যেনবা কয়েক হাজার বছর ধরে শীতরাত্তিরের পথ হাঁটছি আমরা দুইজন। হিমেল হাওয়া জোরে বইলেই আমার গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে! আব্বার ডান হাতের মুঠো আমার বাম হাত ধরে রাখাতে আব্বা হয়তো টের পায়। সিলেটের তুখা শীতে আমি বারংবার কেঁপে উঠছি! দুইপা আগালে আমরা যেন চারপা পিছিয়ে পড়ছি। শীতের জোঁক আমাদের পা তীব্রভাবে কামড়ে ধরছে। ফলে হাঁটার গতি দ্রুত হলেও আমরা যেন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি! আব্বা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁধের উপর হাত রাখে। যেনবা আমায় অভয় দিয়ে বলতে চায় — এই তো আমরা এসে গেছি। আর মাত্র সামান্য পথ বাকি!
কুয়াশামোড়ানো আকাশে কিছু কিছু তারা মিটি মিটি করে জ্বলছে। ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোর চারপাশে শীতের পোকারা ঘুরে ঘুরে উড়ে চলেছে। এতে করে আলোর বৃত্তজুড়ে ডানার আড়াল। পোকাদের অবিশ্রাম ঘূর্ণনে কীরকম যেন আলোর ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। মনে হয়, আলোর বিচ্ছুরণকে বাধা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টারত তারা। অনেক দূর থেকেও পতঙ্গের ওড়াউড়ির মৃদু শব্দ শোনা যায়।
আমি এসব দেখতে দেখতে উস্টা খেতে খেতে নিজেকে সামলে নেই। হাঁটার তাল কেটে যাওয়াতে আব্বাও যেন অপ্রস্তত। আস্তে করে বলে —
দেখেশুনে পথ চলো।
আর কী দেখেশুনে চলব? আমরা প্রায় আব্বার বাসার সামনে এসে পড়েছি। সেই একই রকম বাঁশের খোপ খোপ গেট। সিমেন্টের পথ। পথের দুপাশে ইটের জ্যামিতিক সারি। তবে এই ইটগুলিতে শাদা রঙের চুনের প্রলেপ দেয়া। রাতের আঁধার ফুঁড়ে ইটেরা নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে।
আজ এসব লিখতে বসে ভাবছি — ও-রকম শীতের রাত্তিরে চাচাজানের বাসায় সবারই স্থান হয়েছিল, শুধুমাত্র আমি আর আমার বাবা ছাড়া! চিরকাল মেরুদণ্ড সোজা করে চলা মানুষটি, আমার বাবা, যে নিজের কোনো ভারই অন্য কাউকে দিতে চায়নি। নিজেই সব আগলাতে চেয়েছে। দুইহাতে আগলেছে। বুক দিয়ে পিঠ দিয়ে আগলেছে। কিন্তু এজন্য তো সে বাড়তি কোনোকিছুর সুবিধা পায়নি। হয়তো সেসব সে নিতেও চায়নি। পৃথিবীর সব দায়দায়িত্ব সে নিজেই বহন করতে চেয়েছে।
আব্বা পকেট হাতড়েপাতড়ে চাবি বের করে আনে। অন্ধকারে দুই-তিনবার চাবি ঢোকানোর চেষ্টার পর তালা খুলে যায়। ঘরের এক কোণে একটা হ্যারিকেন মৃদু আলো নিয়ে জ্বলছে। আব্বা আলো উসকে দিলে আমি ঘরের ভেতরটা দেখতে পাই। একটা বেশ বড়সড় খাটে বিছানা পাতা। বালিশ-লেপ সুবিন্যাস্ত। বালিশের কভারের রঙ বিছানার চাদরের মতো। আর লেপের কভারের রঙ কোরা। খাটের মাথার দিকে একটা আলনা। খাটের উল্টা দিকে বেতের একসেট হেলান চেয়ার এবং টেবিল।
আব্বা জুতা-মোজা খুলে আলনার নিচের র্যাকে গুছিয়ে রাখে। পরনের কাপড় বদলাতে বদলাতে বলে — ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে খুব সকাল সকাল উঠতে হবে। আর তোমাকে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে।
আমি কিছুই ধরতে পারি না। কীসের পরীক্ষা? আমি-না কয়েকদিন আগেই পরীক্ষা দিয়ে নতুন ক্লাসে উঠলাম! এইবার পরীক্ষায় প্রথম হতে পারি নাই। কিন্তু দ্বিতীয় তো হয়েছি। আর পরীক্ষার সময়ে টিফিন খেয়েছি। ছোটকার নিয়ে-আসা টিফিন। এই টিফিন নিয়েও তো আমি কম কান্নাকাটি করি নাই। বড়চাচিমার বড়ছেলে আর ছোটকা যখন শহরে বৃত্তিপরীক্ষা দিতে গেল, তখন আব্বা তাদের জন্য টিফিনক্যারিয়ার ভরে খাবার নিয়ে গিয়েছিল। আম্মা পরোটা, মাংশ আর ডিম ভেজে দিয়েছিল। অথচ আমার পরীক্ষা এলে এসবের কিছুই হয় না। আমার পরীক্ষা হয় এক-দুই ঘণ্টা। কোনো টিফিনের ঘণ্টা বাজে না। কিন্তু তাতে কি? ওরা টিফিন খেয়েছে এখন আমার পরীক্ষার সময়ে টিফিন পাবো না তা তো হয় না। আমাকেও টিফিন খেতেই হবে। ফলে ছোটকার হাতে ফিনিফিনে শাদা কাগজে মোড়ানো দুইটা ছানার সন্দেশ আমি এবার পেয়েছি। পেয়েছি নানান কায়দার পরে। আমাদের ইশকুলে ছেলেদের ঢোকা বারণ। ফলে ছোটকাকে দারোয়ান ঢুকতে দেয়নি। ছোটকাও তো কম নাছোড়বান্দা নয়। তাছাড়া আমার টিফিন না এলে বাড়ি গিয়ে তো আমি কেঁদেকেটে তুফান তুলে ফেলব। আমার ইংরেজি মৌখিক পরীক্ষা হয়েছে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। ওই গাছের ছায়ার জেরুফুপুআম্মা চেয়ার-টেবিল পেতে আমাদের পরীক্ষা নিয়েছে। ইশকুলের টিনের বেড়া তেমন উঁচু না হওয়াতে ছোটকা উঁকি দিয়ে আমায় দেখে ফেলে ডাক দেয় —
পাপড়ি, ওই পাপড়ি তোর টিফিন।
বলেই একটা বাদামিরঙা ঠোঙা ছুঁড়ে দেয়। আমি সেটা খুলে দেখি দুইটা সন্দেশ। মাটিতে আছাড় খেয়ে সামান্য ব্যাকাত্যাড়া হয়ে গেছে! ছোটকার বুদ্ধি আছে! এমনভাবে প্যাকেট করে এনেছে, তাতে যেন কিছুতেই ধুলামাটি না লাগে।
আমি অবশ্য ওই সন্দেশ একা একা খাইনি। ফুপাতো বো্ন যূথীকে ভাগ দিয়ে খেয়েছি। এই সন্দেশ চিনি আর ছানা দিয়ে বানানো হয়। খেতে কী যে মজা তা বলে বোঝানো যাবে না।
সন্দেশ খেয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসেছি মাসদুয়েক তো হবেই। এখন আব্বা আবার কীসের পরীক্ষার কথা বলছে?
দরোজা-জানালার ফাঁক দিয়ে শীতের কনকনে হাওয়া এসে ঢুকছে। আমি তড়িঘড়ি লেপের তলায় ঢুকে পড়ি। শুয়ে পড়া মাত্রই রাজ্যির ঘুম এসে আমাকে মরণকাঠি ছুঁইয়ে যায়! ট্রেনের দুলুনিতেও অনেক ঘুমিয়েছি।
আব্বা হাত-মুখ ধুয়ে এসে বেতের চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বলে —
আগামীকাল অগ্রগামী ইশকুলে পরীক্ষা। ভালো জামাকাপড় পরে যেতে হবে কিন্তু।
আমি লেপের ওমে তখন শীতের রক্ষাকবচ পেয়ে গেছি। ভালো জামাকাপড়ের জন্য আর চিন্তা কি? গত ঈদে আব্বা আমাকে একটা কর্ডের প্যান্ট আর সবুজ রঙের কুর্তা কিনে দিয়েছে। সেটা তেমনি রাখা আছে। খুব বেশি পরা হয় নাই। সেটা পরেও যাওয়া যাবে ক্ষণ। কিন্তু আমি পরীক্ষা কি দিব? পড়াশোনা তো সব খেয়ে হজম করে ফেলেছি। সেই কবে নতুন ক্লাসে প্রমোশন পেয়েছি। সিলেটে চলে আসব আসব করে কোনো বইপত্রই কেনা হয় নাই। কিন্তু পরীক্ষার এইসব দুশ্চিন্তা আমার ঘুমের কাঁটা হতে পারে না। আমি পরিস্কার কভারলাগানো লেপের তলায় ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমাবার আগে আমার পাশে আব্বার বালিশটা গুছিয়ে রাখি। আব্বা হয়তো অফিসের কাজবাজ করে ঘুমাবে।
আমার একবারও আর কারো কথা মনে হয় না। কারো জন্যই মনখারাপও হয় না। আমার আব্বা এবং আম্মা দুইটাই যে-মানুষ, আমি তার কাছেই রয়েছি। ফলে আমার আর ভাবনা কী? আমার আর চিন্তা কী?
চলবে
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS