দিবারাত্র দুর্গাপুজো || অসীম চক্রবর্তী

দিবারাত্র দুর্গাপুজো || অসীম চক্রবর্তী

বঙ্গে দেবী শারদীয়া এসেছেন আবারো। চারপাশে দুঃখ, জরা, ব্যাধি, প্রেম, অপ্রেম, পাওয়া না-পাওয়ার হুতাশন। তবুও এক-লহমায় যেন আকাশের শাদা মেঘের ভেলা আর শাদা কাশফুলের শুভ্রতায় ঢেকে যায় সকল কালো। আনন্দ উদযাপনের বারতা বয়ে মহালয়া আসে বংলায়। ছোটবেলায় শ্রাবণ- ভাদ্রমাস শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে শতনাম পড়তাম গোল হয়ে বসে। সেখানে সুখসারির দ্বন্দ্বকথায় ছিল দুটো লাইন :

আশ্বিনে অম্বিকাপূজা হর্ষ দেশে দেশে
কৃষ্ণ বিনে রাধা কাঁদে আলুথালু বেশে।

তখন থেকেই মনের মধ্যে দুর্গাপুজোর উত্তেজনা এসে ভর করত অবর্ণনীয়ভাবে। সে-এক অন্য  অনুভূতি। সে-এক অন্যজীবনের গল্প।

আমাদের মধ্যবিত্তবাড়ির পারিবারিক পুজোর নিয়মমাফিক বংশপরম্পরায় একজন আচার্য্যঠাকুর মূর্তি তৈরি করেন। তাঁর বাবা এবং জেঠা আমাদের বাড়ির প্রতিমা তৈরি করতেন। যদিও অন্যান্য জায়গায় আজকাল কুমোররা মূর্তি তৈরি করেন। পুজোর অন্যতম নস্টালজিয়ার জায়গা হলো মহালয়া। দেবীপক্ষের সূচনায় একটা অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়। আমি সহ আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের প্রায় কুড়ি-বাইশজন কাকাতো-জেঠাতো ভাইবোনদের বেশিরভাগই আমাদের ঠাকুরদা-ঠাকুরমা দেখিনি। তাই বাবা যখন আবক্ষ জলে নেমে তর্পণ করতেন তখন আমরা বিশ্বাস করতাম বা এখনো করি যে আমাদের পূর্বসূরি আপনজনরা আমাদের পাশেই আছেন। আমাদের দেখছেন। আমাদের জন্য দেবীপক্ষের সময়টুকু যতটা আনন্দের ততটাই আবেগের ঘেরাটোপে বন্দি।

মহালয়ার ভোরে ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকত। লোমকূপে হালকা শিহরণ-তোলা শরতের ভোরে বহু কষ্ট করে পুরাতন রেডিওর স্টেশন ঘুরাতে ঘুরাতে অবশেষে পৌঁছানো যেত আকাশবাণী কলকাতার স্টেশন। শুরু হতো ভেতরটাকে আনন্দ আর উত্তেজনায় পূর্ণ করে শ্রীবীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহালয়া অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী। শুরু হতো দেবীর বোধনবন্দনা। আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠল আলোকমঞ্জির … বারবার শোনা, তবুও প্রতিবারই যেন নতুন। এভাবেই বঙ্গসংস্কৃতির জৌলুসভরা শহর কলকাতার আকাশবাণী শাদা মেঘের ভেলায় চড়ে আসামের জঙ্গল পাহাড় ছাড়িয়ে সীমান্তের কাঁটাতার দুমড়েমুচড়ে বীরেনভদ্রের কণ্ঠমাধুর্যে শ্বাশ্বত পুজোর আমেজ পৌঁছে দিত নদী পাহাড় আর সবুজে-ছাওয়া এপারবাংলার সিলেট জেলার একটি কিশোরের মনে।

আসলে দুর্গাপুজোর ইতিহাস প্রায় সবারই জানা। তবে দুর্গাপুজো যতটা না দেবী দুর্গার পুজো ততটাই প্রকৃতি আর নারীর প্রতি আত্মসমর্পণের পালা। সেইসাথে আছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং বাংলার মাটির সুরের সাথে শ্যামাসংগীতের মিলেমিশে একাকার হওয়ার গল্প। ষষ্ঠীপুজোয় দেবীর বোধন করা হয় মণ্ডপের বাইরে। পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্য, আম্রশাখা, মাটির তৈরি ঘট, বটের ডাল, তিল, হরিতকী, পুষ্প, দূর্ব্বা, তুলসী, বিল্বপত্র, ধূপ, দীপ, ধুনা, পিটুলি অঙ্কিত হাঁড়ি, শ্বেতসর্ষে, মাষকলাই, বটের পাতা, বেতের পাখা, শুভ্র (শ্বেত) বর্ণের নূতন বস্ত্রখণ্ড, কাঁচা হলুদ, ঘৃতপ্রদীপ , আঁতমরা ফল, লোহা, তালপত্র এইসকল প্রাকৃতিক উপাদানে দেবীর বোধন করা হয়। চারপাশে বাজে গমগমে ঢাকের বাদ্য আর মঙ্গলশঙ্খধ্বনি। উৎসবের আমেজে ভরে ওঠে আবহমান বাংলার প্রকৃতি।

মা দুর্গা নয়টি নারীরূপে সর্বত্র বিরাজিত। মার্কন্ডেয় পুরাণে দেবীর নয়টি রূপ নয়টি উদ্ভিদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। উদ্ভিদগুলো হলো :

  • কলা — কদলিগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী;
  • কচু — কচুগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা;
  • হলুদ — হরিদ্রাগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা;
  • জয়ন্তী — জয়ন্তীগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী;
  • বেল — বিল্বগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা;
  • ডালিম — ডালিমগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা;
  • অশোক — অশোকগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা;
  • মান — মানগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা;
  • ধান — ধানগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী

সপ্তমীর দিন সকালে সেই নয়টি উদ্ভিদ নদীর জলে স্নান করিয়ে শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে পাটভাঙা লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে  ঘোমটা-দেওয়া নারীর আকার দেওয়া হয়। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডানদিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। যেন বাংলার অবারিত প্রকৃতি একত্রীভূত হয়ে নারীরূপে, মাতৃরূপে সংস্থাপন হয়ে ছেন গোটা বঙ্গে।  দূর্গাপ্রতিমার মতো শৈল্পিক কারুকাজময় উপস্থাপন আর নানান নন্দনে পূর্ণ প্যান্ডেলের সাজসজ্জা সম্ভবত পৃথিবীর খুব কম উৎসবেই হয়ে থাকে।

প্রতিমা স্থাপনের পরেই তৈরি হতো মহাস্নান। অর্থাৎ যেসব উপাদানের মিশ্রণ দিয়ে মন্ত্রের মাধ্যমে দেবীকে স্নান করানো হবে সেই মিশ্রণকে বলা হয় মহাস্নান। সেই মহাস্নান তৈরিও এক এলাহি কর্মকাণ্ড। মহাস্নানে প্রয়োজন হয় তেত্রিশ ধরনের জল, তৈল, মাটি, পাঁচ ধরনের ধাতু, পঞ্চকষায়, পাঁচ ধরনের শস্য, হলুদ ইত্যাদি। তীর্থের জল, গঙ্গাজল, সরস্বতী নদীর জল, সমুদ্রজল, পুকুরের জল, বৃষ্টির জল, শিশিরজল, ঝর্ণার জল, শীতল জল, গরম জল, উম-গরম জল, কুশযুক্ত জল, শঙ্খজল, নারিকেলের জল, তিলযুক্ত জল, পুষ্পজল, মহৌষধি জল, সর্বৌষধি জল, অগুরু জল, পদ্মরেণুজল, শর্করাযুক্ত জল, চন্দনযুক্ত জল, পঞ্চরত্নযুক্ত জল, পঞ্চকষায়যুক্ত জল, পঞ্চগব্যযুক্ত জল। এছাড়াও মহাস্নানে গজদন্ত মাটি, বরাহদন্ত মাটি, বৃষশৃঙ্গ মাটি, সাগরের মাটি, গরুর পাল হেঁটে যাওয়া মাটি, নদমাটি, নদীমাটি, বেশ্যাদ্বারের মাটি প্রভৃতি প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রকৃতির জল, মাটি, বায়ু আর গন্ধ নারীরূপে একাকার হয়ে দেবী দূর্গারূপে আবির্ভুত হলেন। তবে এত আয়োজনের মধ্যে বেশ্যাদ্বারের মাটি বিষয়টা নিয়ে সবার কৌতূহলের অন্ত নেই। কৌতূহল থেকে আজকে এর কারণ পড়লাম এবং যুক্তিটা পড়ে নিমেষেই মনটা ভালো হয়ে গেল। উপনিষদে আছে যে-সকল পুরুষ দেহোপজীবিনীর বাড়ি যায় তাদের জীবনের সমস্ত পুণ্য সে-বাড়ির মাটির সাথে মিশে যায় এবং দেহোপজীবিনীর সকল পাপ সেই পুরুষমানুষটি সাথে করে নিয়ে আসে। এভাবে বেশ্যালয়ের মাটি হয়ে ওঠে পৃথিবীর পবিত্রতম মাটি এবং নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদে যারা এমন রাস্তা গ্রহণ করেন  তারা পাপমুক্ত হন। কয়েক হাজার বছর আগেও এমন যুক্তি দিয়ে সমাজসচেতনতা তৈরি কেবল ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজমনস্তত্ত্বে সম্ভব।

দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ হলো সংগীত। দুইশ বছর আগে কালীভক্ত রামপ্রসাদ সেনের জন্ম। হ্যাঁ, সেই রামপ্রসাদ, যিনি বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মধুমাখা রামপ্রসাদী সুর। যে সুরে মুগ্ধ হয়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল দুজনেই রামপ্রসাদী সুরে গান রচনা করেছেন। ভাবতেই অবাক লাগে দুইশ বছর আগে রামপ্রসাদ যে বাণীতে সুরারোপ করে গান লিখেছেন তা আজকের সময়েও বড্ড মানিয়ে যায়। বিষয়বাসনায় মত্ত হয়ে লাইনচ্যুত রামপ্রসাদ বলছেন :

মা আমায় ঘুরাবে কত
কলুর চোখ-ঢাকা বলদের মতো।
ভবের গাছে বেঁধে দিয়ে মা পাক দিতেছ অবিরত
একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি,
দেখি শ্রীপদ মনের মতো‌।।

আরেকটা গানে রামপ্রসাদ নিজেকে রত্নাকরের সাথে তুলনা করে বলছেন নিজের অন্তরের অগাধ জলে ডুব দিতে। যেখানে রামপ্রসাদকে পাওয়া যায় একজন আধ্যাত্মিক মাতৃভক্ত বাউল হিশেবে। যেখানে তিনি বলছেন :

কামাদি ছয় কুম্ভীর আছে, আহার-লোভে সদাই চলে,
তুমি বিবেক-হলদি গায়ে মেখে যাও, ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে।

রামপ্রসাদ তাঁর গানের বৈচিত্র্য এবং টপ্পার সাথে নিজের স্বকীয়তা মিশিয়ে যে অন্তরাত্মা শান্ত করে দেবার মতো গান রচনা করেছেন তা অবর্ণনীয়। শুধু রামপ্রসাদ নয়, কমলাকান্ত থেকে সলিল চৌধুরী সবাই ভারতীয় রাগসংগীতকে উপজীব্য করে রচনা করেছেন মাতৃসংগীত যা বাংলা সংগীত এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে দুর্গাপুজোর গানে টপ্পার আধিক্য দেখা যায়। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে কলকাতার দুশো বছর পুরানো পুজোর মণ্ডপে যে কীর্তন গাওয়া হয় সেই একই কীর্তন গাওয়া হয় হাজার মাইল দূরে সিলেটের কোনো-এক গ্রামের দুর্গাপুজোর উঠোনবৈঠকিতে। কোনো প্রচারযন্ত্র ছাড়াই একটা গান ভ্রমণ করে শত শত মাইল, হাজার হাজার মণ্ডপ। এভাবেই দেবী দূর্গা হয়ে ওঠেন সার্বজনীন।

বরাক উপত্যকায় দুর্গাপুজোর গানকে বলা হয় মালসি গান। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দুর্গাভক্ত হিশেবে দেখে বড় হয়েছি। বাবাকে দেখলে কেমন যেন সাধক রামপ্রসাদের কথা মনে পড়ে। বাবা যখন রামপ্রসাদের গল্পকাহিনি আমাদের শোনাতেন তখন তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করত। দেবী দুর্গার প্রতি ভক্তি আর সাধক রামপ্রসাদের অনুরক্ত বাবা প্রচুর মালসি গান রচনা করেছেন যা আমাদের এলাকার পুজোমণ্ডপের বৈঠকিকীর্তনে গাওয়া হয়। দেবী দুর্গার অদর্শন এবং জরাগ্রস্ত সমাজের প্রতিনিধি হয়ে অভিমানে লিখেছেন :

দোষ নিও না ওগো উমা
দোষ কিছু বলিব গো মা
মহাজনের ঘরে থেকে গরিবের দুঃখ বোঝো না …

রামপ্রসাদের মতো বাবাও তাঁর লেখা কীর্তনের শেষের কলিতে নিজের নাম লিখতেন :

এবার বঙ্গ আলো করে মা এসেছে রে
মায়ের আবরণের আলো দূর করিল সকল কালো
দ্বিজ অমল বলে আলোয় ভালোয় ভরল ধরারে …

পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হতো সাংগীতিক প্রস্তুতি। কাজিনদের নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় বসতো গানের আসর। কেউ গাইছে রামপ্রসাদী, কেউ গাইছে পান্নালালের গান, কেউ গাইছে মান্না দে অথবা কুমার শানুর গাওয়া শ্যামাসংগীত, আবার কেউ গাইছে বাবার লেখা ব্রান্ডনিউ পুজোর গান। অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের শেষ থেকেই শুরু হয়ে যেত পুজো উদযাপনের পরিকল্পনা। সে-এক অন্যজীবন ছিল।

তবে সিলেট অঞ্চলে ঠাটকীর্তন নামে একধরনের কীর্তন হতো আমাদের ছোটবেলায়। দুইতালের কঠিন মৃদঙ্গের বোলে মাত্র অল্প কথায় সুরের বৈচিত্র্যে গাওয়া হতো সেই গান। যেখানে মৃদঙ্গবাদক থাকতেন মাঝখানে আর তাকে ঘিরে ঘুরে ঘুরে গাওয়া হতো ঠাটকীর্তন। যে-কীর্তনে মৃদঙ্গের তালের সাথে কাঁসর এবং করতালের সাথে অন্যতম ছিল কীর্ত্তনীয়াদের পায়ের আওয়াজ। অর্থাৎ কীর্ত্তনীয়ারা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে কঠিন সুরের ঠাটকীর্তন গাওয়ার সময় পা দিয়ে মাটিতে একটা ভিন্ন রিদমে আওয়াজ দিতেন এবং তালের ডিমান্ড অনুযায়ী থামাতেন এবং কখনো আবার উল্টোদিকে দুইপা চারপা ফেরত আসতেন। একেকটা ঠাটগান দুই-আড়াই ঘণ্টা ধরে গাওয়া হয়। নবমীর শেষরাতে ‘ওরে নবনীর নিশি প্রভাত হইয়ো না, প্রভাত হলে কৈলাসেতে চলে যাবেন মা …’  এই গানের একলাইনেই চলে যেত ঘণ্টাখানেক। সেইসাথে কীর্ত্তনীয়া সহ বাড়ির সবার চোখে ঝরত ঘনিয়ে-আসা সমূহ বিদায়ের জল। সে-এক অবর্ণনীয় থমথমে মুহূর্ত। আমি জানি না এই ঠাটগান এখনো হয় কি না। কুশিয়ারা নদীর পাড়ে শেখপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের বাড়িতে নবমী পুজোর রাতে আরতিশেষে বৈঠকি, এরপরে ঠাটকীর্তন এবং ভোররাতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শেষে লুটের গান।

সে-এক ভিন্ন জীবনের গল্প। যে গল্পে স্বপ্নেও ভাবিনি শারদউৎসবে বাড়ির বাইরে থাকব। অথচ পুজোর ঠিক দুসপ্তাহ আগে এক গোধূলিআলোর শান্ত সন্ধ্যায় বাড়ি ছেড়েছিলাম পশ্চিমা শহর লন্ডনের উদ্দেশ্যে। দেশছাড়ার পরে বহুবার দেশে গেলেও গত বারো বছর হলো পুজোয় দেশে যাওয়া হয়নি। তাই ঘুম থেকে উঠেই কেন জানি বিলেতি বাদলির সাথে মনটাও আর্দ্র হয়ে উঠল। খুব ছোটবেলা অর্থাৎ জীবনের প্রথম পুজোর ভাসাভাসা স্মৃতি আবছা এসে ভর করে মনে। সে-বছর গুরুম-কুটা বৃষ্টি ছিল। চেরাপুঞ্জির সব মেঘ যেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঝড়ি হয়ে আমাদের বিশাল প্রাগৈতিহাসিক উঠোনে ভর করেছে। তখনও আমাদের উঠোন পাকা হয়নি। মাটির উঠোনে কাদা আর জলে একাকার। ইট দিয়ে একটা লেইনের মতো বানানো হলো যাতে সহজেই বাড়ির উত্তরপ্রান্তে স্থায়ী দুর্গামণ্ডপে কাদাজল না মাড়িয়ে যাওয়া যায়। উপরে ত্রিপল (তেরপাল) আর বাঁশ দিয়ে বাঁধা হলো আলং (প্যান্ডেল)। দাদু-দিদিমা তখন বেঁচে ছিলেন। মামা এবং দাদু দুজনেই সরকারি চাকুরিজীবী হলেও সহায়সম্পত্তিতে দাদুবাড়ি ছিল জমিদার। সঙ্গত কারণে দিদিমা এলেন বস্তাভরা চিড়া, মুড়ি, মোয়া, চিকন চাল এসব নিয়ে। ঝড়জলের মধ্যে বাড়িতে শত মানুষের আনাগোনা। যেহেতু পুজোর চারদিন সকালে সবাই উপোস থাকেন তাই নাস্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে বাচ্চাদের জন্য চিড়া-কলা থাকত। একটা ঘরে পুজোর জন্য আনা আস্ত কলার ছড়াগুলো ঝুলিয়ে রাখা হতো। আমাদের মতো দস্যি বাচ্চারা যার বাড়িতে আছে সে কলার ছড়া ঝুলিয়ে রাখলেও তা বাঁচানো যায় না; আমরা ছোট স্টুলের উপর দাঁড়িয়ে বানরের মতো যতটুকু নাগাল পাওয়া যায় ততটুকু সাফাই করে নিতাম।

পুজোর রান্না হতো মায়ের নেতৃত্বে। সাথে আমাদের বাড়ি এবং পাশের বাড়ির মহিলারা হাত লাগাতেন। অন্ন, ব্যাঞ্জন, ডালনা, নানা পদের ডাল, মুগের খিচুড়ি, ভাজা বড়া, পিঠা, সুক্ত, লুচি, পায়েস। পুজোর পাঁচটা দিন সারাবাড়ি মৌ মৌ করত প্রসাদের ঘ্রাণে। আগে থেকে চুনা-উঠা চালকুমড়া, হাতির পায়ের ছাপের মতো মিষ্টিকুমড়া আর আলু কিনে রাখা হতো ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে। পুজোর দিন সকালে স্নান করে নতুন শাড়ি পরে গোল হয়ে পাড়ার মহিলারা বসে সবজি কাটতেন। নানান রঙের সবজির বাহারের সাথে থাকত গালগল্প। সেই একই মহিলারা বিকেলবেলা পাটি পেতে মণ্ডপের দুয়ারে বসে গাইতেন পুজোর গীত। দশমীতে বাবা খুব মনখারাপ করেন। বাবার চোখে প্রতিবছর দশমীবিসর্জনে জল ঝরে। সে-বছরই প্রথম চোখে পড়েছিল। আর মায়ের কথা বাদ দিলাম। মা তো আগমনী আর বিদায় দুটোতেই আনন্দ আর বিষাদে আবেগাক্রান্ত হন। আসলে আবেগ আর ভালোবাসাই সম্ভবত মধ্যবিত্তজীবনকে বাঁচিয়ে রাখে জীবনীশক্তি দিয়ে। চারদিনের উৎসব শেষে দশমীর পরের দিন সারাবাড়ি জুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা ভর করে যা সত্যিই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে বর্ণনাতীত হাহাকারময় আফাল তোলে। তবে দশমীর ভাসান শেষে বাড়ি ফিরে হরির লুটের শেষে সন্ধ্যায় মাটিতে পাত পেড়ে একান্নবর্তী পরিবারের শখানেক মানুষ সারি ধরে পাঁচদিনের নিরামিষ আাহারশেষে কালোজিরা ইলিশের পাতলা ঝোল আর দেশি নানাজাতের মাছের কালিয়া, মুড়িঘণ্ট দিয়ে ভুরিভোজন শেষে দশমীর মিষ্টান্নভোজন বিদায়ের কষ্ট কিছুটা লাঘব করে। আজকে রবিবারের সকালটাও তেমনি বৃষ্টিময়। আকাশে পরদেশী মেঘ আর মনে পুরানো দিনের গল্প। আজকে অনেকেই আর বেঁচে নেই। দাদুদিদিমা গত হয়েছেন বহুবছর। গোল হয়ে সবজি কাটতে বসা সেই মহিলাদের অনেকেই গত হয়েছেন। মান্না দে’র কফিহাউজের টেবিলটার মতো নতুনেরা স্থান করে নিয়েছেন এখন। আর্তরাইটিসে আক্রান্ত মা এখন আর রান্নার নেতৃত্ব দিতে পারেন না, নতুনরাও রান্নাবিষয়ে আত্মবিশ্বাসী নয়। সঙ্গত কারণে পুজোর পাঁচদিন বাড়িতে আসেন রান্নার ঠাকুর।

আগের অনেককিছুই বদলে গেছে। বাড়ির পুজোর বাজেট বেড়েছে প্রায় পনেরো গুণ। অদ্ভুত কারণে বহুবার দেশে গেলেও গত বারোবছর পুজোয় দেশে যেতে পারিনি। তাই এ-সময়টায় আনন্দের সাথে মনেও ভর করে বিষাদের মেঘ। মনে পড়ে শৈশবের উদযাপনের দিনগুলো। নতুন শার্ট, প্যান্ট আর জুতোর বায়না। এখনো বাড়িতে ফোন দিলে নতুন কাপড় কেনার জন্য মায়ের তাগিদ সেইসব দিনে টেনে নিয়ে যায়।

যা-ই হোক, আজ থেকে পুজোর ক’টা দিন আমাদের দুজনেরই ছুটি। পশ্চিমা লন্ডন শহরের তাড়া একেবারেই নেই। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলাম। ওদিকে মৌনি আলুর দম আর লুচি বানাচ্ছে। ভুরিভোজন শেষে ছবি আঁকা হবে। মৌনি ছবি আঁকবে। আমি আর আমাদের ছোট্ট মেয়ে আরুষি বিকেলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানবাজনা করব। সন্ধ্যায় বেরোবো ইস্টলন্ডনের ইলফোর্ডে ঠাকুর দেখতে। আপাতত মৌনি ভোজনের বন্দোবস্ত করছে, এদিকে আমি আর আরুষি শুনছি মান্না দে’র কণ্ঠে শ্যামাসংগীত :

সব ঘৃণা ভুলে তোমার আঁচলে
মুছে দাও সযতনে, বড় ময়লা জমেছে মনে
সময়ের পথে চলে যেতে যেতে
কত ধুলা লাগে নোংরা জগতে
ছুঁয়ে ফেলি ধুয়ে ফেলি
তবু থাকে জীবনে।
বড় ময়লা জমেছে মনে  …

… …

অসীম চক্রবর্তী

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you