গানপার-এ মা লো মা নিয়া সরোজ মোস্তফা সহ অন্যদের বক্তব্য ফলো করলেও লেখার বাসনা হয়নি। কোকওয়ালাদের রিসার্চে ঘাটতি গত দু্ই সিজন ধরে দেখে আসতেছি। তৃতীয় সিজনে সেইটা আরো প্রকট মনে হইতেসে, কাজেই মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ব্যক্তিস্বত্বের যুগে এসব নিয়া স্টাডি প্রয়োজন। উনাদের কোনো রিসার্চ টিম আছে বইলা বিশ্বাস হয় না। যে-কারণে ছেলেমানুষী ঘটেতেসে। সমন্বয়ক হিসেবে অর্ণব এইক্ষেত্রে দায় এড়াইতে পারেন না।
আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতি কপিলেফট (Copyleft) চরিত্র বহন করতেসে গোড়া থেকে। এক মহাজনের গান আরেক মহাজন নিঃসঙ্কোচে ঋণ করেন। একজনের গানের ওপর অন্যজনের ট্রান্সফর্মেশন আপনা থেকে সেখানে বহমান থাকে। এসব নিয়ে উনাদের মধ্যে বড়ো কোনো বিবাদ ঘটতে দেখি নাই। কমিউনিটি হিসেবে উনারা যে-দর্শন লালন করেন সেই জায়গা থেকে একের ভাবজগতে অন্যের প্রবিষ্ট (*ক্ষেত্রবিশেষ অনুপ্রবেশ বলা যাইতে পারে হয়তো) হওয়ার বিষয়টি নতুন না। তবে এর মধ্যে একটা হারমোনি সবসময় থাকে, যেখানে এক মহাজন আরেক মহাজনকে প্রভাবিত করেন আপন স্বকীয়তায়। বাউল কমিউনিটির মধ্যে অনায়াস সক্রিয় প্রথাটি যারপরনাই চরিত্রের দিক হইতে সদা কপিলেফট থাকতে সমস্যায় পড়ে নাই। কোক-এ এসে কপিলেফট-র সহজ প্রথাখান মারাত্মক জখমি হইতেসে বলা যায়। উনারা লোকায়ত সংস্কৃতিতে বহমান লেনাদেনা ও সেখানে সক্রিয় স্পিরিট আমলে নিতে ইচ্ছুক বইলা আশ্বস্ত হওয়া কঠিন। সুতরাং কথা উঠবেই।
মা লো মা-র কেসটা এইক্ষেত্রে জটিল। গানটি কে আগে গাইসিলেন সেইটা নিয়া তর্কে মীমাংসা টানা মনে হয় না সম্ভব। হইতে পারে খালেক দেওয়ান আগে রেকর্ড করসিলেন, তা-বলে তিনি গানটা রশিদ উদ্দিনের আগে লিখসেন ও গাইসেন এমনটা না-ও হইতে পারে। নেত্রকোনা সহ হাওরাঞ্চলে উক্ত গানের প্রচলন এবং এর সঙ্গে বিজড়িত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা গোনায় ধরলে গানটির আদিপ্রণেতা রূপে খালেক দেওয়ানের নাম জপ করার চান্স ক্ষীণ হইতে থাকে। তিনি হয়তো প্রভাবিত ছিলেন ওই সময়। লোকগানের স্বভাবসুলভ কপিলেফট চরিত্রের সুবিধা উনাকে রশিদ উদ্দিনের ভণিতায় গীত গানের কথায় চটুল রদবদল ও সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করার পারমিশন দিতে কঞ্জুসি করে নাই। ওই সময়, মানে ষাটের দশকে গানখানা যখন উনি স্বকণ্ঠে রেকর্ডে তুলতেসেন, তখন এইটা নিয়া বাদ-প্রতিবাদ ঘটে কি? মনে হয় না। সে-আমলের সংবাদপত্রে তার কোনো হদিশ পাওয়া যাবে বলেও একিন করা মুশকিল। লোকগানে রচয়িতার নামনামার গুরুত্ব থাকলেও ষাটের যুগবিশ্বের সঙ্গে আজকের যুগবিশ্বের ফারাক মাথায় রাখা প্রয়োজন। রশিদ উদ্দিন স্বয়ং এই ব্যাপারে কতটা কী অবগত ছিলেন অথবা তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, খালেক দেওয়ান হইতে রশিদ উদ্দিন গানখানা ঋণ করসিলেন, সেইক্ষেত্রে উনারা ধার উধারের ব্যাপারে কতটা কী মামলায় লিপ্ত ছিলেন তার পুরোটাই ধোঁয়াশাঢাকা।
গানটির ব্যাপারে বারী সিদ্দিকীর বক্তব্য আমলে নেওয়া উচিত ছিল। উনি তো কোকওয়ালাদের জন্মের আগে গানের রচয়িতা বিষয়ক বিতর্কে ক্লিয়ার স্ট্যাটমেন্ট রেখে গেছেন। তাঁর কণ্ঠে গানটি শোনার পর বুঝতে বাকি থাকে না এটি রশিদ উদ্দিনের না হওয়াটা অবান্তর। রশিদ উদ্দিন যেভাবে গানখানা রচনা করছিলেন তার মধ্যে হারমোনি নিখাদ, যেইটা আবার খালেক দেওয়ানের গানে সকল জায়গায় অটুট থাকে নাই। দেহতত্ত্বের গান রচিত বা গীত হওয়ার ক্ষেত্রে লালন সাঁই থেকে বাউল শাহ আবদুল করিম অবধি পরম্পরায় ফিক্সড প্যাটার্নটি অত্র বিবেচ্য হবে। প্যাটার্নটিকে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা যাইতে পারে :
এর একভাগে দেহতত্ত্ব আশ্রিত গানের দেহে হিন্দু-বৌদ্ধ ও ইসলামি সুফি সিলসিলা থেকে উদ্ভুত পাকপাঞ্জাতনের পারস্পরিক একীভূত একখানা রূপ দেখতে পাই। দেহ কেন পরমাতীত পরমকে বোঝার চাবি ওইটা এই ধারার গানে বাউলরা বুঝাইতে চেষ্টা করেন। বুঝাইতে গিয়া যুক্তিতর্ক ও মীমাংসার বিষয়গুলায় সচল থাকে উনাদের মন। লালন সাঁইজির গান বড়ো দাগে এই ভাগে পড়তেসে। জালাল উদ্দিন খাঁর তর্কবহুল গানের ধাঁচটিও এর মধ্যে পড়ে বটে! অন্য ভাগে দেহ স্বয়ং লীলার উপমায় রঙিন হইতে থাকে। রাধাকৃষ্ণ লীলাকে উপজীব্য করে দেহমধ্যে পরমকে যাওয়া-অসায় লিপ্ত দেখতেসেন বাউল।
তিন নাম্বার ভাগটা আজব! বাউল পরিভাষায় উলটো গান নামে যে-ব্যাপারখানা শ্রোতা অহরহ শুনতে পায় বাউল এইবেলা ওই জিনিসখানা ধার চেয়ে বসেন। ব্রহ্মাণ্ডে বিরাজিত শত হাজার উপাদানে গড়া মানবদেহ এমন এক জগৎকে আভাসিত করতেসে যেখানে শৃঙ্খলা বিদ্যমান। শৃঙ্খলার জায়গা থেকে বিচার করলে দেহভাণ্ড স্বয়ং পরম অজানা কর্তৃক সযত্নে বিরচিত মানতে হবে। পরমকে জানার উপায় সেখানে মুর্শিদ বা বাউলের গুরু। মুর্শিদ আবার পরমের খবর নিতেসেন নবী ও কানাইকে উসিলা ধরে। এখন শৃঙ্খলা কী কভু সম্ভব যদি বিশৃঙ্খলার অস্তিত্ব জগতে না থাকে? বিজ্ঞানের এনট্রপি প্রসূত ডিজঅর্ডারটা বোধ করি বাউলকে উতলা করে যায়। উনারা তখন দেহমধ্যে লীলাময় ব্রহ্মাণ্ডকে বিপরীত সব কাণ্ডের ইমেজে রঙিন করে বিচরাইতে থাকেন। কাণ্ডগুলা পরিশেষে জগৎ কিংবা জগৎসমতুল দেহকে ফের সুবিন্যস্ত আকার দিতে পারবে কি না এই কৌতূহল রাজ করে বাউলমনে। দুর্বিন শাহ যেমন গাইতেসেন :
ও ভাই রাখোনি খবর
কুনি ব্যাঙের পেটের ভিতর থাকে অজাগর..
ভাই রে ভাই, ব্যাঙের ভিতর সাপের বাসা মানুষ খাইতে চায়
মরা দেখলে দূরে থাকে জ্যান্ত ধরে খায়
উল্টা দেশের উল্টা কথা শুনলে লাগে ডর
ছয় বলদে হাল জুড়েছে লেজ কাটা বান্দর।।
গানের অন্তভাগে দুর্বিন আরেক ধাপ রসিক হইতে থাকেন। এনট্রপিক্যাল ডিজঅর্ডার-এ ঘুরপাক খাইতে থাকা সৃষ্টিলহরির উলটাসিধা কারবারের উপমায় ক্ষয়িষ্ণু দেহকে যখন দেখতেসেন তখন রূপকের চমক তুঙ্গে পৌঁছায়। রসিকতার ছলে দুর্বিন সিদ্ধান্ত টানতেসেন :
ভাই রে ভাই, নিম গাছেতে কাঁঠাল ধরে, তাল ধরে বেলগাছে
কুম্ভীর খাইয়া হজম করে বালিয়াগড়া মাছে
দুর্বিন শাহ্ কয় মরার পেটে জিন্দারই কয়বর
গাছের আগায় মাছের বাসা প্রশান্ত সাগর।।
উলটা গানে বৌদ্ধ জন্মচক্রের কাঠামো যে ঝিলিক দিয়া যায় তাতে সন্দেহ নাই। সেখান থেকে সরে যদি কণাবাদী বিজ্ঞান হাতে নেই তাতে বিষয়টি আরো খোলাসা হয়। অ্যাটমিক ফরমেশন যখন ভাঙে সেইটা মরণ, সেইটা অবক্ষয়। ফরমেশন না থাকার মানে কিন্তু শক্তিবহনকারী কণার মরণ ঘটেতেসে এমন না। অন্য রূপে ও আবেশে নিজেকে সে মহাবিশ্বে প্রাসঙ্গিক ও সক্রিয় রাখে। যে-কারণে বিজ্ঞানীরা কথাটি বলতেসেন ইদানীং : মহাবিশ্বে এম্পটি স্পেস বইলা কিছু নাই। আপাত শূন্যসমতুল আয়তন কণাশক্তির লহরিতে বোঝাই এবং সেখান থেকে সৃষ্টি নামুমকিন নহে। প্রাণের নবনীত সৃজন ও উৎসার অগত্যা অনন্ত। লোক-নিরালোক যা-ই বলি, সর্বত্র পুনর্জন্মের চক্রটি অন্তহীন। ধ্বংস ও অবক্ষয়ের ইতি নাই। সেখান থেকে আবার সৃষ্টি ও সৃজনে যতি টানার অবকাশ খোদ ঈশ্বর যদি থাকেন, উনার পক্ষেও এই খেলার অন্ত টানা সম্ভব নয়। দুটোই সমানে চলতে আছে ও চলবে। তো এই জায়গা থেকে জীবন অনিত্য ভেবে মন যখন বিধুর হইতে থাকে তখন তাকে নিয়ে জগৎজুড়ে চলতে থাকা ভাঙাগড়ার খেলার কথা ভেবে হাসি পায়। ওপরে উদ্ধৃত গানের অন্তভাগে দুর্বিন শাহ এই সত্যটাই ডেলিভারি দিতেসেন। দেহতত্ত্বের তিন নাম্বার ভাগটির আভাস রশিদ উদ্দিনের গীতকলিতেও খানিক ধরা পড়ে।
শব্দ ও রূপকের ব্যবহারে উলটা গানের ফ্লেভার রশিদ শুরুতেই নিয়া আসতেছেন : ‘মা গো মা ঝি গো ঝি / করলাম কী রঙ্গে / ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে / গুমাই নদী নষ্ট করল ওই না কোলাব্যাঙ্গে’…। গুমাই নদী ও কোলাব্যাং কেন সিগনিফিকেন্ট ধরতে হইলে দেহতত্ত্বের গানরচনায় উলটা গানের অনুষঙ্গ বাউল কখন কীভাবে টানতেসেন সেইটা বিবেচনায় আসবে। রশিদ যেভাবে টানসেন তার সঙ্গে জালালউদ্দিন, দুর্বিন শাহ, করিম সহ আরো অনেকের পদে ব্যবহৃত রূপব্যঞ্জনার বিশেষ তফাৎ নাই। জালালউদ্দিনের কূল নাই নদীর পারে বৃক্ষ একটি মনোহর গানের সঙ্গে যেমন রশিদ বিরচিত মা গা মো ঝি গো ঝি গানটি কার্যত অভিন্ন। ট্রান্সফর্মেশন সেখানে আলাদা কিন্তু ভাবতরিকায় গান দুইখানা একে অন্যে লীন। শোনার পরে ভাবখানা সর্বাগ্রে মনে জাগে। গুমাই নদী আর কোলাব্যাঙে দাগানো দেহনদীকে রশিদ এইবেলা আরো গভীরে নিয়া গেলেও দুর্বিন তাঁর উলটা গানে যেখানে ল্যান্ডিং করতেসেন, তিনি কিন্তু ওই জায়গায় ল্যান্ডিং করেন নাই। দেহভাণ্ডকে অনিত্য ও অমোঘ অবক্ষয়ের বেদনায় গাঢ় হইতে দেখতেসেন রশিদ উদ্দিন। সেইখানে দম নিতে আপাতত কমফোর্ট ফিল করতেসেন উনি। হ্যাটস অফ বারী সিদ্দিকী, উনার অতুল কণ্ঠে শুরুর পরিহাস ও অন্তের বেদনা দুটোই পরিষ্কার ধরা পড়তেসে এখানে।
খালেক দেওয়ানে ভাবটার ট্রান্সফর্মেশনে উলটা গানের অনুষঙ্গরা জীবিত নাই। গুমাই নদী ও কোলাব্যাঙ-এর রূপকে মানবজন্মের আবর্তন, তার বিকাশ-পরিণাম বিষয়ে মালজোড়া গানে লিজেন্ড রশিদ উদ্দিন যে-তামাশাঘন বাকবিস্তার ঘটান এবং পরিশেষে ট্রাজিক এন্ডিংয়ে উপসংহার টানতে থাকেন…খালেক দেওয়ানকে তার সবটা কাটছাট করে কামনাসাগর-এ স্থির হইতে ইচ্ছুক মনে হইতেসে। বাউল গানের পরম্পরা, যেখানে এক মহাজন আরেকজনের অবিরাম প্রতিধ্বনি এবং এভাবে ঐকতান ধরে রাখতেসেন, উনার গানে অদ্য ওই জিনিসটার খামতি কানে লাগে।
কোক-এ গানখানা গেয়ে ভাইরাল হওয়ার ক্ষণে উনার উত্তরপুরুষরা আবার খালেককন্ঠে গীত গানকলির মূল জায়গা বাদ দিয়া আগাইসেন। গানের ইন্ট্রোতে মা লো মা ঝি লো ঝি-র সঙ্গে জুড়ে খালেক পদ গাইতেসেন : “নদী করে কল্ কল্ বাইন চুয়াইয়া উঠে জল / কত ভরা তল হইল এই গাঙ্গে।। / নদীর নাম কামনা সাগর, পাকে পাকে উঠে লাহর / আমি হইলাম ফাঁপর পড়িয়া তরঙ্গে।। / ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।”
আরিফ ও সাগর দেওয়ান গানটারে মাঝখান থেকে ধরতেসেন। ধরতেসেন ভালো কথা কিন্তু সেইখানে বাউলগানের চিরাচরিত প্রবণতা যেইটা থাকে আর কি, অর্থাৎ গানের কথায় বিচ্যুতি, ওই ব্যাপারটা আটকাইতে পারেন নাই। ওরিজিনাল রেকর্ডে খালেক দেওয়ান শিশুকাল থেকে জোয়ানকিতে দেহের উত্তরণ ও পরিণতি বুঝাইতে গাইতেসেন : “আমার দেহেতে আইল জুয়ানি / উজান বহে গাঙ্গের পানি / কামিনী বসিল বাম অঙ্গে…”। সাগর বাম অঙ্গে কথাটার বদলি হিসেবে ভাব অঙ্গে কথাখান কোকগানে ডেলিভারি দিয়ে বসছেন! স্বেচ্ছায় না মনের ভুলে সেইটা আন্দাজ করা কঠিন। কামকামিনীতে ভরা দেহসাগরে বাম অঙ্গ জিনিসখান পঞ্চ বা ষড়রিপুর সহগ হিসেবে বাউলরা কী অর্থে ব্যবহার করেন সেইটা উনার উত্তরসূরি খালেক দেওয়ান ঠার করতে পারলেও কোকচক্করে দিশেহারা সাগর ওসব গোনার টাইম পান নাই মনে হয়! ভাব অঙ্গে কথাখান গানের চলন ও ভাবমাহাত্ম্যের সঙ্গে বদসুরত লাগে শুনতে। খাপ খায় না বিলকুল। ভাব অঙ্গে আবার কী চিজ? খালেক দেওয়ান জীবিত থাকলে বোধ করি উনার নাতিপুতিদের জিগাইতেন!
খালেক নিজেও গানের কলিতে কামনা আর কামিনীকে, ভ্রমবশে ধারণা করি, একত্র করসিলেন। শুরুর দিককার পদে, আগেই কোট করছি, মানবদেহটারে নদীর উপমায় বিস্তারিত করার ক্ষণে খালেক কামনা সাগর কথাখান গানে জুড়সিলেন। “নদীর নাম কামনা সাগর/ পাকে পাকে উঠে লাহর / আমি হইলাম ফাঁপর পড়িয়া তরঙ্গে / ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।” ভাববিচারে কামনাসাগর ব্যবহারে মাহাভারত অশুদ্ধ হইতেসে এমন না। ক্ষয়িষ্ণু দেহ কামনার ভাগাড় বটে! কামনা সরলার্থে ইচ্ছা, বাসনা থেকে আরম্ভ করে যা-কিছু প্রলোভন তৈয়ার করে তার সবটা মিন করতে জানে, কাজেই ব্যবহারে দোষ ধরার কারণ নাই। তবে দেহতত্ত্বের গানে বাউলরা সচরাচর কামনার পরিবর্তে কামিনী কথাখান হরহামেশা ব্যবহার করেন। কেন করেন তার সঙ্গে হিন্দু তান্ত্রিক সাধনা, বৌদ্ধ থেকে সুফি তরিকা অবধি বহমান জটিল অনুষঙ্গের ভূমিকা ও প্রভাব প্রকট। শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ ও এর সঙ্গে বিজড়িত স্নায়ুব্যবস্থাপনা, একালের ভাষায় নিউরোলজি বলা যাইতে পারে হয়তো, তার সঙ্গে আবার কামকুণ্ডলি ওরফে কুণ্ডলিনী শক্তিটারে তাঁবে রাখা বা রাখতে গিয়া ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার মাহাত্ম্য অবধানের মতো গুহ্য ব্যাপারস্যাপার এতে জড়িত। যারপরনাই নদীর উপমায় দেহকে বিচরানোর ক্ষণে বাউলরা কামনাকে কামিনী রূপে অহরহ উল্লেখ করতে ভালোবাসেন।
নদীর বিস্তার, বাঁক, অনিশ্চয়তার জায়গা হইতে নদী এবং নদীসমতুল দেহ বাউলের কাছে কামকামিনীভরা চোরাটান। খালেক দেওয়ান যার কারণে গানের মধ্যপর্বে এসে আবার কামনার বদলি কামিনীতে ফেরত গেছেন : আমার দেহেতে আইলো জুয়ানি / উজান বহে গাঙ্গের পানি / কামিনী বসিলো বাম অঙ্গে / ভাঙ্গা নৌকা বাইতে / আইলাম গাঙ্গে। রশিদ উদ্দিনের প্রায় দুর্লভ পাণ্ডুলিপিতে কামনা ও কামিনী উভয়ের দেখা মিলতেছে। বারী সিদ্দিকী কিন্তু গাওয়ার সময় ওইটা কারেক্ট করতেসেন। উভয় জায়গায় কামিনী জুড়েছেন আমাদের এই জাদরেল বাঁশিয়াল। সংগত কারণে জুড়েছেন। গানের ভাব ও বাউলের দেহ নিরিখ করার তরিকা বিবেচনায় নিলে কামিনীসাগর হওয়ার কথা, রশিদ উদ্দিনের গোটা গান জুড়ে নদীর যে-রূপকাশ্রিত বিবরণ চলে এবং সেইটা খালেক দেওয়ানে পৌঁছে সঙ্কুচিত হইতে থাকে, প্রেক্ষাপট বিচারে বারী সিদ্দিকীর এই কারেকশন মোক্ষম সন্দেহ নাই।
তো এইসব বিবেচনায় দুই মহাজনের গানের টেক্সট ভালোমতন নিরিখ করা আগে প্রয়োজন। এইটা হয়তো গান দুটির ঐতিহাসিকতার জায়গা ক্লিয়ার করতে পারে। সমস্যা হলো দেওয়ান সিলসিলা বাংলাদেশে প্রভাবশালী। তুলনায় রশিদ উদ্দিন হাওরবাওরের মানুষজনের সুহৃদ। তারাই উনাকে আজোবধি বাঁচিয়ে রাখসেন। দেওয়ানকুলের মতো উনার অতো নামধাম প্রতিপত্তি নাই। উনি প্রান্তিক মানুষ। দেওয়ান ঘরানায় মাতাল রাজ্জাকের মতো গায়েন যদিও একসময় ছিলেন। যেমন সাহসী তেম্নি অকপট। তাঁর মতো জাত সাহসীর উত্তরসূরিরা নিজেদের বাণিজ্যিক আর সস্তা করে তুলতেসেন মনে হইল। গানটির স্বত্ব নিয়া উনাদের কথাবার্তা আপত্তিকর ও অশোভন। বাউলদের চিরাচরিত বিনয় ও ফিলোসোফি সেখানে মৃত। আফসোস!
সুখের ঘটনা এটুকুন, কোক-এর সুবাদে গান দুখানা পুনরায় আলোচনায় আসছে। মানুষ শুনতেসেন। কোক যে-ফরমেটে গান সাজায় তার দিক থেকে শুনতে বেশ লাগে। বিশেষ করে মনসা দেবী ও আলী হাসানের র্যাপ পার্টটা শ্রবণ আর নয়নসুখকর। র্যাপের জায়গা হইতে আলী হাসান নিজের ভূমিকা ভালোমতো নিভাইতে ত্রুটি করেন নাই : ‘হুম, আপনি কি ভাবতেসেন ভাই / আপনার নৌকায় leak আসে? / আমি তো দেখতেসি ভাই আপনার নৌকা ঠিক আসে /… জীবনের তরী বাইয়া জায়গামতো যাইতে হবে / তরিকা সবারই এক ভাঙ্গা নৌকা বাইতে হইবো…’ একদম! ঠিক জিনিসখান র্যাপবুলিতে আপনে ধরসেন ভাই আলী হাসান। রশিদ উদ্দিন বলি আর খালেক দেওয়ান…উনাদের গান গাওয়ার তরিকায় Leak বড়ো একটা নাই। ফুটো বা ছিদ্রের সবটাই আপাতত প্রীতম হাসান ও অর্ণব-এ দৃষ্ট হইতেসে। উনারা সেইটা আদৌ বুঝতেসেন কি না আল্লা জানেন!
কার গান — রশিদ উদ্দিন না খালেক দেওয়ান
বাউল গান : অথেনটিসিটি ও মালিকানার প্রশ্ন
গানপারে কোকস্টুডিয়ো
কোকস্টুডিয়ো কম্পোজিশনে আলোচ্য গান
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS