ব্রেসন ও বালথাজার || আহমদ মিনহাজ

ব্রেসন ও বালথাজার || আহমদ মিনহাজ

খেয়েপরে বেঁচে থাকার লড়াই যেহেতু করতেই হবে সে-নিয়ে নালিশ ঠুকে লাভ নেই জানি, তবু  মাঝেমধ্যে ভীষণ ক্লান্ত আর ভারবাহী লাগে নিজেকে। ফরাসি সিনেনির্মাতা রবার্ট ব্রেসনের আঁ হাসার্দ বালথাজার   নামে একখানা ছবি দেখেছিলাম মনে পড়ে। ফ্রান্সের  সীমান্তবর্তী  অজপাড়াগাঁয়ের কতিপয় মানুষের গল্প দিয়ে ছবিটা বোনা হয়েছিল। জ্যাকুয়েস ও ম্যারি আর তাদের মাঝখানে ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ বখাটে ছোকরা জেরার্ডের বিতিকিচ্ছিরি কাজকারবার ও তার পাল্লায় পড়ে ম্যারির বিড়ম্বিত জীবনের কাহিনি নির্মাতা পর্দায় তুলে এনেছিলেন। মেয়েটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বালথাজার নামের এক গাধার জীবনচক্র ছবির পুরোভাগ দখলে রেখেছিল। মাসখানেক আগে ছবিটি আবার দেখেছি বলে হয়তো গল্পটা মনে টাটকা রয়ে গিয়েছে। এই ফাঁকে সেটা বলে নিতে চাই :—

জ্যাকুয়েসের খামারি পরিবার মূলত ব্রেসনের ছবির গাধাটির মালিক ছিল। ওরা তাকে বাপ্তিস্ম অর্থাৎ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে এবং তার নাম রাখা হয় বালথাজার।  জ্যাকুয়েসের ছোটবোন অকালে মারা গেলে তার বাপ খামার খালি করার সিদ্ধান্ত নেয় ও আপাতত গ্রাম ছাড়ার সময় খামার সহ গাধাকে ম্যারিদের পরিবারের জিম্মায় রেখে যায়। ম্যারির বাপ  গরিব স্কুলমাস্টার। বালথাজারকে এই ফাঁকে অন্য এক খামারির কাছে সে বিক্রি করে দেয়। দুঃসহ খাটুনির ভার বহনের দিনগুলায় বেচারা গাধা গাড়ির তলে চাপা পড়ে জখম হয় ও ম্যারির কাছে ফিরে আসে।  জ্যাকুয়েসরা গ্রামে ফিরে এলে ম্যারির বাপের সঙ্গে খামার ও বালথাজার নিয়ে ঝগড়া বাঁধে। ম্যারির বাপ গাধাটিকে নিজের সম্পত্তি দাবি করে ও তাকে এক বেকারিমালিকের মাল টানার কাজে বিক্রি করে দেয়। ম্যারিকে জোর করে হলেও পেতে মরিয়া বখাটে জেরার্ড আবার গাধাটিকে দু-চোখে দেখতে পারে না। তার ধারণা ম্যারি তার চেয়ে গাধাটিকে অধিক পছন্দ করে। জেরার্ডের চক্করে অতিষ্ট ম্যারি শেষতক হার মানে ও নিজের পরিবার ছেড়েছুড়ে তার সঙ্গে বখে-যাওয়া প্রণয়ে লিপ্ত থাকতে বাধ্য হয়।

ওদিকে বালথাজারকে ব্রেসন ভুলতে দেন না। সমানে এক হাত থেকে অন্য হাতে পড়তে থাকে সে! এক মাতাল তাকে কিছুদিন পর্যটক বহনের কামে লাগায় ও মওসুম শেষ হলে বেকারিমালিকের কাছে বিক্কিরি করে দেয়। বেকারি থেকে সে পালায় ও সার্কাসদলের হাতে গিয়ে পড়ে। সেখানেও শান্তি মিলে না। মাতাল তাকে ফের পাকড়াও করে ও তাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় পড়ে গিয়ে মারা যায়। পুলিশ এইবেলা গাধা মহাশয়কে বাজারে নিলামে করে দেন। এক মিলমালিক তাকে কিনে নেয় আর নির্মম খাটুনির কাজে নিয়োগ করে। জেরার্ডের চক্করে দিশেহারা ম্যারির জীবন ততদিনে দুর্গতির চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। বৃষ্টিসিক্ত রাতে মিলমালিকের কাছে সে আশ্রয় প্রার্থনা করে। মালিক তাকে আশ্রয় দিলেও পরদিন ম্যারির বাপ-মা তাকে খুঁজতে এলে ম্যারির সঙ্গে বালথাজারকেও সে তাদের হাতে গছিয়ে দেয়। ম্যারির প্রেমে কাতর জ্যাকুয়েস তার সঙ্গে দেখা করে ও বিয়ের প্রস্তাব দেয়। দারিদ্র্য আর বখাটে জেরার্ডের বুনো ভালোবাসার সঙ্গে লড়ে ক্লান্ত ম্যারি  সদয় এই প্রেম নিবেদনকে এইবেলা আর নিতে পারে না। তার মনে হতে থাকে তাদের আশৈশব প্রণয়ের মধ্যে যে-নিষ্পাপ আবেদন ছিল সেটা সময়ের চাপে এখন মৃত। তার জন্য হয়তো জেরার্ডই অন্তিম ঠিকানা। ম্যারি অগত্যা জেরার্ডের কাছে ফেরত যায় এবং যথারীতি নির্মম পিটুনির শিকার হয়। জেরার্ড তাকে নিজের খামারবাড়িতে অবরুদ্ধ করে পালায়।

ম্যারির বাপ-মা মেয়েকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। বালথাজারের পিঠে চড়ে নিজ বাড়িতে সে শেষবার ফেরত যায়।  জ্যাকুয়েস পরদিন ম্যারির খোঁজে তাদের বাড়িতে গেলে জানতে পায় সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে এবং হয়ত আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। ম্যারির গরিব বাপটিও এইবেলা পটল তোলে। ওদিকে বালথাজারকে জেরার্ড ম্যারির মায়ের কাছ থেকে শোভাযাত্রার জন্য ধার চেয়ে নেয় এবং চোরাই পণ্য বহনে তাকে ব্যবহার করে। চোরাই মালের বখরা নিয়ে ফ্যাসাদের ক্ষণে দুই পক্ষের গোলাগুলি শুরু হলে জেরার্ডরা ছত্রখান হয়ে পড়ে। বালথাজার গুলিতে জখম হয়।  পরদিন প্রাতে দর্শক জীবনের বোঝা অনুযোগহীন চিত্তে টেনে চলা বালথাজারকে মাঠে মৃত শুয়ে থাকতে দেখে। তার মৃত শরীরে মাছি ভনভন করছে। খামারিদের ভেড়ার পাল তাকে তখন ঘিরে ছিল! তাদের গলায় বাঁধা ঘুঙ্ঘটের টুংটাং শব্দ যেন বালথাজারকে এইবেলা শেষ অভিবাদন জানাচ্ছিল!


অভিবাদন বললাম এই কারণে যে, নিছক সাদামাটা গল্পে বালথাজারকে একটিবারের জন্যও রবার্ট ব্রেসন মহিমা দানের চেষ্টা করেননি। গাধার জীবন সচরাচর যেমনটি হয়ে থাকে বালথাজার তার ব্যতিক্রম নয়। অনুযোগ, অভিযোগ কিংবা বাদ-প্রতিবাদের কোনোটাই সে করে না। এর হাত থেকে ওর হাতে গিয়ে পড়ার ক্ষণে প্রতি পদে নির্দয় আচরণ ও দুঃসহ বোঝা টানার চাপে তার জীবনচক্র তামাদি হয়। গাধাটিকে বাদ দিয়েও ব্রেসন গল্পটা বলতে পারতেন এবং সেটা তাঁর নির্মাণকুশলতার গুণে হয়তো-বা আবেদন বহাত, কিন্তু ছবির পুরোভাগ জুড়ে বালথাজারের সিসিফাসসুলভ নির্লিপ্ত ঘানি টানার চাপ দর্শকের মনে যে-প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার ঘটায় সেটা মনে হয় পাওয়া যেত না। উইকিপিডিয়ায় ব্রেসনের ছবিখানা সম্পর্কে গুণীজনদের প্রতিক্রিয়ার খবর নিতে গিয়ে বার্গম্যানের মন্তব্যে চোখ আটকে গেল। বার্গম্যান দেখি সেখানে বলেছেন, ‘ওহ ওই বালথাজার, আমি এর একবর্ণও বুঝতে পারি নাই, ওটা ভীষণ একঘেয়ে ছিল…একটা গাধা আমাকে একদমই টানে না কিন্তু মানুষ সবসময়ই আকর্ষণীয়।’

বার্গম্যানের মন্তব্য অবশ্য মিথ্যে নয়; — মানুষকে বাদ দিয়ে কেবল গাধার গল্প বলে গেলে ব্রেসনের ছবির কোনো মানেই হয়তো দাঁড়ায় না। অন্যদিকে তাঁর প্রতিক্রিয়া খুব সুবেদি হয়েছে এমন কিন্তু নয়; — বালথাজারকে বাদ দিলে যে-মানুষকে বার্গম্যান তাঁর জন্য আকর্ষণীয় বলে ভাবছেন তাকে নিয়ে কথা বলার বিশেষ জায়গা থাকে না। ছবির পুরোভাগ জুড়ে গাধার জীবনচক্রে অবিচ্ছেদ্য বালথাজারকে দেখার সুবাদে বার্গম্যানের সাধের মানুষরতনকে দর্শক নতুন করে চিনতে বা তাকে নিয়ে ভাবনায় গমন করতে তাড়া বোধ করে। কোনো ওজর-আপত্তি ছাড়াই গাধাটি জীবনের ঘানি টানে ও শেষতক টেঁসে যায়। মানুষ ওদিকে ঘানি টানতে ওজর-আপত্তি করে, নিজের ইচ্ছা ও স্বাধীনতাকে ফিরে পেতে সে ব্যাকুল হয় এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতার চক্করে জখম হতে থাকে, যদিও সিসিফাসের পাথর ঠেলার নিয়তি তার পক্ষে এড়ানো সম্ভব হয় না। জীবনের ভার টেনে চলা তার ক্ষেত্রেও সমান অমোঘ হয়! এদিক থেকে ভাবলে বার্গম্যানের প্রতিক্রিয়া ব্রেসনের ছবির প্রতি অবিচার ঘটিয়েছে বৈকি।

মানুষের সম্পর্কের বিচিত্র সুতো নিয়ে কারবার করতে অভ্যস্ত বার্গম্যান ব্রেসনের ছবিতে সচল যে-গাধাটিকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না কার্যত ওই গাধাই ছবিটার প্রাণভোমরা। তাকে ছাড়া এই সিনেভাষ্য নিছক মানবিক সম্পর্কের জটিল নিয়তি ও পরিণতির কাহিনি হলেও অতটা মর্মবিধুর নয় যতটা বালথাজারের কারণে সে তা হতে পেরেছে। ব্রেসনের ছবির যদি কোনো জুড়ি মানতে হয় তবে সেটা বেলা টারের তুরিনের ঘোড়া, পটভূমি ভিন্ন কিন্তু ভাবনার জায়গা থেকে বেলা টারব্রেসন দুজনেই অভিন্ন। জীবন হচ্ছে স্রেফ বোঝা টানার খেলা, গাধা যেমন টানে…ঠিক সে-রকম! বাদবাকি যা-কিছু সেখানে পড়ে থাকে তার ষোলোআনা আদতে এই সান্ত্বনায় নিজের তুষ্টি খুঁজে মরে, যার কথা ফরেস্ট গাম্প-র মুখ দিয়ে রবার্ট জেমেকিস ঠিক বলে দিয়েছিলেন, — “আমার মা সবসময় বলত, জীবনটা চকোলেটের বাকশের মতো। তুমি কোনোদিনই জানতে পারবে না তুমি কি পেতে যাচ্ছো।”


ব্রেসনের গাধার সঙ্গে আজকাল নিজের মিল খুঁজে পাই বলে হয়তো কথাগুলা বলা।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS