আতিকের বান ও অন্যান্য শোনাশুনি

আতিকের বান ও অন্যান্য শোনাশুনি

গল্পটা ছোট্ট।

আঙ্গুলিনার গল্প শুনেছেন না? হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডার্সানের গল্পের সেই আঙ্গুলিনার মতোই ক্ষীণকায়া আখ্যানভাগটুকু। যথাসাধ্য সংক্ষেপে এবং ছোট্ট করে ফুড়ুৎ পাখিস্বরে বলে ফেলব গল্পটা, ধার তার না-রহিবে না-রহিবে ভার। গল্পের দৈর্ঘ্য ম্যাটার করে কি কখনো? মনে হয় না আদৌ। গল্পের যা ম্যাটার করে, কবিতারও তা-ই ম্যাটার করে, কি সেইটা? টেক্নিক? বলনকেতা? চালচলন? বক্তব্যদর্শন? কি সেইটা, তা যদি জানিতাম তাইলে নিজেই তো কবিসাহিত্যিক হইতাম। হায়, জানি না বলেই দশা আজ ধূলিধূসরাভা, আফসোস! গল্পটা তাহলে এবার বলে ফেলা যাক।

গল্পটা আমি শুনেছি আমাদের কলিগ দীপকদার মুখে। ধ্রুবজ্যোতি রায়, ভালোনাম, তার ডাকনাম দীপক। উনার জীবন থেকে নেয়া গল্প। ঘটনা ও চরিত্র কোনোকিছুই ফিক্টিশাস্ নয়। সম্পূর্ণ সত্য ও বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে এই গল্পটি বিরচন করা যাচ্ছে। একটুও রঙ চড়ানো হবে না। ক্ষ্যামতা থাকলে তো রঙ চড়ানো হবে; ক্ষ্যামতাই নাই। কিন্তু গল্পটা আমার নয়, দীপকদার; বা, সত্যি বলতে কি, গল্পটা আতিকের। গল্পের বিষয় বান; আতিকের বান। বিষয় উপজীব্য করেই গল্পের নামকরণ। সার্থকতা তালাশ করা বারণ।

এলাকায় এমন ভ্যাগাবন্ড টাইপের লোক থাকেই সর্বত্র যারা যাকে বলে জ্যাক অফ অল ট্রেইডস বাট গ্যুড ফর নাথিং বলিয়া খ্যাত। সবকিছুতেই আছে তারা, আবার কোনোকিছুতেই নাই। আজকাল এমনধারা লোকের দেখা আপনি বিশেষ পান না, কেন জানেন? এখন জ্যাকযুগ, তাই, দ্যাট’স্ হোয়াই। আতিক সেই কিসিমের লোক অংশত, পুরো বলা যাবে না। কারণ তখন সমাজপ্যাটার্ন এমনই ছিল যে, দেখেছি আমরা, অ্যাকোমোডেইট করে নেবার স্কোপ অনেক বেশি ছিল এসব ক্ষেত্রে। স্পেস্ ছিল সংসারে এমনকি আপাত অকেজো লোকটারও। অকিঞ্চিতের ভেতরেও যৎকিঞ্চিৎ গুণ খুঁজে নিত লোকে।

এমনিতে আতিকের চালচুলোর ঠিক নাই, কিন্তু একটা গুণ ছিল তার, লোকে হক কদরও করত সেই গুণের। বিশেষ একটা স্কিল ছিল বলে আতিক সর্বগৃহে স্বাগত হতো প্রয়োজনের সময়। কি সেই গুণ? ওই যে, বান, আতিকের বান। একেবারে ব্র্যান্ডেড। আতিক ব্র্যান্ডের বান সংসারের সেরা বান। ন্যাচার‌্যাল ক্যালামিটিতে দুনিয়া ধসে গেলেও আতিকের বান ফস্কাবার আশঙ্কা প্রায় নেই বলেই লোকবিশ্বাস ছিল। অন্য সবকিছুতে সে অনির্ভরযোগ্য হলেও এই একটা ব্যাপারে আতিক ছিল নির্ভরতার প্রতীক। আবশ্যক সময়ে আতিকের ডাক পড়ত জনপদের ঘরবাড়িগুলোতে। যে-লোক এমনিতে বিশেষ কাজের ছিল না, তাকে সবার ডাকেই মিলত, এই একটা কাজ করেই সে তার গ্রাসাচ্ছাদন জুটিয়ে নিত। সকলের ফুটফরমাশ খাটার ইন-জেনারেল কাজের ভিড়ে এই এক বিশেষজ্ঞ মর্তবার কাজ ছিল আতিকের।

আজকাল বান জিনিশটা কাজে লাগে না বিশেষ। জামানা পাল্টেছে। একটা বান, যেইটা আমরা স্ন্যাক্স হিশেবে খাই, শবেবরাতের হালুয়ার সঙ্গে এইটার ব্যবহার কালক্রমে বেড়েছে এবং নান্দুস্   বা পিজা হাট  ইত্যাদি কেএফসি টাইপ রেস্তোরাঁগুলোতে এর ব্যবহারজনিত বিকাশ লক্ষ করে থাকব আমরা। আরও যে-একটা বান গ্রামবাংলায় ছিল যুগ যুগ ধরে, ব্যক্তিমানুষ টার্গেট করে বান মেরে তাকে বাগানো বা বাঁকানো, অনিষ্ট সাধন করা ব্যক্তিবিশেষের, ‘বানিয়া বন্ধু রে / একটা তাবিজ বানায়া দে’ ইত্যাদি অজস্র লোকগানে যে-বান পাওয়া যায়, কুসংস্কার বা যা-ই হোক একটা ব্যবসা ছিল রমরমা বানকেন্দ্রিক তুকতাক ও জড়িবুটির, সেইটাও ক্রমশ অন্তর্হিত। আতিকের বান এই বর্ণিত দুইয়ের কোনোটাই নয়।

আতিকের বান ঘরামিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত দক্ষতাবিশেষ। ঘরের চালা বা বেড়ার খুঁটি ইত্যাদি বছর-বছর রিনোভেইট/রিপ্যায়ার করার একটা কাজ গৃহকর্তাকে ইনিশিয়েট করতে হতো। এইটে এসেনশিয়্যাল ছিল সব গেরস্তালিতেই। অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়িভিটেতে ইট-সুরকির পাকা দালানের পাশাপাশি কাঁচা ও সেমিপাকা ঘর থাকত একাধিক। নানা কাজে ব্যবহার্য ঘর সেগুলো। বছর-বছর খুঁটি বদলানো বা চালা ছাওয়া বা কড়িবর্গা পাল্টানো বা আরও অন্যান্য প্রয়োজনে ঘরের বান দোহারিতে হতো। তখনই খোঁজ পড়ত আতিকের। এমনকি রীতিমতো তোয়াজ করতেও দেখা যেত আতিককে। মুরুব্বিরা আতিকের তারিফ করতেন তার গুণের/স্কিলের কারণে, সমীহ করতেন আতিকের ইউনিকনেস্। বলতেন, “আতিকের বান! ভূমিকম্পে ভবন ধসিয়া যাইব তবু আতিকের বান এতটুকুনি ঢিলা অইব না। আতিকের বানের আঁটুনি এমন বজ্র যে ঝড়ে ঘর উপড়ে গেলেও খুঁটির বান তথা বাঁধুনির গেরো ফস্কাবার কোনো দুশ্চিন্তা নাই।” কিন্তু এই জিনিশ হরেদরে ঘরামি দিয়া পাবেন না আপনি, পাবেন আতিকের হাতে, যদিও আতিক আদৌ ঘরামি হিশেবে প্রোফেশন্যাল ছিল না। আতিক ছিল গ্যুড ফর নাথিং। গল্পগোড়ায় এই তাচ্ছিল্য করে এসেছি আমরা।

আজকাল আমরা কাউকে অ্যাপ্রেইজ/ভ্যাল্যুয়েইট করি সে কি করে, এমন কোন ছাতার মাথা সে আপনাকে-আমাকে দিচ্ছে তা দেখে নয়; সে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাইতেই আমরা তার মান নির্ধারণ করি। অমুক ক্যাল্কুলেটর ছাড়াই মোটা মোটা গ্র্যান্ড ও মেটা হিসাবনিকাশ সমাধা করে ফ্যালে, এইটা আর দ্যাখে না কেউ, এখন দ্যাখে অমুক কোন শাঁসালো সুযোগসুবিধের ব্যাঙ্কে নোকরি করে তা-ই। ফিজিক্সের অঙ্ক বা ক্যামিস্ট্রির ইক্যুয়েশন অমুক পানির মতো বোঝাতে পারে, এই মূল্যায়ন নাই এখন; দেখা হয় অমুক কোন কাচঘেরা প্রাইভেট য়্যুনিভার্সিটিতে মাল্টিমিডিয়া লেকচার ফলায় এবং ফলানো লেকচারের সেল্ফি তুলে ফেসবুকে আপ করে। বাপ রে বাপ! কত্ত বড় মাশ্টর হৈছৈন উনি!

ইয়ে হ্যায় ডেমোকর্পোরেটোক্রেসি, ম্যেরে ইয়ার! আতিকের বান দেবার মুরদ থাকলে অংবংচং আইএনজিওর নাম ভাঁড়িয়ে বাঁচতে হতো না তোমারে। লোকে তোমারে প্রতিষ্ঠান দেখে, তোমার নোকরপনা দেখে, ভ্যাল্যুয়েইট করত না তোমারে; ভ্যাল্যুয়েইট করত তোমারই নিজের জিনিশ দিয়ে, তারিফ করত তোমার হিম্মতের, তোমার গুণের কদর করত কর্পোরেশন অগ্রাহ্য করে। এত পাশটাশ দিলা, ভাগিনার মামা, আতিকের বানের কাছে শেষকালে এসে খাইলা ধরাটা! ব্যক্তি হিশেবে তুমি তো নাই-ই, বুঝতে পারো? অস্পষ্ট, অপ্রভ অনুজ্জ্বল, ক্ষয় হতে হতে চকগুঁড়োর মতো তোমার দশা। দেখাই তো যায় না তোমারে আজকাল। ফালাফালি আর সেমিনার-বোর্ডমিটিং-লেকচারপোডিয়াম থেকে সেল্ফি খিঁচে এই নিজেরে একটু স্পষ্ট করে তোলার মরিয়া চেষ্টা।

জাহেদ আহমদ / জুলাই ২০১৫

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you