ত্রিশের দশকের বিশিষ্ট কবি অশোকবিজয় রাহা (১৪ নভে. ১৯১০-১৯ অক্টো. ১৯৯০) একাধারে যশস্বী প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলেও কবিতাসমূহ রচিত হয় ত্রিশের দশক জুড়ে। তিনি রবীন্দ্রকালের কবি হলেও বাংলা কাব্যধারায় স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর বজায় রেখেছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রপ্রভাব ও ত্রিশের কবিগোষ্ঠীর প্রবল প্রবাহের মধ্যে তিনি হারিয়ে যাননি। কবিতা ও প্রবন্ধের ক্ষেত্রে স্বকীয় উচ্চারণ ও শিল্পচিন্তার দ্বারা তিনি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। অশোকবিজয় রাহা বহুলপ্রজ ছিলেন না, বিচিত্র প্রকরণের রচনাও তাঁর নেই। কবিতা এবং প্রবন্ধই ছিল তাঁর সাহিতচর্চার অধিক্ষেত্র। মাত্র কয়েকটি কাব্য এবং প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহ হচ্ছে : ডিহাং নদীর বাঁকে (১৯৪১), রুদ্রবসন্ত (১৯৪১), ভানুমতীর মাঠ (১৯৪২), জলডমরু পাহাড় (১৯৪৫), রক্তসন্ধ্যা (১৯৪৫), শেষচূড়া (১৯৪৫), উড়ো চিঠির ঝাঁক (১৯৫১), যেথা এই চৈত্রের শালবন (১৯৬১), ঘণ্টা বাজে : পর্দা সরে যায় (১৯৮১), পৌষ-ফসল (১৯৮৩), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৪)। The Enchanted Tree (১৯৮৩) নামে তাঁর নির্বাচিত কবিতার একটি অনুবাদগ্রন্থও প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধগ্রন্থসমূহ হলো : বাণীশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ (১৩৮০); পত্রাষ্টক (১৯৮১); প্রবন্ধসংগ্রহ (২০১৩)। তাঁর জলডমরু পাহাড়, রক্তসন্ধ্যা, এবং শেষচূড়া কাব্য তিনটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘শ্রীহট্ট লেখক ও শিল্পী-সংঘ, শ্রীহট্ট’-র পক্ষ থেকে। তিনি এই সংঘের সক্রিয় সদস্যও ছিলেন। বাকি সবকটি গ্রন্থই প্রকাশিত হয় কলকাতা হতে। এগুলোর মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা ভবন’ হতে প্রকাশিত ভানুমতীর মাঠ ছিল বিশেষ সাড়া-জাগানো ব্যাপার।
কবি অশোকবিজয় রাহার জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ গ্রামে। পড়াশোনা করেন সিলেট গভর্নমেন্ট হাই স্কুল এবং সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে (এমসি কলেজ)। কলেজটিতে তিনি ১৯২৭-৩১ খ্রি. পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মুরারিচাঁদ কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে Murarichand College Golden Jubilee Volume নামে দুই খণ্ডে কলেজপ্রশাসন কর্তৃক যে স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাতে অশোকবিজয় রাহার সৃজনশীলতার তথ্যটি গুরুত্বের সঙ্গে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে ‘Author of Literary works and poems—‘Rudra-Basanta’ and ‘Dihang Nadir Bake’. মুরারিচাঁদ কলেজে অশোকবিজয় রাহা দর্শনে বিএ অনার্স সম্পন্ন করেন। পরে শিক্ষকতা করেন সিলেটের প্যারীমোহন পাবলিক একাডেমি (পরে রসময় মেমোরিয়াল স্কুল?), মদনমোহন কলেজ। ১৯৪৭ খ্রি. ১ জানুয়ারি যোগ দেন বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জ কলেজে। তিনি ১৯৫১-৭৪ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ছিলেন রবীন্দ্র-অধ্যাপক। কবি, প্রাবন্ধিক এবং শিক্ষক—সবক্ষেত্রেই অশোকবিজয় রাহা উজ্জ্বল ছিলেন।
১৯৩১ খ্রি. রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিতম জন্মজয়ন্তী উদযাপন করা হয় সিলেট শহরের দুর্গাকুমার পাঠশালায়। মুরারিচাঁদ কলেজের অধ্যাপক শশীমোহন চক্রবর্তী ছিলেন এর সভাপতি, অশোকবিজয় রাহা ছিলেন সদস্য। সিলেটের ‘রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী উদযাপন পরিষদ’-এর পক্ষ হতে কলকাতায় গিয়ে অশোকবিজয় রাহা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তিনি কবির হাতে ‘রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী উদযাপন পরিষদ’-এর মানপত্র ও দুর্গতদের সাহায্যার্থে উত্তোলিত নগদ অর্থ হস্তান্তর করেন। কবিকে উৎসর্গীকৃত স্বরচিত কবিতা ‘নমস্কার’ ও অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রীর একটি চিঠিও তুলে দেন। তাঁর শিল্পবোধ রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েছিল। অশোকবিজয় রাহাকে তিনি অভিহিত করেছিলেন সাহিত্যজগতের ‘তরুণ চাঁদ’ বলে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সত্তর, অশোকবিজয় রাহার একুশ।
ছাত্রজীবনেই অশোকবিজয় রাহা কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। ছাত্রাবস্থায় সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিন, মুরারিচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিন এবং সিলেট হতে প্রকাশিত খ্যাতনামা সাহিত্যপত্র কমলা ও বলাকা সাহিত্যপত্রে তাঁর কবিতাবলি প্রকাশিত হয়। তখন মুরারিচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিন ছিল একটি ত্রৈমাসিক জার্নাল, যা ১৯১৭-৩৯ খ্রি. পর্যন্ত ২৩ বছর প্রকাশিত হয়। ম্যাগাজিনটিতে তাঁর অন্তত চারটি কবিতা ও একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। মুরারিচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিনের ১১শ বর্ষের (১৯২৭-২৮) দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘ভোরের আলোয়’ (আজ বনে বনে প্রভাত বায়ু) এবং চতুর্থ সংখ্যায় ‘শরৎ-প্রাতে’ (মোর জীবনে এই শরতের রৌদ্র-উজল দিবা) নামে অশোকবিজয় রাহার দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়। সে-সময় তিনি উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ১৯৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘মরু-সন্ধ্যা’ (দিনান্তের রক্তমাখা দুই খণ্ড মেঘে) —এবং ‘রাতের সোওয়ার’ (পাহাড়ের জঙ্গলের গোলক-ধাঁধায় ঘুরে’) নামক আরও দুটি চমৎকার কবিতা প্রকাশিত হয় ২০বর্ষের ১ম ও ৩য় সংখ্যায়।
কবি অশোকবিজয় রাহা ছিলেন একজন অসামান্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক। রবীন্দ্রকাব্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধসমূহ অতুলনীয়। ১৯৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে মুরারিচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিনের ১৯বর্ষ, ৩য় সংখ্যায় তাঁর ‘কাব্য ও বিজ্ঞান’ নামে একটি প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায় যাতে তিনি Sir James Jeans-এর The Mysterious Universe গ্রন্থের পর্যালোচনা করেন এবং সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞান ও দর্শনের সম্বন্ধ বিশেষভাবে আলোচনা করেন। স্যার জেমস জিন্সের গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এবং পরবর্তী আট বছরে বিস্ময়করভাবে এর পনেরোটি সংস্করণ বের হয়। স্যার জেমস জিন্স এই গ্রন্থটিতে দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমকালীন বৈজ্ঞানিক যেমন ম্যাক্স প্লাঙ্ক, হাইজেনবার্গ এবং আইনস্টাইন প্রমুখের তত্ত্বসমূহ বিশ্লেষণ করেছেন। ‘কাব্য ও বিজ্ঞান’ নামক প্রবন্ধটি অশোকবিজয় রাহা লিখেছেন জিন্সের গ্রন্থের পাঠপ্রতিক্রিয়াস্বরূপ।
অবশ্য এ-প্রবন্ধটি যখন অশোকবিজয় রাহা রচনা করেন তখন তিনি বিএ অনার্স পাশ করে পুরোদস্তুর অধ্যাপক। কিন্তু মুরারিচাঁদ কলেজের সৃজনধারার সঙ্গে যোগাযোগের সূতোটা অক্ষত ছিল। অশোকবিজয় রাহা মূলত কবি। কাছাড়ের চা-বাগানে চাকুরিরত পিতার সঙ্গে তাঁর শৈশব কেটেছিল। এজন্য সিলেটের আরণ্যক জীবন ছিল তাঁর কৈশোর ও যৌবনের বিচরণক্ষেত্র। এরই সার্থক প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্যে। এ-প্রসঙ্গে মুরারিচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত অশোকবিজয় রাহার দীর্ঘ কবিতা ‘রাতের সোওয়ার’ হতে নমুনা হিসেবে কিছুটা উদ্ধৃত হলো :
এ আমি কোথায় চলেছি?
যখন খেয়াল হোলো
চেয়ে দেখি, চাঁদ আর নেই।
পশ্চিম-দিগন্তের খানিকটা জায়গা
বিবর্ণ ধূসর,
যেন ওখানে কা’র চিতার আগুন নিবছে।
বাকী আকাশে ছড়িয়ে আছে
তারি কয়েক মুষ্টি ছাই আর ভস্মকণা।
নীচের পৃথিবীতেও
যেন এইমাত্র কা’র চিতা জুড়’লো।
(‘রাতের সোওয়ার’, অশোকবিজয় রাহা)
[The Murarichand College Magazine,Vol, XX, 1937-38, No. iii., P., 158-162]
মুরারিচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কবিতাগুলো তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থভুক্ত হয়েছিল কি না জানা যায় না। তবে বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা হতে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’ নামে তাঁর প্রবন্ধসম্ভার প্রকাশিত হয়। কিন্তু এতে ‘কাব্য ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি বা এটির সম্বন্ধে কোনো তথ্যও নেই। প্রবন্ধসংগ্রহ গ্রন্থটিতে অশোকবিজয় রাহার মোট সাতটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো— ‘রবীন্দ্রকাব্যে ইন্দ্রিয়চেতনার মিশ্রণ ও রূপান্তর’; ‘রবীন্দ্র-প্রতিভার স্বরূপ’; ‘রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা’; ‘রবীন্দ্রকাব্যে শিল্পের ত্রিধারা’; ‘কাব্যের শিল্পরূপ’; ‘জীবনানন্দের জগৎ’ ও ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি হতে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অশোকবিজয় রাহা নামে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, এর লেখক অমল পাল। কিন্তু এতেও তাঁর ‘কাব্য ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধটির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রবন্ধটি অগ্রন্থিতই রয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়। নিচে The Murarichand College Magazine (Vol, X1X, 1936-37, No. iii., P., 101-111) হতে ‘কাব্য ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধটির বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত রেখে সংকলন করা হলো :
কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ
রচনাটি পড়ার জন্য উপরের লিঙ্কে ক্লিক করুন।
ভূমিকা, সংগ্রহণ ও সংকলিতকরণ : মোহাম্মদ বিলাল। কবি ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট। Email: mdahmedbil@gmail.com
- কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ - January 14, 2025
- মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল - January 14, 2025
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
COMMENTS