নির্বেদঘন জীবনবেদে শান দেওয়ার অভ্যস্ত প্রথায় জৈবিক বিস্ফার সকল দশকের কবিতায় রাজত্ব করলেও নব্বইয়ে ব্যক্তিকবির মনোজগৎ বিবেচনায় নিলে এই ধারায় স্বচ্ছন্দ কবিদের জংশন ভাবতে পাঠকমন স্বস্তি বোধ করে। সংকটাপন্ন যুগবিশ্বের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে তাদেরকে পাঠ করা যায় এবং সময়বিশেষে সেটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আশিক আকবর যেমন উপভোগ্য হয়ে ওঠেন তাঁর তির্যক বচন, বিদ্রুপ আর সরস সময়-সচেতনায় :—
আকাশে মেলেছে বলাকারা ডানা
জমিন হয়েছে তার ধ্যানে ফানা
পাপিষ্ঠ আমি পুড়েছি প্রেমে
ফুলকড়ি দিয়ে তারে নজরানা
(কবিতার কবিতা)
…
একটা খতম জরুরি হয়ে পড়েছে।
একটা টসফায়ার জরুরি হয়ে পড়েছে।
জরুরি হয়ে পড়েছে একটা ডজফায়ার।
মানা যাচ্ছে না,
মানা যাচ্ছে না,
কুকুরের মতো একটা কুত্তাকাণ্ড,
হত্যাকাণ্ড,
চাই, চাই, চাই।
(শ্লোগান কবিতা)
…
আমার কবিতা আমার মতো হইলেই,
ছাইড়া যাইও না।
ব্রহ্মাণ্ডের একেক কবিতা একেক রকম।
একেক কবিও একেক রকম। ঝাঁকের কৈ গো,
বিল জলাতেও বিরিক্ষের ছায়া পড়ে।
কোনো কবির ছায়াতেই কোনো কবি বাঁচে না।
কবিতা বাঁচে না।
কবিতা এ এক স্রোতে
রক্তের উপর ভাসা সোনালি বুদ্বুদ।
(নিউট্রিনো)
রাজনীতি সচেতনা, যৌনতাড়না ও মরমি আবেশকে প্রতীকী রূপ দানের পরিবর্তে বিবৃতির ধাঁচে ডেলিভারি দেওয়ার প্রবণতা বাংলা কবিতায় নতুন নয়, তবু আশিক আকবরকে পড়তে ভালোই লাগে, কারণ তাঁর ব্যক্তিত্ব সেখানে অন্যের অনুকারী না হয়ে স্বকীয়ই থাকে। কবির ভাষাভঙ্গি ও শ্লেষে বাহুল্য নেই। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের প্রতীকী আবেদন নির্মাণে কষ্টকল্পিত সহজতা তৈরির চেষ্টা অনেক কবিকে খাটিয়ে মারে, আশিক আকবর সেখানেও ব্যতিক্রম! কষ্টকল্পিত সহজতা তৈরির কসরতে পাঠককে উত্যক্ত করার খায়েশ তাঁর নেই। জীবনকে যেভাবে যাপন করেন সেভাবে লেখেন বলেই হয়তো কবিতার প্রচলিত পাঠ্যতালিকায় কবিকে বিশেষ প্রভাবিত হতে দেখা যায় না।
আশিক আকবরের সঙ্গে এদিক থেকে মাহবুব লীলেনের সাদৃশ্য চোখে পড়ে। দুজনেই জীবনরসিক, সময় ও রাজনীতি সচেতন, এবং ঠোঁটকাটা। বিদ্রুপমাখা রসবোধে নিজের অনুভূতি তুলে ধরার সময় কবিতার জাত গেল টাইপের ভাবনা তাঁদেরকে তিলেক বিচলিত করে না। কবিতায় মৌখিক বচনের ডিরেক্ট পাঞ্চিং ভাষাকে উদোম করে ফেলে এবং সংগত কারণে কবিরা ও-পথ মাড়াতে সচরাচর দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। আশিক আকবর বা মাহবুব লীলেন ওসবের তোয়াক্কা করেন বলে মনে হয় না। চায়ের দোকানে আড্ডায় গুলজার হওয়ার মুহূর্তে যেসব বাক্য মুখ দিয়ে ছিটকে বের হয়, তাদের কবিতায় ওইসব বাক্য ও বচন অনায়াস জায়গা করে নেয় :—
আমাদেরও অন্তরে বহুকিছু ডামি করে নিয়েছি আমরা সৌন্দর্য ও সভ্যতার নামে
বহুকিছু ফেলা হয়ে গেছে ছেঁটে; বহু অঙ্গ বিক্রি হয়ে গেছে ভাত আর ভর্তার দামে
কিন্তু কোথাও আমাদের কোনো কামড়ের স্মৃতি নেই। কোনো অবচেতন পিঁপড়াও
আমাদের মনে করিয়ে দেয় না আমরা কেউই এখন আর না আছি পূর্ণ মানুষ — না সম্পূর্ণ বাঙাল…
(রিফরমেশন)
…
জীবনেরা হাসপাতালে আইসা বড়ো অদ্ভুত টিটকারি মারে
ন্যাড়া ন্যাড়া ডালে পাতা নড়ে; কেউ বলে নাই তবু নড়ে; বেহুদাই
খামোখাই পাখি উড়ে
কোনো কাম নাই তবু গাভিন লেঙ্গুর নিয়া মৌমাছি ঘোরে
গাড়িরাও ফুটাঙ্গি করে; জানালার বাইরে; অযথাই…
অথচ ভিতরে কত মহাজন ওষুদের হাত-পায়ে ধরে — কিঞ্চিৎ চাগায়ে দাও;
আরো কিছুদিন খাইয়া হাগার মতো বহু দরকারি কাম পড়ে আছে মোর…
(দম)
মাহবুব লীলেনের কবিতায় স্টান্ট থাকে, আশিক আকবরও তা-ই। মুখের বচন দিয়ে লেখার বচনকে ডিনাই করার ফুটানি দুজনের কবিতায় সহজাত, তবে বয়ানের এই ধারা ব্যক্তি আমির সঙ্গে বিশেষ ঝামেলা তৈরি না করায় বেশ মানিয়ে যায় এবং উপভোগ্যতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। কবিতায় অর্থ-সংকেতের উপমা বহু উপায়ে তৈরি হতে পারে। লীলেনের ‘দম’ কবিতাটি এখানে যেমন কবির জীবনভাবনায় বৈধ হয়ে ওঠা ব্যক্তিত্বের চাপ সহ্য করেই পাঠকের মনে দ্বিরাভাস জাগিয়ে যায়।
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
COMMENTS