রক্ততরমুজ || জাহেদ আহমদ

রক্ততরমুজ || জাহেদ আহমদ

ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের ওপর দিয়া যাতায়াতকালে দুর্জয় স্কয়ারের নাতিপ্রশস্থ অনতিউচ্চ মন্যুমেন্ট চোখে পড়তেই চিরদিন ‘অদূরেই গৃহ লভ্য’ ধরনের একটা সাধুভাষা-আশ্বস্ত বোধ জন্ম লয় ভেতরে ভেতরে। এই রোডের ধারে কিংবা প্রান্তভাগে যারা আজন্ম অধিবাসী তাদের ক্ষেত্রেই কথাটা খাটতে পারে। একই জিনিশের বোধোদয় হতো অতি প্রাচীনকালে ট্রেনসভ্যতায়, রেলগাড়ি ছিল যখন দুনিয়ার উচ্চতর রহস্যাধার এবং রোমাঞ্চকর রাতজাগা খানাপিনা-গালগল্পভরা তাসুড়েদের আরাধ্য পিক্নিক্, আখাউড়া জংশনে এসে রেলগাড়ি বিশমিনিটের বিরতি নিলে ‘এই তো পৌঁছে গেছি’ কিসিমের একটা শান্তি নামত শরীর জুড়ে। এখন অবশ্য সড়ক বদলেছে ট্রেনের, যাওয়াও হয় না রেলগাড়ি ঝমাঝম চেপে আন্তঃ-ও-অনন্ত সৌরজাগতিক নগরসমূহে। এখন ভলভো অথবা নন্-ভলভো পরিবহন। ভুয়া গাড়িগুলো। দশক-অতিক্রান্ত কবিদের মতো। অধিকাংশ কবি/গাড়িরই রক্ষণাবেক্ষণ/মেইন্টিন্যান্স নাই। কিন্তু বড়াই আছে। একআনা নয় দুইআনা নয়, এক্কেরে ষোলোআনা, পাক্কা ষোলোআনা বাঁদরলম্ফ ও বদমাইশির বড়াই-বারফট্টাই বহাল আছে ট্র্যান্সপোর্ট ও পোয়েট্রি সোসাইটিতে। এমনকি মিহি-গোঁদা মাস্তানি ছাড়াও মিচকে শয়তানি ইত্যাদি বয়ঃসন্ধিকালীন বৈশিষ্ট্যসমূহ কমে নাই বরঞ্চ বেড়েছে। ভেতরে সদরঘাট হলেও বহির্বিভাগে ফিটফাট কবিয়ানা/গাড়িয়ানা। বাহারের সীমা হাতের মাপে সাড়ে-তেরো, অন্তরে দেড়আংলারও অধমর্ণ, যদিও চলতে শুরু করলেই বোঝা যায় এইটা লাইনে চলার রোডপার্মিট বহুবছর আগেই খুইয়েছে; এখন চলছে স্রেফ পুরানা ক্লায়েন্ট/প্যাসেঞ্জারের অভ্যস্ততা আর অনড় স্থিতাবস্থা পুঁজি করে। অ্যানিওয়ে। এখন তো নদীপথের মতো সড়কপথও গণপরিবহনব্যবস্থা হিশেবে গৌণ হতে লেগেছে। আন্তঃজেলা যাতায়াতে অ্যায়ারট্র্যাভেলে প্যাসেঞ্জারের ভিড় বাড়ছে। এমনিতে যে-হারে স্থলপাথেয় ক্রমবর্ধমান, পথের বাঁকে বাঁকে মন্ত্রী ও মাস্তান, লোকে প্রেফার করবে অ্যারোপ্লেনে ট্র্যাভেল করতে।

এক-দশক আগেও দুর্জয় চত্বর ছিল না আলবৎ, তবে ভৈরব ছিল। কোথায় ছিল? ভৈরব ছিল ভৈরবেই, কিংবা যাতায়াতপথের ধারেই আমাদের, ছিল তখনকার মিতালীশ্যামলী  ইত্যাদি শীর্ষক যাত্রীপরিবহনগুলোর ‘বিরতিহীন’ পরিচয় সত্ত্বেও পথে-বেপথে কয়েকমিনিট করে থামানো এবং শর্তভাঙা যাত্রী ও মালামাল ওঠানো-নামানো। বরাবর ব্যাপারটা ভালো লাগত, কথা দিয়া গাড়িয়ালদের এই কথা না-রাখা তথা ছ্যাঁচড়ামো করে এক্সট্রা দুইপয়সা আর্ন করার প্রবণতা, আজও লাগে ভালো। ভৈরবেই নিদ্রাটা ভাঙত মধ্যিপথে, চেল্লাপাল্লা-বাজারমোচ্ছব ইত্যাদির অভিঘাতে, দেখা যাইত বাসবাতায়নে ভৈরববাহার। কাঁচাবাজার। ফলের আড়তদার। মুটে-মজুরের হুড়োহুড়ি হাঁকডাক। বাসের উদরে থাকা যাত্রীদের রাগলহরি ছিল শোনার মতো শিল্প, সমস্তই ড্রাইভার মহোদয়কে লক্ষ করে বর্ষানো। বর্তমান যুগের ট্রলসাহিত্যিক কবিলেখকদের মতো বর্তমান যুগের পরিবহনযাত্রীরা গালিগালাজটা আদৌ যুৎসই দিতে পারে না। ড্রাইভার মজা কিংবা লজ্জা পাবে কি, স্থিতাবস্থায় চিড় ধরাবার তাক্কত তো রচয়িতাদের বর্তমানে নাই, যিনি গালিদাতা তিনি নিজেই নিশ্চয় গালি দিয়া বুঝতে পারেন যে আত্মঘাতী গোল্ হয়ে গেছে, তিনি বুঝতে সক্ষম হন অচিরে যে এমনকি ঠিকঠাক জায়গামতো বল্/গালিটা লাগাবার মতো বৌলার/গালিয়ার/খেলোয়াড় তিনি হইতে পারেন নাই। কিন্তু ওই সময়, যে-সময়ের স্মৃতির সম্মানে এই নিবন্ধ, একেকটা গালি ছিঁড়িয়াফাড়িয়া ধারে এবং ভারে দুইদিকেই কাটত মনে পড়ে। এমনকি তৎকালে এই নিবন্ধকার শিশুটিও ওইসব গালি শুনে বিস্তর আনন্দ পেত। ময়মুরব্বিরা তো সক্রিয়ভাবে গালিগালাজ আর রোয়াব প্রকাশের অভিনয়ে রীতিমতো অংশই নিত।

তখন তো বর্তমানকালের মতো ভৈরবের প্রেসিডেন্টল্যান্ড হিশেবে খ্যাতি ছিল না। কালক্রমে প্রেসিডেন্টসিটি হিশেবে এর একটা এহেন বনেদ তৈয়ার হয়েছে যে একনাগাড়ে দু-দুজন প্রেসিডেন্ট এই পোলিটিক্যাল্ পুণ্যভূমি থেকে মসনদাসীন হলেন। কিশোরগঞ্জের মিঠামৈন এলাকাটা আপাতত ভৈরবের পাশে রেখে এই নিবন্ধ পড়িয়া যাইবার বিনীত অনুরোধ করা যাচ্ছে। যেহেতু দুর্জয় স্কয়ার কিংবা রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি ইশ্যুজ্ অনেক পরের কাণ্ডাকাণ্ড; তখনও ভৈরবের, কিংবা আরেকদিকে যেমনটা আখাউড়ার, অরিয়েন্টেশন্ ছিল অন্য। পরিচয় হিশেবে সেই ভৈরব কিংবা আখাউড়া অনেক বেশি ঋদ্ধ ও সম্পন্ন ছিল স্বীকার করতে হবে এখনকার চেয়ে। এখনকার মতো অত জৌলুস না-থাকলেও অঞ্চলগুলোর, ভৈরব-আখাউড়া ছাড়াও অন্যান্য, স্বকীয় রোয়াবই ছিল আলাদা। আদিকাল থেকেই ভৈরব ছিল বর্তমান নোটকের/নিবন্ধকারের নিকটে এক অন্যতর কৌতূহলস্থল, নগরান্তরে গতায়াতকালে, গঞ্জ আর নগরপৌরাণিক জঙ্গমতা তার এক প্রধান কারণ সম্ভবত। গল্পের সেই বাপ-ব্যাটা আর তাদের ঢোলের বাদ্যিবাজনা মনে পড়ে না? মাহমুদুল হকের সেই গল্প, ভৈরব ও হৈরব দুই ভীষণ জীবনোজ্জীবক ক্যারেক্টার যেখানে, ভৈরব শব্দোচ্চারের সঙ্গে সঙ্গেই হৈরবের কথাও মনে এসে যায় নিশ্চয়। কিন্তু ভৈরবের প্রসিদ্ধির সঙ্গে গল্পটার আদৌ যোগসাজশ নাই।

দিন-কতেক আগে একবার ভৈরব দিয়া আপ-ডাউনকালে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কারভাবে দেখে নেবার মানসে তথাকার বাজারে দীর্ঘবিরতি নিতে প্ররোচিত হই। হোয়াই দি প্লেইসেস্ লাইক্ ভৈরব অ্যান্ড আখাউড়া অ্যাট্র্যাক্টস্ মি ইত্যাদি নিয়া ভাবতে ভাবতে যেয়ে পৌঁছাই ভৈরবে। এই ভৈরব অবশ্য সেই ভৈরব নয়। ভৈরবের বাজারসংলগ্ন একটা জায়গায় জুড়িগাড়ি থামায়ে ঘোড়া পাঠাই পার্শ্ববর্তী নাবাল জমিনে ঘাসপাতাপানি খেয়ে একটু তাগড়া হয়ে ফিরতে। গ্যাসস্টেশন্ থেকে গ্যাস্ নিয়ে ফেরার আগে আমরা ‘হাজির হোটেল’ সাইনবোর্ডওয়ালা ভাতের দোকানটাকে হালাল খানা খাইবার নির্ভরযোগ্য স্থল কন্সিডার করি এবং ইতিউতি তাকিয়ে ঢুকি তথায় এবং আচ্ছামতো কষানো গরুর গোশত দিয়া ভাত মাখাই আর হিউজ্ স্পাইসি বিফভুনা হাপুস-হুপুস করতে করতে দুই-নয়নের জলে ভেসে এক-সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্লেট থেকে হাত উঠায়ে নিতে বাধ্য হই। কিন্তু ততক্ষণে তিনটে ঘটনা ঘটে গেছে। এই তিন ঘটনার সমস্তটুকুই যুগান্তকারী বলা যাবে না হয়তো, তবু অনুল্লেখের মতো নয় বলা বাহুল্য। প্রসঙ্গের চক্করে পড়ে গেলে সেগুলো হয়তো কোনো-একদিন বলার মতো তৌফিক আল্লা আমাদিগেরে দেবেন। আপাতত প্রসঙ্গান্তরে যেতে হতেছে।

পেট পুরে খেয়েদেয়ে হাজি সাহেবের মেসিয়ারের সঙ্গে আদাব-মুসাফা সেরে বেরিয়ে ইতস্তত হণ্টনে প্রবৃত্ত হই। তিন-চার ফার্লং হাঁটতেই দেখি দুই-তিনটা আমড়াগাছ, দুই-তিনটা শাটার-নামানো দোকানলাগোয়া আমড়াগাছের রীতিমতো পুরানা বৃক্ষ, পরে এক-সময় আরও কয়েকটা আমড়াগাছ নজরে এলে ব্যাপারটা আমলে নেবার কথা ভাবি সিরিয়াস্লি। কী ব্যাপার! একটা মার্কেটপ্লেসে এত পুরানা আমড়াগাছ থাকার তো কথা না। তাহলে? একটা আন্দাজ আছে এই রকমে যে, একটা-কোনো এলাকার বাজারে যে-গাছটার আধিক্য লক্ষ করবে সেই গাছটা গোটা এলাকার নিসর্গের মধ্যে ডমিনেইটিং হিশেবে গণ্য করা যেতে পারে। এই আন্দাজের বশবর্তী হয়ে এক-দুইটা কানাগলি দিয়া বাজার-সন্নিকট মহল্লার ভিতরে উঁকি দিতে যেয়ে দেখি যে, হ্যাঁ, তাই তো! ঘরবাড়িগুলোর সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে এক-দুইটা আমড়াগাছের পাতা ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছে গলির উপরে বেহেশ্তি ছায়া সমেত।

নয়া আর পুরানা মিলিয়ে বেশ চোখে পড়ার মতো আমড়ার গাছপালা শোভিত ভৈরবলোকালয় দেখতে দেখতে ফের বাজারে ফেরত আসি। যাই ফলের আড়তে। এখন তরমুজঋতু। ফলবিক্রেতারা ব্যস্ত তরমুজ আর বাঙ্গির বিক্রিবাট্টা নিয়া। আড়তদারদের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে খুঁজতে থাকি বছর-পাঁচ আগের এক পানের দোকান। পানশালা নয়, পানের তথা পানসুপারির দোকান, পানভাণ্ডার। বছর-পাঁচ আগে ‘ভৈরব পানভাণ্ডার’ নামে এক পানদোকানের সামনে পসরা সাজিয়ে বসা তরমুজওয়ালার সনে রেপো তৈয়ার করা গিয়েছিল তরমুজ খরিদের সুবাদে। এত সোয়াদের হয়েছিল তরমুজজোড়া, পাঁচ বছর আগের রসবন্ত তরমুজ, আজও সেই রেশ লেগে আছে রসনায়। কিন্তু জব্বর রসানো কথাকার সেই তরমুজশিল্পীটিকে ফেরত পাইবার আশায় আশপাশের দোকানিদেরে পুঁছতাছ করে তেমন সুবিধে করে উঠতে পারিনে শেষমেশ। ফলে তরমুজ শালা কিনবই না ভেবে বাঙ্গির শরীরে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। সিরিঞ্জ দিয়া কালার করার ঘটনাটা বাঙ্গির ক্ষেত্রে এখনও সংঘটিত হয়েছে বলিয়া নিউজ্ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু ভৈরব যেহেতু বাংলাদেশের হৃদয় হতে বাহির হওয়া ডাঙা, বাংলাদেশে যা যা দশা ভৈরবেরও দশা তা তা হইবারই কথা, কাজেই সিরিঞ্জ কর্তৃক ইঞ্জেক্টেড রক্তলাল তরমুজ ভৈরবেও উৎপন্ন না-হইবার কোনো কারণ তো দেখিনে।

এই লালফৌজিদের দৌরাত্ম্যে বর্তমান বাংলায় তরমুজ আস্বাদন ব্যতিরেকেই বিদায় নিতেছে আমাদের জ্যৈষ্ঠ তথা বাংলার বিখ্যাত মধুমাস। ঘটনাটা এতই গুরুতর যে এমনকি ভৈরবের তরমুজবণিকের উপরেও অধুনা আস্থা রাখা প্রায় ডিফিকাল্ট হয়ে উঠেছে। ব্যবসাবাণিজ্য থেকে শুরু করে বেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র আজি সিন্ডিক্যাটের সমারোহ। ভৈরব কোনো অন্যতর অপরূপ-রূপে-বেরোনো রসগোল্লা না যে এর অন্যথা হবে। অ্যাজ্ অ্যা রেজাল্ট ভৈরবের তরমুজবণিকের আগের সেই বিখ্যাতি ইদানীং হুমকির সম্মুখীন। পঞ্চাশোত্তীর্ণ বাংলাদেশে এখন দুর্ধর্ষ সময় যাচ্ছে। একের পরে এক মানুষ তরমুজবাণিজ্যে নেমে ফেঁপেফুলে প্যায়সাওয়ালা হচ্ছে। এবং অন্য নানাবিধ ব্যবসায় নামছে। সেই ব্যবসাগুলো নট নেসেসারিলি তরমুজেরই, কিন্তু সর্বত্রই বিজনেসবেপারিদের হাতে মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট তথা ব্লাড ট্র্যান্সফিউশনের সিরিঞ্জ। রক্ত পরিসঞ্চালন করছে ব্যবসায়ীরা মাটি থেকে মেদুর আকাশ অব্দি। বিষই ব্লাড, বর্তমান বাংলায়, বিষ প্রবিষ্টকরণই বৃহৎ কমার্স সমস্ত সেক্টরেই। কিছুই আর আগের মতো থাকছে না, নাই আর আগের মতো কিছু বর্তমান বাংলায়; বাংলাদেশ তরমুজরাঙা হয়ে উঠছে ডে-বাই-ডে ব্যবসায়ীদের আখাম্বা সিরিঞ্জের ভোজবাজিতে। একটা আশ্চর্য রক্ততরমুজের লোভে আমরাও বণিকদের উত্তরোত্তর সুস্থায়ী সফলতা কামনা করছি। কিছুই সবুজ কিছুই শাদা কিছুই স্বাভাবিক থাকছে না আর রক্ততরমুজমত্ত এই বিপন্ন করুণ ডাঙায়। এই দীর্ঘদুঃশাসনস্থায়ী ফ্যাসিবাতাসের বাংলায়।


জাহেদ আহমদ রচনারাশি

COMMENTS

error: