‘ধান কাটা হয়ে গেলে পরে…’ : স্কুলজীবনের মতো কইরা ব্যাখ্যা || তানভীর হোসেন

‘ধান কাটা হয়ে গেলে পরে…’ : স্কুলজীবনের মতো কইরা ব্যাখ্যা || তানভীর হোসেন

“এমন কিছুই নাই যারে কল্পনার মোচড়ে অন্যকিছু বানাইয়া দেয়া যায় না” — কইছিলেন কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস্।

ইমরুল হাসান শুনতেছেন নিজেরে। মুছে দিতেছেন ইরেজারে, আবার শুনতেছেন নিজেরে, মুছে দিতেছেন, এইভাবে বারবার। যেহেতু নিজেরে শুনতে কান লাগে না সেহেতু নিজের বাইরের জগৎ শুনতে লাগে। তিনি শুনতেছেন সেইটাও। উপেক্ষা করতেছেন না কিন্তু মোটেও। সাগ্রহে-বিগ্রহে আনন্দে-ঘৃণায় পুইড়া তিনি সব শুনতেছেন আর শুনতেছেন। আর ভাবতেছেন মাওবাদীদের ঘর থিকা দূরে ফাঁকা একটা শিরোনামহীন বেওয়ারিশ ঘরটাই তার! সেইখানে বইসাই তিনি মাওবাদীদের স্বপ্ন দেখতেছেন।

বিশ্বাস করেন আর নাই-ই করেন, কবি-কবিতা ইত্যাদি নিয়া আলোচনা জগতের সবচে টাফ জবগুলার একটা। কবিরে ধার না কইরা জগতে না হইছে গান না হইছে যুদ্ধ না হইছে প্রেম না হইছে বিচ্ছেদ না হইছে ক্যাপিটালিজম না হইছে সোশ্যালিজম। কবিরে বাদ দেওয়ার হেডম দেখাইছেন একজনই আর তিনি হইলেন প্লেটো।
ক্যান?

সম্ভবত, এই কারণে যে কবিরা কনফিউজিং, রুবিক্স কিউব,অ্যাবরাকাড্যাবরা … স্কুবি-ডু-বিডু।

~ মিনিমালিস্ট
মিনিমালিস্ট আর্টিস্টিক অ্যাপ্রোচ আর্টের নানান মূল কাণ্ড শাখা পাতায় আপনি পাবেন। দ্বিতীয় যুদ্ধের পরে মূলত এর শুরু। এখন তো পোস্টমিনিমালিজমও শুরু হইয়া গেছে।

পড়াশোনা করতে গেলে দেখবেন দুনিয়ার যাবতীয় পাইওনিয়ারের খাতায় পশ্চিমাগো নাম অথচ আরেকটু ঘাঁটলেই পাবেন এগুলার অনেককিছুর শুরু তাদেরও বহু আগে এশিয়া আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি এলাকায়। আসলে আমরা হয়তো অর্থনৈতিক চিপায় পইড়া এগুলা এক্সপ্লোর করতে পারি নাই কিংবা করলেও কালচার মার্কেটে এগুলারে ট্যাগলাইন দিয়া পণ্য বানাইতে পারি নাই।

জাপানিজ হাইকু কিংবা খৈয়ামের রুবাই এগুলাই আপনের চেনাজানার মধ্যে মিনিমালিস্ট পোয়েট্রির জ্বলন্ত নমুনা হইতে পারে। তাছাড়া এজরা পাউন্ড, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস্, স্টিফেন ক্রেনদের লেখাপত্র তো আছেই!

একটু খিয়াল, পাউন্ড সা’ব ক্যান্টো  লিখছিলেন জানেন তো! কাদের দেইখা? পইড়া নিয়েন। আর বাংলাদেশে মিনিমালিস্ট ঘরানা আমি প্রথম দেখছি রিফাত চৌধুরীর কবিতায়।

তো সেই জায়গা থিকা ইমরুল হাসানের কবিতা মিনিমালিজমের চরম উদাহরণ। ইমতিয়াজ মাহমুদ ম্যাক্সিম লিখছেন, দেখা গেছে মজনু শাহ-র আমি এক ড্রপ আউট ঘোড়ার ওয়ান টু থ্রি লাইনার্স। দুইদিন আগে বগুড়ায় দেখলাম শোয়েব শাহরিয়ার লিখেছেন ‘সুভাষণ সংহিতা’। এইভাবে তিনি লিখতেছেন দারুণ লাইনগুলা—

যেই পাবলিক পারসোনাল
রাস্তার ধারে, গাছের কিনারে
মুততেছেই তবে?

পলিটিকস হয়ে দেখবা
আবার আসবো ফিরা

~ পপ কালচার, ফিট ইন করার প্রবণতা
২০১৯ সালে মেটাফরিকাল আলাপ সহ কবিতার অন্যান্য টুলসের ঘনঘটা থিকা বাইর হওয়ার চিন্তা না থাকাটাই অস্বাভাবিক ঠেকে। তারপরও কবিতা কি টুলসের বাইরে যাইতে পারে? মানে প্রথম যেদিন আপনি কবিতা লিখছেন সেদিনও আপনি জানতেন যে কবিতাই লিখতে চাইতেছেন আপনি, মানে কবিতা বিষয়ক একটা ডিফল্ট সেটিং আপনার মাথায় ছিলই।

তারপর আপনি ছ্যাঁকা খাইছেন বা সফল-বিফল কিছু-একটা হইছেন জীবনে, আপনার পোষা বিড়াল মাইয়া বিড়াল পাইয়া ভাইগা গেছে, কুত্তাটা কাটা পড়ছিল ট্রেনে, আম্মা মারা গেছিল বা আব্বা বা এমন-কেউ যারে চিনেনই না কিন্তু শকড হইছিলেন, বারে গ্লাসটা কনুইয়ের ঠোকায় পইড়া চিল্লায়া উইঠা ভাইঙ্গা গেছিল ব্লা ব্লা। আপনি ক্রাশ উইড ভাতভুত খায়া মোটা হইয়া গেছিলেন ডিপ্রেশনে মেলানকোলিয়ায়। এইখানে আপনি বড় হইয়া গেছেন বয়সে, কিছু একটা কইরা খাইতেছেন কিন্তু কানেক্ট করার একটা তাগিদ আপনের ভিতরে আছে টেক্সট দিয়া।

“ইয়ে দুনিয়া পিত্তালদি” লিখতেছেন যখন ইমরুল হাসান তখন তা তার জন্যে বুমেরাংই মনে হয়। বুমেরাং শব্দটারে রোমান্টিকতা দিয়া মাইখা খাইতেও পারেন না-ও পারেন তা আপনের ব্যাপার বটে।

ইনবক্স নিয়াও কথা আছে তার কবিতায়। আছে ইভোল্যুশন, ইয়েলো সাবমেরিন, অল্টারনেটিভ রক এমন আরও অনেক কিছু।

বিড়াল  নামের একটা কবিতা পাইলাম তার, বিবর্তনবাদরে এত সুন্দর কইরা কবিতার মতো জিনিশে ফিট করানোর উদাহরণ চোখেই পড়ে না।

~ উইট, ঘাড় ত্যাড়ামি
স্লোগান নাই কবিতাগুলায় একদমই। থাকার কথাও অবশ্য না কারণ তার টোটালিটির মধ্যে নিস্পৃহ এক কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারের ইনটেন্ট আছে। উইট বলেন বা স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গ আছে তার লেখায় ভালো পরিমাণেই। ডেমোক্রেসি  কবিতাটা এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।

~ ফিল্টারিং
ইমরুল হাসানের কবিতার ফিল্টারিং শুরু হইছে ভাষা দিয়া। এতদঞ্চলে যেহেতু মেজরিটি কবিতার ভাষা প্রমিত সেহেতু তার এই ভাষারীতি মানে অপ্রমিত (গতরাতে নব্য ধনিক শ্রেণির অবসংবাদিত প্রতিনিধি হযরতে সোলায়মান সুখনের ‘মুতিভেশনাল’ ভিডিওতে দেখলাম তিনি এরশাদ করতেছেন যে, এমন হইল গাঁইয়া। আবার এফবিতেই কার যেন স্ট্যাটাসে দেখলাম কবি আসাদ চৌধুরী এরশাদ করছেন যে স্কুল-কলেজের পোলাপাইন প্রমিতে কথা কইলে তাগো বেতানো উচিৎ!) তো একরকম ফিল্টারিংই আর-কি।

ভাষা যেহেতু যোগাযোগ ঘটায় সেহেতু ভাষার বড় রাজনৈতিক অস্ত্র আর নাই। ইমরুল হাসান ক্যান, ক্যাম্নে, কবে থিকা এই ভাষারীতি আপনাইলেন তা আমরা জানি না তবে জানতে চাই। এইটা তার কাছে আমাদের প্রশ্ন (?)

তার এই ভাষারীতি কি টানতে পারতেছে মানুষরে? টানলেও কাদের? তিনি কি সজ্ঞানেই একটা বড় অংশরে ইগনোরাইতেছেন না?

~ অব্জেক্টিভিজম
ব্যাপারটা এমন যে ইমরুল হাসান যখন লিখতেছেন ফুটবল নিয়া তখন তিনি তা ফুটবলের নিয়মনীতি মোতাবেক লিখতেছেন না, লিখতেছেন বরং কোনো-একটা খেলায় খেলোয়াড়েরা মাঠে ক্যামনে খেলছেন, ইম্প্রোভাইজ করছেন, লালকার্ড দেইখা বাইর হয়া গেছেন, ট্যাকল করতে গিয়া কার শর্টস হঠাৎ খুইলা গিয়া আন্ডারওয়্যার বাইর হয়া গেল এইরকম পার্সপেক্টিভ থিকা।

সবকিছুরে এইরকম তাজা ফ্যাক্ট হিসাবে দেখানোর ইচ্ছা তারে তার নিজের স্টাইলের মধ্যেই অনেক স্পেইস আইনা দেয়। ফলে ঘটনার ধারাবাহিকতায় আগানোর পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক শর্টকাটও যেমন কাজে লাগাইতে পারছেন আবার লাগানও নাই কোনো কোনো জায়গায়।

~ নাটশেল
আসলে কবিতা তাদের কাছেই বিমাতাসুলভ যারা নৈমিত্তিক জীবনটারে বুইঝা উঠতে পারেন না ঠিকঠাক। তো এই ২০১৯ সালের বাংলা কবিতায় ইমরুল হাসানের কবিতারে আমরা যে জায়গাটা দিতে পারি তা হইল, নৈমিত্তিক মানুষেরা যে আরাম নিয়া নিজের মতো কইরা কথা কয় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সেই আরামের ভাষায় তার লিখিত কবিতাগুলা মূলত কবিতার ওই বিমাতাসুলভ হইয়া ওঠাই ঠেকায়। কবিতারে মানুষের আরও কাছে নিয়া যাইতে থাকে। তিনি দেখাইতে পারছেন সাধারণ অনাড়ম্বর ভাষায় ক্যামনে একদম তাজা এক্সপ্রেশন বা রিয়্যাকশন দেখান যায় এবং ক্রিটিক্যাল চিন্তার ভেতর থিকা উইঠা-আসা নতুন নতুন ডাইমেনশনগুলারে সরাসরিই হোক বা কবিতার অন্যান্য টুলস ব্যাবহার কইরাই হোক পাঠকের কাছে পৌঁছান যায়।

এই তো হইল ঘটনা।

আমার গল্পটি ফুরালো
নটে গাছটি মুড়ালো।

এখন যান ইমরুল হাসানের কবিতা পড়েন।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you