সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান

সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান

সুরমাসায়র

সিলেটের মেঘেরা যেন উড়ে আসত সোজা মেঘালয় থেকে। ফলে সেসব মেঘেদের ছিল নানান বরন ও খেয়াল। শাদা শাদা মেঘেদের গুচ্ছ ভেসে-বেড়ানো দেখতে না দেখতেই তারা হাতির মতো অতিকায় হয়ে উঠত। মুহূর্তে তাদের রঙ যেত পাল্টে। তারা তখন মহিষের শিঙের মতো কালসিটে ও দুর্দান্ত বলশালী। দুদ্দাড় করে শুরু হতো দমকা হাওয়া। সেই হাওয়ায় ভর করে বিষ্টি এসে যেত। কখনো পরবের সেমাইয়ের মতো ঝিরিঝিরি বিষ্টি। কখনো-বা বড় বড় ফোঁটায় বিষ্টি। কখনো তা ঝরে পড়ত সরল রেখায়। কখনো-বা বক্র রেখায়। কখনো-বা জিগজ্যাগ গতিতে। তা বিষ্টি যেভাবেই পড়ুক না কেন আমরা হইহইরইরই করে বিষ্টি উদযাপন করতাম। বিষ্টি মানে ক্লাসে নাচ আর গানের জম্পেশ আসর বসানো। টিচারদের ক্লাস নিতে না-আসা। কিন্তু সব টিচারই যে বর্ষামুখর দিনে ক্লাস ক্যান্সেল করে দিত তেমন নয়। কেউ কেউ বিষ্টিবাদলা মাথায় করে ঠিকই চলে আসত রঙিন ছাতা ফুটিয়ে। তখন আমরা নাচ-গান বন্ধ করে যে যার ডেস্কে লক্ষ্মী হয়ে বসে পড়তাম।

শুধু টিচারদের নয়, ওই বাহারি রঙিন ছাতা ইশকুলের বেশিরভাগ স্টুডেন্টেরই ছিল। এর কারণও ছিল। সিলেটের প্রায় পরিবারের কেউ না কেউ তখন লন্ডনে বসবাস করত। কেউ না কেউ লন্ডনে থাকার সুবাদে প্রজাপতির মতন রঙবেরঙের ছাতা রোদ-বিষ্টিতে তাদের ঝলমলে পাখনা মেলে দিত। তবে রোদের চাইতে বিষ্টিতেই এই ছাতার রঙবাহার অধিক খোলতাই হতে দেখেছি। তখন রোদ্দুর আড়াল করতে ছাতার এমন যথেচ্ছ ব্যবহার ছিল না।

আবার আরেকটা মজার বিষয়ও ছিল, বিষ্টি নামলেই আমরা ক্লাসের সামনের পাকা রাস্তার বা খেলার মাঠে ছাতা মাথায় দিয়ে নেমে পড়তাম। মাঠের সরু সরু দুর্বাঘাসেরা তখন জলের তোড়ে নাকানিচুবানি খেতো। বিষ্টির জলের ভেতর ডুবে-থাকা ঘাসের বিছানা আমার ভারি পছন্দনীয় ছিল। আর পছন্দ ছিল বিষ্টির জলে পা ডুবিয়ে ছপছপ করে হেঁটে বেড়ানো। হাঁটতে হাঁটতে খামাখাই চারদিকে জল ছিটিয়ে  দেয়া। তবে এইসব অদ্ভুতুড়ে কায়কারবার করতে গিয়ে জলের প্রাণীদের ভয়ও আমার একেবারে কম ছিল না। কেঁচো, জোঁক আর লালরঙা ক্যাড়াদের যত্রতত্র মাথা উঁচিয়ে চলা দেখতে দেখতে ভয়ে আমি প্রায় সেন্সলেস হওয়ার উপক্রম হতাম। এসবে আমার খুব গা ঘিনঘিনাত। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আর সিলেটের ঘাস ছিল চিনাজোঁকের অবাধ আশ্রয়। ক্যাড়াগুলি ছিল আজব কিসিমের। সামান্য স্পর্শ লাগলেই এরা কুণ্ডলী পাকিয়ে মৃতবৎ হয়ে যেত। যেন তাদের দেহে আর প্রাণ নাই! অথচ সামান্য আগেই হয়তো তারা মন্থর ভঙ্গিতে হেঁটে গেছে!

অঝোর বিষ্টিতে সবাই যখন প্রজাপতির মতো ছাতার ডানা মেলে মাঠময় ঘুরে বেড়াত, আমি কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে পড়তাম। কারণ আমার ছাতাটা ওইরকম রঙিন ছিল না। আমার ছাতাটা ছিল কুচকুচে কালো কাপড়ের, যার বার্নিশ-করা কাঠের ডাঁট ছিল ভারি মজবুত। ঝড়ো হাওয়াতেও উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের বাসার প্রায় সব ছাতার চেহারা এই রকমই ছিল। কালো আর বড় বৃক্ষের কোনো বড় পাতা মেলে দেয়া ছাতা! এই চেহারার ছাতা আমার একেবারে না-পছন্দ ছিল। আমি চাইতাম ওইরকম লন্ডনি ছাতা। তেমনই রঙিন আর হালকাপলকা। ফোল্ড করলেই ছোট হয়ে যায়। তখন অনায়াসে ব্যাগে ভরে রাখা যায়। কিন্তু আমাদের কালোছাতা একেবারে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকত। ফোল্ড করা দূরে থাকুক, তাদের কোনোভাবেই হিকজিক খাওয়ানো যেত না।

প্রজাপতির পাখনার মতো একটা রঙিন ছাতার জন্য আমি আম্মার কানের কাছে সারাক্ষণই ঘ্যানঘ্যান করতাম। অকাতরে আম্মা সেসব সহ্য করে যেত। আমার বড়মামা তখন সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফুড ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে। আম্মা আমাকে বলতো — তোর বড়মামা এইবার তোর জন্য একটা রঙিন ছাতা কিনে পাঠাবে।

বছর ঘুরে যেত। বৈশাখের গা-চিটচিটানো গরম আর আম-কাঁঠালের দিনও চলে যেত। এরপরে শুরু হতো লাগাতার বিষ্টি। টানা বিশ-বাইশদিন বিষ্টিতে মাঠ-ঘাট-নদী-নালা সব সয়লাব হয়ে যেত। সুরমার দুই কূল ভেসে যেত ঘোলা জলে। ইশকুলের যাতায়াতের পথের পাশের গাছগুলো অদ্ভুত রকম সবুজে খিলখিলিয়ে উঠত। আর পুরো বর্ষাকাল আমি কাটিয়ে দিতাম আমার পুরাতনী কালোছাতার তলায়।

বড়মামার দেয়া কোনো ছাতা আমার কাছে পৌঁছাত না। লন্ডনি ছাতা দূরে থাকুক, মেরুদণ্ড-সোজা-রাখা কোনো কালোছাতাও বড়মামা আমায় পাঠাত না। আম্মার দেয়া মিথ্যে আশ্বাস আমাকে ক্রমশ হতাশ করে তুলত। মনে মনে আমি নিদারুণ দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে উঠতাম।

এরই মাঝে আব্বার এক ফুপাতো ভাই বরমচাল ফরেস্টের সিসিএফ হয়ে এলেন। উনার ডাকনাম রাজা। আমরা ডাকতাম রাজাকাক্কা। রাজাকাক্কার মেয়ে বিউটিআপা অগ্রগামীর উঁচু ক্লাসে ভর্তি হলো। হোস্টেলে সিট পাওয়া গেল না বলে সে আমাদের বাসায় থেকেই ইশকুলে যাতায়াত করতে লাগল। একদিন দেখি বিউটিআপার ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে ছাতা — লন্ডনি ফোল্ডিং ছাতা! আমি আনন্দে একেবারে আটখানা হয়ে গেলাম! ইশকুলে যাওয়ার পথে বিউটিআপার রঙিন ছাতাটা আমার মাথার উপর ছায়া দিতে লাগল। আর আমার মেরুদণ্ড-সোজা-করে-রাখা কালোছাতাটা বিউটিআপার মাথায়। বিউটিআপা ভারি মিশুক প্রকৃতির ছিল। বয়সে ঢের বড় হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমার অত্যন্ত ভাব জমে গেল। এই বিউটিআপার কাছ থেকে আমি অনেককিছুই শিখেছিলাম। জলা-জংলার যে আলাদা ঘ্রাণ রয়েছে বিউটিআপাই আমাকে তা অনুভব করতে শিখিয়েছিল। গণ্ডারের শরীরের গন্ধও আমি তার কাছ থেকেই চিনেছিলাম।

বিউটিআপা হোস্টেলে চলে যাওয়ার পর ফের আমি আমার কালোছাতার তলায়। ফের আমার শক্তমক্ত এক লাঠিময় ছাতা। তবে এই ছাতাটা বাদলার কালে আমার খুব সহায় ছিল। সুরমা নদীর তীরের পাহাড়ি মাটির পিচ্ছিল পথ আমি এই ছাতায় ভর করে পেরিয়ে যেতাম। অন্ধজন যেভাবে লাঠি দিয়ে পথ পেরোয়, আমিও সেভাবে ছাতা নিয়ে পথ পেরোতাম। আছাড় খাওয়া থেকে এই ছাতা আমাকে বারংবার রক্ষা করত।

ঝড়ো হাওয়ার প্রকোপে যখন অন্যদের পলকা ছাতাগুলি বেঁকেচুরে যেত, হাত থেকে উড়ে গিয়ে বহু দূরে ঘুর্ণি তুলত — তখন ওই কালোছাতা আমাকে ভরসা দিত। যত তুমুল ঝড়ই আসুক না কেন সে তার মেরুদণ্ডটি সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকত। ঠিক আমার ডানহাতের মুঠোর ভেতরে দৃঢ়ভাবে সেঁটে থাকত — যেন কতকালের বিশ্বস্ত বন্ধু সে আমার!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you