ইসলামের কাহিনি || প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ

ইসলামের কাহিনি || প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ

[বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের গৌরবোজ্জ্বল বিভিন্ন ঘটনাবলি, কীর্তিকাহিনি ইত্যাদি লিপিবদ্ধ বইয়ের আকারে এখন সর্বত্র সুলভ বলা যাবে না। আছে যেটুকু, সেইটা আলেম সমাজের হাতে লেখা। ‘আলেম সমাজ’ নামে একটা আজব ‘গোষ্ঠী’ নিজেদেরে আলাদা করে রাখে এবং সমস্ত গতিশীলতায় গায়ের জোরে একটা বাধাবিপত্তির গদা হাতে নিয়া হাজির হয়। ইন্টেলেকচুয়াল আর আলেম সমাজ, এই দুই সিন্ডিকেটের কথাবার্তা মানুষে এখন এককান দিয়া শোনে এবং তৎক্ষণাৎ আরেক কান দিয়া বাইর করে দেয়। সিন্ডিকেট জিনিশটা ভালো নয়, তা বলছি না; বাট সিন্ডিকেট মাত্রই হিডেন অ্যাজেন্ডা নিয়া কাজ করে এইটা আমরা দেখে আসতেছি আবহমান। তবে এইটাও বলে নেয়া দরকার যে ব্যক্তি আলেম বা ব্যক্তি ইন্টেলেকচুয়াল আমাদের ভালোবাসাভাজন হতেই পারেন, গোষ্ঠী নৈব চ। দুনিয়ার খবর রাখি না, বাংলাদেশে এইটাই রিয়্যালিটি।

ইসলামের আওতায় যেসব শাসনসময় এসেছে এবং গিয়েছে, সেসব সময়ে ব্যাপক বিস্তর ঘটনাঘটনের জন্ম হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু কথিত সনদ-পাওয়া ‘আলেম সমাজ’ যখনই ইসলামের কথাকাহিনিগুলো জনসমক্ষে নিয়া আসেন, একটা সংকীর্ণ বদ-উদ্দেশ্য হাজির থাকতে দেখি প্রায়শ। জুম্মাবারের বয়ানে এই জিনিশটা হাজির নাজির পাইবেন সবাই। ইমামসাহেবের ওয়াজ শুনে এমনকি মুসলমানরাও মুখ লুকাইবার জায়গা পান না, এতটাই বিদ্বেষভরা তাদের আওয়াজ। অথচ অন্য সমস্ত ধর্মের লোকশিক্ষামূলক গল্পগাছাগুলোর মতো ইসলামের গল্পগাছাও সর্বগ্রাহ্য হবার কথা। আলেম সমাজের প্রত্যেকটা বাক্য থেকে একটা জিনিশই বেরিয়ে আসে, আর তা হলো এ-ই যে ইসলাম দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যলুব্ধ ধর্ম। যদিও মনে হয় না আলেম সমাজ নামে এই বিকট একদেশদর্শী সিন্ডিকেট নিজেদের কথার মানেটা নিজেরা বুঝতে পারেন। যদি বুঝতেন তাইলে হপ্তান্তে মসজিদের মিম্বর থেকে বলা মাইকচিৎকারের কথাগুলো থেকে সাম্রাজ্যলোলুপতা সাধ্যানুযায়ী ছেঁটে বয়ান রাখতেন।

যা-হোক। আমরা এমনকিছু রিডিং ম্যাটেরিয়্যালের তালাশে থাকি সবসময় যেগুলো কোনো সিন্ডিকেটের পার্পাস সার্ভ করে না। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ আলেম সমাজের লোক বলিয়া কোনোদিন কোথাও বড়াই করেছেন বলিয়া আমরা শুনি নাই। কিন্তু তার ইলিম নিয়া আমাদের অন্তত সন্দেহ হয় না। খাঁ সাহেবের ক্যারিয়ারগ্র্যাফ সম্পর্কেও আমরা আদ্যোপান্ত না হলেও মোটামুটি জানি। ইহলৌকিক ক্যারিয়ারগ্র্যাফ, আমাদেরই মতো, দুনিয়ার প্রতি ঘিন্নাপিত্তি তার কমই ছিল যেমনটা আমাদেরও। উনার অনেক প্রকাশনা আছে, এর মধ্যে বেশকিছু পড়েছিও আমরা পাঠ্যপুস্তকের আন্ডারে ইশকুলবেলায়। কিন্তু বহুদ্দিন হয় ইবরাহীম খাঁ বা বন্দে আলী মিয়া বা গোলাম মোস্তফা বা আরও যারা আলেম সমাজের গদাধারী নন তাদের লেখা আমরা হাতের কাছে অ্যাভেইলেবল পাই না। আওয়ামী আলেম সমাজের সময়ে সেসবের কোনো কোয়েশ্চনই কেউ তুলছে না।

ইবরাহীম খাঁ সাহেবের একটা বই আমরা হাতে পেয়েছি ‘ইতিকাহিনী’ শীর্ষক। বহু আগের বই। ইন্ট্রো থেকে জেনে উঠছি যে এইটা অ্যানেকডোট্যালের সংকলন। শুধু ইসলামের অ্যানেকডোট্যাল নয়, হিন্দুর বৌদ্ধের খ্রিশ্চানের ইহুদির ভারতের আরবের এবং আরও বহু ব্যক্তির বহু ভুবনের ইতিকাহিনি/অ্যানেকডোট্যাল ধরা আছে বইটায়। ইংরেজিতে লেখক বইটা ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে পয়লা ছাপিয়েছিলেন বলিয়া জানাচ্ছেন। পরে এইটা বাংলায় বাইরায় ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এবং তখন বাংলায় এই বই ছাপাইবার মতো ‘প্রগতিশীল’ ইন্টেলেকচুয়াল পাব্লিশার পাওয়া না-যাওয়ায় লাহোরের জনৈক শেখ মুহম্মদ আশরাফ বইটার প্রকাশভার গ্রহণ করেন।

বর্তমানে যে-তিনটা কাহিনি নিয়েছি এই রিপ্রিন্টে, এইগুলা ইসলামের শাসনকালীন কাহিনি। যে-এডিশনটা ব্যবহার করেছি বর্তমান কাজে, এইটা ছাপায়েছিল ঢাকা থেকে ঝিনুক প্রকাশনী ২০১১ সনে। এই বই থেকে আরও কয়েকটি রিপ্রিন্টপ্রোজেক্ট আমরা প্ল্যানের আন্ডারে রেখেছি। আপাতত তিনটা কাহিনিই পড়ি এবং মনে রাখবার চেষ্টা করি।

লা তাক্নাতু মির রাহমাতিল্লা। — গানপার]

একটি নির্বাচনী বক্তৃতা
খলিফারূপে নির্বাচিত হইবার পরই হযরত আবুবকর দাঁড়াইয়া উপস্থিত নির্বাচকমণ্ডলীকে সম্বোধনকরত বলিলেন :

“আমি চাই নাই, তবু আপনারা আমাকে এই দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন করলেন। আমার এ পদে আর-কাউকে বসালে তাতেই আমি বেশি খুশি হতাম। কিন্তু যখন এ পদে বসিয়েছেন, তখন আমার কয়েকটি কথা রাখতে হবে। কথা কয়টি এই :

আমি সামান্য মানুষ মাত্র — আপনাদেরই দশজনের মতো একজন। সুতরাং আমার উপর নজর রাখবেন : যদি দেখেন যে আমি ন্যায় পথে আছি, তবে আমার হুকুম পালন করবেন। যদি দেখেন যে আমি ভুল পথে চলেছি তখন আমাকে উপদেশ দিবেন। তথাপি যদি আমি অন্যায় পথে চলি, আমাকে বাধা দিবেন।

আপনারা সকলে জেনে রাখুন, বন্ধুগণ, ধর্মকাজই সবচেয়ে ভালো কাজ; পাপকাজই সবচেয়ে মন্দ কাজ। আমার কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সবল যে সবচেয়ে দুর্বল, কারণ তার যা পাওনা, তা আমাকে তার কাছে পৌঁছাতে হবে। আর আমার কাছে সবচেয়ে দুর্বল সেই ব্যক্তি যে-ব্যক্তি প্রবল, কারণ প্রবলের নিকট হতে তার দেয় আমাকে আদায় করতে হবে।

আমার বক্তব্য বললাম : আপনাদের ও আমাদের প্রতি আল্লা যেন প্রসন্ন থাকেন।

আচ্ছা, এখন বিদায় — আসসালামু আলাইকুম।

সৈন্যদের প্রতি আবুবকর
সিরিয়া অভিযানের জন্য সৈন্যরা প্রস্তুত। ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান সেনাপতি পদে বৃত হইলেন।

সৈন্যরা যাত্রা করার পথে। হযরত আবুবকর তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন :

“তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিচ্ছি, মন দিয়ে পালন কোরো, কখনো যেন ভুল না হয়।

নারী, শিশু আর বৃদ্ধকে হত্যা কোরো না।

ফলবান বৃক্ষ ছেদন কোরো না।

শস্যক্ষেত বিরান কোরো না।

খাওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া ভেড়া-উটের প্রাণনাশ কোরো না।

খেজুরগাছ কেটো না।

গনিমতের মাল আত্মসাৎ কোরো না।

লড়াইয়ে সাহস হারিও না।

কোনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কোরো না।

দুশমনের লাশকে বেইজ্জত কোরো না।

কোনো শিশুকে মায়ের কোল হতে ছিনিয়ে নিয়ো না।

আক্রান্ত না হইলে কাউকে আক্রমণ কোরো না।

কোনো অবস্থাতেই কাউকে জোর করে মুসলমান করার চেষ্টা কোরো না।

খ্রিস্টান ও ইহুদি সাধু ও পাদ্রিগণকে আক্রমণ কোরো না।

প্রতিদ্বন্দ্বী আবিষ্কার
খলিফা হওয়ার আগেও হযরত ওমর গরিব-দুঃখীদের খবর লইবার জন্য ছদ্মবেশে রাত্রির অন্ধকারে মদিনার মহল্লায় টহল দিয়া ফিরিতেন।

তিনি একদা ঘুরিতে ঘুরিতে মদিনার একপ্রান্তে একটি গরিব বুড়িকে আবিষ্কার করিলেন এবং তাহাকে সাহায্য করিবার ভার মনে মনে গ্রহণ করিলেন।

পরদিন বুড়ির কাছে যাইয়া শোনেন, কে একজন আগেই যাইয়া বুড়ির অভাব মিটাইয়াছে। ওমরের কৌতূহল হইল, তাঁহার এ প্রতিদ্বন্দ্বী কে?

তাহার পরের দিন। ওমর আগেই যাইয়া কাছে লুকাইয়া রহিলেন; তিনি দেখিলেন, কে সেই ব্যক্তি যিনি মানুষের সেবায় ওমরকে পরাজিত করে।

একটু পরেই একটি মানুষ আসিল। মানুষটি বুড়ির কাছে যাইয়া তাহার অভাব মোচন করিল।

ওমর ভালো করিয়া চাহিয়া দেখেন — ও আল্লা! এ যে আবুবকর!

দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ হইল — উভয়ের ঠোঁটে স্নিগ্ধ মধুর হাসি। ওমর বলিলেন, “আল্লার দরগায় শোকর যে স্বয়ং খলিফা ছাড়া আর কারো হাতে পরাজিত হই নাই।

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you