কাজী নজরুল ইসলামের এইসব নিয়া তো অনেক লেখা হইছে। অনেক লেখা পড়ি নাই; তারচে বেশি আসলে পড়তে পারি নাই। কারণ আলাপের একইরকমের প্যার্টানটাতেই আটকাইয়া গেছি; যারা লিখছেন, উনারা হয়তো বলছেন নতুনকিছু, কিন্তু পুরানা-ভঙ্গির ভিতর নতুনের-আশা আমার মইরা গেছে অথবা সাহিত্য যে খালি পুরানেরই রিপিটেশন এই আইডিয়াতেই আমল আনতে পারি নাই আর!
তো, কাজী নজরুল ইসলাম নিয়া নতুন কইরা আলাপ করার ইচ্ছা হইল কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিকথা বইটা পইড়া। উনার বইটাতে নজরুলরে নিয়া কয়েকটা লেখা আছে, ওইগুলার বেসিসেই কবি নজরুল ইসলামরে বোঝার একটা কোশিশ (নজরুল-এফেক্ট) করা।
কাজী মোতাহার হোসেন লিখতেছিলেন –
সে-যুগে (১৯১২) চোস্ত ভাষা বলতে বঙ্কিমী ভাষাই বুঝাত;… দেখা যায় ততদিনে (১৯১৯) ভাষাটা অনেকটা রাবীন্দ্রিক হয়ে এসেছিল আর ভাবও প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের থেকে ধার করা… একটা সময় (১৯২৬) লক্ষ করলাম, আমার ভাষার বঙ্কিমী ও রাবীন্দ্রিক ভাব কেটে গিয়ে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য এসে পড়েছে। দীর্ঘ সমাস, আর দুরূহ শব্দ বিদায় নিয়েছে; ভাষা হয়ে উঠেছে সহজ, প্রাঞ্জল আর বাহুল্যবর্জিত বা অনাড়ম্বর – যাতে পরিমাণমতো মূর্চ্ছনা থাকলেও গিটকারির প্রাধান্য নেই।(কাজী মোতাহার হোসেন, আমার সাহিত্যিক জীবনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতিকথা, প. ৭৩ – ৭৫)।
যদিও উনি ক্লেইম করছেন যে, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের চাইতে উনার ভাষা চেইঞ্জ হয়া আসছে, তত-একটা হয় নাই আসলে; বাহুল্য, অনাড়ম্বর আর প্রাঞ্জলতা – এইসবকিছু রয়া গেছিল বা আছে; এই যে চেইঞ্জ, এর গরিমা উনি দিছেন ওই সময়কার মুসলমান লেখকদের কনশাস এফোর্টরে, শিখা-গোষ্ঠীরে; হয়তো এইটা উনারে দাবি করতে হেল্প করছে, কিন্তু সাহিত্যে বুঝতে পারা এবং লিখতে পারা দুইটা আলাদা আলাদা ঘটনা; উনার ভাষা-বদল বইলা যদি কিছু ঘইটা থাকে সেইটা জায়েজ করার কথার মতো সাহিত্যিক উদাহারণ হিসাবে তার আগ পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামই আছিলেন।
নজরুল যতটাই কবি হইছেন তার কারণ উনার বিদ্রোহ, প্রেম, হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি জিনিস না; বরং ওই সময়কার এস্টাব্লিশড যে সাহিত্যরুচি তার বাইরে গিয়া উনি সাহিত্যরে ডিক্টেট করার ট্রাই করছেন, এই ভাষা-ব্যবহারের জায়গাটা এইরকম একটা ঘটনা। এইটাই উনারে আলাদা কইরা রাখছে, এখনো (আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাঁস গায়ি … গানটা শোনা যাইতে পারে এইখানে)। উনার ভাষা কিছু এফেক্ট রাইখা গেছে বাংলা-সাহিত্যে, কারণ দেখবেন এখন শব্দ তো আর খালি শব্দ না, এইটা দিয়া আপনি একটাকিছু বলার চেষ্টাটাই করতেছেন; এখন এর সিগ্নিফিকেন্স যারা আবিষ্কার করতে গেছেন, তারা এই প্রেজেন্সগুলারেই গ্লোরিফ্লাই করছেন নিজেদের সাহিত্যবুঝ দিয়া এবং কাজী নজরুল ইসলাম তার শব্দব্যবহার দিয়াই আইডেন্টিফাইড হইছেন এবং হইতেছেন।
এখন শব্দ তো আর খালি শব্দ না, এইটা দিয়া আপনি একটাকিছু বলার চেষ্টাটাই করতেছেন; নজরুলের এই বলার-জায়গাটা ঠিক ‘আধুনিক’ না এইরকমও বলছেন মনেহয় বুদ্ধদেব বসুরা। এর আন্ডারলায়িং মিনিংটা হইল যে, উনার শব্দের রেফারেন্সগুলা ইউরোপিয়ান কালচারের ভিতর থিকা আসে নাই। এর বিপরীতে মনে হইতে পারে যে, এইটা আসছে এক-ধরনের মুসলিম কালচারের রেফারেন্স থিকা (পরে ফররুখ আহমেদও এই রাস্তায় সার্চ করছেন); ওই সময়ের খেলাফত আন্দোলন হয়তো এইরকম একটাকিছু ভাবতে নজরুলরেও কনফিডেন্স দিয়া থাকতে পারে, কিন্তু ন্যাশন বা জাতির ভাবনা একটা ল্যান্ডের সাথেই জড়িত (একটা ইমেজারি বিষয় হইলেও) এবং নজরুলের মুসলিমজাতির যে ভাবনা (যদি সেইটা থাকেও) সেইটা ভারতভূমিতে নিজের জায়গা কইরা নিতে পারে নাই। [এইখানে এ.আর.রহমানের স্বদেশ গানটা শোনা যাইতে পারে, এমটিভি আনপ্লাগড-এর ভার্শনটা, হিন্দির লগে উনি উনার ভাষাটা ঢুকাইয়া দিছেন।] একটা সেন্স অফ অরিজিনালিটি থিকাই ন্যাশনের কল্পনাটা আসে; তার মানে এই না যে, একটা অরিজিনালিটি আছে, বরং একটা অরিজিনালিটিরে যে অ্যাজিউম করা, সেইটা নজরুল করতে পারেন নাই। ভারতভূমি থিকা সরতে গিয়া সনাতনভারত মানেই যে হিন্দুজীবন – বাঙালি সাহিত্যিকদের এই আবিষ্কারেই তিনি ফিরা আসছেন। হয়তো একটা সমঝোতায়ও যাইতে চাইছেন এবং তখন কিছুটা হইলেও ফিল করতে পারার কথা যে, এই সনাতনভারত একটা ইউরোপিয়ান অরিজিনালিটিরই ইনোভেশন।
নজরুলের কথা কোট কইরা মোতাহার সাহেব লিখতেছিলেন, একবার একটা প্রোগ্রামে যাওয়ার কথা, কিন্তু নজরুল দেরি করতেছিলেন এবং বলতেছিলেন :
রায়বাহাদুর খানবাহাদুররা অপেক্ষা করবেন না তো কি করবেন? জানো না আমার সঙ্গে তাঁদের কি সম্বন্ধ? আমি কবি আজ রাজপথ দিয়ে হাতিতে চড়ে যাব, আর রায়বাহাদুর খানবাহাদুররা রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আমাকে কুর্নিশ করবেন, – এই তো আমাদের মধ্যেকার আসল সম্পর্ক।
তখন নজরুল অলরেডি মোটরকারে চড়েন, কিন্তু বলতেছেন হাতির কথা; মানে, উনার সাহিত্যভাবনায় মোটরকার তো হাতিই একরকমের! আবার দেখেন, কবি নজরুলের বিদ্রোহ রায়বাহাদুর-খানবাহাদুরদের এগেনেস্টে, যাঁরা সোশ্যালি ডেড একটা ক্লাস; নজরুল সেই সমাজের পার্ট হইতে চান নাই যেইখানে কবি হইলেন অনুগত একটা প্রাণী, যদি ওই সমাজ স্টিল ভ্যালিড থাকতে পারে, ওইখানে উনি কুর্নিশ নিতে চাইছেন, উনার রেভোল্যুশন ওইটাই। যখন ফিল করছেন সেইটার কোনো ভ্যালু নাই, তখন আর পাত্তা দিতে চান নাই সেই সমাজরে। বরং বন্ধু হইতে চাইছেন পশ্চিমা-ঘরানার-দেশি সংস্কৃতির; যদিও পারেন নাই; যাওয়া-আসা ছিল হয়তো, তারপরও উনি আউটসাইডারই আছিলেন।
উনার প্রেমের ব্যর্থতাগুলা থিকা এইটা বোঝা যায়। আমরা ভিন্ন ইকোনোমিক্যাল ক্লাসে থাকতেই পারি কিন্তু আমাদের রুচিবোধ এক; প্রেমের লাইগা এইটা খুব জরুরি জিনিস (একই গান শোনা, আইপডে দুইটা হেডফোন লাগাইয়া; একই সিনেমা দেখা এবং ঠিক জায়গামতো হাসতে এবং মনখারাপ করতে পারা, এইরকম…)। ঢাকায় আইসা নজরুল প্রেমে পড়ছিলেন নোটনের এবং ফজিলতের; এই দুইজনের কারো কাছেই পাত্তা পান নাই উনি, কাজী মোতাহার হোসেনের অব্জার্ভেশনে। নোটনের কাছে তো উনি প্রেম নিবেদন করারই চান্স পান নাই, শেষে মেয়ের বাপেরে বই উৎসর্গ করা লাগছে।
আর ফজিলতের কাছ থিকা যেই রিজেকশনটা উনি পাইছেন সেইটারে ড্রামাটাইজ করার পরেও সেই সদমা হজম করতে উনার অনেক টাইম লাগছে। নোটন ঠিক আছে ব্রাক্ষ্ম-সমাজের লেডি, আপার-ক্লাস, সুন্দরী, এটসেটরা; কিন্তু ফজিলত তো মুসলমান, তারপরও কেন! কারণ আর যা-ই হোক, আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানও যে একটা ইউরোপিয়ান সত্তা, এইটা উনি বুঝতে পারলেও মাইনা নিতে পারেন নাই মন থিকা বা উনার সাহিত্যে উনি জিনিসটারে লোকেট করতে পারেন নাই আর। যদিও কাজী মোতাহার হোসেন অনুমান করছেন যে, ফজিলাতুন্নেসা দোজবররে অ্যাক্সেপ্ট করতে রাজি ছিলেন না; কিন্তু এই অনুমান ফজিলাতুন্নেসারে এইরকম একজন মেয়ে হিসাবেই পোর্টেট করে যিনি বিয়ার বাইরে প্রেমের এক্সিস্টেন্সের কথা ভাবতে পারতেন না। এইটা কাজী মোতাহার হোসেনেরই ফজিলাতুন্নেসাভাবনা, ফজিলাতুন্নেসার নিজের ভাবনা বইলা ভাবার কোনো কারণ নাই।
ব্রিটিশ শাসনের এগেনেস্টে নজরুল ইসলাম ফাইট করছেন পলিটিক্যালি; হয়তো এই কারণে ভিন্ন একটা কালচারাল গ্রাউন্ডে অপারেট করতে চাইছেন, কিন্তু এর বাইরে কোনো গ্রাউন্ড তিনি ক্রিয়েট করতে পারেন নাই। যেই মুসলিম-সাহিত্য তিনি তৈরি করছেন সেইটা পরে খালি মুসলমানের-সাহিত্য বইলা একটা ধারাতে পরিণত হইছে এবং হিন্দু-সাহিত্যিকদের পিঠ চাপড়ানিতেই খুশি হইছে। মুসলিম-সাহিত্যের প্রতিভা এই পর্যন্তই ছিল আসলে। মানে, এইগুলা ‘বৈচিত্র্য’ হিসাবে ভালোই, কিন্তু ওই পর্যন্তই; একটা চরকির ভিতরই তারা ঘুরতে থাকে; যেমন গরিবের সাহিত্যের বাইরে বড়লোকের সাহিত্য, গ্রামবাংলার সাহিত্যের বাইরে গিয়া যখন আপনি প্রবাসী সাহিত্য করেন, সেইটা ওই ‘বৈচিত্র্য’ পর্যন্তই আটকাইয়া থাকে। নজরুল এই সীমানাটারে ফিল করছেন এবং এক্সটেন্ডই করতে চাইছেন; অ্যাট-লিস্ট উনার পার্সোন্যাল লাইফের ঘটনাগুলিতে এইরকমটাই মনেহয়।
কারণ জীবন দিয়া আসলে সাহিত্যরে ব্যাখ্যা করা যায় না, বরং সাহিত্য দিয়াই জীবনরে বোঝার চেষ্টা করলে একটা সত্যর কাছাকাছি যাওয়া যাইতে পারে।
স্মৃতিকথা। কাজী মোতাহার হোসেন। নবযুগ প্রকাশনী। এপ্রিল ২০০৪। পৃষ্ঠা ১৪৮। মূল্য ১৫০ টাকা। প্রচ্ছদ শিশির ভট্টাচার্য্য
… …
- এন্ড্রু কিশোর আর ক্যাসেটে বন্দী আমাদের গানের জীবন || ইমরুল হাসান - July 22, 2020
- বাংলাদেশি সিনেমা : অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি ১ || ইমরুল হাসান - July 15, 2020
- আবারও কবিতার নয়া বই || ইমরুল হাসান - September 14, 2019
COMMENTS