রবি ঠাকুরের দল (২) || অশীন দাশগুপ্ত

রবি ঠাকুরের দল (২) || অশীন দাশগুপ্ত

রবিবাবুর সঙ্গে তাঁর দলটির তফাৎ আছে। এই তফাতটুকু না বুঝলে এই নিবন্ধে মূল যুক্তিটা বোঝা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ সাধনমার্গের পথিক। নিখিলেশের যে উপলব্ধি আর যে তেজ সে-বস্তু সাধারণ জীবনে মিলবে না। কিন্তু এমন অনেক লোক মিলবে যারা নিখিলেশের মধ্যে নিজের আদর্শ দেখতে পাবে। জীবন যদি এমন হয় যে, আদর্শকে আদর্শ বলে চেনা যায় কিন্তু জীবনের দিনগুলিতে আদর্শ বজায় থাকে না, তাহলে তেমন ক্ষোভ নেই। আদর্শের স্বীকৃতিটাই প্রথম কথা। জীবনে কে কতটুকু করতে পারব জীবনই ঠিক করে দেবে। এমন হতেই পারে বিপদের মধ্যে পড়ে শোণিত ফুটে ওঠা দূরে থাক, শোণিত ঠাণ্ডা হতে থাকে। কিন্তু মনে রাখা দরকার কাঠবিড়ালিও সেতুবন্ধনে সাহায্য করেছিল। আদর্শকে আদর্শ বলে যারা চিনতে পারে তারাই রবি ঠাকুরের দল। কী করবে, বলতে পারি না। হয়তো কিছুই করবে না, আঙুল কামড়াবে। কিন্তু এই লোকগুলি সন্দীপের সঙ্গে নেই। পরের জিনিস কেড়ে নেওয়ার ঝোঁকটা এদের মধ্যে নেই। সেজন্য ভাবি এই নিরীহ ভালোমানুষগুলির মধ্যে রবি ঠাকুর আজও বেঁচে আছেন। এদের মধ্যে সমাজের আদর্শ বেঁচে রয়েছে। অন্য পক্ষ দলে ভারী বলেই এদের স্মরণ করছি। এদের কাছে বেশি বীরত্ব কিন্তু আশা করবেন না।

নিখিলেশ ক্ষণজন্মা পুরুষ। প্রয়োজন হলে সে লাঠির সামনে মাথা পেতে দিতে পারে। বলতে পারেন, এ একরকম শরীরের সাহস। অবশ্য অন্যকে আঘাত করার ইচ্ছা না থাকলে শরীরের সঙ্গে মন মিলে যায়। সাহস সত্যকার বীরত্ব হয়ে ওঠে। তবু স্বীকার করতে হয় বিমলাকে যেদিন নিখিলেশ ছুটি দিলো সেদিন সাহসের অন্য একটা রূপ সে যেন দেখাতে পারল। মনের অভ্যাস কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন। উত্তেজনার মুহূর্তে জীবনপণ করার যে শারীরিক সাহস সেটা দুর্লভ কিন্তু অভাবনীয় নয়। আগেই বলেছি সন্দীপের উপর রবি ঠাকুর যদি রাগ না করতেন তাহলে সে পালাত না। ঘটোৎকচের মৃত্যু তো বীরের মৃত্যু। কিন্তু ঠাণ্ডা রক্তে বিশাল আশার মৃত্যু মেনে নেওয়া অন্য দরের বীরত্ব। নিখিলেশ যখন বলে : “তবু যেন প্রাণপণে বলতে পারি, হে সত্য, তোমারই জয় হোক”, তখন চমকে ভাবি এ তো অনেক পরের কথা, আগে এসে গেছে। ক্ষুব্ধ চিত্তে স্বীকার করি রবীন্দ্রনাথের মনে সব ভাবনাই বোধহয় ছিল, সময় বুঝে কখনো কোনোটা এগিয়ে এসেছে। এই একজন মানুষ যাকে নিয়ে বেশি অঙ্ক কষলে ঠকতে হবে। নিখিলেশের এই সাহসটুকু লক্ষ করুন। শরীরের মৃত্যু এর কাছে তুচ্ছ। মনের মৃত্যুটুকুও বোধ করি মেনে নিচ্ছে। এই সাহস থেকেই স্রোতের উল্টোদিকে যাওয়া।

রবি ঠাকুরের দল এমন করে উজান বেয়ে চলে যাবে, এমন ভরসা করি না। উজান বাইবার সাহস নিখিলেশের ছিল, অন্যের নেই। কিন্তু সাহসকে সাহস বলে স্বীকার করার ক্ষমতাটুকু তো রয়েছে। এই সাহসকে মূর্খতা বলে যারা হাসে, তাদের দল ভারী না করার যোগ্যতাটুকু তো রয়েছে। এইটুকুকেই যথেষ্ট মানি। এরপরে যদি এই জায়গা থেকে এগোনোর ক্ষমতা কারোর লক্ষ করি তাকে সাধুবাদ দেওয়ার শক্তিটুকু যেন থাকে। যেন বলতে পারি, সে আমাদেরই লোক।

চলবে

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you