মার্কিন প্রবাসী সিলেটি র্যাপার ফকির লাল মিয়ার হাত ধরে বাংলাদেশে র্যাপ গানের শুরুয়াত গেল দেড় দশকে কতিপয় ভালো র্যাপারের জন্ম দিয়াছে। লাল মিয়া তো ছিলই, এছাড়া জালালি সেট-র শাফায়েত, গালি বয়-র তাবিব মাহমুদ এবং সিলেটের কিছু র্যাপার দ্রুততালের সংগীতে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষার ইডিয়ম নিয়া পুরাদমে খেলে। রাকিম, জে-জেড, ফিফটি সেন্ট, গিগস হইতে রিজ আহমদ অবধি বিস্তৃত র্যাপ গানবাজনা সইতে পারলে বাংলার র্যাপারদের হল্লাগল্লা সইতে না পারার কারণ দেখি না।
লাল মিয়ার পয়লা দিকের গানগুলা মোটের ওপর আজো অমলিন। সদ্য অবমুক্ত দৌড় দে গানটাই-বা কম কি? দ্রুততালের গানের ভাষায় জীবনযুদ্ধের কথা ডেলিভারি দেওয়ার ক্ষণে গায়কের মুখ থেকে অবলীলায় ছিটকায় জান বাজি রেখে ঘোড়ার মতো দৌড়ানোর কাহিনি। সেখানে তার শক্তি কেবল সে নিজে। না দেশ, না পরিবার, না স্বজন, না মহামহিম গায়েবি ঈশ্বর, — কাউকে সাথে পায় না বেচারা। দৌড়বাজির খেলায় লাল মিয়া তাই অনায়াস বলতে পারসে, ‘আমি হইলাম উড়োজাহাজ / এইটা আমার রানওয়ে।’ কথাটা সহজ, কিন্তু ভাবতে বসলে কথার শক্তিটাকে পাথরের চেয়ে ভারী ঠেকে কানে। উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ে কিন্তু রানওয়েতে ঠিকঠাক ল্যান্ডিং সবসময় সম্ভব না-ও হইতে পারে। বাংলা র্যাপটা এইখানে লাল মিয়ার রানওয়ে। এখান হইতে আকাশে উড়াল ও অবতরণকে নিজের জন্মার্জিত অধিকার বলে মানে সে। আরেক সিলেটি র্যাপার সি-লেট বা তার মতো র্যাপারদের দিকে হয়তো এভাবে গানে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। তারা অনেকে আজকাল বলে বেড়ায়, — বালের র্যাপ গায় এই লোক!
র্যাপ গানের সবটাই খুল্লামখুল্লা ঘটনা। প্রতিবাদের ভাষা কোনো রাখঢাক মানে না। আফ্রিকার মাটি হইতে উড়াল দিয়া মার্কিন দেশে নামার কারণে হয়তো র্যাপের সারা অঙ্গ জুড়ে নাচের ছন্দটা সমানে ঢেউ তোলে। র্যাপ গায়ক দ্রুততালে একখান কবিতাই আসলে পাঠ করে যায়। বাদ্যযন্ত্রে উৎপাদিত আওয়াজগুলা কবিতার সঙ্গে সেখানে সংগত করে। ওদিকে গায়ক নিজের দেহকে নাচায়। বাংলার ফকিরি-দরবেশি গানে গায়কের দেহ বেদম ছন্দে আন্দোলিত হইতে দর্শক দেখে। একে বাদ দিলে গানের কথায় মর্মরিত ফানাভাবকে ধারণ করা তার পক্ষে শক্ত কাজ মনে করে সে। র্যাপ গানে গায়কের দৈহিক আন্দোলন বা মুভমেন্ট অনেকটা সে-রকম। এর মধ্য দিয়া গানের কথারা জীবন পায়। র্যাপের সামগ্রিক পরিবেশনা যেহেতু রাখঢাক জানে না, সংগত কারণে র্যাপ গাইয়েদের একে অন্যকে নাকচ করার ঘোষণা সরাসরি গানের ভাষায় ঢুকে পড়ে। লাল এই ঘটনার ব্যতিক্রম নয়। জীবন ধরে চলমান দৌড়ের কাহিনি শ্রোতাকে শোনায় সে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ র্যাপারদেরকে দৌড়ানির ভয় দেখিয়ে ধামকিও দিয়া দেয়, — ‘দৌড় দে দৌড় দে / সময় থাকতে দৌড় দে / মাথায় একখান গামসা বাইন্ধা / যেমনে পারস দৌড় দে… / আল্লাহর কাছে জানটা রাইখা / চোখটা মুইঝা দৌড় দে / তুই কে আর হে কে / আমার লগে তাল দে / আমি হইলাম উড়োজাহাজ / এইটা আমার রানওয়ে।’ র্যাপ গান গাওয়ার সঙ্গে জীবনভর দৌড়ানোর তফাত নাই, সুতরাং নো কম্প্রোমাইজ ব্রাদার! তোমায় যে দৌড়ানি দিতে আসছে তারে পাল্টা দৌড়ানি দিতে না পারলে রানওয়ে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়।
লালের গানটা শেষ হয় খোদার নিকট ফরিয়াদ জানিয়ে। খোদা তো সাত আসমানের ওপরে বসে মজা লইতাসে। কে ভালো আর কে মন্দের তালিকায় ব্যস্ত খোদাতালার লিস্টে লাল নিজের জায়গা খুঁজে পায় না। লিস্টে আর কারো নাম ঢোকানোর উপায় নাই। উপায় যদি থাকেও লাল নিজেকে পাপী ভাবতে নারাজ। সে তো জীবনভর পাঞ্জা লড়েছে নিজেকে বাঁচানোর আশায়। এখন ভুলচুকের দায় তার ঘাড়ে কেন চাপাবে খোদাতালা! গানের জবানে লাল ফরিয়াদ করে, ‘চোখে পানি জমসে ঠিকই আমি কিন্ত কান্দি নাই / উষ্ঠা খাইয়া ঠিকই পড়ছি শুইয়া কিন্তু থাকি নাই / দুই হাত তুইলা চাইসি খোদা তুমি তখন দেখো নাই / আজ এক-দুইটা প্রশ্ন আছে আমি খালি জবাব চাই।’
লালের এই প্রতিরোধ নতুন ঘটনা মোটেও নয়। সাধক জালালউদ্দিন বা সমগ্র বাউলাঙ্গে গীত বিচারগানে সুরটা কমবেশি সুলভ। মার্কিন দেশে প্রবাসী র্যাপারের বাউল গানের ভাবুকতায় মগ্ন হওয়ার টাইম নাই, যদিও গানের ছন্দে গাঁথা আর্তি ও আত্মশক্তি বাউলের সহগ। গায়েবি খোদাতালার পাপপুণ্য বিচারের পদ্ধতিকে বাউলের মতো সেও প্রতিরোধ করে। লাল মিয়ার র্যাপ গানে সচল ভাষাকে ইচ্ছে করলে এভাবে ভাবা যায়, ভাবা সম্ভব, কেবল ছুঁৎমার্গ ছেড়ে লেখকদের এইসব নিয়া দুছত্র লেখা প্রয়োজন।
কবুল যাই এইবেলা, বাংলা র্যাপ গানের সবটাই সুখকর এমন নয়, তা-সত্ত্বেও বাংলা জবানে এই গানের সম্ভাবনাকে তারা আগায়া নিচ্ছে। সিলেটি উচ্চারণে লাল মিয়ার প্রতিরোধ কিংবা জালালি সেট-র আপাত অশ্লীল ঢাকাইয়া কথ্য বুলির বাহারে যে-দেশ ও সমাজকে চমকাইতে দেখি তাকে নিছক বিনোদন ভাবাটা সুবিচার নয়। এই ভাষা বুঝ-এ আনতে না পারলে বিগত ত্রিশ বছর ধরে বিবর্তিত বাংলাদেশের সমাজকে কি সত্যি বোঝা যায়? তাবিব মাহমুদকে হয়তো এ-কারণে তার শ্রোতারা আদর করে এ-যুগের নজরুল নামে ডাক পাড়ে। বাংলার রকগান দারুণ শুরুয়াতের পর এক পর্যায়ে পথহারা পাখির ন্যায় প্রেম, বিরহ, স্মৃতিকাতর হতাশা ও বিষাদে নিজেকে নিঃস্ব করতে থাকে। তার সামাজিক উপযোগ যারপরনাই ক্রমশ গৌণ হইসে। বাংলা গানের দেহে গুঞ্জরিত রোমান্টিকতায় নিজেকে গোর দেওয়া ছাড়া নতুন পথে হাঁটতে পারে নাই। ঘাটতি পূরণের ক্ষমতা বাংলা র্যাপ রাখে কি? অনুসন্ধানটা যদি কেউ করেন তবে ভাবনার নতুন জানালা খোলার সুযোগ অবারিত হবে হয়তো।
ওপার বাংলায় নচিকেতার শুরুর দিকের গান এই বেশ ভালো আছি-র পরিবেশনায় র্যাপছন্দের আমেজ ছিল মনে পড়ে। খাঁটি র্যাপ ছিল না তবে একুনে আঠাশ বছর আগের গানে দ্রুততাল থেকে ঢিমেতালে উঠানামার খেলায় নচিকেতা ধর্মীয় সংকীর্ণতার নবউত্থানের সংকেত দিয়াছিলেন। সমাজে বিদ্যমান অনাচারকে একহাত দেখে নেওয়ার র্যাপভাষা তাই বাংলার পপ কালচারে নতুন শক্তির দ্যোতক। ভাষায় অরাজকতা মাঝেমধ্যে দরকারি ঘটনায় মোড় নেয়। জালালি সেট যেমন সুরা টার্গেট গানে সেইটা জানান দিয়েছিল, — ‘লাঠি ভাঙ্গার আগে বাইরাই পিটাই মারি সাপরে / আর গানের ভিতর target করি তর মায়রে বাপরে… / দৌড়ের উপ্রে গাবতলি এক মিনিটে মাইল পার / আর এইবার দেখবেন কত ধানে কত চাইল কার / আর বাপের আগে সব কপাল থাপড়াইয়া গাইল পার / কারণ দেশ চালায় যত চোর-চোট্টা-বাটপার… / আবে তর ট্যারাক্কা চ্যাকা মারানির পোলা / কইয়া গাইল পারে রাস্তার যত ঢাকাইয়া পোলা।’
নৈরাজ্যের সুরত ধরে বিকশিত বাংলা র্যাপ গান নিয়া ক্রোড়পত্র নামানো বিরাট সাহসের কাজ। রুচির গোয়া মেরে যারা কাজটা করতে পারবে তারা পাইওনিয়ার। ধ্রুপদী গানবাজনার পাশে জনস্রোতের ভিড় ঠেলে আবির্ভূত গায়নরীতিটা ভীষণ রাজনৈতিক মূল্য রাখে। এর ব্যবচ্ছেদ অনলাইন/অফলাইন ছোট/বড় কাগজে করতে পারাটা তাই পুণ্যি। সে-রকম লোক অবশ্য প্রয়োজন যারা লাল, তাবিব বা জালালি সেট-র ভোকাবুলারিতে সক্রিয় এবং নগরজীবী বাঙালি আমজনতার মুখে হরহামেশা ব্যবহৃত ভাষার সমাজ-রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাখ্যার হ্যাডম রাখে।
র্যাপকাহন ৩ : বাংলায় হিপহপ
র্যাপকাহন ২ : বাংলায় হিপহপ
র্যাপকাহন ১ : বাংলায় হিপহপ
ইসলামি হিপহপ
পাঙ্ক ইসলাম : তাকওয়াকোর
বাংলায় হিপহপ ও র্যাপ নিয়া গানপারে অন্যান্য রচনা
বাংলায় রিদম অ্যান্ড পোয়েট্রি নিয়া প্রাথমিকা
বাকরুদ্ধ ভুবনের পলিটিক্যাল অ্যান্থেম : স্কিব খানের ‘সব চুপ’
র্যাপ, রাজা কুমারী, প্রাচ্য ও পশ্চিম
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS