বাঁশ দিয়ে জালির মতো খোপ খোপ করে বানানো গে্টের আংটা খুলে দিলে সিমেন্টবাঁধানো সামান্য পথ, যে-পথ অতি সহজে ঘরের দ্বারে গিয়ে ঠেকেছে। পথের দুপাশে ইটের এককোণা বের করিয়ে রেখে জ্যামিতিক নকশা। আমি খানিকটা ভীরু পায়ে এগোই। এ কোন বালিকা? লম্বায় প্রায় আমার মাথাসমান। সে কোন কারণে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাচ্ছে? এদিকে আমার পেটের ভেতর ইঁদুর-ছুঁচো লম্ফঝম্ফ শুরু করেছে। ভাত খাইনি কতকাল!
বালিকা বাসায় ঢুকেই কলকল করে কথা বলে ওঠে, যেন সে কোনো নদী — যাতে মাত্রই জোয়ার এসেছে! অথবা কোনো পাহাড়িয়া ছড়া — ঝুমঝুম করে তার জলের ঘুঙুর বাজিয়ে চলেছে! হাত-পা নেড়েচেড়ে বকুল বলে —
‘শোনো তোমার সাথে আমার নামের মিল আছে।’
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে ফের বলে —
‘তোমার নাম পাপড়ি, ফুলের অংশ। আর আমার নাম বকুল। বকুলফুল। কিন্তু আমাকে সবাই ডাকে বকু বলে। তুমিও আমাকে বকু বলে ডাকবে।’
রেলগাড়ি দেখে আমি যেমন তব্দা খেয়েছিলাম বকুলকে দেখেও আমি তব্দা খাই। কি করা? তব্দা খাওয়াই আমার ভাগ্য।
হ্যারিকেনের ম্লান আলোর মাঝে বকুল ওর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওর বড়আপা। তার কোলে একটা অত্যন্ত ফুটফুটে শিশু। ওর দুলাভাই। যাকে বকুল ডাকে বড়দাদাভাই বলে। ওর মায়ের পানখাওয়া ঠোঁট। মুখের পানের পিক সামলে বলে — ‘ওই বকু পাপড়িরে ভাত খাওয়াইয়া দিস কইলাম।’
আমি মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠি। বকুলের সাথে আমার মাত্র ঘণ্টাখানেকের পরিচয়। এর মাঝেই আমি এদের বাসায় ভাত খাবো কী করে?
কিন্তু বকুল নাছোড়বান্দা। আমি বলার চেষ্টা করি আব্বার সঙ্গে আমার এখনো দেখা হয় নাই। আব্বা এসে আমাকে খুঁজবে। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারি না। এর মাঝে একবার বলেছি —
‘শোনো বকুল!’
নিমিষে বকুল, — ‘আহ্ হা, বলসি না আমাকে বকু বলে ডাকবা।’
আমি বেশ বিপদে পড়ে গেছি বলে মনে হচ্ছে! যাকে জানি না, চিনি না, তার নাম বকুল। এখন একঘণ্টার পরিচয়েই বকুলকে কিনা বকু ডাকতে হবে! ঘাবড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাই বটে! তবে এই-রকম ঘটনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হলো — আসল নাম কেটেছেটে ছোট করে ফেলা! বকুলকে দেখার আগে আমি বিষয়টা জানতামই না!
বকুল যে তার বাসায় ‘বকু’ — এ-বিষয়ে এখন আমার আর কোনো সন্দেহ নাই। কারণ যখন-তখন সবাই তাকে ডাকছে বকু এটা কর, বকু ওটা কর। বকুলও নীরবে করে যাচ্ছে।
আমার চাইতে দুই ক্লাস উপরে পড়া বকুল এ সংসারে কর্ত্রীরও অধিক, এতক্ষণে আমি তা বুঝে গেছি। বকুল জোর করেই আমাকে তার রান্নাঘরে নিয়ে যায় আর হ্যারিকেনের আলোয় ভাত বেড়ে দেয় তামচিনির প্লেটে। ভাতের উপর তরকারি। কোনো আলাদা বাটিফাটির ধার সে ধারে না। কিন্তু ভাতের উপর তরকারি ঢেলে খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই। আমি খাই বড়চাচিমা বাটি থেকে চামচ দিয়ে পাতের একদিকে তরকারি তুলে দিলে। এখন বকুল আমাকে ঝোল জবজব করে ভাত দিয়েছে। আমি খাবো না বলতেও পারছি না। কি আর করা? হাত ধুয়ে ভাত খেতে বসে যাই। পাতে আছে প্রমাণ সাইজের এক কইমাছ। তার সঙ্গে আলু আর ফুলকপির ট্যালট্যালা ঝোল। কইমাছটা ভেজে রান্না করা। ভাজা কইয়ের কালো কালো অংশ ফুলকপিতে মাখামাখি হয়ে আছে। আমরা বাড়িতে মাছ ভেজে এ-রকম রান্না কখনো খাইনি। এখন ভাজামাছের এমন পাতলা ঝোলের তরকারি যদি আমার মুখে বিস্বাদ ঠেকে? তখন তো মুখ ফুটে কিছুই বলতেও পারব না।
কিন্তু খেতে খেতে দেখি অদ্ভুত মজাদার রান্না! একেবারে অন্যরকম স্বাদ! আমার পেটের ভেতরের ইঁদুর আর ছুঁচোর দৌড়াদৌড়ি ক্রমে শ্লথ হতে থাকে। অতটুকু ভাতেই আমার পেট ভরে যায়।
সিলেটে পা ফেলা অব্দি কতকিছুই-না ঘটে যাচ্ছে! একদম অচেনা এক বালিকা, যে নিজ থেকে তার নামের বর্ণ ছেঁটে ফেলে। আর কারো বাসায় ঢোকা মাত্রই ভাতের প্লেট হাতে তুলে দেয়! আমার চোখমুখে সত্যি ভেল্কি লাগতে শুরু করেছে। এদিকে আমি যে আম্মাকে ছেড়ে এসেছি সেসব নিয়ে আমার তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। বা আম্মার জন্য বা ছোটভাই প্রদীপের জন্য মনদিলও খারাপ হচ্ছে না। আমি বরং উন্মুখ হয়ে আছি, আব্বার সাথে আমার কখন দেখা হবে? আহা রে! আমি আব্বাকে কতদিন দেখি না?
আমার ভাত খাওয়া শেষ হলে বকুলই বলে —
‘চলো তোমায় বাসায় পৌঁছে দিই।’
বাসায় পৌঁছানো মানে কি? সামান্য খালি জায়গা পেরোলেই চাচাজানের বাসা।
বকুল আমাকে পৌঁছে দিয়ে বড়চাচিমার সাথে কিছুক্ষণ গল্পটল্প করে চলে যায়।
এদিকে মর্জিনার মায়ের রান্নার খুশবু ঘরদোর আমোদিত করে রেখেছে। বড়চাচিমার দঙ্গলেরা হাতমুখ ধুয়ে খাবারের জন্য উশখুশ করছে। এ দঙ্গল তো আর কোনো ছোটমোটো দঙ্গল নয়! বড়চাচিমার তিন ছেলে, বড়চাচিমার দুই ভাই, ছোটকাকে নিয়ে ছয়জন। আমি আর আব্বা আটজন। চাচাজান আর বড়চাচিমা মিলে দশজন।
দশজন লোকের থাকা-খাওয়া ওই আড়াইখানা কক্ষের ভেতর!
আব্বার সাথে আমার যখন দেখা হয়, তখন শীতরাত্তির আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। বাইরে বেশ কনকনে ঠাণ্ডা, যার আভাস ঘরে থেকেও পাওয়া যাচ্ছে। আমার গায়ে পাতলা একটা সুতির চাদর। আব্বার গায়ে স্যুয়েটার, গলায় মাফলার, মাথায় উলেন টুপি, পায়ে জুতামোজা। আমি আব্বাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। শ্যামলা মায়াময় একটা মুখ। বড় বড় ভাসা চোখ। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল এলোমেলো পড়ে আছে। নাকের নিচে কালো কুচকুচে গোঁফ। ভারী হাতে পুরুষ্ঠু আঙুল। ডানহাতের মধ্যমা ও তর্জনীতে নিকোটিনের হাল্কা হলদেটে দাগ।
আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, হাসিতে বিকশিত হয়ে আব্বা বলে — কি রে পাপঙ্গে আসছিস নাকি?
পাপঙ্গে আমার বড় আহ্লাদের নাম। এ নামে আব্বা ডাকে। আম্মা ডাকে। দিদি ডাকে। দাদাজান ডাকে। আর মামারা ডাকে। অন্যেরা কেউ এ নাম জানে কি না জানি না। হয়তো ছোটকা জানে। ছোটফুপু জানে। জানলেও তারা আমায় এ নামে কখনো ডাকে না। আমি আব্বার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালে কেমন ‘আব্বা আব্বা গন্ধ’ পাই। এ গন্ধ আব্বার ঘাম আর সিগারেটের মিশ্রণ! এই গন্ধ আব্বার একেবারে নিজস্ব। আমি চিনি এই গন্ধ। আব্বা যখন কস্কো বা লাক্স সাবান দিয়ে স্নান করে আসে, তখনো থাকে এই গন্ধ। কিন্তু সামান্য ফিকে হয়ে আসে গন্ধটা।
আব্বা বলে — চল আমার সাথে।
আমি অবাক হয়ে তাকাই। কই যাব আবার এত রাত্তিরে? আব্বা ফের হেসে বলে — চল চল আমার সাথে ঘুমাবে।
চাচাজানের বাসায় একদঙ্গল মানুষ! আমার ঘুমানোর জায়গার চিন্তা তাই আব্বার। আমার সবকিছুর চিন্তাই বুঝি আব্বার?
হিমের রাত। ঝরঝরিয়ে কুয়াশা পতনের শব্দ শুনতে শুনতে আব্বার হাত ধরে হেঁটে যাই। ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলো আমাদের পথের প্রগাঢ় অন্ধকার দূর করে দিয়েছে। কিছুদূর হেঁটেই আব্বা জানতে চায় —
কি রে পাপঙ্গে শীত করছে নাকি?
আমি শীতে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলি —
না না শীত করছে না।
আব্বা গলার মাফলার খুলে আমার গলায় পেঁচিয়ে দেয়। আব্বার করতলের মাঝে আমার কচি হাতখানা ক্রমশ উষ্ণতা পেতে শুরু করে। এই উষ্ণতা সেই উষ্ণতা, পাখি যা তার ছানাকে দেয়!
চলবে
সুরমাসায়র পর্ব ১ লিঙ্ক : সুরমাসায়র || পাপড়ি রহমান
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS