গেরিলা রকারের নস্টালজিয়া || তানভীর হোসেন

গেরিলা রকারের নস্টালজিয়া || তানভীর হোসেন

আসি আসি বলে তুমি আর এলে না

যুদ্ধফেরত এক গেরিলা যোদ্ধার মেলোডিক হুংকার। যেন প্রেশার-কুকারে হিস হিস শব্দে সেদ্ধ-হতে-থাকা সুস্বাদু প্রথম শ্রেণির আমিষ। এখনকার টেকি সেটআপে তখনকার আজম খান যদি গানটা গাইতেন তবে এই মহাবিশ্ব সম্মোহনের চোটে নিজের মাথায় যে গুলি চালায়া দিত না তার কোনো ভরসা নাই।

আমার অবশ্য তা লাগে নাই মানে টেকি আবহ মিস করি নাই। ছোটবেলায় গানটা বাজত রেগ্যুলার চাচাদের সদ্য ১৮/২০-এর চিরন্তন অবদমিত বাঙালি যৌবনে ক্যাসেটে টু-ইন-ওয়ানে। বিশ্বরোডে এমন শীতের মৌসুমে দাপায়ে বেড়ানো পিকনিকের কত না বিচিত্র বাস! তাদের কোনটা ছাদে রাখা মাইকটিতে আজম খান বাজাল না বলে দেয়া যায়।

একটা মজার অব্জার্ভেশন আছে। ব্লুজ, জ্যাজ, রকের প্রত্যেকেরই খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হইল বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। আমরা যখন ছোট, আজম খান ততদিনে শারীরিকভাবে প্লাটু থেকে ভূপাতিত, ধরাশায়ীপ্রায়। কিন্তু তার গান, ওই যে বললাম, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাজানো থামেনি।

টিভিতে কালেভদ্রে যে আজম খানকে আমরা দেখতাম তা আসলে ছিল সত্তর দশক থেকে আশির ধ্বংসাবশেষ। আর ছিল তার বিচিত্র দেহভঙ্গিমা যা দেখে টিভির সামনের দর্শকদের খুব মজা নিতে দেখতাম।

আমার মনে হয় পূর্ণ যৌবনের রাফ অ্যান্ড টাফ ল্যুকের সাথে যখন তিনি এই কায়দার ভঙ্গিমায় রকাইতেন তখন তার পাশে রবার্ট প্লান্টকেও নস্যি দেখাইত।

REW-লেখা বাটনটার মানে যে পুনর্বার তা জানতে আমাদের Rewind শব্দটা জানতে হয় নাই — কিছু গানই যথেষ্ট ছিল বরং।

প্রথম অন্তরার প্রথম লাইন ‘অভিমান কেন করে’ — এই লাইনের দ্বিরুক্তির প্রথমবারে ‘করে’ শব্দটা বলার ধরনে খুব খিয়াল। আর দ্বিতীয়বারে ‘অভিমান’ বলার ধরনে আরেকবার খুব খিয়াল। কলিজা কেঁপে উঠতে বাধ্য যে-কারও। একই লাইনের দ্বিরুক্তিতে ভিন্ন দুইটা শব্দে প্রেশারাইজড মেলোডিক জোর দিয়া যিনি গান তারে মায়েস্ত্রো বলা ফরজ।

দ্বিতীয় অন্তরার ‘ঝড়ে পাখি পড়ে কভু কি ফেরে নীড়ে’ তুলনামূলক সোবার, নরম কিন্তু কী বেদনাময় আর ঠিক তারপরই আবার সেই রেজ এসে ভর করে গেরিলা রকারের স্টেনগানিস ভোকালে — ‘আমিও চলেছি বহুদূরে’ — এই যে ‘বহুদূরে’-তে এক অনন্ত, পৌনপুনিক শব্দের মতো আপনার স্নায়ুতে রেখে যাবে শ্রবণানুভূতির অসীম স্থায়িত্বকাল। যেন যে কোনো ঝড়মুখর বিকালে জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে থাকা যে-কোনো মানুষ সেই কালের মধ্যে সেই তীব্র রেজের সাথে নিজেকে রিলেট করে নিতে পারে অবলীলায়।

অন্তরার ফাঁকে ফাঁকে থাকা ‘তুরু রু রু রু রু রু রু / লালা লালা লালা লা / তু রু রু তু রু রু / লালাল লালাল লা’ রিফ্রেইনটা যা সাধারণত কোরাস হয়, এখানেও হাল্কা গলা কেউ মিলাইছিল কি না বোঝা যায় না (পুরানা রেকর্ডের কারণে)। দুর্দান্ত এক ইয়ারগাজমের ভেতর দিয়া নিয়ে যেতে থাকে। দুই পাশে থাকা লাইনগুলি যেন চিৎকার করে বক্তে থাকে কত ভালোবাসে তারা এই ইম্প্রোভাইজেশনটা, এর হার্মোনিটা।

আর আছে যোদ্ধার যুদ্ধপরবর্তী রেজারেকশানের সেই চরম উপলব্ধি। আপনি এইটাকে রোম্যান্টিক বলবেন না রাজনৈতিক তা আপনার ব্যাপার। আর তা ফোটে জ্বলজ্যান্ত হয় এই লাইনটায় — ‘জানি না কে হারে কে জিতে’; আর এখানেও সেই অনন্ত অসীম এ এ এ এ এ … ।

এসবের মধ্যে দিয়া আমাদের অজান্তেই প্রমাণিত হয়ে যায় আজম খান পপসম্রাট নন, রকসম্রাট; তার কোনো শরিক নাই।

… …

 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you