সিতারা ও কাজরি || শেখ লুৎফর

সিতারা ও কাজরি || শেখ লুৎফর

আকমল হোসেন নিপুর ছোটগল্প নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা অনেক দিনের। আমি তখন ছোটগল্পের একজন মগ্ন পাঠক। একটু অবসর পেলেই সংসারের যত আজব আর দুঃখী মানুষ মগজে ভিড় করে। অগ্রজদের গল্পবলার ভঙ্গি, ভাষার বুনট, চরিত্রের বিকাশ এসব খুব মন দিয়ে ঠাহর করি। পকেটে শ-খানেক টাকা জমলেই সিলেট শহরে চলে আসি। দীনভাই, টিএম আহমেদ কায়সার, আহমদ মিনহাজদের পিছে পিছে নীরবে হাঁটি। গোটা দুনিয়ার সাহিত্য বিষয়ে তাদের আলাপ চলতেই থাকে। তাদের বিচার-বিশ্লেষণ খুব মন দিয়ে শুনি। রাত একটা-দেড়টা হলে শহরটা একটু থিতিয়ে আসে। তখন দীনভাইরা শাহি ঈদগার মোড়ে চা খেতে যায়। ভাপা পিঠা খেতে খেতে আমি প্রায়ই দেখতাম, টিলার ওপর কলেরা হাসপাতালের বারান্দাটা ঝকঝকে আলোয় খা খা করছে। সেই নির্জন বারান্দাতে শেষবারের মতো আমাদের আড্ডাটা জমে উঠত। এমনি একদিন দীনভাই তার ব্যাগ থেকে রোগা রোগা গতরের একটা বই বের করে। আমি ভেবেছিলাম কোনো চটি হবে। দেখলাম চটি না, আকমল হোসেন নিপুর ‘জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ’।

আড্ডা থেকে উঠে আসার সময় দীনভাই বইটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। পরদিন ভোরের বাসে ফিরার পথে একটানে বইটা শেষ করেছিলাম। এখনও মনে আছে, সব-কয়টা গল্পই আমার ভালো লেগেছিল। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়েছিল, ‘কবজপুরাণ’ ও ‘জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ’ গল্পদুটি। ১৯৯৯-এর সেই  ভালোলাগাকে আজও আমি ছুঁতে পারি!

‘কবজপুরাণ’ গল্পের বাঁজা সিতারার মানসিক বিকাশ আমাকে আজও পথ দেখায়। লেখার ভঙ্গিটা গতানুগতিক হলেও তেজ আছে। পাকা আমের ডালে ঝাঁকি মারার মতো গল্পের নায়িকা সিতারা পাঠকের মনে ধাক্কা মারে। সমাজ-সংসার, রাষ্ট্র-রাজনীতি ও সময়কে নিপুভাই তালমিছরির দানার মতো একসাথে কেলাসিত করেন। কিন্তু এই দুটো গল্পকে নিপুভাই সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। খণ্ড খণ্ড দৃশ্য জুড়ে দিয়ে বয়ন করেছেন কবজপুরাণের সিতারা আর ‘জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ’ গল্পের কাজরিকে। তাদের দীর্ঘশ্বাস পাঠকের পাঁজরে এসে বাড়ি খায়।

‘কবজপুরাণ’ গল্পের দ্বিতীয় প্যারায় একটা নিপুণ ইশারা আছে। একটু নজর করে দেখলে যেমন আমরা দেখতে পাই, যাদুকাটা নদী কিংবা টাঙ্গুয়ার হাওরের ভাসা স্রোতের নিচে আরেকটা চোরাস্রোত তরতর করে বইছে। তেমনি এই ধরা এই গল্প দুটোর ভাব ও ভাষায়। একটা জটিল বাক্যের পরেই আপনি দেখা পাবেন আপাত সরল ও ছোট একটা বাক্যের। ঝকঝকে ছোট এইসব বাক্যগুলোতেই নিপুভাই লুকিয়ে রাখেন পরত পরত ভাবনা। যা আপনাকে সারল্যভরা শিশুর হাসির মতো নির্দ্বিধায় স্বাগত জানাবে। তাহলে আসুন আমরা সেদিকেই একটু নজর ফেরাই, —

…কখন আঁচল খসে পড়েছে সিতারার। শাড়ির জড়িয়ে থাকা প্যাঁচ-পোছকে এমন মুহূর্তে তপ্ত বানবিদ্ধ, বিরক্তিকর বোঝা মনে হয়। এই ক’দিনে সমস্ত গতরে লক্ষকোটি ঘামাচি ফুটেছে। একটু গরম লাগলেই গা চুলবুল করে, আঙুলের নখে নখে মাংস উঠে আসলেই যেন আরাম।

আসলে কম-বেশি আমরা সকলেই যে জীবনটা যাপন করছি সেখানে কোনো আরাম নেই। নেই স্বস্তি। তাই তাকে আমরা একটুও মেনে নিতে পারি না। এক-কথায় এই দলামচা জীবন আমরা কেউই চাই না। ‘কবজপুরাণ’ গল্পের সিতারা মা হতে চায়। কিন্তু হতে পারছে না। নিপুভাই সিতারার এই কষ্টকে গল্পে এভাবে দেখান, —

নগ্ন সূর্যের প্রচণ্ড তাপে মাটি পোড়ে; সবুজ পোড়ে; সবুজ পুড়ে গেলে নিসর্গ ধূসর ম্লান হয়ে যায়।

আমরা দেখি গল্পের সিতারাও তা-ই। এই জীবন তার একটুও কাম্য নয়। তার কোল জুড়ে সে চায় সাতরাজার মানিক এক পুত্র। গা-গতরে খুব ছোট এই ‘কবজপুরাণ’ গল্পটি এভাবেই একটু পরপর বাঁক বদল করে পাঠকের সারা অন্তর দখল করে রাখে। সিতারার চাওয়া-চিন্তা আর কথা বলার ভঙ্গিটি মনে গেঁথে যায়। তখন তাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়।

একটা সন্তান কামনার তপস্যায় মগ্ন সিতারা যখন দেখে সে এতটা বছর খামাখা একবস্তা তাবিজ  বয়ে বেড়াচ্ছে, তাবিজ তাকে বন্ধ্যাত্ব থেকে উদ্ধার করতে পারছে না, তখন সে তাবিজগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেয়। তার স্বামী যখন কবজগুলোর কথা জানতে চায় তখন সিতারা বলে, ‘কত আর বোঝা বই কও!’

নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক মারিও বার্গাস য়োসা ( জন্ম ১৯৩৬) বলেছেন যে, “গল্পকথকের গল্পগুলোও মানুষের স্মৃতিতে টিকে থাকতে পারে যদি তা জাদুময়তার সাথে বলা হয়, কিন্তু বয়ানকালীন কুহক থেকে বেরিয়ে আসার পরে শ্রোতারা বুঝতে পারে যে তাকে বলা হয়েছে একটি শিল্প, একটি মিথ্যা, একটি কাল্পনিক আখ্যান; শিল্পী যাকে বাস্তব জীবনে উত্তীর্ণ করে তুলেছেন। … স্মৃতিকে সংরক্ষণকারী চরিত্র ও অভিযানে পরিপূর্ণ এই আত্মগত ও স্পর্শাতীত জীবনে বেঁচে থাকবে — শ্রোতার এই সচেতনতাকে স্বীকার করতে গিয়ে হারিয়ে যাবে না এই জীবন।”

গল্পকার আকমল হোসেন নিপুর ছোটগল্প ‘কবজপুরাণ’ কিংবা ‘জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ’ তাই আমার কাছে একেকটি ব্যতিক্রম পাঠ। সবদিক গুছিয়ে তিনি আলাপ জোড়েন। ভাষার ঝলমলে এক ডিঙি তরতর করে চরিত্রকে ঘটনার নিউক্লিয়াসের দিকে টেনে নেয়। তীব্র আবর্তনের মাঝে ছোট ছোট দৃশ্যে ভেসে ওঠে রক্তমাংসের মানুষ, দেশ, সময়, ব্যক্তির দহন, ক্ষয়। তখন মনে পড়ে ফ্রানৎস কাফকার কথা। তিনি বলেছেন যে, “এ-জীবনে একান্ত ব্যাপার তার আনন্দগুলি নয়, বরং আমাদের উচ্চতর জীবনে আরোহনের ভয়; এ-জীবনের নিজস্ব জিনিস তার নিদারুণ যন্ত্রনা নয়, বরং ওই ভয়ের কারণে আমাদের আত্মদগ্ধতা।”

ভয় মানুষের নিজস্ব কিছু নয়। ছিলও না। কিন্তু মানুষ যখন সভ্যতার আলোতে এসে দাঁড়াল, দশজনের কাঁধে বসে একজন পা নাচানোর প্রতিযোগিতায় নামল, তখন থেকেই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা নিজেদের সময় দিয়ে নিজের হাতে আমাদের চারপাশে পুঁতছি ট্র্যাজেডির নতুন নতুন খুঁটি। আমাদের চারপাশে গড়ে উঠছে অদৃশ্য জাল। আমরা এখন ফাঁদে আটক সেই মাছ, যে তার চারপাশের সাথি ভাইকে ডেকে এনে এনে  ফাঁদে জড়ায়।

কেউ যখন নিচে নামতে থাকে তখন পাশের জন তৃপ্ত চোখে তা উপভোগ করে। একটু একটু করে গড়ে ওঠা হাজার বছরের এইসব একদমে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসাটা এত সহজ কথা নয়। তবু কেউ কেউ সেই কঠিন পথেই পা ফেলে। ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে হাঁটে। সেই স্বপ্ন দেখা শুধু ব্যক্তির মনের জোরেই ঘটে। মেনে নিতে না-পারা জীবনটা ড্রেনে ফেলে দিয়ে, নতুনটা পাওয়ার জন্য আগুনে হাত বাড়ায়। তাই তো দেখি ‘কবজপুরাণ’ গল্পের সিতারার গলায় ডজনখানেক তাবিজ। তাবিজ যদি তার মরা গাঙে বান ডেকে আনতে পারে! কিন্তু সিতারার এই তপস্যা ফলবান হয়ে ওঠে না। তখন সে বিদ্রোহ করে। তার গলায় ঝোলানো তাবিজের পোটলাটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বামীর বাহুতে ধরা দেয়।

‘কবজপুরাণ’ গল্পের সিতারা যেখানে ক্ষেতের আল-বাতর ভেঙে দিয়ে নিজের জমিনে বীজ বুনতে প্রস্তুত হয় সেখানে ‘জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ’ গল্পের কাজরি স্বপ্নহীন আন্ধা চোখে জলদাসের পথ চেয়ে অপেক্ষা করে। জীবন তাকে দিয়েছে কঠিন পাথরসমান অপেক্ষার প্রহর। তাই একটু কান পাতলেই আমরা কাজরির বুকের হাহাকার শুনতে পাই।

কুড়িবছর আগে সিতারা আর কাজরির সাথে আমার চিন-পরিচয়। সে-গল্প শুরুতেই শুনিয়েছি। আজও আমি চোখ খুললে দেখতে পাই দগ্ধ দুপুরে আলুথালু সিতারা একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। খা খা মাঠের দিকে তার উদাস নজর। সময়ের স্থির চৌকাঠে কে যেন তাকে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে। তাই আকমল হোসেন নিপুর সিতারা ও কাজরিকে ভুলে যাওয়া অত সহজ নয়।

সেপ্টেম্বার ২০১৭

শেখ লুৎফর রচনারাশি
শেখ লুৎফর প্রণীত ধারাবাহিক উপন্যাস চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you