বাংলা কবিতাপাঠকেরা নিচের ১, ২, ৩ নং বক্তব্যে আস্থা রাখেন আশা করি :
১) শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “সে কি জানিত না যত বড় রাজধানী / তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর” একটি অবিস্মরণীয় বাক্য। [‘আনন্দ ভৈরবী’ কবিতার ]।
২) বিনয় মজুমদারের “ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা, / রথ হয়ে, জয় হয়ে, … এসো” বহু পাঠকচিত্তের ইস্পাত-অগ্নির আরাম ।
৩) আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতায়, সেই শহরযাত্রী ছেলে ভোরে ট্রেন ফেল করে বাড়ির দিকে ফেরে, তখন এই ইমেইজারি স্মৃতিহর্ষায় আমাদের :
“দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে”।
এবার আসুন মূল বক্তব্যে।
সাধারণভাবে বাংলা আধুনিক গানের কথারচনাকারগণ তিরিশি যে-ভাষাবদল — তার বাইরে ছিলেন, কবীর সুমনের আগ পর্যন্ত; এটা ঢিলা জামা পরার মতো হলেও মেনে নেন, আপাতত। ব্যতিক্রম নির্দিষ্ট গান হতে পারে, কোনো কথালেখক সম্পূর্ণভাবে কেউ নাই।
তা সত্ত্বেও, সেসব গানের বাক্য কি কোনোভাবে আধুনিক কবিতার বাক্যের সাথে যোগাযোগ রাখে?
খেয়াল করলাম, উপরোক্ত ১, ২, ৩ নম্বরকে দূর থেকে পুত্রহারা আম্মা হয়ে কোলে ডাকতেসে তিনটা গানের বাক্য।
১ নম্বর :
গানটি দিলীপকুমার রায়ের রচনা। দিলীপকুমার, সকলেই জানেন, কবি দ্বিজেন্দ্রলালের জগৎ-আলো-করা সন্তান। বলা হয়ে থাকে, সংগীতের ইতিহাস দিলীপকুমারের মতো পূর্বপশ্চিমউত্তরদক্ষিণ জোড়া দেয়া জিনিয়াস একবারই পেয়েছিল। তো কেম্ব্রিজফেরত ও পরবর্তীতে সাধনাপন্থায় সমর্পিত অসামান্য দিলীপকুমার রায় গাইছেন :
ভুলে যাওয়া হে সুদূর স্মৃতি
কেন বলো আসো ফিরে ফিরে …
বিশ্বের বিলাস
আমার এই ডালি
দিয়েছিল ভরে জানি
মন তবু ভরেনি,
বিষাদে ঘিরিল হিয়ার রাজধানী।
সিংহের মতো দীর্ঘশ্বাস যেন, সাধক দিলীপকুমার রায়ের। মূল্যবান, যাঁরা দিলীপকুমার রায়কে জানেন, বুঝবেন। খেয়াল করুন, অসামান্য বাক্যটা :
“বিষাদে ঘিরিল হিয়ার রাজধানী”।
২ নম্বর :
ওস্তাদ শচীন কত্তারে কে না জানে? তবে গানটা আমি প্রথম শুনি সোহরাব হোসেনের কণ্ঠে, রেডিয়োয়। পরে শচীন কত্তার (ও, আরো অনেকের ) —
তুমি যে গিয়াছো বকুল-বিছানো পথে,
নিয়ে গেছো হায় —
একটি কুসুম আমার কবরী হতে।
কিন্তু খেয়াল করেন এর শেষ লাইনের রূপক :
দিয়ে গেছো মোরে শত পরাজয়,
ফিরে এসো জয়-রথে।
‘রথ’, ‘জয়’, ও ‘ফিরে এসো’-র লগারিদমে বিনয় মজুমদারকে না ভাবলে, না ভাবেন। চক্রবর্তী> চাক>চাকা এই সমীকরণ জানলেও, আমি ভাবতে চাই বিনয়কে, কারণ, গানটা বিখ্যাত। স্মৃতি হয়ে বিনয়ের মগজে তা না থাকবে কেন?
এই গানের লেখক অজয় ভট্টাচার্য। তিনি কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য-র ভাই।
৩ নম্বর :
আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতাকে যে যেভাবেই পড়েন, আমার স্মৃতিতে এই ইমেইজটি মাত্র : ‘দীর্ঘ পাতাগুলি না না করে কাঁপছে’!
গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে যাঁরা দূর থেকে বাতাসপীড়িত পাতার নড়া দেখেছেন, তাঁরা জানেন এ কী।
কিন্তু, আমি জানতাম না, এর আগে আরেকজন আছেন, অভিন্ন ইমেইজে । গানটি হিমাংশু দত্ত-র সুরারোপিত :
“চাঁদ কহে চামেলী গো, হে নিরুপমা, ফিরালে যদি গো চলে যাই”।
গানটার শেষ প্যারা :
পাতায় পাতায় বাজে মানা
‘যাও ফিরে হে পথিক না না’
অকারণে যদি প্রাণ সহসা কাঁদে
ফিরিয়া দেখিবে সে তো নাই।।
এই গানের লেখকের নাম সুবোধ পুরকায়স্থ।
… …
- পুত্রহারা তিন আম্মা || মহসিন রাহুল - May 9, 2019
- মেঘরাজার কোলে অমর পাল, মাহবুব পিয়াল || মহসিন রাহুল - April 27, 2019
- তোমারই পথপানে চাহি, আমারই পাখি : পশ্চিমা দর্শনের দুই ধারা || মাইক ফুলার :: অনুবাদ / মহসিন রাহুল - March 20, 2019
COMMENTS