আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগেকার ঘটনাবলি স্মৃতিতে এখনও টলটলে। এর আগের স্মৃতি ইয়াদ হয় ইনডিরেক্টলি, বিভিন্ন বয়সী গুরুজনের কথাবাহিত হয়ে সেইসব স্মৃতিচিত্রকল্পগুলো মগজে গেঁথে গেছে, ডিরেক্ট মেমোরি বলতে যে-ঘটনাবলির সঙ্গে সরাসরি নিজে দণ্ডায়মান এবং যা আমি স্মৃতিরিভিয়্যু করে ভিশ্যুয়্যালাইজ করি হামেশা। আমি হিসাবকিতাব সেরে দেখেছি ডিরেক্ট স্মৃতির ঘটনামালা আমার ক্ষেত্রে তেত্রিশ বছর আগে প্রথম সংঘটিত হয়েছে। এই বছরগণনা প্রতি বছর একটা করে বাড়বে, ন্যাচারাল নিয়মে, বলা বাহুল্য।
কুর্বানির সিজনে ছেলেপুলেদের ভিতরে একটা আশঙ্কামিশ্রিত দোলাচল কাজ করত যে ফ্যামিলিতে এইবার কুর্বানি দেয়া হবে কি না। বাপচাচারা আগে থেকেই ডিক্লেয়ার করতেন, ছদ্মঘোষণা আসলে, পয়সাকড়ির টানাটানি বিধায় এইবার কুর্বানি দিতে পারবেন না। খাজুল হয়ে বসে থাকতাম ঘোষক বাপচাচাদের সামনে, একান্নবর্তী পরিবারে বাপ-চাচা মা-চাচিমা ভাইবোন-কাজিন নিয়া বাইশ-পঁচিশজন মেম্বারের পুরাই বিশ্বকাপ ফ্যুটবলটিম। ঘোষণার দুই-আড়াইদিনের ভিতরেই শুরু হতো আম্মা-চাচিআম্মাদের পিছনে ঘুরেঘুরে ঘ্যানরঘ্যানর। কুর্বানি দিতে হবে, না-দিলে ক্যাম্নে কি, দুনিয়ার সবাই কুর্বানি দিবো আর আমরা কি কাঙালের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকব? অতএব, গরু না হোক খাসি বা ভেড়া কুর্বানি দিলেও তো হয়। এই নিয়া জল্পনাকল্পনায় কাটত ছোটমহলের কুর্বানিপূর্ব কয়েকটি দিন।
পরে একদিন বাপচাচাদের মজলিশ বসে সিদ্ধান্ত হতো যে এইবার একটা মুর্গা কুর্বানি দেয়া যাবে বড়জোর, এরচেয়ে বেশি কুলিয়ে ওঠা যাবে না। আচ্ছা, আমরা ভাবতাম, নাইমামার চেয়ে মুর্গামামা। দিন-দুয়েকের মধ্যে কিনে আনা হতো মুর্গা একটা। লাল-ফিরোজা কালারের, ঘোড়ার মতো টগবগে তেজি, কেশর ফোলানো, পেখম ছড়ানো। কুর্বানিদিনের তখনও পনেরো-ষোলো দিন বাকি। দিনভর আমরা মুর্গার খিদমতে লেগে থাকতাম। লোকে জিগ্যেশ করলে বলতাম, কুর্বানির মুর্গা। দানা খাওয়াতে একলগে এগারোজোড়া হাত মুর্গার সামনে মেলে ধরতাম, আর মুর্গাটা গ্রীবা বাড়িয়ে খপ খপ করে একেকটা খুদে হাতে ঠুক্কর দিত। মুর্গার যত্নে লেখাপড়ার পাট প্রায় উঠেই যেত কুর্বানিপূর্ব পক্ষকাল আমাদের। বিদ্বান হবার পেছনে এই দিন-পনেরো পড়ালেখায় ঢিলে দেয়াটারে এত বড় কোনো অন্তরায় ভাবতেন না আমাদের বাপচাচারা।
তারপর ক্রমে কুর্বানিদিন আগায়ে আসত। দুই-তিনদিন বাকি থাকতে একরাতে ডেকে তোলা হতো ঘুম থেকে। ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠানে দেখতাম বড়সড় একটা গরু। কুর্বানির গরু। কম পয়সায় পেয়ে একটা গরু শেষমেশ কিনেই ফেলা গিয়েছে, এমন একটা ভাবের কথা বাপচাচারা আমাদেরে শোনাতেন। মুর্গার পাশাপাশি এই গরুটাও কুর্বানি দেয়া হবে। এরপরের দুইদিন গরুর আশেপাশে ঘুরঘুর করা, গরুর চোখ দিয়া কান্না ঝরছে কি না নীরবে এইগুলা নিরীক্ষণ করা, কার হাত থেকে গরু লম্বা ঘাসের ডাঁটাটা খাইল ইত্যাদি নিয়া লাফালাফিই ছিল দিনকাবারি কাজ আমাদের। মুর্গার যত্নআত্তিও চলত, তবে আগের মত্ততায় একটু কমতি চলে এসেছে দেখা যেত।
মূল ঘটনাটা ঘটত কুর্বানিদিনের সকালবেলায়। মুর্গাকে আমরা ভাইবোনেরা মিলে গোসল করালাম, গরুর গোসল বাপচাচা বা জ্ঞাতীদের কেউ করাইতেন। ঈদের নামাজ পড়ে এসে আব্বা-কাকারা হাঁক পাড়তেন গরুকুর্বানির কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে নিতে, বেইল চড়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। ছোটমহলে তখন শুরু হতো মাতম। এই গরু কুর্বানি দেয়া যাবে না। কান্না করছে যে-গরুটা তারে কি কুর্বানি দেয়া যায়? আমরা গরুর চোখ বেয়ে নামা কান্নার রেখা দেখাইতাম আব্বা-কাকাদেরকে ডেকে। সুপারিগাছের সঙ্গে বেঁধে-রাখা গরু, গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে শেষগোসলের পানি, মুখের সামনে মাটিতে ঘাসের খাবলা রাখা কিন্তু মুখ নিচ্ছে না সে একবারটিও স্তূপীকৃত সবুজ-কচকচা ঘাসে, সে বুঝে ফেলেছে খেয়ে বাঁচবার দিন তার ফুরিয়েছে এই ভবে, এইসব দেখিয়েও বড়দের কসাই মনে রেখাপাত ঘটাইতে পারতাম না আমরা। তারপর একসময় দাদিস্থানীয়দের মধ্যস্থতায় রফা হতো মুর্গা কুর্বানি দেয়ার দরকার নাই, কিন্তু গরু কুর্বানি দিয়ে দেয়া হোক। আমরা সান্ত্বনা খুঁজে পেতাম গরুর বিনিময়ে মুর্গাটাকে জবাইয়ের হাত থেকে বাঁচাইতে পেরে।
এরপরের বছরের কুর্বানি আসার আগ পর্যন্ত অনেকদিন আমরা মুর্গাটারে পেলেপুষে বাড়তে দিতাম, একদিন কোনো দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাড়িতে কুটুমখেশ এলে সেই মুর্গাটা আমাদের অগোচরে কতল করা হতো। ইশকুল থেকে ফিরে এসে আমরা আর মুর্গাটাকে দেখতে পেতাম না। কয়েকদিন আম্মা-চাচিআম্মার লগে রাগারাগি-আস্ফালন আর ঘরের দরোজা ধিড়িমধিড়িম করবার পরে ফের কুর্বানি এসে যেত বছর ঘুরে, ফের একটা কুর্বানির মুর্গা পালতে পেতাম আমরা। নাটকের পুনরাবৃত্তি হয়েছে আমরা ডাঙ্গর হবার আগ পর্যন্ত টানা কয়েক বছর।
এই গল্পটা ইয়াদ হয় আজকাল কুর্বানিসিজনে কয়েকটা কারণে। এক হচ্ছে, এর মধ্য দিয়া আমাদের বাপচাচারা সংসারের নিষ্ঠুরতাটা যেমন দেখাইতেন তেমনি মায়ামমততার জায়গাটাও সফলভাবে শেখায়ে গেছেন আমাদেরে। একটা মুর্গা পালাপোষার ভিতর দিয়া আমরা যে লেসন লার্ন করে গেছি, এর তুলনা নাই বুঝতে পেরেছি বড় হয়ে। এছাড়া বাপচাচারা সর্বশক্তিমান, এই শিশুতোষ ভুল বোঝাটা আমরা শুধরে নিতে পারতাম এইরকম কন্ট্রোলড নাটকের মাধ্যমে। বাপচাচারা টাকার অভাবে কুর্বানির পশু কিনতে পারেন না, তারপর অনেক কষ্টে একটা জুটাতে পারেন ঈদের দিন-দুই আগে, এই জিনিশটা আমাদেরে যেমন নরম করে রাখত তেমনি জীবনে আরও পয়সাকড়ি কামাইবার ইচ্ছাও যোগান দিত মনের ভিতরে। এখন দেখতে পাই বীরবিক্রমে আমার বয়সী বাপচাচারা হাট থেকে কুর্বানির একটা ধামড়া সিন্ধি বা ফিজিয়্যান কিনে এনে সেল্ফি খিঁচেন আর বীরবিক্রমে ছেলেপুলে সমভিব্যহারে কুর্বানি দেন। এইগুলো দেখি আর ফিরে ফিরে নিজের ছেলেবেলাটারে দেখি।
লেখা : সুবিনয় ইসলাম
… …
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
- নগরনাট সঞ্জীবস্মরণ - November 21, 2019
COMMENTS