মেঘরাজার কোলে অমর পাল, মাহবুব পিয়াল || মহসিন রাহুল

মেঘরাজার কোলে অমর পাল, মাহবুব পিয়াল || মহসিন রাহুল

অমর পাল বাউল ও মাহবুব পিয়াল মারা গেলেন কয়েকদিনের ব্যবধানে। অমর পালের বয়স হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়জন, রোগমুক্ত থাকলে, স্বাভাবিকভাবে আরো দিন বাঁচার কথা ছিল।

অমর পাল বাউলের গলায় গান আরো অনেকের মতো আমারো ভালোভাবেই শোনা। প্রথম শুনি ১০ বছর বয়সে। আকাশবাণী রেডিয়োয়, — ‘কইয়ো আমার প্রাণবন্ধুয়ার ঠাই’। এত অদ্ভুত গলা ছিল যে, আকাশবাণীর ঘোষকের জানানো ‘অমর পাল বাউল’ নামটি  ভোলা অসম্ভব হয়। পরে শুনি ক্যাসেটে, এবং সিডিতেও। তাঁর কণ্ঠের তুলনা — বা ধারেকাছে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে — কেউ নাই, মনে করি। এগুলি একধরনের ইডিওসিনক্রেটিক গলা, এদের ভয়েসপ্রিন্ট সম্ভব হয় না, যেমন আরেকজন, নির্মলেন্দু চৌধুরী।

মাহবুব পিয়াল গান গাইতেন, ও লোকগান সংগ্রহ করবার গুরুত্বপূর্ণ কাজে লিপ্ত ছিলেন। গান-গবেষক ছিলেন। ‘লোকরঙ’ নামে একটা গানের দল আছে উনার, রেডিও-টিভিতে তাঁরা পারফর্ম করতেন। মাহবুব পিয়ালের অকাল মৃত্যুতে শোক জানাই।

মাহবুব পিয়ালের কণ্ঠে গান আমার তত পছন্দের ছিল না। কিন্তু, তিনি সুরে গাইতেন। সতর্ক ছিলেন গানের বাক্যের বা শব্দের অথেনটিসিটি বিষয়ে। এবং, ভালোবেসে, উৎসর্গিত-চিত্তে গাইতেন।

সম্ভবত ২০১০-এ তাঁকে আমি দেখি, ও তাঁর কণ্ঠে গান শুনি, এক ঘরোয়া আড্ডায়, মৌলভীবাজারে। বিভিন্ন গুণীজনের ভিড়ে আমি একদমই গৌণ দর্শক-শ্রোতা হিসাবে ছিলাম। কিন্তু, মাহফুজভাই, যাঁর সূত্রে পিয়াল সেখানে আসেন, তিনি আমাকে স্নেহবশত দাওয়াত করেছিলেন। (হায় রে, মাহফুজভাইও অকালে মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। কী যে দুঃখের।)

পিয়াল সম্ভবত সেই ঘরোয়া আসরেই মৌলভীবাজারের মীর ইউসুফের গলায় গান শোনেন, এবং পরে গানের দল ‘লোকরঙ’ গঠন করলে ভোকাল হিসেবে ইউসুফ(ভাই)কে নেন।

পিয়াল তাঁর গাওয়া একটা সিডি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন সেদিন। আমি খুবই যত্নে সংরক্ষণ করি সেটা। বাজাইতে দেখলাম, সিলেটের বাউল আরকুম শাহ-র গান আছে। ‘পাগল আরকুমে বলে’-তে ‘আরকুম’-কে তিনি ‘আরখুম’ উচ্চারণ করলেন, — সিলেটের সব ‘ক’-ই ‘খ’ উচ্চারিত হয় এমন ভুল ধারণায়।

সিলেটে বহু ‘ক’-ই ‘খ’-এর মতো উচ্চারিত হয়, কিন্তু সব না। ইউটিউবেও আছে একটা, পিয়ালের গাওয়া, ‘ইতা কিতা করে গো বন্ধে / পায়ে খেনে ধরে’, — ‘কিতা’-কে ‘খিতা’ উচ্চারণ করে গাওয়া। পুরা সিলেটের কেউ জিন্দেগিতে ‘কিতা’-কে ‘খিতা’ উচ্চারণ করেছেন বলে শুনি নাই।

তদুপরি, ফেসবুকে আমি একদিন দুর্লভ সূত্রে প্রাপ্ত একটা গান আপ করি। ‘এত রাইতে চরকার বাজ বাজে বি, গুমগুমগুম , কুমকুমকুম, চেরাগালি মিয়াভাই মেরাজের বাপ, আ আ কুমকুম করে নানি চরকার মাপ…’ — ইত্যাদি, এরকম ছিল লিরিক। তাঁকে ট্যাগ করে গানটার ব্যাপারে বলতে অনুরোধ করি। তিনি সাড়া দিলেন না । বা, হয়তো ফেসবুকে ঢুকেননি ওইদিন। কিন্তু, আমি পরের দিন সকালে উনাকে আনফ্রেন্ড করে দেই। উনি হয়তো এসব টেরই পান নাই।

বা, উনার সিলেটি গান গাওয়ার ভুলভালও হয়তো কেউ তাঁকে বলেননি। সেসব অবশ্যই বড় বিষয় না। অন্য বহু গান নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স হিসাবে তাঁর কণ্ঠে আছে। গান সংক্রান্ত তাঁর সক্রিয়তা আমি ফলো করতাম, ও পছন্দ করতাম, যেহেতু এ-ধরনের গানের আমিও শ্রোতা। আর, অমর পাল বাউলের কমপক্ষে একটা গান পিয়ালের গলায় আরো মধুর লাগে আমার , — ‘শয়নে গৌর, স্বপনে গৌর,…’।

অমর পালের মৃত্যুর সম্ভবত মাস দুয়েক আগে মীর ইউসুফ (ভাই) আমাকে জানান, অমর পালের সাথে মাহবুব পিয়ালের ব্যক্তিগত ভালো যোগাযোগ আছে। তখন আমি ইউসুফ(ভাই)কে অনুরোধ করি ‘কালো মেঘ দিয়া রে / মেঘরাজা বানাইলো সিংহাসন’ গানের পরের লাইনগুলো যেন পিয়াল সংগ্রহ করেন অমর পাল থেকে। অমর পাল এক সাক্ষাৎকারে দুই লাইন শুনিয়ে আর গান নাই। (‘কালো মেঘ দিয়া রে, মেঘরাজা…’ সম্পর্কে আমার আগ্রহের কারণ : ‘দাদা পায়ে পড়ি রে / মেলা থেকে বউ এনে দে’ গানের সুরের একই সুর এটার। প্রথম দুই লাইনেই যে-ইমেইজারি, তা অসামান্য। আমার সন্দেহ, ‘মেঘরাজা’ হয়তো ‘দাদা পায়ে পড়ি রে’-র উত্তমর্ণ।)

কিন্তু, তা আর হতে পারল না। দুইজনই বিগত। ভালো থাকবেন, অমর পাল বাউল, মাহবুব পিয়াল। পরকালে কখনো দেখা হলে শুরুতেই মেঘরাজার আলাপ করব, বলাবাহুল্য।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you