ব্যাডবয় কিউ ও তাঁর গার্বেজ || আহমদ মিনহাজ

ব্যাডবয় কিউ ও তাঁর গার্বেজ || আহমদ মিনহাজ

সিনেভাষায় উপমহাদেশে বিরাজিত টাবু ধ্বংস করতে মরিয়া কিউ ওরফে কৌশিক মুখার্জির কথা প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল। উপমহাদেশে যৌনতা থেকে শুরু করে শতেক বিষয়কে সমাজ যে-আঙ্গিকে ভাবে ও রায় বা জাজমেন্ট  দিয়ে থাকে কৌশিক সেখানে নৈরাজ্য সৃষ্টির পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন। যারপরনাই তাঁর সিনেভাষায় নগ্নতা, সহিংসতা, নৈরাশ্য এবং সব মিলিয়ে ইরোটিক অ্যানার্কিকে কাজে লাগিয়ে প্রচলিত মূল্যবোধ ধসিয়ে দেওয়ার স্বরগ্রাম তীব্র হয়ে ফোটে। বিষগাণ্ডুকসমিক সেক্স  বা রবিঠাকুরের তাসের দেশকে নতুন আঙ্গিকে ভাষা দানের ক্ষণে নৈরাজ্যকে অনিবার্য করতে চাইলেও বাঙালি সংস্কৃতির ঘোরচক্করে পড়ে আটকে গিয়েছিলেন মনে হয়। হিন্দি ভাষায় নির্মিত গার্বেজ-এ তাঁর সেই মিশন একপ্রকার পূর্ণতা লাভ করেছে মনে হলো। পুরুষের হাতে বোনা নারীভাবিক নৈরাজ্যের ইতিনেতি নিয়ে মন্তব্যের আগে ছবির কাহিনিসূত্র খানিক ধরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করি :—

অনলাইনে নিজের যৌনমিলনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার সুবাদে প্রধান নারীচরিত্র রামি কুমার ট্রমার সম্মুখীন হয় এবং কাহিনির গতিধারায় স্যাডিস্ট বিকার তার মধ্যে ভর করে। মেডিকেল কলেজের ছাত্রী রামির এই ট্রমায় গমনের ঘটনাকে উপলক্ষ করে নির্মাতা উপমহাদেশে প্রভাববিস্তারী যত অনুষঙ্গ রয়েছে তার সবকিছুকে আবর্জনা হিসেবে পর্দায় তুলে ধরেন। ধর্ম অবধারিতভাবে সেখানে গার্বেজে রূপ নেয়। ট্রমার সম্মুখীন রামি শহর ছেড়ে গোয়ায় গমন করে ও এক বান্ধবীর নিরালা বাংলোয় আশ্র্রয় নেয়। মনোরম গোয়া শহরকে বিস্বাদ ও ভাগাড়তুল্য স্থান রূপে কৌশিক ক্যামেরায় ধারণ করেন। 

পুরুষভাবিক দুনিয়ায় যৌনপাশব হেনস্থার শিকার রামি গোয়ায় পা রাখার দিন থেকে পর্যটক বহনকারী ট্যাক্সিচালক পানিশ্বরের সঙ্গে পরিচিত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসে প্রচণ্ড সাধুভক্ত ও  সাধুবাবার সমকামী খিদে মিটানোয় নিবেদিত পানিশ্বরের ঘরে শিকলে বাঁধা মূক এক নারী সেবাদাসীর দেখা মিলে। ছবিতে সে অনামা হলেও এই চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন অর্থাৎ শতরূপা দাস নামে তাকে ডাকা যেতে পারে। এই ভূবর্ষে জন্ম থেকে ধর্মীয় টাবু ও শতেক পুরুষভাবিক উপাদানের সেবাদাসী রূপে শিকলবন্দি নারীটি এখানে ভন্ড সাধুবাবার ঘোরচক্করে মগজধোলাই পানিশ্বরের সমুদয় চাহিদা ও বিকার পূরণে নিজেকে নিঃস্ব করে যায়। 

ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়া ফ্রিক পানিশ্বর আচমকা রামি কুমারীর ভাইরাল ভিডিওর সন্ধান পায় এবং তার মনে তাকে সম্ভোগের বাসনা জেগে ওঠে। বিদেশি পর্যটকে ভরভরন্ত গোয়া শহর রামিকে স্বস্তি দিতে ব্যর্থ হয় ও উল্টো নারকীয় হয়ে ওঠে। দেশিবিদেশি পুরুষ আর রমণীকুলের ইভটিজিং ও বিচিত্র যৌনপাশব প্রস্তাবের শিকারে পরিণত হয় সে। পানিশ্বরের বিকারগ্রস্ত বাসনার খবর ওদিকে গোপন থাকে না। খবরটা জেনে যাওয়ার পর ট্রমা ও ট্রলের ঘুরপাকে দুর্বিষহ রামি নিজের শেষ সহ্যশক্তি হারিয়ে বসে। সকল যন্ত্রণার প্রতিকার ঘটাতে পানিশ্বরকেই ভারতীয় পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি ঠাউরায় এবং নিজের বাংলোয় তাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে লোহার খাঁচায় বন্দি করে। যৌনপাশবতার জবাবে পাল্টা যৌনপাশবতার খেলা ছবির ক্লাইমেক্সে এসে চরম সহিংসতার দিকে মোড় নেয়। বাবার সেবাদাস পানিশ্বরের ওপর স্যাডিস্ট পন্থায় অকথ্য নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে। 

হিন্দুত্বের জোয়ারে উতাল-পাতাল ভারতবর্ষের পুরষাঙ্গ ধরে টান দিতে পানিশ্বরের ফেসবুক অ্যাকাউন্টকে রামি এইবেলা এস্তেমাল করে। বাবা সমকামী ও ভণ্ড এই স্ট্যাটাস বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। পুরষভাবে পুরুষকে নিপীড়নের কোনো পন্থা সে আর বাদ রাখে না। জলপিপাসায় কাতর পানিশ্বরকে নিজের মূত্র পান করানো থেকে শুরু করে ডিলডো দিয়ে পায়ুসঙ্গম … সোজা কথায় পুরুষভাবের দুনিয়ায় নারীদেহকে যত উপায়ে পীড়নের শিকার হতে হয়  রামি একে-একে তার স্বাদ সেই পুরুষকে গিলতে বাধ্য করে। ওদিকে শতরূপাকে সে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে ও পানিশ্বর তথা পুরুষতন্ত্রের হালত দেখাতে বাংলোয় নিয়ে যায়। পানিশ্বর এই ফাঁকে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসে ও প্রবল আক্রোশে রামিকে খুন করতে গিয়ে শতরূপাকে খুন করে বসে। কাহিনি অন্তে পৌঁছায়। শতরূপার মৃতদেহ কোলে সর্বস্ব হারানো পানিশ্বর গোয়া শহরের ময়লা ফেলার ভাগাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর ওদিকে রামি গাড়ির চাবি ঘুরায় তাকে জন্মের মতো শেষ করে দিতে। 

প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বহমান এই সহিংসতা এ-কারণে যে, ভারতীয় সিনেমার ব্যাড বয়  কৌশিক হয়ত ভাবেন সহিংসতা এখানে একমাত্র বৈধ ঘটনা, একে অমোঘ করা ছাড়া বিচিত্র টাবুজালে বন্দি উপমহাদেশের লোকের মনোজগতে ধস নামানো সম্ভব নয়। কুশলতার সঙ্গে বোনা সিনেভাষায় নিজেকে অতিক্রম করে গেলেও নৈরাজ্যের পুরুষভাবিক ধাঁচটাই মূলত নারীসংবেদী ভাষাকে বাহানা বানিয়ে কথা কইতে উন্মুখ থাকে। ভারতীয় পুরুষ দর্শক ছবিখানাকে নিতে পারেনি এবং নারীর অবস্থাও তথৈবচ। সকলেই নির্মাতাকে অসুস্থ ও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী রাজনীতির বিকারগ্রস্ত পরিণাম রূপে দেগেছেন। বলিনায়িকা ক্যাটরিনা কাইফও দেখলাম খাপ্পা হয়ে মন্তব্য ছুঁড়তে কসুর করেননি :—

আমি ভাই হিন্দু নই তবে ‘গার্বেজ’ নামের ছবিতে আপনার চোখেমুখে হিন্দুফোবিয়ার ইতর প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মোটেও অবাক হইনি, কারণ ছবিটা কমিউনিস্ট পশ্চিমবঙ্গ থেকে চালান হয়েছে। হিন্দুদের যেসব কাজকারবার ছবিতে ওরা দেখায় সে-তুলনায় এই বামপন্থীগুলা হাজার গুণ নীচ আর জঘন্য। 

বামপন্থী ও পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে ক্যাটরিনার ধারণা বালখিল্য তাতে সন্দেহ নেই। কৌশিককে কমিউনিস্ট বলে দাগানোও তাঁর অগাধ মূর্খতার পরিচয় তুলে ধরে। বলিপাড়ায় বাঙালির দাপুটে বিচরণ থাকলেও হিন্দিবলয় বাঙালি সম্পর্কে মার্কামারা কতিপয় ধারণার মধ্যে বরাবর সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছে। একুশ শতকেও মনোভাব বিশেষ পাল্টায়নি। নার্গিস দত্ত সত্যজিৎকে দারিদ্র্যের ফেরিওয়ালা বলে কটুক্তি করতে সেই সময় দ্বিধা করেননি। একালেও কাইফ থেকে কঙ্গনা সকলে কমবেশি বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব পুষেন বৈকি। সেইসঙ্গে এটাও সত্য যে, কৌশিক যে-ঘরানায় ছবির কাহানি ফাঁদেন সেটা উপমহাদেশের হজমশক্তির পক্ষে গুরুপাক। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার পছন্দের নির্মাতা নন। তাঁর আকাট নিহিলিজমে নারীকে দাগানোর ঘটনায় বিস্তর গোজামিল রয়েছে। তবে হ্যাঁ, পশ্চিমা সিনেবিশ্বে টাবুধ্বংসী নিহিলজমের ঝাণ্ডা উড়াতে যেসব সিনেভাষা অহরহ তৈরি হয় ও পুরষ্কারের বন্যা থেকে শুরু করে রজার ইবার্টদের বাহবা কুড়ায়, গার্বেজ-এ কৌশিক এই প্রথমবার সেই মানকে অনায়াসে ছুঁয়েছেন বলা যায়।

তাঁর ছবি ভারতের হলে রিলিজ সম্ভব নয়। কৌশিক নিজে সেটা জানেন এবং হয়ত পরোয়া করেন না। তাঁর লক্ষ্য কাল্ট ক্লাসিক  হয়ে ওঠা, যা হয়ত আগামীদিনের নির্মাতাদের টাবুধ্বংসী ছবি বানাতে প্রেরণা দিয়ে যাবে। ভেনিস-বার্লিন ও নেটফ্লিক্স সেখানে তাঁর সহায় বটে। ভারতীয় দর্শকের নাড়িভুঁড়ি মোচড়ায় দেখে তাঁর তাই পুলক জাগারই কথা। নারীসংবেদী নৈরাজ্যের প্রবক্তা রূপে নিজের জায়গায় তিনি সৎ এবং সফল। এখানেই প্রশ্নটা ওঠে, — একজন ধর্ষিতা কিংবা যৌন-প্রতারণার শিকার নারীর অভিজ্ঞতাকে কৌশিক যে-অঙ্গে বয়ন করেন, নারীরা কি সেই ছক ধরে আগাবেন, নাকি সেখানে নতুন মোড় নেওয়ার কথা ভাববেন?


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you