আমার বাসায় টিভিসেট আছে, কিন্তু ক্যাবললাইন নাই। ফলে আমি বহু বিনোদন থেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত। এইটা একার অনুসিদ্ধান্ত বা প্রকল্প না কারো, বাসার সবার গণতান্ত্রিক ফ্রিডম অব চয়েস যে উইদাউট টেলিভিশন সংসার আমাদের। ফলে টিভি বলতে, ইলেকট্রনিক বিনোদন বলতে যে-যে সাস্পেনশন বোঝায় তা আমি জানি না সচেতনভাবে অনেকদিন। সকালে পত্রিকা পড়া মানে হেডলাইন দেখা। ইদানীং তা-ও দেখা হচ্ছে না। সংবাদ একটা বেচাকেনার ব্যাপার, প্রপাগান্ডামূলক ব্যাপার। তারা কখন যে সত্য লেখে আর কখন যে মিথ্যা বলে তা বোঝার জন্য সকালবেলা আপনাকে সুপারকম্প্যুটার নিয়ে বসতে হবে। দুইজন বিশেষজ্ঞও লাগবে সংবাদপত্র আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদের সত্যতা বের করার জন্য। আমার মতো সরল মানুষের পক্ষে পোস্ট-ট্রুথযুগে বসবাস করে ফেইক, জাল আর বানোয়াট সংবাদের পার্থক্য বের করা সম্ভবই না। সত্য বোঝার ও জানার আশা আমি রাখি না। ফলে, সকল অর্থে আমি তেমন একটা সমকালীন না। পেরুর রাজধানীর নাম আমি জানি না। সংবিধানের ধারা উপধারা তা-ও জানি না। মাঝে মাঝে ভাবি দেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, না জামাত চালায়? বুঝি না। ভাববেন না বইপুস্তক পড়লে সমকালটা জানা যায়। বই পড়ার সাথে সমকালীন থাকার তেমন কোনো সম্পর্ক নাই। আমি সাধারণত ৫০ থেকে ১০ বছর পুরানা বই বেশি পড়ি। সমকালীন যা যা পড়া দরকার তা বই-আকারে না পড়লেও হয় মনেহয়। কেননা যাদের সমকালে পড়া দরকার বই-আকারে তাদের সাহিত্য, চিন্তা, কর্মকাণ্ড, যাপন, অ্যাক্টিভিটি ইত্যাদি সম্বন্ধে একটা আইডিয়া আমার আছে। ফলে সমকালের বিশেষ কারো লেখা না পড়লেও একটা আইডিয়া আপনাআপনি পেয়ে যাবেন। ১০ থেকে ১৫ মিনিট সমকালের অনেকের উপর বলা ও লেখা যাবে তাদের না পড়লেও। সমকাল নিয়ে কিছু বলা ও লেখার জন্য এই কালের বহুকিছু না পড়লেও হয়। আমাদের অধিকাংশের চিন্তা যেহেতু অতীত দিয়ে ঠাসা, ফলে ২০ বছরের পুরানো জার্গনগুলো দিয়ে কিছু-একটা লিখতে পারলে পাঠকের ভালো হাততালি পাওয়া যায়। অতি পুরানা ভঙ্গিমার নানা রকম লেখা ও অপরের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত অনেক চিন্তা আছে আমার। শুদ্ধ কথা হলো মানুষের অধিকাংশ চিন্তাই অপরের ধার করা বা অন্য কোথাও থেকে ইন্সপায়ার্ড। মৌলিক চিন্তা একশ বছরে তিন-চারটা হয়। মার্কস, নিৎসে, ফ্রয়েড বছর বছর জন্ম নেয় না। বিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শন, নৈতিকতা, শিল্প সকল জায়গায় এদের কোনো-না-কোনোভাবে তাদের মৌলিক চিন্তার অবদান আছে। আবার মনে রাখা দরকার কেউই আকাশ থেকে নেমে আসা দেবদূত না। প্রত্যেকের গুরু ছিলে। ফলে আমার মনে হয় জ্ঞান কোনোভাবেই মৌলিক কিছু না। এটা একটা নর্মের শেয়ার্ড ফাংশন। ফলে জ্ঞানের জন্য সমকালের থেকে অতীত ভালো। তবে লব্ধ প্রজ্ঞা কাজে লাগাতে হয় বর্তমানে। ড্রেস, রুচি, ফ্যাশন, খাদ্যাভাস, পছন্দ সব মিলিয়ে আউটডেটেড আমি। পুরাতন, রেফারেন্স দেওয়া বইপুস্তক উল্টানো, পড়া ও সামান্য লেখালেখি, গান, মাঝে মাঝে সিনেমা ও মেয়ের সাথে লম্ফঝম্প, ঘোরাঘুরি, অপ্রয়োজনীয় তর্কাতর্কি, ভাব ও ভান এইগুলোই আমার অবসর, বিনোদনও। টেলিভশন না দেখলে তেমন কিছু হয় না। পত্রিকা রেগুলার পড়া নিয়মিত কালো ধোঁয়া সেবন থেকেও খারাপ। আমি পালিয়ে থাকি আমার সময় থেকে, বিশেষত সকালবেলা।
২
টিভি দেখার উপায় একটা আমার আছে বটে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে শ্বশুরালয়ে বসে আছি লিভিঙে। সামনে খোলা টিভি। ‘আজ আমার আশার অশ্ব কোথায় থামবে তুমি!’ রিমোট তুলে নিলাম। প্রথমে কিছুক্ষণ বাংলাদেশি চ্যানেল দেখলাম। বোরিং। সদ্যকালের বাংলা সিনেমার কিছু গান শুনলাম। বাংলা সিনেমার গানের দুইটা জিনিস পরিবর্তন হয়েছে। এক, গানের কথা। বাংলা সিনেমার গানকে এরা খুব সিরিয়াস অ্যাপ্রোচ থেকে দুনিয়াদারির মধ্যে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বাংলা গানে মমতাজের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সংস্কৃতিগবেষকরা এসব নিয়ে একদিন চিন্তাভাবনা করবেন। মাপ দিয়ে বের করবেন রবীন্দ্রনাথ কাম পুতুপুতু বাংলা সিনেমার গান কার কার অবদানের কারণে সমকালীন হতে পেরেছে। আগুনের গাওয়া ডিপজলের মুখের গান ও মুনমুন বা ময়ূরীর লিপে গাওয়া গান বাংলা সিনেমার গানকে মুক্তি দিয়েছে। দুই, নায়ক-নায়িকার ড্যান্স আগের থেকে ফাস্টার। তবে তাদের কোনো উত্তরসূরী নাই। তারাই আগামীর রঙে-রসে ভরা নাচগানের নবীন ইন্টার্প্রেনর। বউ পাশে থাকার কারণে নায়িকাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। এরপর দেখলাম বোরিং সংবাদপাঠ। বিটিভির যুগে যেভাবে কণ্ঠশীলনের মাধ্যমে সংবাদ পড়া হতো, এখনো তেমন। বিরক্তিকর। কোনো পরিবর্তন নাই। সবগুলো চ্যানেলের সংবাদপাঠপদ্ধতি ও খবর একই রকম। এরা কেন যে সম্মিলিতভাবে একটাই সংবাদের রের্কড ভার্শন চালাতে পারে। মৌলিক পার্থক্য যেহেতু নাই হুদাই তারা আলাদা-আলাদাভাবে একই সংবাদের পেছনে দশজন দৌড়ায়। অর্থ ও সম্পদের বিপুল অপচয়। এরপর গেলাম বাঙালির জীবন মানেই জি বাংলায়। বুঝলাম বিজেপি কেন সামনে পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় যাবে। ভগবান আর নিয়তিকেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে তাদের কোনো সিরিয়াল নাই। হিন্দুত্ববাদের মহা উৎসব চলছে কলকাতাকেন্দ্রিক চ্যানেলগুলোয়। আমার ভাবতে অবাক লাগে পশ্চিমবাংলায় একসময় বামরা ছিল ক্ষমতায়। এখনো তো নামে বামই চলছে টুপি মাথায় দিয়ে। কলকাতার কালচারাল উৎপাদনটা তাহলে এইসব! মব কালচার হলো সমাজের আয়না। বোদ্ধাদের শিল্পসাহিত্য দিয়ে সমাজ বোঝা যায় না। বোদ্ধারা যা লেখে সমাজ তার থেকে বহুদূর দিয়ে হাঁটে। সেই কারণে কলকাতার ভেতরে কী হয়ে গেছে তা বোঝার জন্য জি-বাংলাসম চ্যানেলগুলোর উপর চোখ রাখুন। তারা বিজেপির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। শুধু শরীর সায় দিচ্ছে না এখনো। মমতা আপার এগুলো দেখা দরকার। তার কালচারাল ফ্রন্টগুলো কাজ করছে না। কালচার যেখানে হারাতে থাকে বুঝতে হবে সেখানে নতুন রাজনীতি তৈরি হচ্ছে। সেই হিসাবে ‘নতুন বাংলা’য় নতুন হিন্দুবাদী রাজনীতির উত্থান হতে বড়জোর ৫ থেকে ১০ বছর লাগবে। মজার বিষয় হলো আমাদের দেশে সিনেমা ও সিরিয়াল বানায় বোদ্ধারা। ফলে আপনি বাংলাদেশের টিভি দেখে সমাজের কিছুই বুঝতে পারবেন না। বাংলাদেশের টিভি দেখে বোঝার উপায় নাই এই দেশে রামু ট্রাজেডি হতে পারে। নিরাপদে মানুষ মরে যেতে পারে। মন্দির, বিগ্রহ ভাঙা হতে পারে। তবে জি বাংলা দেখে বোঝা যায় পশ্চিমবাংলায় বিজেপি কায়েম হবে অচিরেই। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো চরম ও পরম সেক্যুলার সেজে বসে আছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কী হচ্ছে তার খোঁজ তারা রাখে না। সেক্যুলারিটির জায়গা থেকে বাংলাদেশের ও নতুন বাংলার চ্যানেলের পার্থক্য আছে। হিন্দুত্ববাদ ভারতে হলো ঐতিহ্য। সেটার সাথে যে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধ তারা কাটিয়ে উঠেছে ওয়ার অন ইসলামের মাধ্যমে। আর আমাদের মিডিয়ার সংস্কৃতি ও চিন্তার দার্শনিক গুরু হলো দিল্লি বা পশ্চিমা মিডিয়া। ফলে তাদের অনুকরণে এখানে হামদ-নাত তেমন একটা পাবেন না। ইসলামবিযুক্ত মিডিয়া এখানে। কারণ ধর্মের সাথে বাংলাদেশের উপযোগী সেক্যুলারিটির হিসাবপত্র আমরা মেলাতে পারিনি এখনো। ফলে সেক্যুলারিটি মানে বিদ্বেষপূর্ণ একটা ব্যাপার এই দেশে। ধর্ম নিয়ে ভীতিগুলো আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে কাটিয়ে ওঠা দরকার। জি বাংলা দেখে বহুকিছু বুঝলাম। এরপর দেখলাম হিন্দি সিনেমা চ্যানেল, মানসিকতা যেহেতু দিল্লিমুখী আমাদের। ফলে শিখলাম, আপনি নায়ক হলে, মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টা বাজান। মনের আশা পূর্ণ হবে। আরেকটায় দেখলাম রাধাকৃষ্ণ মূর্তি। নারায়ণ নারায়ণ। রাম রাম। নায়ক, নায়িকা, তাদের বাব-মা মন্দিরে মঙ্গলকামনায়। নায়কের ঘণ্টা বাজানোর শব্দে বৃষ্টি নামে। ঝড় ওঠে। মিরাকল ঘটতে থাকে। সে-এক স্যুরিয়ালিটিতে ভরা জগৎ। এমন অনেককিছু ঘটতে থাকে। আমার প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের সিনেমায় নায়ককে নামাজ পড়তে দেখেন না কতদিন? মনে করে বলুন তো! নায়কদের বাপ-মাও নামাজ কাজা করা শুরু করেছে। তাদেরও তেমন-একটা নামাজ পড়তে দেখা যায় না। আপনারা যারা সেক্যুলার তারা লক্ষ করে দেখবেন হিন্দি সিনেমা থেকে বাংলাদেশি রিকশাওয়ালাদের সিনেমা অনেক বেশি প্রগতিশীল ভাবাপন্ন আপনাদের প্রগতিশীলতার সংজ্ঞায়। ঠিক কি না? আসলে এই যে বাংলাদেশের সিনেমায় মানুষের ধর্মকর্মকে আড়াল করা হয়েছে তা কি সেক্যুলারিটির জায়গা থেকে? নাকি হীনম্মন্যতার জায়গা থেকে? আমাদের চলচ্চিত্রের লালসালু লিখল কারা কারা? কোন সময়ে? এই সমস্ত বাংলাদেশি নিম্নরুচির সিনেমায় আপনার আপত্তি কেন? সিনেমা দিয়ে প্রগতিশীলতার যা যা করতে চান, তার থেকে বেশি আপনি বাংলা সিনেমা দিয়ে করছেন। জনপদের বৃহৎ অংশের জীবনের নানা চর্চাকে লুকিয়ে ফেলতে পারছেন সিনেমা থেকে। বিরাট পাওয়া এটা বাংলা সিনেমার!!! ঋতুপর্ণ ঘোষদের মতো অতি সেক্যুলার ধার্মিকদের সিনেমায় ঢাকের শব্দ, পুজোর দৃশ্য থাকলে সমস্যা হচ্ছে না। আর এখানে টুপিটা পর্যন্ত আপানারা খুলে নিয়েছেন। আপনারা আরো লক্ষ করবেন যারা হিন্দি ছবি দেখে তারা বেশি মাত্রায় অপ্রগতিশীল। নারীকে পণ্য করে দেখে। বাংলা সিনেমার শিক্ষা মেয়েরা ‘মা ও বোন’। বাংলা নিম্নমানের সিনেমা সমাজে অধিক নারীবাদী। এটা বড় বিষয় বাংলা সিনেমার। আমাদের সিনেমা বিনোদন থেকে বেশি বেশি সামাজিক শিক্ষামূলক হয়ে উঠতে চায়। টিভি দেখতে দেখতে মনে হলো বাংলাদেশিরা বেশি কাজের সিনেমাশিল্পে। সিনেমার প্রযুক্তিকে সিনেমা জ্ঞান করবার মতো হতভাগা কাজটা করেছে বোদ্ধারা। আগেই বললাম সমাজ যেমন না তেমন সিনেমাই তৈরি করে আমাদের দেশের বোদ্ধারা। হতাশার হলো এদেশে সিনেমা বানায় জ্ঞানীলোক। ফলে, জীবন থেকে ক্যামেরা, মিউজিক, শট এগুলো মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। তারা সিনেমা বানায়ও জ্ঞানীলোকদের জন্য। ফলে, এগুলো অদেখাই রয়ে যাবে যুগের পর যুগ। মালেক আফসারী বা কাজী হায়াৎ নিম্নমানের যা যা বানান তার জন্য ফারুকীর মতো আনন্দবাজারের দিকে তাকায়ে থাকতে হয় না তাদের। এইটাই আপাতত আমাদের সমকালীন সিনেমার ইতিহাস। বাংলাদেশের সিনেমা বানাতে হলে বাংলাদেশের ভেতরের দিকে তাকাতে হবে।
১ঘণ্টায় ৬০টা চ্যানেল দেখে আমিও বোদ্ধা হয়ে উঠলাম।
… …
- কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব - February 15, 2020
- মুখোমুখি গুন্টার গ্রাস || মৃদুল মাহবুব - January 6, 2020
- হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব - December 15, 2019
COMMENTS