক।
*দেখতে চাই তোমার লীলা ও সংলাপ, শঙ্কা, আগুন / জ্যোৎস্না, ফুল
*ভাবনায় যে মেঘ খেলা করে তা কী দেখানো সম্ভব!
*সাদা হরফের শব্দগুলি সাদা পেজে / দেখা যায় না কখনোই
*অবহেলাগুলো লালন করেছি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা
*যা যা বিশ্বাস করো তা-ই হবে, পাপ কেউ কাউকে দেয় না / নিজেকে তা অর্জন করতে হয়, পরিবেশ আর পছন্দ থেকে
*কেউ বানান ভুল করে ঠিক করে, / কেউ ভুলটাই জানে বিধায় ঠিক করা আর হয় না।
*আমি ছাড়া সবকিছু যদি প্রকৃতি হয় / — আমি কে?
*আগুন সবকিছু জ্বালিয়ে দেয়, এইটা দোষ নয়, তার চরিত্র।
*যারে ভালোবাসি তারে পর আর বাসি না বলেই / পৃথিবী এত সুন্দর আর স্বপ্ন দেখার উপযুক্ত / … / ভোরের আলোর মতো সহজ কথা — / ক্ষিধা লাগলে চরিত্রের চিহ্নগুলো প্রকাশিত হয়।
*দিন কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তার একটা নমুনা / আজকের দৈনিক পত্রিকা হাতে নিলেই পাবেন…
*পাতাঝরার শব্দ ভালো লাগে / শব্দে-শব্দে মাঠঘাট ছেয়ে যায়; / … / বৃষ্টি এলে সবার পা ভিজিয়ে যায়।
*মনে রাখতে হবে / ডুবুরি আর সাঁতারজানা লোক / এক নয়
*যে সৃষ্টি করে বা জন্ম দেয় / সে আবার বিচারক হয় কী করে, বুঝি না! / … / একজন পিতা বিচার নয়, তিনি শাসনই করে থাকেন…
*স্বপ্নপূরণের ক্যাসেট বাজাতে থাকলে / ফিতা আটকে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যায়…
*নিঃশ্বাসের একটা শব্দ আছে, কেউ না-শুনলেও / নিজে শোনা যায়
*নীরবতা দিয়ে ভালোই শাসানো যায়।
*জীবনের সৌন্দর্য দেখার জন্য / দেখার চোখটাই প্রয়োজন, দেখানোর নয়…
*আর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী যারা / তারাই আজ জ্ঞানবৃক্ষ…
*চল্লিশ বছর সংসার করে বউ জানতে পারেনি / স্বামীর শরীরের ঠিক কোন স্থানে রিসেট বাটন রয়েছে…
*যা-কিছু চোখে দেখা যায় তার সবটাই সত্য না-ও হতে পারে
এইসব পঙক্তি পিকআপ করবার সময় আরও অন্তত দুইটা আস্ত কবিতা আমার নজরে এল, ‘পলায়নের পথ’ তন্মধ্যে একটা। আমি আস্ত কবিতাটাই দিতে চাইব —
অন্ধের দেখার সাথে যখন আপনার দেখার মিল পেয়ে যাবেন
বুঝতে হবে — শীঘ্রই পলায়ন করতে হবে, আর
সারাটা গ্রাম জুড়ে যখন অন্যায়ের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়বে
তখন বিচারক আর ডাকাত একসাথে চলাচল করতে দেখবেন
প্রকৃতি তার হিসাবে দ্বন্দ্ব রাখে না, ছায়াই বলে দিতে পারে
প্রার্থনার সময় মাত্র এল, না শেষ হয়ে গেল
কেউ ছায়া দেখে চা-চক্রে বসে, কেউ পলায়নের পথ খোঁজে।
যেতে যেতে এমন কবিতার সাক্ষাতে স্যালভ্যাশন খুঁজে পায় পাঠক। বইটার মাল্টিলেয়ার কবিতার নজরানা আর একটাই দিতে চাই, ‘মিরর’ নাম তার —
শুধু মিরর নয় পূর্ণ পৃথিবীটাই
সৃষ্টি করা হয়েছে নিজেকে দেখার জন্য
দেখার জন্য আমি আবিষ্কার করেছি এক সহজ তলোয়ার —
যা দিয়ে কেটে ফেলা যায় পৃথিবীর দুঃখ
ভয় আর ঘৃণা করার সবগুলো বিষদাঁত
উদ্ধৃতিস্ফীত হয়ে উঠবার আগে এই নিবন্ধ গোটানোর আঞ্জাম করি। বিনয় ছাড়াই জানাই, কবিতার পঙক্তিবিন্যাস ও স্তবক বিভাজন অধিকাংশ সময় প্ল্যানড মনে হয় নাই। চিহ্ন ব্যবহারেও কবির সচেতন বিবেচনা ঠাহর হয় থোড়াই। ড্যাশপ্রধান পঙক্তিপ্রবাহ অনেক সময় নিরুদ্দেশ নন্দনেই নিপতিত করে পাঠকেরে। এর বাইরে এই কবিতামালার প্রাণ ও প্রকরণ উভয় জায়গায় কিছু অনপনেয় অনটন নিয়াই চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শিরের দেশে এই বই সেইলআউট করতে চায়।

৮
আহমদ সায়েম। কবি, সম্পাদক, পুস্তকপ্রকাশক, স্থিরচিত্রগ্রাহক ও স্বতঃপ্রণোদিত তথ্যচিত্রনির্মাতা। আবির্ভাবকাল বিবেচনায় একবিংশ শতকের প্রথম দশকের লেখকদলের অন্তর্ভূত। পূর্বপ্রকাশিত কবিতাবই দুটো : ‘অনক্ষর ইশারার ঘোর’ ও ‘কয়েক পৃষ্ঠা ভোর’; অন্য বই ইংরেজিতে অনূদিত : The Layers of Dawn; সম্পাদনা করেন কাগুজে সাহিত্যপত্র ‘সূনৃত’ এবং দু-দুটো ওয়েবম্যাগ ‘রাশপ্রিন্ট’ ও ‘ফিলাডেলফিয়া’। প্রাসঙ্গিক কারণে উল্লেখ্য, ‘সূনৃত’ পত্রিকাটি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের বিশেষত বাংলাদেশের কবিসাহিত্যিকদের ধারণ করেছে অপার মমতায়। তাছাড়া, ‘হরমা’ নামে একটা কাগজের একের অধিক সংখ্যা প্রকাশের পাশাপাশি কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার ও বাউল মকদ্দস আলম উদাসীর মৌলিক পাণ্ডুলিপি পিনডআপ পুস্তিকা আকারে পাব্লিশ করেন নব্বই-উত্তীর্ণ সময়ে। ‘কোলাজ’ নামে একটা পাব্লিশিং লাইনআপ গড়ে তোলেন, প্রকাশিত হয় সেই ব্যানারে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বইপত্র। ছোটকাগজ সম্পাদনায় পেয়েছেন ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস ২০১৩’ সম্মাননা। নাট্যসংগঠনের সঙ্গে সংলিপ্ত। জন্ম ও বেড়ে-ওঠা বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী সিলেট শহরে; প্রপিতামহসূত্রে প্রাপ্ত ঘরগিরস্তি আছে, ভানুগাছে। পেশাসূত্রে সপরিবার বসবাস যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। সম্প্রতি ফিলাডেলফিয়া থেকে একই নামে একটা বাংলা সাহিত্যপত্রিকা প্রিন্ট ও ওয়েব প্রকাশ করছেন, যেখানে ডায়াস্পোরা কমিউনিটির সৃজন ও মনন উপস্থাপনের প্রতি বিশেষ যত্ন গ্রহণ করা হয়। এর বাইরে আর যা বলার তা এ-ই যে, এই কবি দিলখোলা ও দরদি; লিবারেল আর নিয়োলিবারেলদের নৌটঙ্কি ব্যতিরেকে এই কবি ইন ট্রু সেন্স উদার হাওয়াবাতাসের মর্মান্বেষী; বিষাদমুক্ত, ভ্রমণপ্রিয়, বন্ধুবৎসল। অবসরে ক্যানভ্যাসফ্রেমে পেইন্টিং করেন, অবিরল ড্রয়িঙখাতায় স্কেচ সমেত। অত্যন্ত অকাব্যিক বিষয়াবলি নিয়া ভাবতে এবং বলতে পারার মতো সবিবেচন লিখনশৈলীর সন্ধানে চেষ্টাশীল কবিকে জ্যান্ত ও জজবাপূর্ণ পাওয়া গেল ‘রুদ্ধজনের রাগ ও সম্বিৎ’ শীর্ষক সর্বসাম্প্রতিক বইটায়।

৯
হোয়াট অ্যান আয়রনি, মিউজিক্যাল মোটেও নয় এমন একটা বই পড়তে পড়তে সেই মিউজিকেই ফিরে যেতে হয়! কারণ আছে। এই বইয়ের টাইটেলেই নিহিত আছে সেই কারণ। ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত মনে পড়ায়। সাউন্ডঅ্যাফিনিটির কারণে। দেবব্রত বিশ্বাসের কাল ও ক্রাইসিসগুলি ইয়াদ করায়। বিশেষত বইয়ের যে-দিকটা আলাপের বাইরে থেকে গেল তা এই শিরোনামেও লক্ষ করা যায়, ডিকশনারিনির্দেশিত প্রয়োগপ্রেফ্রেন্সের ফান্দে পাও দিয়া সংবিৎ না লিখে সম্বিৎ লেখায়। এই প্রয়াস ছড়ায়া আছে বেবাক বইটায়। একটা বানানও অনেক সময় ম্যাটার করে, একটা পাঙচুয়েশনও অনেক সময় গানের কাছে প্রেমের কাছে প্রাণের আরও কাছাকাছি নিয়া যায়। বাঙ্গু প্রুফরিডাররা বাংলা অ্যাকাডেমি আর অ্যাআই নিয়া খাড়া। তাদিগের পেটে নাই প্রজ্ঞার লেশমাত্র ও কল্পনাপ্রতিভা।
আভিধানিক সংস্কৃত বাংলা ফালায়া ভাবনার অনুবর্তী স্পিরিচুয়ালিটি রিভিল করতে সক্ষম মুখবাচনিকতার প্রবর্তন ঘটিয়েছেন কবি নিশ্চেষ্ট পরিমিতির সঙ্গে। এই বইটায়। এর বুনটকৌশল অনন্য এইজন্যে যে এখানে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনাচারের অনেকটুকুই ইমান আকিদা খাসিয়ত সমেত পঙক্তিতে এনেছেন কবি নিজে সেসব বাহাসে তেমন লগ্ন না হয়ে, সেসবের ইন-জেনারেল এসেন্স নিয়া আলাপ উঠিয়েছেন প্রায় নিরুচ্চারে, এমন অলগ্ন অনুঘটকের ভূমিকায় থেকে কবি বরং কবিতাগুলিকে ফ্যাসিলিটেইটই করেছেন।
অকাব্যিকই, বিষয়গুলি ডিল করা, ডিফিকাল্ট অ্যাসাইনমেন্ট, বাংলা কবিতার অভ্যস্ততায় এই মিসিং আলাপগুলা অ্যাড-ইন করতে চেয়েছেন কবি। ডিলিঙগুলির স্পয়লার দিচ্ছি না। আশা করি টিজার দিতে পেরেছি।

১০
গিয়েছে পেরিয়ে সময়, টাইম আউট, নিভেছে উনুন। জ্বলে উঠেছিল, জ্বলে যে উঠে কখনো ছিল উনুন, প্রমাণ তার ছাই। প্রমাণ এই বইয়ের কবিতাগুলাই। প্রমাণ দুইহাজারচব্বিশের গোটা আগস্টের আগের আস্ত জুলাই। দিন যেতে না যেতেই বিষয়টা, আগ্নেয় উনুনের বিষয়টা, আমরা ভুলে যাব সবাই। ইনডিড, ভুলে গেছি। কিন্তু, কবির কাজ, কবিতার কাজ, সমস্ত অব্লিভিয়ন সমস্ত বিস্মৃতিবিবর এক্সপ্লোর করা। তারপর কবিতায় তা ধরা। আহমদ সায়েম কবিতায় তার সময়ের স্বদেশের স্ববিশ্বের হাউকাউগুলা ধারণ করতে পেরেছেন।
বইটা পাব্লিশ করেছে জলধি, ঢাকা থেকে, ফেব্রুয়ারি পঁচিশে। কেয়ারের ছাপ আছে পাতায় পাতায়। ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার, ছয় ফর্মার, বই। কিছু অলঙ্করণ আছে, রেলেভেন্ট। রঙিন। প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন করেছেন তাইফ আদনান। বইয়ের গায়ে লেখা দাম তিনশ ষাইট টাকা, বাংলাদেশি মুদ্রায়।
রাগ ও সম্বিতের এই বইটা আগাগোড়াই প্রীত করেছে আমায়। নাদান পাঠক আমি, তৃপ্তি যার তৃষ্ণায়।
আহমদ সায়েম রচনারাশি
কবিতায় আহমদ সায়েম
- ফিরলে না তুমি সম্বিতে নিভে গেল উনুনের আঁচ - December 22, 2025
- দ্য পোয়েট হু রৌট দ্য রৌড অ্যান্ড দ্য রৌভার - December 7, 2025
- নগরমুসাফিরির নবতরঙ্গ - November 24, 2025

COMMENTS