ক্লাসরুমের প্রায়ান্ধকারে মঙ্গলার একাকী জীবন। তার তেল-জবজবে চুলে অগণিত উকুনের সংসার। উকুনেরা প্রতিদিন মনের সুখে বংশবিস্তার করে চলে। মাথায় চুঁইয়ে-পড়া তেল আর উকুন বাদে আমার জীবনও এক অর্থে মঙ্গলার সমান্তরালে চলে। আমি ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে বাসে করে ইশকুলে চলে যাই। গিয়ে দেখি লাস্ট বেঞ্চে মঙ্গলা যথারীতি চুপটি করে বসে আছে। অন্ধকারে তার মুখটি দেখা যায় কি যায় না! কিন্তু বোঝা যায় ভারি বিষণ্ণ ও বিব্রত একটা মুখ!
আমি মঙ্গলার একবেঞ্চ সামনে গিয়ে বসি। তখনও ক্লাসরুম জুড়ে অন্ধকার বেশ জুত করে বিছিয়ে থাকে। আর ক্লাসরুম খালি করে সকলেই অ্যাসেম্বলির উজ্জ্বল রোদ্দুরের ভিতর চলে গেছে। আমার আর মঙ্গলার ইউনিফর্ম নাই বলে আমরা দুইজন ক্লাসেই বসে থাকি। হয়তো দর্জিবাড়িতে আমার ইউনিফর্মের কাটছাঁট চলছে। মঙ্গলার ইউনিফর্ম কোন কাপড়ের মিলে প্রস্তুত হচ্ছে আমি তা জানি না। হয়তো সেও তা জানে না।
অ্যাসেম্বলি শেষ হলে সকলে দুদ্দাড় করে ক্লাসে ঢুকে পড়ে। যে যার বেঞ্চে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ফার্স্ট পিরিয়ডের বেল বেজে যায়। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি ক্লাসটিচারের জন্য। হাতে রেজিস্টার খাতা ঝুলিয়ে যিনি ক্লাস নিতে আসেন, তিনি যেন সদ্যই স্বর্গ থেকে পাতালে অবতরণ করেছেন। তিনি ক্লাসে ঢোকা মাত্রই যত অন্ধকার যেন নিমিষেই দূরীভূত হয়ে যায়। তাঁর রূপচ্ছটায় আমরা বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকি। গল্পবইতে পরীদের কথা যেভাবে পড়েছি তিনি দেখতে ঠিক তেমনই। পার্সিয়ান নারীদের মতো নীল নীল আঁখি। পুকুরের ঝিনুকের খোসা ভাঙলে ভেতরে যেমন মসৃণ ও হলুদাভ রঙের জেল্লা দেখা যায়, তাঁর গাত্রবর্ণ ঠিক তেমন! দুধশাদা রঙে সরু পাড়ের শাড়ি পরে আসেন তিনি। সোনার হাতে সোনার কাঁকন ঝিলিক দিয়ে উঠে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়! তাম্বুলরসে ওষ্ঠাধর সদা রঙিন। শাড়ির নিচে পায়ের পাতায় লালচে আভা! রোলকলের সময় তার কণ্ঠে আমি পাখির ডাক শুনি। যেন কোনো পাখি মিহি অথচ স্নেহসিক্ত গলায় ডেকে ওঠে! সবার শেষে ভর্তি হওয়াতে আমার নামটি ডাকেন সবার পরে। আমি সাড়া দিই —
ইয়েস ম্যাডাম!
তারপর ছাত্রীসংখ্যা গণনা করে দফতরির খাতায় লিখে দেন কতজনের টিফিন আসবে আজ ক্লাসে। ততদিনে একটু একটু আমার ‘বেঙ্গলি’ পরিচয় ফিকে হতে শুরু করেছে। ক্লাসক্যাপ্টেনের হাত আমার হাতে ঝুঁকে টিফিন দিতে শুরু করেছে।
দুই-একজনের সাথে ভাব হতেও শুরু করেছে, যারা সিলেটি হলেও আমার মতোই ‘বেঙ্গলি ভাষায়’ কথাবার্তা বলে। তারাও ক্রমে পান্নার সাথে যুক্ত হতে শুরু করেছে। ফলে আমিও তাদের ঝাঁকের কই হতে শুরু করেছি।
ওই পরীআপার ক্লাসের পড়া আমি খুব গুছিয়ে করার চেষ্টা করি। ফার্স্ট পিরিয়ডে বাংলা ক্লাস। এই ক্লাসের প্রতিটা বাক্য আমি মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। ক্লাসের কাজ দিলে দ্রুত শেষ করে আপাকে দেখাই। আপা আমার খাতায় রাইট দিয়ে নাম সিগ্নেচার করে দেন। আমি আপার নাম পড়ার চেষ্টা করি। গোটা গোটা হরফে মুক্তাসদৃশ লেখা। উপরে লেখা ‘ভালো’। আর নিচে লেখা ‘রা খা’। এই ‘ভালো রা খা’ আমার খাতার প্রায় প্রতিটা পাতা পূর্ণ করে তোলে। আমি মাঝেমাঝেই থমকাই, এই আপার নাম কি? ‘ভালো রা খা’ — এটা কেমন নাম? পরে ভাবি, হতেও পারে। কারণ আমি তো এই নতুন দেশের কতকিছুই বুঝি না। নতুন মানুষ, নতুন ভাষা, নতুন বইপত্রের সাথে আমার মনে আপার নাম খটকার মতন ঘুরপাক খায়। এর মাঝেই একদিন ক্লাসের কাজে শুধু ‘রা খা’ লিখে টিক চিহ্ন দিয়ে দেন। আমি অবাক! পরে ভেবে নিই আজ আপা তাঁর নামের ‘ভালো’ অংশটি লিখতে ভুলে গিয়েছেন! থাক। মানুষের কী ভুল হতে পারে না?
আম্মা ততদিনে সিলেট চলে এসেছে। আম্মার সাথে সাথে প্রদীপ। আব্বা একটা বাসা নিয়েছে। এই বাসাতেও আড়াইখানা রুম। আমার আর আব্বার একাকী ‘মেসজীবনের’ ইতি ঘটেছে। তবে আমাদের এই বাসার চারদিকে বিশাল জায়গা। আব্বা বাঁশ দিয়ে ঘন করে বেড়া করে দিয়েছে। আমরা বলি ক্যাঁচার-বেড়া। আম্মা আর ছোটকা মিলে ধুমসে পালান মানে কৃষিকাজ করে চলেছে। মাটি খুঁড়ছে, আগাছা ফেলছে, গোবর-সার দিচ্ছে। কাঁচামরিচ-আলু-লাউ-শিম-টমাটো-বেগুনের গাছে আমাদের চারপাশে বিস্তর সবুজের উঁকিঝুকি। সব্জির সঙ্গে আম্মা আর ছোটকা এন্তার ফুলগাছও লাগিয়েছে। গোলাপ, জিনিয়া, বেলি আর দোপাটির শোভাতে সকালবিকাল ঝারি দিয়ে জল ঢালার কাজও চলছে পুরোদমে। এই নতুন বাসায় উত্তরাধিকা্রসূত্রে আমরা পেয়েছি একটা কাঁঠালিচাপা, একটা যুবতী নারিকেল, একটা পাহাড়ি আমড়া গাছ আর হাস্নাহেনার ঝাড়। পেয়েছি ‘লিভিং ফিশ’ জিইয়ে রাখার জন্য সিমেন্টের বাঁধাই করা হাউজ। মুরগির খোঁয়াড়।
তবে এই বাসায় আমাদের জীবনযাপন ভারি অদ্ভুত! আম্মা ভোরবেলায় উঠে চাচাজানের বাসায় চলে যায়। ওখানেই দিনমান বড়চাচিমার সাথে সংসারের কাজে সাহায্য করে। আমরাও সবাই ওই বাসাতে যাই। ওখানেই সারাদিন খেয়েদেয়ে-থেকে রাতে ঘুমুবার ঠিক আগে চলে আসি। তবে আমি ইশকুল থেকে ফিরে ভাত খেয়ে আব্বার বাসায় চলে আসি। আমার পড়াশোনা এখন আব্বাই দেখিয়ে দেয়।
একদিন পড়া দেখানোর ফাঁকে আব্বা জানতে চায় —
‘তোমার ক্লাসটিচার কে?’
আচানক এমন প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকি। আমি কি করে আব্বাকে বলি যে, কী অদ্ভুতুড়ে নাম আমার ক্লাসটিচারের? ওই নাম আমি বলব কীভাবে?
আব্বা ফের জানতে চায় —
‘বললে না তো ক্লাসটিচারের নাম কি?’
আমি বলি —
‘ভালো রাখা।’
আব্বার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। বলে —
‘ভালো রাখা?’
আমি বলি —
‘হুম। তা-ই তো।’
‘কে বলল তোমাকে?’
‘কেন নিত্যদিন আমার খাতায় লিখে দেন যে!’
‘কই দেখি? খাতাটা নিয়ে আসো তো!’
আমি ব্যাগ থেকে ক্লাসওয়ার্কের খাতাটা বের করে দেখাই। আব্বা ঘরদোর ফাটিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলে —
‘উনার নাম ভালো রাখা নয়। উনার নাম রাবেয়া খাতুন। তোমার ভর্তির দিন আমার সাথে আলাপ হয়েছিল। খুব সুন্দর দেখতে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ পরীর মতো!’
আব্বা হাসে। আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাই —
‘তাহলে আমার খাতায় ভালো লিখেন কেন?’
আব্বা ফের জোরে হেসে ওঠে। হাসতেই হাসতেই বলে —
‘তুমি যে ভালো লিখ তাই ভালো লিখেন। এই ভালো মানে গ্যুড।’
আমি মাটির দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকি। প্রতিদিন আমি ‘গ্যুড’ পেয়েছি আর কী না ভেবে নিয়েছি ক্লাসটিচারের নাম বুঝি ‘ভালো রাখা!’
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS