মোনিকা আনা মারিয়া বেলুচি (জ. ১৯৬৪)। পেশাগত জীবনে পরিচিত মোনিকা বেলুচি নামে। ফ্যাশন মডেল ও পারফরমার। তের বছর বয়স থেকে মডেলিং করছেন। ব্রিটিশ চর জেমস বন্ডের সঙ্গী হয়েছেন এস্পেকটার (২০১৫) সিনেমায়। অনিন্দ্য সৌন্দর্যের অধিকারী মোনিকার রূপকলাকে স্থির-ক্যামেরায় বন্দী করেছেন হেলমুট নিউটন, রিচার্ড অ্যাভেডন, ব্রুস ওয়েবার থেকে শুরু করে অনেক কুতুব আলোকচিত্রী। সিনেমা করেছেন গুইসেপ্পো তোরনাতোরা, গ্যাসপার নোয়া থেকে ওয়াচোস্কি সিব্লিংসের সাথে। হাজির হয়েছেন নানাবিধ চরিত্রে, একাধিক পার্শ্বচরিত্রে। এই উর্বশী রমণী এখনও ইতালির টপ মডেল হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন।
দর্শকবৃন্দের কারও চোখে ঘোর। আবার কারও জন্য অবশেসন। কারও জন্য ভ্রু-কুটিও বটে। তাঁর অভিনয়শৈলীগত দক্ষতা নিয়েও অনেকের চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্নের পাঁয়তারা দেখা যায়। বিষয়টা স্বাভাবিক। এই অর্থে যে, তিনি দর্শকের আরামের দুনিয়ার ঘুম (খানিকটা হলেও) হারাম করতে পেরেছেন। অনিয়মিত সব চরিত্রে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ দেখা যায় মোনিকার। এসবের ভিড়ে কখনওসখনও উৎকর্ষহীন চরিত্রে যে হাজির হন না তা বলা যাবে না।
তবে কী…যে-কোনো অবস্থাতেই এই পৌরুষিক সমাজে একজন নারীকে মানুষ হিসেবে যোগ্যতার মাপকাঠিতে ভ্যালু করার রেওয়াজটা এখনো গড়ে ওঠেনি। নারীকে টিকতে হয় তার লৈঙ্গিক পরিচয়ের রাজনীতি মোকাবেলার ভেতর দিয়ে। দাম্ভিক পৌরুষের চাপে যেমন নেই স্বাধীন মানুষ তেমনি স্বাধীন নারী বলতে যা বোঝানো হয় তাও যেন খুকির হাতের মোয়া। যে-কারণে, দিনশেষে মোনিকা লড়াই করে টিকে থাকুন বা না-থাকুন নারীপুরুষ উভয়ের চোখেই তাকে শুনতে হয় — রূপের দেমাগ আছে বলেই এত কিছু। এর বাইরে আর কী আছে ক্ষমতা।
তো, এইখানে আমরা দেখি যে — মোনিকা বেলুচিকে বেশ প্রাণবন্ত এবং সজীব সত্তা হিসেবে, যিনি শুধু রূপের সদাই করেন না ভিজুয়াল বিজনেসের হাটে। বরং আক্কেলের ব্যবহার জানেন। প্রয়োগ করেন দরকারমতন।
গ্রিক ব্যুৎপত্তি অনুসারে মোনিকা অর্থ নিঃসঙ্গ। আর ইতালিয় উৎস মতে বেলুচি মানে রূপবান/রূপবতী। এই নিঃসঙ্গ রূপবতী কোনো-এক অবসরে বসেছিলেন দ্য টক্স কর্তৃপক্ষের সাথে। একটি খাটো কিন্তু সুঠাম টাইপ সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য।
সেটি পেশ করা হলো এখানে। মোনিকা বেলুচির এই আলাপচারিতা আমাদের জাজমেন্টাল, স্টেরিওটাইপড দুনিয়াবাসীর জন্য একটা খোলামেলা করুণা। করুণা এই অর্থে যে, জাজমেন্টাল, স্টেরিওটাইপড দুনিয়াবাসীরা বড্ড হিপোক্রেট বা মোনাফেক। আর এইটা দিনের বা বাতির আলোয় স্পষ্ট করে দেখাটা খুব একটা স্বস্তিকর হয় না।
আমেন।
মোনিকা আনা মারিয়া বেলুচি : নিঃসঙ্গ রূপবতী কন্যার মন || ভূমিকা ও ভাষান্তর ইমরান ফিরদাউস
সিনোরিটা বেলুচি, সুন্দরী হওয়ার কারণেই কী ঘনঘন কাজ পেয়ে থাকেন?
আমি জানি সৌন্দর্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কৌতূহলকে উপভোগের নিমন্ত্রণ জানায় থাকে। তবে, এ প্রসঙ্গে অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, “সৌন্দর্য্য এর দীর্ঘায়ু মাত্র পাঁচ মিনিট, যদি না আপনার কাছে কৌতূহল টিকিয়ে রাখার মত আর কিছু না থাকে।” আমার মনে হয় না শুধুমাত্র সুন্দরী বলেই এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী হতে পেরেছি আমি। পরিচালকরা তোমার রূপ দেখে ফ্যোওন করে না, কাজের যোক্তা দেখেই কল করে।
আপনার এই মাধুর্য কখনো কী প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে হয়েছে?
হ্যাঁ, অবশ্যই—বিশেষ করে যেহেতু আমি ফ্যাশন বিজনেস সার্কিট থেকে সিনেমার জগতে এসেছি…। পরিস্থিতিটা একদমই মড়ার উপর খাড়ার ঘা মার্কা ছিল; জানো তো, ফ্যাশন ও রূপমাধুরী সবচেয়ে যাচ্ছেতাই যোগ্যতা সিনেমালাইনে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। আর যেহেতু আমি সুন্দরী, তাই মানুষ মনেই করে আমি একটা বেক্কল। বিষয়টা হলো—এই রূপসী চেহারা আদতে একটা মুখোশ, আড়ালে থাকা মুখটাকে আলোতে আনতে হলে মুখোশটাকে ভাঙা চাই, ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া চাই। তোমাকে দেখাতে হবে আসলে তুমি কে—নচেৎ তোমারে আবিষ্কার করার ঠ্যাকা পড়ে নাই কারও।
উরাধুরা ভূমিকায় সিনেমায় হাজির হওয়ার কারণও কি তাহলে এইটা?
নিজের জন্য তো বটেই, অন্যদের জন্য মোটেও না।
সত্যি?
আলবাৎ হ্যাঁ! আমার নিজেকে অন্বেষণের তাড়না আছে। কেউ যদি আমার কাছে কোনো নতুন ধারণা নিয়ে আসে বা এমন একটা চরিত্রের ভাবনা উপস্থাপন করে যা ঝুঁকিপূর্ণ—যদি আমার পছন্দ হয় তখন আমি তাতে অংশ নেই। আমি এমন সিনেমাই পছন্দ করি, যা নানাবিধ আলোচনার সূত্রপাত ঘটাবার উচ্ছ্বাস ধারণ করে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, আমি যখনই সিনেমা করি/করেছি সেসব আলোচনার কাপে বেশ তুমুল পরিস্থিতি তৈরি করে থাকে। যেমন—ইরঋভার্সেবল, দ্য প্যাশন অফ ক্রাইস্ট, ম্যালেনা ; এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও কৌতূহলোদ্দীপক অনুভূতি। মানুষের ডার্ক সাইডগুলো আমাকে বেশ টানে, আমি ঐ গুপ্ত জগৎটাকে বুঝতে চাই, অন্ধকারের বুনটটাকে স্পর্শ করতে চাই। আর এই জন্যই আমি অভিনয় করি বলি মনে করি।
সময় অবসরে নিজের সিনেমাগুলো কি বারবার দেখেন?
না, আমি এক সিনেমা দুইবার দেখার চাপ নিতে পারি না। অথবা, বিষয়টা এ-রকম যে অনেক বছর পর হয়তো একদিন দেখি; যেমন এরই মাঝে মেলাদিন পর ম্যালেনা দেখলাম এবং দেখার সময় বেশ ফানি লাগতেছিলো আর কি। একটা সিনেমার রিপিট শো দেখতে হলে মাঝে একটা লম্বা সময় চাই আমার, কারণ ওই সিনেমা সম্পর্কে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি ধারণ করা একটা প্যারা। আর নিজেরে এতক্ষণ ধরে পর্দায় দেখতে গিয়ে অসম্ভব ক্লান্তি ভর করে আমার গায়ে।
ভিনসেন্ট ক্যাসেল—আপনার স্বামী; উনিও তো একজন অভিনেতা। পর্দার কোন চরিত্রে তাকে রূপান্তরিত হতে দেখতে কেমন লাগে?
মেজ্রিন দেখে আমি রীতিমতো শকড্ হইছিলাম; কারণ ওর তারছিঁড়া পারফরমেন্স! আমি চিনতেই পারি নাই যে—এই মানুষটাকে আমি জানি। সিনেমায় সে যখন কারাগারে বসে সন্তানদের স্নেহ করতেছিলো, শুধুমাত্র তখন যেন চকিতে মনে হলো এই ভিনসেন্ট ক্যাসেলকে আমি চিনি। কিন্তু, সেইটা কথা না। কথা হইলো, সিনেমাটায় ওর শ্রম একাধারে যেমন মনোমুগ্ধকর তেমনি হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।
যুগল আপনারা কী নিজেদের কাজ ও সিনেমা নিয়া আলাপে মশগুল হন?
মোটেও না। ভিনসেন্ট এবং আমি দুইজনেই ভিন্ন দুই জগতে থাকি। আমি ওর বন্ধুদের চিনি না,সেও আমার বান্ধবদের জানে না। আমরা কোন মিউচুয়াল মানুষের সাথে উঠা-বসা করি না। আমরা একই জীবন শেয়ারও করি না। কালেভদ্রে আমরা যার যার জগৎ থেকে বের হয়ে আসি,বসি দু দণ্ড, কথা কই, দেখা করি, মিশি পরস্পরের সাথে। পরন্তু, আমরা দুইজনই ভিন্ন প্রাণী। আমি যেমন স্বাধীন মানুষ, সেও একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি—আর এটাই মনে হয় আমাদের একসাথে ভাগেযোগে জীবন কাটাতে উৎসাহ দেয়।
এমনে করে পোলাপান মানুষ করা কষ্ট না?
নাহ।
আপনার কন্যা কী বোঝে তার প্যারেন্টস রুটিরুজির জন্য কি কাজ করে?
না। কয়েকদিন আগে আমার মেয়ে বলতেছিলো, “মা, আমি তোমার মতো হবো। আমি কোনো কাজ করবো না। আমি শুধু মা হবো আর তারপর আমি যখন বড় হবো তখন আমার মেয়েকে কাজে পাঠাবো।” ঠিকই আছে ওর ভাবনাটা, কারণ সে মনে করে আমি কোনো কাজ করি না। সে বলে : “জীবনটা কত সুন্দর, আমরা হোটেল হোটেলে থাকতেছি,এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যাইতেছি…কী মজা!” আমিও অনেক সুখ অনুভব করি এতে। মানে, আমি বলতে চাইতেছি যে—আমার সন্তানকে আমি টাইম দিতে পারতেছি…সেও আমার সঙ্গ উপভোগ করতে পারতেছে।
একদিন সেও কি আপনার মতো অভিনেতা হয়ে উঠবে?
আমি এমনটা আশা করি না।
কেন?
কারণ এটি একটি বিশেষ কাজ; কিন্তু সে যদি এসে বলে সে নাইট হবে বা বীরব্রতী হবে আমি তাতে খুশিই হবো। কারণ, আমি মনে করি জীবনের মাধুর্য ধরা থাকে উষ্ণ আবেগে বা প্যাশনের মাঝে। আর তার প্যাশন যদি তাকে চালিত করে অভিনেতা হতে, তবে সে তাই হবে।
সেও তো একেকজন ব্যক্তি মানুষ…
সেই…ওই জানে ও কি চায় বা না চায়। তার যদি প্যাশন থাকে তাহলে তো এটি আশার কথা—তবে অভিনয় বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। পেশা হিসেবে জোশ কিন্তু ভেজালও আছে। এই পেশায় তখন আসাই ভালো, যখন আপনার আগে আর কেউ এই পথ মাড়ায়নি। যেমন ধরেন—ভিনসেন্ট এর বাপ অ্যাক্টর ছিল। এই পরিচয় উৎরায় নিজের আইডেন্টিটি ডেভেলপ করতে বান্দার জানের উপর কিন্তু বেশ ধকল গেছে।
তোমার পরিবারও কী এমন ছিল?
আমি একদম আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের ফ্যামিলি থেকে এসেছি। তাই, আমার জন্য বিষয়টা তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। কিন্তু, তুমি যখন কোনো পেশাদার অভিনয়শিল্পীদের বাড়ি থেকে আসো অভিনয় করতে, তখন তুমি চাও বা না-চাও মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তোমাকে তুলনার পাল্লায় তুলবে। যেইটা ভিনসেন্টকে ফেইস করতে হইছে একটা সময় পর্যন্ত।
ইমরান ফিরদাউস রচনারাশি
গানপারে ম্যুভিরিভিয়্যু
গানপারে বেলুচি
- ফিউরিয়োসা - September 26, 2024
- অনবরত অনুসন্ধান || সজীব তানভীর - September 26, 2024
- অ্যাক্টর্স জার্নাল : শতেক পাতার লাইনটানা ব্ল্যাঙ্ক নোটবুক - September 26, 2024
COMMENTS