বারোমাসের বাচ্চু || সত্যজিৎ রাজন

বারোমাসের বাচ্চু || সত্যজিৎ রাজন

প্রয়াণের পর থেকে এবি-ট্রিবিউট রচনা না-হলেও কুড়ি-তিরিশের মতো পড়ে ফেলেসি এরই মধ্যে। বেশিরভাগ রচনাই স্মৃতিচারণমূলক। ফলে বেগ পেতে হয় না পড়তে গিয়ে। বেশ তরতরিয়ে পড়ে ফেলতে পারি। নিউজফিডে এসে লেখাগুলা হাতছানি দিয়া যায়। না-পড়ে চলে যাব গুরুগম্ভীর মুখে, এতটা পাষাণ তো নই। কিন্তু রক মিউজিকের অতটা ফ্যান আমি না। আইয়ুব বাচ্চু আমার সময়ের আইকোনিক ফিগার, আমার আযৌবন বন্ধুদের অনেকেরই প্রিয় সংগীতকার, অতএব রক মিউজিকের সমুজদার না-হয়েও এবির অকাল প্রস্থানে ব্যথিত হয়েছি। কিন্তু অনলাইন নিউজপোর্ট্যালগুলাতে এবি-উপজীব্য রচনাগুচ্ছ পড়তে পড়তে একসময় মনে হলো অন্তত একটা পয়েন্টে আমিও দুইটা কথা আলগোছে বলে রাখি। নিশ্চয় কেউ ভুল বুঝবেন না আমায় যে আমি হুদা পাণ্ডিত্য ফলাইতেসি।

মেইন পয়েন্ট রেইজ্ করার আগে এবিশ্রদ্ধার্ঘ্য পড়তে পড়তে যে-ফ্ল্যাশব্যাকের মুহুর্মুহু উদয়-অস্ত হতেসে আমারও অভ্যন্তরে, সেই জিনিশগুলা মার্জিনে একটু বলে থুয়ে এগোই। কিছুক্ষণ আগেই লিখেসি যে এবি যে-একটা ধারায় গান বানতেন, মানে যেইটারে লোকে রক মিউজিক কয়, আমি সেই জিনিশ বা সেই ধারার সমুজদার না আদৌ। কথাটা হান্ড্রেড ভাগ সত্যি হলেও অর্থ এইটা না যে আমি রক মিউজিক শুনি নাই। বিশেষ করে ব্যান্ডসংগীত শুনে এসেছি শুরু থেকে, এমন অসংখ্য গান আছে ব্যান্ডের যেইগুলা আমারে তেল-পানি-খাদ্য যুগিয়েছে উঠতি বয়সের মনে, এখনও অনেক ব্যান্ডগান আমার ব্যক্তিগত ন্যুব্জ মুহূর্তগুলায় পাওয়ারহাউজ্ হিশেবে কাজ করে দেখতে পাই। কিন্তু রকগান, বা হালের মেটাল গানের কথাও বলতে পারি, আমারে ঠিক কমিউনিকেট করতে পারে নাই বা আমি তারে পারি নাই কমিউনিকেট করে উঠতে। এবি তার প্রাইম টাইমে যে হার্ডরক ঘরানায় গান বেঁধে গেয়েছেন সেইগুলা আমি তখন-তখনই হৃদয়ঙ্গম করে উঠতে পারি নাই। বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু অনুরাগ জন্মেছে এবির প্রাইম টাইম ফুরাইয়া যাবার অনেক পরে। সেই গল্পই করতে এই লেখায় অবতীর্ণ হয়েছি।

ইশকুলবেলায় আমার সহপাঠী ক্লাসফ্রেন্ড অনেকেই ছিল আইয়ুব বাচ্চুর মহাভক্ত। বকা খাইতে হতো ওদের কাছে এই ইশ্যুতে যে এবির মাহাত্ম্য আমি বুঝতেসি না, আমি একটা মাকাল ফ্রুট অথবা কালকুষ্মাণ্ড, আরও ঘনিষ্ঠ যারা তারা তো আমারে বলদ বলতেও বাদ রাখে নাই। কিন্তু আমি ওই সময়টায় আইয়ুব বাচ্চুর তৈরি-করা গানের বা সংগীতের রসাস্বাদন করতে ব্যর্থ হয়েছি বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও। বরাবরই আমি কিছুটা ক্ল্যাসিক সাহিত্য আর প্রথানুগতা বাংলা গানের সাবস্ক্রাইবার। যতটুকু যা পাঠের বা শ্রবণের ভিতর দিয়া গেসি তা সবই ট্র্যাডিশন্যাল সর্বার্থেই। সিলেটে বর্ন অ্যান্ড ব্রটাপ হবার কারণে এখানকার বাউলা গানের সঙ্গে একটা আত্মীয়তা রক্তেই ইঞ্জেক্টেড ছিল জন্মসূত্রে। ব্যান্ডগানে মেলোডি ড্রিভেন অংশটাই নিজের মতো করে অ্যাপ্রিশিয়েট করে এসেছি আগাগোড়া। আইয়ুব বাচ্চু তার ম্যাগ্নামোপাসগুলাতে যেই মিউজিক অফার করেন সেইটা আমি নিতে পারতাম না বহুদিন অব্দি। কিন্তু অনেক পরের দিকে এসে এবি যখন থেকে মেইনস্ট্রিমড হইতে শুরু করসেন তখন আমি তার গানে এন্ট্রিপয়েন্ট খুঁজে পাই। রিসেন্টলি তার আকস্মিক প্রস্থানের পরে দেখতেসি সবাই এবির শেষদিককার সাংগীতিক ক্যারিয়ার নিয়া বাঁকা বাক্যাবলি লিখতেসেন। সকলেই তারা হার্ডকোর হার্ডরকখোর নিশ্চয়। মিউজিকের সমুজদার সবাই নিঃসন্দেহ আমি। কিন্তু লজ্জার মাথাটাথা খায়া আমি কীভাবে শেষের দিকের এবিক্রিয়েশন দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তার প্রাইম টাইমের গ্রেইট নাম্বারগুলায় নিবিষ্ট হয়েছি সেইটা জানাই নিঃসঙ্কোচ অভিজ্ঞতা শেয়ারের নিমিত্তে।

যেই সময়টায় এবি ফিল্মি প্লেব্যাকের জন্য সংগীত প্রোডিউস করতেসেন, দুইহাতে টেলিভিশনশোয়ের শীর্ষ সংগীত থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ইত্যাদি করতেসেন, প্রোমো করতেসেন নানাবিধ প্রোডাক্টের, ওই সময়টাতেই এবির কিছু গান আমার কর্ণগোচর হয়। আমার বাসগৃহ থেকে বেরিয়ে দেড়-দুইপা ফালাইলেই বন্দরবাজার। মোড়ের দুইপাশে সারি সারি দোকানপাট। সারাক্ষণ হৈহল্লা আওয়াজের মেলা। গানও অবধারিত। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসতেসি ‘গীতের কলি’, ‘গীতঘর’, ‘সিম্ফনি’ ইত্যাদি শিরোনামের দোকানে ক্যাসেট-সিডি বিককিরি হয় আর হাই-ভলিউমে গান বাজে। ব্যান্ডের গানই বেশি বেশি বাজতে শোনা যায়। এবির গান আমি কিনে না-বাজাইলেও এইভাবেই চিরদিন প্রতিদিন সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় কানে গেসে। তেমন রস-কষ পাই নাই। কিন্তু শুনেসি ‘ঘরছাড়া এক সুখী ছেলে’, ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’ ইত্যাদি গানগুলা। ভালো তখন না-লাগার পিছনে একটা কারণ হতে পারে এবির মোটেও-সুরেলা-নয় এমন খাট্টা একটা গায়নভঙ্গিমা আর তার গলা, বাংলা উচ্চারণে ইংরেজি অ্যাক্সেন্টের টেন্ডেন্সি, আর সর্বোপরি গিটারের আওয়াজাধিক্যে লিরিকের আগামাথা চটজলদি ধরতে না-পারার বাধা।

তা, ‘বারোমাস’ নামে একটা গান বোধহয় তার পড়ন্ত সময়ের ক্রিয়েশন। উদাহরণ হিশেবেই বলছি, ওই গানটার মতো গুটিকয় আরও গান রয়েসে এবির সিগ্নেচারটিউন হয়তো নয় কিন্তু আমাকে এবিশ্রবণে মনোযোগী করে তুলেসে। “আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি / তুমি সুযোগ পাইলে বন্ধু বাসিও” ইত্যাদি লাইনের ব্যবহারে যেই গানটা আইয়ুব বাচ্চুর আদি ভক্তদেরে বিরক্ত করেসে হয়তো, কিন্তু আমার মতো কতিপয় শ্রোতারে একটু হলেও এবির দিকে কান ফিরাইতে হেল্প করেসে। এরপরে এবির পুরানা গানগুলাও শুনে দেখেসি যে আমি আগের চেয়ে ব্যেটার এবিলিস্নার হতে পারতেসি। ‘দরজার ওপাশে’, ‘সেই তারাভরা রাতে’, ‘গগনে তারাগুলো নিভে-যাওয়া রাতে’ ইত্যাদি গানগুলা বাংলা গানে একেকটা আবিষ্কারের উল্লাস নিয়াই হাজির হইসে আমার কাসে। শেষের দিকের গানগুলার বরাতেই কিন্তু আমি এবির শুরুর দিকের ‘হার্ডরক’-‘ব্লুজ’ নাম্বারগুলায় এন্টার করতে পারসি। সবার তো সবকিছু ক্রম মেনে হয় না সবসময়।

এখন, আমার পয়েন্টটা হইতেসে যে, হ্যাঁ, এবি হয়তো সংগীত বা গানের লিরিক ইত্যাদি বিবেচনায় শেষের দশকে একেবারেই নিজের প্রতি জাস্টিস করেন নাই। কিন্তু আমার প্রতি নিশ্চয় জাস্টিস করেসেন। কেন ভাবব না যে এইর’ম আমার মতো অনেক শ্রোতার উপকার হইসে তার শেষের গানগুলার সিঁড়ি বাইয়া আগের গ্রেইট গানগুলায় যাইয়া পৌঁসাইতে? এবি যদি তার প্রথম দিনের শ্রোতামণ্ডলের ভিত্রে থেকেই মিউজিক করে যেতেন, বলা যায় না আমার মতো অত-রকভক্ত-নয় লিস্নারের পক্ষে ম্যে-বি এখনও চমৎকার তার গানগুলার প্রতি নিবিষ্ট হওয়া হতো না।

কাজেই, সৃজনরত মানুষদেরে একটা আবদ্ধ ঘেরাটোপে রেখে দেখবার ভঙ্গিটা বাদ দিতে হয় সবসময়। স্টার্ট-সময়ের ভক্তদের অহং আহত করে একজন বড় শিল্পীই পারেন কিছু অবনমিত হয়েও নয়া রাস্তা হাতড়াইতে। সেই রাস্তা ধরে আমার মতো শ্রোতারা যেন তার মূল সড়কের দেখা পায়, মঞ্জিল-এ-মোকামের হদিস পায়, শিল্পীকে এই জিনিশটা মাথায় রাখতে হয়। নিজের মহাখ্যাতির পশ্চাদ্ধাবন করে যাওয়া, খ্যাতির মূর্তিটা ধরিয়া রাখবার মরিয়া প্রয়াসে নয়া কিছু বানাইবার ব্যাপারে ঝুঁকি না লওয়া, বামনেরা পারলেও বড় শিল্পীরা তা পারেন না।

আইয়ুব বাচ্চু বড় শিল্পীই ছিলেন এই বিবেচনায়। একটা ক্যানভাসে আঁকা তার বিশেষ একধাঁচের চিত্রকলা তারে আর্লি জীবনে প্রসিদ্ধি এনে দিলেও উনি রিস্ক নিয়া তার প্রতিষ্ঠিত ভক্তমজমা ফালায়া বারোমাসই মিউজিকমত্ত রয়ে গেসেন শেষ ভোর পর্যন্ত। শুরুর নিঃশ্বাস থেকে শেষের নিঃশ্বাস অব্দি তিনি কেঁদেই গিয়েসেন, গানের কান্না, সুরের কান্না, সংগীতের কান্না, বাদ্যযন্ত্রযোজনার কান্না। আর কিসুই করতে হয় নাই তারে। আর কিসুই করতে যানও নাই তিনি। এইটার চাইতে গ্রেইট ব্যাপার কিসু হইতেই পারে না। বারোমাসই তিনি গিয়েসেন গান গেয়ে একটি জীবন কাটিয়ে, এর চাইতে সাহসের সুন্দরের ব্যাপার এই শফিহুজুরের শোকরানা প্রাগৈতিহাসিক প্রগতিশীলতার দেশে আর কিসু হইতেই পারে না।

আমি বারোমাস আইয়ুব বাচ্চুর গানই শুনে যেতে পারব বাকি জীবনভর। এইটা আমার দেশের লড়াকু সংগীতকারের গান। এইটা আমার বন্ধুদের গল্পবলা গান। এইটা আমারই নিখোঁজ প্রেমের গুনগুনাইনা গান। এইটাই আমার গান। আমার দেবোত্তর শিল্পসম্পত্তি।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you