দশকি কবিতার (’৮০) ’৯০ : যাত্রাবিন্দু ও যাত্রিকগণ || আহমদ মিনহাজ

দশকি কবিতার (’৮০) ’৯০ : যাত্রাবিন্দু ও যাত্রিকগণ || আহমদ মিনহাজ

পূর্ব পরিচ্ছেদ / লোক দশকতামামি ৬ : পরিণত নব্বইয়ের প্রবাহ ও পরিপক্কতা

ত্রিশ-পরবর্তী অর্ধশতক জুড়ে সময় ও পরিপার্শ্বের যেসব উৎসারণ বাংলাদেশের কবিতায় মুদ্রিত হয়েছে তার থেকে আশির মধ্যভাগের পার্থক্যটি উপলব্ধি করতে না-পারলে নব্বইয়ে সংঘটিত বাঁকবদলের চরিত্র বোঝা কঠিন হয়। অগ্রজ দশকগুলো থেকে পৃথক মোড় নিলেও আশির মধ্যভাগ নব্বইয়ের সূচনায় দৃশ্যমান খোলসে নিজেকে গুটিয়ে রাখেনি। পরিপার্শ্বে নিজের সংযুক্তি পাঠের প্রবণতায় মোটের ওপর ভিন্ন পথে কবিরা মোড় নিতে যাচ্ছিলেন।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী, রেজোয়ান মাহমুদ, জুয়েল মাজহার, মাসুদ খান, শামসেত তাবরেজী ও সহযাত্রীরা ভাষায় নতুন অর্থস্তর জন্ম দিতে সচেষ্ট হলেন এবং নিকট-অগ্রজদের সঙ্গে মিলন ও বিরোধ সেখানে সমানে ঘটছিল। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ও রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় ব্যক্তিসত্তার নিরালম্ব যেসব তল পাঠক খুঁজে পায় তাদের অনুজরা সেগুলোকে ইয়ার্কিঘন সামষ্টিক আকার দান করছিলেন। স্টালিন লিখেছিলেন :—

আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত
মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা
আমার জন্ম কোনো সময়কে ইঙ্গিত করে না
এমনকি ঘটনাগুলো মুহূর্তের শৃঙ্খলমুক্ত।
(সূচনাপর্ব)

এই বিঘোষণায় নব্বইয়ের কালপর্বে ঘনীভূত বোধির অনুরণন টের পাওয়া যায়। সময়ের গতিধারা সময়হীনতার তীরে নির্বাপিত জেনেও স্টালিনের কবিতায় ছলকে-ওঠা ‘ব্যক্তি আমি’ অবশ্য নিজেকে ‘…পৃথিবীর প্রথম সূচনা’ ঘোষণা দেওয়ার পুনরাবৃত্তি থেকে বের হতে পারেনি! এমতো আত্মঘোষণা যারপরনাই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঘনবদ্ধ আমিত্বের ধারায় কবির জিরান খোঁজার শামিল হয়ে ওঠে। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সংবেদি কবিতার ভাষা সময়ের স্রোতোধারায় নিজের সংযুক্তি তালাশের ক্ষণে পুরাতন বৃত্তেই ফেরত গিয়েছিল :—

মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বরের দিগন্ত-প্রসারী আলখাল্লা
না নদী না জন্মভূমি।
মানুষের কোনো উপমা নেই, রূপকল্প নেই, ব্যতিহার
বহুব্রীহি নেই, স্বরলিপি ব্যাকরণ নেই
শাসনতন্ত্র, অর্থ-অভিধান চর্যাচর্য নেই।
(মানুষ)

‘মানুষ’ কবিতার অর্থস্তরে নিহিত বার্তা চিরকালের সত্য হলেও অন্তর্লীন সুরপ্রবাহ পঞ্চাশ থেকে ষাটের কালপর্বে সক্রিয় জীবনবোধের বেদিতলে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। ‘জীবনের সমান চুমুক’ আশির অন্তে এসে প্রকাশিত হলেও কবির মনোবিশ্ব তখনো পূর্ববর্তী দশকি বলয়ে সত্তার নির্ণয় সন্ধানে নিমগ্ন ছিল। কবিতার পালাবদলের সঙ্গে কদম মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সময়-সংযোগ প্রবণতায় পরের দুই দশকে পরিবর্তন ঘটে যায় এবং নব্বইয়ে অমোঘ-হয়ে-ওঠা জীবনবেদ ও ভাষাঅঙ্গে নিজেকে তিনি একাত্ম করেন। তো এই সন্ধি ও বিচ্ছেদের যোগফলে আশির মধ্যভাগে দেখা দেওয়া কবিগণ ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাদের পাল্লায় পড়ে আস্থাশীলতার পুনরাবৃত্তি বা ঘুরেফিরে সেখানে নোঙর খোঁজার প্রবণতা রূপ পাল্টাতে শুরু করে। নব্বই থেকে শূন্য দশক জুড়ে ‘গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত’ সময়ের কোপানলে দগ্ধ ব্যক্তি তার ব্যক্তি-একক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার স্পর্ধা হারিয়ে ফেলে। ব্যক্তি নয় বরং ব্যক্তিসমগ্রয় তার রূপান্তর ঘটে যায় এবং বলাবাহুল্য উক্ত সমগ্রের মাঝে নিহিত ব্যক্তিসত্তাকে খেলো ও হাস্যকর করে তুলতে মাসুদ খানরা রূপান্তরটি ঘটিয়ে বসেন! রূপান্তর কেন অনিবার্য ছিল তার ইশারা শূন্য দশকের অন্তে প্রকাশিত জুয়েল মাজহারের ‘মেগাস্থিনিসের হাসি’ কাব্যগ্রন্থের নাম-শিরোনামে মুদ্রিত কবিতাটি হয়তো-বা পষ্ট করে যায় :—

নিঃশব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ
শীতকাল গেল;

নিঃশব্দ কামানে তুমি একা কেন ভরছো বারুদ?

আমি ভাবছি : মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?

শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
ঘোটক উড়ে যায়;
—এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়।

নিঃশব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?
(মেগাস্থিনিসের হাসি)


গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you