ইসলামি হিপহপ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামি হিপহপ || আহমদ মিনহাজ

র‍্যাপগানের ভাষা ও পরিবেশনায় যেসব নৈরাজ্য দেখি তার কিছু লক্ষণ পশ্চিম গোলার্ধের রক পাঙ্করক  ঘরানার গানবাজনায় আগে থেকে প্রকট ছিল। নাতিদীর্ঘ মুখবন্ধ সম্বলিত রচনা (*র‍্যাপ নিয়ে লেখা সময় ওটা পাঠ করেছি) আর ই-মেইলের বক্তব্যে আভাসটা আপনি দিয়েছেন। আমি নিজেও লেখা শেষ করার পরে এই দিকটা ভেবেছি। মুসাবিদায় হাত দিলে র‍্যাপের সঙ্গে পাঙ্কের মিলন ও দূরত্বের জায়গাকে বাজিয়ে দেখা যাবে। তাৎক্ষণিক ভাবনার ওপর ভর করে লেখার কারণে এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল আর ওদিকে আরববিশ্বে র‍্যাপগানের জমিজিরেত বিষয়ক আলোচনায় বিস্তারিত হতে পারিনি। এই সুযোগে ওদিকপানে ধাওয়া করা যায় হয়তো। রবিন রাইটের রক দ্য কসবা : দ্য র‍্যাগ অ্যান্ড রেবেলিয়ন অ্যাক্রোস দ্য ইসলামিক ওয়ার্ল্ড  কিতাবখানা আরব দেশগুলোর সাংস্কৃতিক পালাবদলের পরিধি বুঝতে বেশ কাজে দিয়েছে। হিপহপ ইসলামের বিকাশ-প্রকাশের ধারা ও প্রবণতাকে অগত্যা র‍্যাপকাহনে প্রাসঙ্গিক করা যাবে বলে মনে হচ্ছে।

নাইন ইলেভেন পরবর্তী আরবের সাংস্কৃতিক পালাবদল ও জনমনে এর অভিঘাতকে রবিন তাঁর কিতাবে ভালোই বিশ্লেষ করেছেন দেখতে পাচ্ছি। লাদেনকাণ্ডের পর থেকে আরবভাষী জনগোষ্ঠীকে পরস্পর বিপরীত দুটি প্রবণতার সঙ্গে কুস্তি লড়তে হয়েছে। পশ্চিম গোলার্ধে প্রকটিত ইসলামভীতির চাপ আরব ছাড়াও সমগ্র মুসলিম সমাজকে এখনো কমবেশি সইতে হচ্ছে। চাপ মোকাবিলার ঘটনায় পশ্চিম থেকে আগত সংস্কৃতির হাজারটা লক্ষণ ও চিহ্নকে তারা হাতিয়ার করে নিয়েছিল। রবিনের কিতাব পাঠ করতে বসে টের পেলাম নিজের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ছাঁচে ফেলে সেইসব লক্ষণ ও চিহ্নের নবায়ন ঘটাতে তারা ভুল করেনি। পালাবদলের চিহ্নগুলো সেখানে পশ্চিমা সংস্কৃতির ছাপ বহন করলেও আরব জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়কে গেল দুই দশক ধরে তারা সদর্পে তুলে ধরছে।

আরবের গ্রাফিতি, ডিজে, রক, পাঙ্করক, র‍্যাপ ইত্যাদিকে আপনি ডিরেক্ট  মার্কিন দেশের কপিক্যাট  ভাববেন সে-অবকাশ তারা রাখেনি। আমাদের হিপহপচর্চার ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি বেশ গুরুতর। র‍্যাপকাহনে আমি ইচ্ছে করে ওদিকে বেশি যাইনি। হালকা-পাতলা ইশারায় সংযত থাকা বেহতর মনে করেছি। শুরুয়াতের বিষয়টি মাথায় থাকায় বেশি আগে বাড়িনি। খোঁচা ও সমালোচনা যথা সময়ে যথা স্থানে পরেও করা যাবে ভেবে বিরত থেকেছি। হিপহপ নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তায় ওটা করতে গেলে বাঙালি শ্রোতার কানে র‍্যাপগানটাকে পৌঁছানোর লড়াইয়ে নিবেদিতজনদের সৃজনশীল ভাবনার দৈন্য বড়ো বেশি নগ্ন হয়ে উঠত! রক আঙ্গিকে গীত বাংলা ব্যান্ডসংগীতেও সমস্যাটি রয়েছে। মার্কিনি প্রভাবের স্থানিক রূপান্তর সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে এর পুরোধা ব্যক্তিরা যেসব কথাবার্তা আওড়ান সেগুলো আমার কাছে স্ববিরোধী লাগে। গানপার-এ প্রকাশিত কোনো এক তাৎক্ষণিকায় বোধহয় বিষয়টি নিয়ে দু-ছত্র লিখেছিলাম। আপনার দেওয়া তথ্য মোতাবেক উক্ত রচনাটি জনৈক ব্যান্ডশিল্পীকে সেই সময় রাগিয়ে তুলেছিল। এ আমারই ব্যর্থতা ছিল যে বক্তব্যটা আমি স্পষ্ট করতে পারিনি, যে-কারণে তিনি হয়তো এর উল্টো মানে করে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এবার তাই সাধু সাবধান  ছিলাম বলতে পারেন।

র‍্যাপকাহন লিখতে বসে উল্টা বুঝলি রাম-র সমস্যায় যেন পড়তে না হয় সেজন্য প্রারম্ভিকায় বাংলা র‍্যাপচর্চার হালত বা হিপহপকে বুঝে নেওয়ার খাসলতকে Bold Criticism-এ বিদ্ধ করার ভাবনাটা বাদ দিয়ে আগানোর চেষ্টা করেছি। তবু ফাঁকফোকরে দুটোচারটে কথা বলেছি যা পাঠককে রাগিয়ে দেওয়া বিচিত্র নয়। সিলেটি লেখকদের দেহমনে আভিজাত্য ও উন্নাসিকতার বিমার নিয়ে আপনি ই-মেইলে অভিযোগ হেনেছেন। আমার তো মনে হয় বাঙালি জাতির মধ্যেই মোটা দাগে বিমারটা ব্যাপক। কবি-লেখক-গায়ক তথা সংস্কৃতিসেবী সকলেই কমবেশি নিজের মতের বিপক্ষে কিছু বলতে গেলে রে রে করে তেড়ে আসেন। টলারেন্স  শব্দটি অন্তত এই দেশে পাবলিকে খায় না।

যা-ই হোক, আরবের কথায় আবার ফিরি। রবিন রাইটের কিতাব থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করতে গিয়ে মনে হয়েছে মার্কিনি সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে আরবের কবি-লেখক-শিল্পীরা গেল-গেল রব তুলতে এখন আর অতটা আগ্রহী নয়। তারা বরং আরবের মাটিতে ঘনীভূত রক্ষণশীল উগ্রতা ও সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে ইসলামী সংস্কৃতিকে কীভাবে উদ্ধার করা যায় তার উপায় খুঁজছেন। এই জঙ্গে নেমে পশ্চিম গোলার্ধে সুলভ হিপহপের বিচিত্র বিক্ষেপে স্থানিক উপকরণকে প্রাসঙ্গিক করার ভাবনায় তাদের গমন করতে হয়েছে। আরববিশ্বে র‍্যাপগানের পরিবেশনা বা সামগ্রিক অর্থে হিপহপটা এই বিবেচনায় আমাদের চেয়ে পরিপক্ক। যুগ-প্রাসঙ্গিক এবং প্রাগ্রসরও বলা যায়।

নবতি (Nabati) আঙ্গিকে বিরচিত কবিতা থেকে শুরু করে সিনেমা, গানবাজনা, চিত্রকলা এবং গ্রাফিতি-রক-পাঙ্করক ও র‍্যাপ গানে আরব সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও আন্তঃসংঘাতকে ফুটিয়ে তোলার সবাক চেষ্টা চোখে পড়ে। মিশরের নাগরিক খালেদ হাফেজের ছবি আঁকার ধরতাই (দ্রষ্টব্য : The Hyperreal world of Khaled Hafez by Kirno Sohochari) বুঝতে গিয়ে এ-ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা হয়েছিল। ছবি আঁকার পদ্ধতিতে খালেদ মার্কিনি পপ আর্টের আঙ্গিককে মিশর তথা আরববিশ্বের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের মতো ব্যবহার করেছেন। ফেরাউন থেকে হালফিল যুগ অবধি বিস্তৃত মিশর দেশকে চিনে নিতে এটা বেশ সাহায্য করে। খালেদের অঙ্কনপদ্ধতি হিপহপের মূলধারায় একীভূত হলেও ক্যানভাসে যে-বক্তব্য তিনি রাখেন সেটা আবার বদ্রিলারের হাইপাররিয়েল  বা অধিবাস্তবতায় মিশরবাসীর গুম হওয়ার ইশারা দিয়ে যায়।

ফেরাউনদের যুগ থেকে আজোবধি স্থানিক ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির টালমাটাল সংঘাতে নবায়িত মিশর দেশটা সেখানে যেনবা পরাভূত পাখি! অধিবাসীরা কখনোই দেশটাকে মিশর নামে ঠিকঠাক দাগানোর উপায় খুঁজে পায়নি। অথবা উপায় খুঁজতে গিয়ে দেখেছে আরব নয়তো সাদা সায়েব-ম্যামের গোলার্ধ থেকে আগত জাতীয়তাবাদের গর্ভ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা অতিকায় সুপার আইকনরা তাদের ফিরে-ফিরে শাসন করে যায়। শাসিয়েও যায় বৈকি! আইকনের একদিকে যদি আল্লাহ ও মোহাম্মদ বিরাজ করতে থাকেন তবে অন্যদিকে সাদারা দাপট ফলান। দুয়ের চাপে ফেরাউন যুগের যত অ্যাভাটার তারা সকলে যেন মিসিং লিংক বৈ অন্য কিছু নয়! ওইসব অ্যাভাটার  বিরাজিত ওই পিরামিডে আর এখন খালেদ তাদেরকে ফিরিয়ে আনছেন ক্যানভাসে।

মিশরের জনগণ স্থানিক ঐতিহ্যকে বুকে ধরে বালেগ হলেও আরব ও ইউরো-মার্কিন বায়ুবাহিত অ্যাভাটার  তাদের এই স্থানিকতাকে অবিরাম প্রশ্নবিদ্ধ ও নিজের অনুকূলে গড়েভাঙে। পিরামিডের ভিতরে বিরাজিত সব কক্ষ ও অলিন্দে সেই অর্থে মিশরটা জীবিত, যেখানে হয়তো ফেরাউনশাসিত শত-হাজার স্মারক মমিবন্দি স্তব্ধতায় ঘুম যায়। তাদের পক্ষে জাগ্রত হওয়া ও পিরামিডের বাইরে সক্রিয় মিশরকে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। অধিবাস্তব এই Conflict of interest-র জগতে বসবাসে অভ্যস্ত মিশরবাসী তাই নিজেকে হারায়ে খুঁজে ফিরে খালেদের ক্যানভাসে। এ-যুগের অসংখ্য চিহ্ন ও চরিত্রের মিছিলে খালেদ পিরামিডের কুঠুরিতে মমিবন্দি আরো শত-হাজার চিহ্ন ও আ্যভ্যাটারকে কমিক স্ট্রিপ-র আদলে আঁকা ছবিতে আলগোছে চালান করতেই থাকেন। তারা সেখানে একালের সব সুপারম্যানসুপারসনিক  ঘটনার সঙ্গে গলেমিশে একাকার হয়। সে যাকগে, খালেদ হাফেজ নিয়ে আপাতত এটুকু বলে দাঁড়ি টানি। র‍্যাপকাহনে এসবের তাৎপর্য যেহেতু তুলে ধরতে পারিনি যদি আবার বসা যায় তবে কাজটা পূর্ণতা পাবে মনে হচ্ছে।


পশ্চিম থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ে টালমাটাল হওয়া সত্ত্বেও আরববিশ্বে নারীদের সম্মুখগামী হওয়ার গেরিলা পদ্ধতির স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে কিছু কথা টুকে রাখা (*পরে ভুলে যেতে পারি তাই) আবশ্যক মানি। কিতাবের বিস্তৃত পরিসর জুড়ে রবিন এই লড়াইকে জায়গা দিয়েছেন। উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ার একাংশ জুড়ে বিস্তৃত মুসলিম অথবা মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্রসংঘে নারীজাগরণের সাংস্কৃতিক বিস্ফার সাদা সায়েব-ম্যাম বিরচিত বয়ানের প্রচুর লক্ষণ বহন করলেও এর কপিক্যাট নয়; — নিজের এই অণুবীক্ষণের সপক্ষে প্রচুর নজির তিনি কিতাবে দাখিল করেছেন। আরব জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী সংস্কৃতির বলয়ভুক্ত রাষ্ট্রে নারীকুলের আত্মপরিচয় সন্ধানের খুঁটিনাটি বিবরণে কিতাবটা বোঝাই বলা চলে।

ইসলাম ধর্মের সুবাদে পাওয়া চিহ্নগুলোকে প্রত্যাখ্যানের পরিবর্তে ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের বাহক রূপে বক্ষে ধরতে সেখানকার শিক্ষিত ও প্রাগ্রসর নারীসমাজ এখন আর দ্বিধায় ভোগে না। পশ্চিমা বয়ান রপ্ত করলেও একে নিজ সুরতের উপযোগী করার প্রয়োজনীয়তাকে তারা নারীপ্রগতি বলে বুঝে নিয়েছে। আমাদের নারীজাগরণের পটভূমি ও চিন্তনপদ্ধতির সঙ্গে এর দূরত্ব সুদূর! পশ্চিমা নারীপ্রগতির বয়ানকে স্বীকরণের নজির আমাদের এখানে বিশেষ চোখে পড়ে না। আরবের নারীগণ পৃথক সমাজবাস্তবতায় বসবাস করে, এখানে ঐতিহ্য ও ইসলামকে ছেটে দিয়ে কোনো প্রগতি সম্ভব নয়। যারপরনাই এর সঙ্গে সমন্বয় ও সংহতি স্থাপনের ভাবনাটি তাদের উত্যক্ত করে যায়।

গোত্রশাসিত ঐতিহ্যে ইসলামের অজস্র চিহ্ন সঙ্গী করে সাবালিকা আরবনারীর জঙ্গ ও প্রতিবাদ আল্লাহ, মোহাম্মদ বা ইসলামের সঙ্গে নয়; — কিতাবে রবিন এমনটাই বলতে চেয়েছেন। তাঁর মতে ইসলামের ভেক ধরে সংঘটিত চরমপন্থা মোকাবিলায় ওই অঞ্চলের শিক্ষিত সচেতন নারীটি সবিরাম লড়াই করে। শ্বেতাঙ্গ সমাজের মনোজগতে ইসলামভীতির মজ্জাগত রোগ দূর করতে খোদ ইসলামকে ভাগাড়ে নিক্ষেপের ভাবনা তাকে উতলা করে না। সে বরং কোরান-হাদিসকে মন দিয়ে পাঠ যায়; এর পুরুষবিরচিত ব্যাখ্যা ও বয়ানের অসংগতি তুলে ধরতে তৎপর হয়। শত প্রতিরোধের পাহাড় ঠেলে নিজের ব্যাখ্যা সেখানে জুড়তে চেষ্টার ত্রুটি করে না। ইসলামের লিঙ্গনিরপেক্ষ চরিত্রকে সকলের সামনে হাজির করার ঔদ্ধত্য তাকে দ্বৈত করে। সে এখন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আবার কোরানে দীক্ষিত মুসলিমাও বটে! এই জায়গাটি আরবের নারীজাগরণকে পৃথক মাত্রা দান করছে বৈকি।

বাংলাদেশে সম্প্রতি যে-ইসলাম সমাজের ঘরে-ঘরে বেনোজলের মতো ঢুকছে এবং নারী-পুরুষ সকলে তাকে আলিঙ্গন করছেন তাকে আরববাহিত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে অনেকে গড় করেন আজকাল। গড় করাটা মিথ্যে এমন নয়, তবে এর মধ্যে চরমপন্থী যে-তরঙ্গ তাকে আলাদা করতে না পারলে এটা কোনোভাবেই আরবে জন্ম নেওয়া আদি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না। দেরিতে হলেও আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের ইসলামী আচারব্যাভারে চরমপন্থার সমস্যাটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে ও এর কবল থেকে ইসলামকে উদ্ধার করার উপায় নিয়ে নতুন ভাবনার তরঙ্গ উঠছে সেখানে। সংস্কৃতি যদি খারাপ দিকে মোড় নেয় তাকে চট করে ভাগাড়ে ফেলা যায় না অথবা ফেলতে গিয়ে বালাই বাড়ে। তারচেয়ে তাকে কী করে প্রশমিত বা ম্রিয়মান করা যায় সেই ভাবনাটা আগে করা উচিত। আরবে দেশের নারীজাগরণ সূচনা থেকে এই দিকটায় মনোযোগী হওয়ার কারণে তাদের ওপর ইসলামের নাম করে যা চাপানো হয়েছিল সেগুলোকে এখন তারা পাল্টা ব্রহ্মাস্ত্র রূপে ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে আরব থেকে ধেয়ে আসা চরমপন্থী ইসলামী কালচারের সাম্প্রতিক প্রভাবকে মোকাবিলায় আরব নারীগণের কৌশলটা কাজে দিতেও পারে হয়তো।

আরবের সচেতন নারীসমাজ হিজাব-নেকাব-বোরখাকে ছুড়ে ফেলার বাতিক বাদ দিয়ে ওগুলোর ব্যবহারকে নিজের পছন্দ ও অধিকার বলে ঘোষণা দিতে আজকাল পছন্দ করছে; — রবিন তাঁর অনুসন্ধানে এমনটাই দেখতে পাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। ভয়ানক এক পুরষতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে নেমে আরব নারী দেখতে পাচ্ছে একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারলে বরং ফায়দা অধিক মিলে। একফালি কাপড়ের আচ্ছাদন তাকে পুরুষশাসিত বিশ্বে ইমামা থেকে বায়ুসেনার ভূমিকায় নামার সুযোগ ও স্বাধীনতা এনে দিচ্ছে। অন্যদিকে পুরুষের অযথা মাতবরি ফলানোর বিরক্তিকর খাসলত ও কুনজর থেকে খানিক সুরক্ষাও দিয়ে থাকে। পশ্চিমের মুক্ত দুনিয়া কিংবা আরো অনেক দেশ ও সমাজে যে-কাজগুলো মেয়েরা আকসার করে থাকে এখানে আরব নারী নিজেকে কাপড়ের আচ্ছাদনে ঢাকার ছলে তার সবটাই পুরোদমে চালিয়ে যায়। রবিন মনে করেন আরব নারীর এই মনস্তত্ত্বকে পশ্চিমা বিশ্বে বিরাজিত নারীবাদের বাইবেল হাতে নিয়ে ব্যাখ্যা করা অনুচিত। লড়াইয়ের কৌশলটা বিলকুল পৃথক। প্রতিকূল সমাজে বিচরণের কারণে তার লড়াইকে বাঁকা চোখে না দেখে বরং এটা ভাবা সংগত, ‘It is an instrument that makes a female untouchable as she makes her own decisions in the macho Arab world.

বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্র কিংবা সাম্প্রতিক ইসলামতন্ত্রে ভর করে আরো উগ্র ও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা বেটাগিরি  এক্ষেত্রে আরববিশ্বের সঙ্গে অভিন্ন বলা যায়। সমস্যা হলো পশ্চিমের নারীজাগরণের পাতা উল্টে মুচমুচে গরমাগরম বুলি কপচানো দেশের সচেতন নারীসমাজ তাদের ওপর নিপতিত কাপড়ের আচ্ছাদনকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন তার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। একদল ওটাকে ছুড়ে ফেলে প্রয়োজনে ন্যাংটো হতে মরিয়া। আরেকদল এর পেছনে আল্লাহ ও মহানবিকে দেখতে পেয়ে ভয়ে শিউরে উঠছেন। তাদের মনে দোজখের আতঙ্কটা দেশের উগ্র ইসলামী ভাবধারায় মাথা মোড়ানো পুরুষসমাজ ভালো করে ঢুকিয়ে দিতে সফল হয়েছেন। দ্বৈতসংকটের মিডল পয়েন্টে দাঁড়িয়ে বাদবাকিরা দুটোর মধ্যে সমন্বয়ের বুলি আওড়াতে ব্যস্ত। আরবের নারীকুল এই জায়গাগুলো পেরিয়ে বরং কুশলী গেরিলা। The Politcis of Religion গ্রন্থের প্রণেতা নাবিল আব্দেল ফাত্তাহকে উদ্ধৃত করে রবিন সেটা ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। ফাত্তাহ-র মতে কাপড়ের ওইসব আচ্ছাদন ওরফে পর্দাপুশিদার পুরোটাই ক্রমশ এক সমরকৌশলে রূপ নিয়েছে। আরব নারী ভালো করেই জানে পর্দাপুশিদা ধরে রেখে কীভাবে সাংঘাতিক উগ্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজের পথ করে নিতে হয়। সুতরাং মিশর কিংবা সামগ্রিক আরববিশ্বের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলাই যায়, ‘The veil is the mask of Egyptian women in a power struggle against the dictatorship of men, … gives women more power in a man’s world’.

খেয়াল করা প্রয়োজন, সমানাধিকারের চেয়ে ন্যায্যতাকে আরবের নারী অধিক প্রাসঙ্গিক ভাবে এখন। সমতা নয় বরং ন্যায্যতা; — এই আওয়াজে সোচ্চার নারীপ্রগতির বয়ান একদিন আমিনা ওয়াদুদের মতো সুপণ্ডিত ও সংস্কারপন্থী নারীকে নিজের পথ চিনে নিতে সাহায্য করেছিল। আমিনার মতো আরো নারীর কাহিনি রবিন তাঁর কিতাবে উঠিয়ে এনেছেন। ইতিবাচক ও যুগানুকূল সংস্কারের প্রবণতাকে যদি বিবেচনায় আনি তাহলে আরব আঞ্চলটি এই মুহূর্তে ভারতীয় উপমহাদেশের তুলনায় ঢের প্রাগ্রসর। লাদেনবিভীষিকার জের ধরে একের-পর-এক চরমপন্থার উত্থান ও মার্কিনি আগ্রাসন থেকে মুক্তির আকুলতা এখানে ভূমিকা রেখেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুঃশাসনের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে মরিয়া তিউনিসিয়া ও মিশরে সংঘটিত গণজাগরণের ঢেউ বা তার পরবর্তী অভিঘাত গভীর প্রভাব রেখে চলেছে। সেইসঙ্গে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে-পড়া ইসলামভীতিকে মোকাবিলার তাগিদ আরববাসীকে যুগানুকূল সংস্কারের সপক্ষে হ্যাঁ  বলতে বাধ্য করছে। গেল দুই দশকের সাংস্কৃতিক পালাবদলের নেপথ্যে যত অনুঘটক কাজ করছে রবিন রাইট সেগুলোর খবর করেছেন সযত্নে। আমিনা ওয়াদুদের কাহিনি হয়তো যার মধ্যে সবচেয়ে দূরবিস্তারী ঘটনা বলে বিবেচনা করা যায়।

ইতিহাসে খবর করলে দেখতে পাই মহানবি তাঁর জীবদ্দশায় ইসলামে দীক্ষিত উম্মে ওয়ারাকাহকে (Umm Waraqah) ইমামা হিসেবে সালাত পরিচালনার অনুমতি দিয়েছিলেন। নারী-পুরুষ একত্রে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেন। সংকলিত হওয়ার আগেই আস্ত কোরান ওয়ারাকাহ কণ্ঠস্থ করে নিয়েছিলেন। তার এই যোগ্যতাকে মহানবি স্বীকৃতি দিলেন এই ঘোষণা সহকারে, — ওয়ারাকাহ যদি ইচ্ছে করেন তাহলে নারী-পুরুষের মিশ্র জামাতে ইমামতি ও খুতবা দিতে পারবেন। জুম্মাবারে তার খুতবা শুনতে নারী-পুরুষ একত্রে সমবেত হতো তখন। আদি হাদিসে বর্ণিত অকাট্য প্রমাণকে পরে চালাকি করে বিকৃত করা হয়েছিল। মিশ্র মোটেও নয় বরং ওয়ারাকাহকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সালাত পরিচালনার অনুমতি মহানবি দিয়েছিলেন; আরবি দার শব্দের বুৎপত্তি সে-রকম ইঙ্গিত দিচ্ছে; — আদি হাদিসকে ঝাপসা করতে ইসলামী ব্যাখ্যাশাস্ত্রের দিকপাল পুরুষগণ হাজার বছর ধরে এই ব্যাখ্যাটা দিয়ে এসেছেন। আমিনা আঘাতটা হেনেছেন সেখানেই। ওয়ারাকাহর পথ ধরে মসজিদে নারী-পুরুষের মিশ্র সমাবেশে ইমামতি করার সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন। এর সপক্ষে যুক্তিও দিলেন আচ্ছামতো, যার সারবত্তায় তিনি বলছেন :—

ওহে পুরুষকুল, আরবিদার’ শব্দটি লিঙ্গনিরপেক্ষ; কথাটি আপনারা কী করে বেমালুম ভুলে গেলেন ভেবে বিস্মিত হই শব্দটির অর্থ এক নয় বরং একাধিক দার দিয়েঘর’, ‘প্রতিবেশী’, ‘গ্রামএমনকিবেহেশত বোঝায় আপনারা এখন কার পাল্লায় পড়ে লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দটিকে নারীসমাজের সঙ্গে বারবার জুড়ে দিচ্ছেন কে জানে! কেবল তা-ই নয়, ইমামা হিসেবে উম্মে ওয়ারাকাহর সালাত পরিচালনার ক্ষেত্রটি সেকালে বৃহৎ ছিল স্বয়ং মহানবি যেকারণে তাঁর জন্য পৃথক মোয়াজ্জিন নিয়োগ করেছিলেন

কোরান-হাদিসের ভাষা ও শব্দতত্ত্বে গমনের সড়ক সেদিনতক নারীর জন্য অবরুদ্ধ ছিল। বাইবেল-র ব্যাখ্যাশাস্ত্রে নারীর অংশগ্রহণকে বৈধ বলে মেনে নিতে গির্জাশাসিত খ্রিস্টান পুরোহিতরা একদা আপত্তি তুলেছিল। ইসলামের মোল্লাতন্ত্রকে সেক্ষেত্রে গির্জাতন্ত্রের কপিক্যাট  ডাকা যেতে পারে। মৃত্যুভয় পায়ে দলে যারা এই আগল ভাঙলেন আমিনা ওয়াদুদ তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন। ওয়ারাকাহর পথে ইমামার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সংকল্প পূরণে হুমকি-ধামকি-আপত্তি থেকে শুরু করে পুরুষকুলের গালমন্দ ও অভিশাপ তাঁকে হজম করতে হয়েছিল। কোরানের বয়ানকে নারীর মস্তিষ্ক দিয়ে পাঠ যাওয়ার শুরুয়াতে তাঁর অবদান যুগান্তকারী। ইমামা রূপে অবতীর্ণ হওয়ার সঙ্গে কোরানের তফসির রচনায় হাত দিয়েছিলেন। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষঠাসা বিদ্যায়তন তফসিরটাকে অনুমোদন দিতে বিস্তর টালবাহানা করলেও হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। আরববিশ্বের সাবকালচারে সক্রিয় এইসব ঘটনার অভিঘাত তাই গভীর। রবিন রাইট সেখানে আলো ফেলায় প্রত্যাখ্যানের চেয়ে সংস্কার কেন অধিক গভীর হয়ে থাকে সেই বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।

ডালিয়া জিহাদের মতো চলচ্চিত্রসংগঠকের কথা পাঠক রবিনের কিতাবখানার সুবাদে জানতে পায়। মিশর সহ উত্তর আফ্রিকা জুড়ে পিঙ্ক হিজাবকে ঘিরে চলমান ফ্যাশন আন্দোলনের সারার্থ তাকে ভাবিত করে। ড্যাম (*চিরন্তন কিছু বোঝাতে DAM শব্দটি প্যালেস্টাইনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে) নামধারী র‍্যাপ (RAP) দলের ছায়ায় সমেবত একঝাঁক গায়ক আরবের সংস্কৃতিকে কীভাবে নতুন আঙ্গিকে গড়েপিটে নিচ্ছে সেই বিবরণ আরবের সাংস্কৃতিক পালাবদলের ধারণা পেতে তাকে সাহায্য করে। ফিলিস্তিনি র‍্যাপার তামের ও সুহেল নাফারের হাতে গড়া ড্যাম-র প্রতিটি গানে নিজদেশে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা কোনো রাখঢাক মানে না। ওদিকে ইহুদি-মুসলমান-খ্রিস্টানের কামড়াকামড়িকে সে আবার ন্যায্য বলে মেনে নিতে আপত্তি জানায়। এইসব কূটক্যাচালকে প্রত্যাখ্যানের ভাষা ড্যাম-র গানে সদা উপচে পড়ে। আরবনারীর নিজ দেহটাকে চেনানোর গানে নারীদেহ ও স্বদেশ পরস্পর গলেমিশে একাকার হয়। উভয়ের নিপীড়িত হওয়া ও নিপীড়নের পাল্টা জবাব সোজাসাপ্টা উঠে আসে JASADIK-HOM-র র‍্যাপগুলির ভাষায়। গানখানা ইউটিউবে সুলভ, তবু এর মর্মঘাতী লিরিক্সের কিয়দংশ উদ্ধৃতির লোভ সম্বরণ কঠিন। বাংলাদেশে র‍্যাপগানকে এভাবে কথার গুলি ছোড়ার ক্ষেত্রে এখনো নাবালক দেখায়। কথা না বাড়িয়ে গানের অংশবিশেষ পাঠ করা যাক :—

… A free soul inside an unfree body
Take the time to understand my body, my feminine body…

My body is in the palm of my hand, one mistake, one slip
One picture one video
How many eyes are in my body?
How many faces in my body?
My female body, my Arab body, my Arab female body
How many conscience in my body
In me and in you in us and in them
They are against us and you are against me,
everyone is against me and I am against all …

 If you resist, you hurt their Zionism
If I resist, I also touch their masculinity
My body is conscious of oppression remains unbreakable
Take time to learn to love my Arab female body…

 42 million times they traded in my body
200 million times they circumcised me and took responsibility for my body
120 million times they raped my body
136 million births a year and this life is only from my body
[JASADIK-HOM; Songwriters: Mahmoud Jreri/Maisa Daw/Tamer Nafar/Ziegler Itamar]

র‍্যাপকাহনের সঠিক জমি চিনতে এইসব অনুষঙ্গকে প্রাসঙ্গিক করা প্রয়োজন। পালাবদলের নজির তুলে ধরতে রবিন যেসব উদাহরণ টেনেছেন সেখানে তাঁর বিশ্লেষণ বা অ্যানালিসিসটা বাড়তি পাওনা হয়েই আসে। আরববিশ্বের বাঘা-বাঘা কবিকুলের বাইরে বসে যারা পরিবর্তিত এক বিশ্বে নিজের ভাবনাকে কবিতায় তুলে ধরছেন তাদের খবর পাওয়ার উপায় সহজ নয়। রবিন রাইট সে-রকম এক সৌদি কবির খবর নিয়েছেন তাঁর কিতাবে। বোরখা ও নেকাবকে বেদুইনের চিরন্তন ঐতিহ্য ঘোষণা দিয়ে তাকে অঙ্গে ধরতে অভ্যস্ত হিসসা হিলালের নামধাম কস্মিনকালে জানার সুযোগ ঘটত বলে মনে হয় না। এই সুযোগে তাঁকে টুকে রাখতে চাই।

প্রথমত আফগানিস্তান ও পরে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আত্মগোপনের দিনকালে ওসামা বিন লাদেনের ঘাড়ে কবিতা লেখার ভূত চেপেছিল। মার্কিন পরাশক্তি আর ইহুদি-নাসারাকে ঘায়েল করার জিহাদি জোশ থেকে বিরচিত লাদেনপঙক্তির বেশ অর্ধেকটা দাম্ভিক, বিকারগ্রস্ত, হতাশ এক মানুষকে চিনিয়ে যায়। ওদিকে তাঁর চরমপন্থী কাজকারবারে মুসলিমবিশ্বের অযুত বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগে বিরক্ত হিসসা হিলাল নিজের মনের গোসসা ঢেলে দিতে বুঝি-বা আরব আমিরাতে আয়োজিত কবিতার আসরে নবাতি (Nabati) পড়তে মঞ্চে ওঠেন। পুরুষ কবিকুল ও বিচারকে বোঝাই আসরে মোল্লাদের ফতোয়াকে সপাটে ইসলাম নয় সন্ত্রাস  বলে নাকচ করেন হিলাল। তাঁর পেছনে জোঁকের মতো সেঁটে থাকা পশ্চিমা গণমাধ্যমের কাছে মুখের নেকাব সরাতে অনিচ্ছুক স্বভাবকবি রবিনকে সেদিন যা বলেছিলেন তার সারার্থ এইবেলা স্মরণ করি। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি হিসসা হিলাল মুখের নেকাব না সরিয়ে রবিনকে নসিহত করছেন :—

আমার নেকাব বেদুইন ঐতিহ্য থেকে এসেছে এর সঙ্গে ইসলাম, কোরান আল্লাহর সম্পর্ক নেই তুমি বোন ক্যাডা যে তোমায় আমার মুখ দেখাতে হবে আমি এভাবেই চলাফেরায় স্বচ্ছন্দ জেনো আমার নেকাব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ইসলামকে যারা সন্ত্রাসে রূপ দিতে মরিয়া, মেয়েলোকের ওপর অযথা খবরদারি হম্বিতম্বিকে বেটাগিরি প্রমাণে পাগলপারা পারলে তাদেরকে ধরে ঠেঙ্গাও আমি নবাতি লিখি শখে কিন্তু এর মধ্যে বারুদ পোরা থাকে জেনো

আমিরাতে আয়োজিত কবিতার আসরে পঞ্চম স্থান দখল করলেও সমগ্র আরববিশ্বে হিলাল তুমুল সমাদৃত হয়েছিলেন সেই সময়। আমিনা থেকে হিলাল সকলেই নারীজাগরণের পতাকাবাহী হলেও ইসলাম বা কোরানকে প্রত্যাখ্যানে উতলা বোধ করেননি। তাঁরা কেবল নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে এর ব্যাখ্যাটা দিচ্ছেন এবং নারী হিসেবে নিজের ন্যায্যতা আদায়ের জিহাদ থেকে পিছু হটছেন না। আমাদের নারীপ্রগতির কাণ্ডকীর্তিকে এর সঙ্গে তুলনা করলে ফাঁপা ও হাস্যকর লাগে। এত বছরেও পশ্চিমকে নকল করা ছাড়া বড়ো কোনো অর্জন তার ঝুলিতে জমা পড়েনি। বিদ্যাসাগর, রামমোহন বা বেগম রোকেয়া যে-পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন সময়ের সঙ্গে সেটা পথহারা পথিক বটে।

মোদের প্রগতিপন্থী নারীজাগরণে প্রত্যাখ্যান হচ্ছে একমাত্র ভাষা! বিনির্মাণ  সেখানে বিলকুল গরহাজির! মোরা ব্যস্ত বাতিলের খেলায়। রাষ্ট্র বাতিল, সমাজ বাতিল, পুরুষ বাতিল, আল্লা-ভগবান-নবি-অবতার-মোল্লা-পুরুত সব্বাই বাতিল…! বাতিল করতে-করতে যা পড়ে থাকে সেখানে নারী নামধারী লিঙ্গ ছাড়া কারো অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। সেকেন্ড জেন্ডার-র গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে হেট স্পিচের  পাল্টি হেট স্পিচ  ছোড়ার কেরদানি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষা সেখানে আজো অনুপস্থিত। ব্যাপারখানা আমোদ জাগায় মনে।

আমাদের ব্যাপক সহানুভূতি নয়তো তাচ্ছিল্য-উপহাসের শিকার আরবের নারী ওদিকে বাতিলে কাজটাজ হবে না বুঝে সমানাধিকারের জটিল ক্যাচালকে সাইডে ঠেলে দিয়ে ন্যায্যতা আদায়ে সোচ্চার আগাগোড়া। কোরানকে নতুন যুগচিন্তার আলোয় পাঠ করলে তাদের ভাবনাকে অবান্তর ভাবার সুযোগ অল্পই থাকে। যেহেতু কোরানের লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাষা অদ্য নতুন যুগের চিন্তকদের কল্যাণে খোদ আরববিশ্বে বেশ সড়গড় এখন। আল্লাহ নারী ও পুরুষকে পৃথক বৈশিষ্ট্যে মুড়ে ধরায় প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে সমতা নেই, সমতার সুযোগ নেই, তবে ন্যায্যতা অবশ্যই থাকতে হবে আর সেটা নিশ্চিত করা প্রকৃত মুসলমানের কাজ। সৌদি বাদশাহ এমবিএস ওরফে মোহাম্মদ বিন সালমান হয়তো এ-কারণে বলতে পারছেন :—

কোরানের একটা নোক্তাও বদলাবে না তাকে বদলানোর সুযোগ অথবা প্রয়োজন আমাদের নেই কোরানের ভাষাকে বোঝা ব্যাখ্যার তরিকা নিয়ে বরং ভাবা বেশি প্রয়োজন ব্যাখ্যার তরিকা যুগ সময়ের পালাবদলে পাল্টাবে আর এটাই স্বাভাবিক চৌদ্দশ বছর আগেকার সময়ে পড়ে থেকে যারা কোরানকে ব্যাখ্যা করতে চাইছে তারা আহাম্মক!

ন্যায্যতার দাবিকে আরবের নারীরা এভাবে নিজের করে নিয়েছে। হেজবুল্লা বা মুসলিম ব্রাদারহুডের ছাতার নিচে বসে অনেকে কাজটা করে থাকে। বড়ো অংশ এর বাইরে বসে অনুরূপ দাবিতে সোচ্চার গেল দুই দশক ধরে। জনসংখ্যার অনুপাতে প্রায় ষাট শতাংশ যুবা ও যুবতীগণ ইসলামকে টোটাল কালচার রূপে বক্ষে ধারণ করে রক্ষণশীলতার জটিল সংস্কৃতিকে মোকাবিলা করছে। বিশ্বের কাছে নিজের আত্মপরিচয়কে তারা কীভাবে নানা সাংস্কৃতিক তৎপরতার মধ্যে ভাষা দিতে তৎপর তার বিবরণী রবিন বিশ্বাসযোগ্য উপায়েই দিয়েছেন। পশ্চিমা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সপক্ষে আগাগোড়া ওকালতি করে গেলেও এই প্রথম একখানা কিতাব পাওয়া গেল যেটি কিনা আরব মনোজগৎকে ছলেবলে সমালোচনায় বিদ্ধ বা নাকচ করার বদলে যৌক্তিক বলে দাগিয়েছে। আরবের নিজস্ব ধাঁচে গতিশীল এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পালাবদলকে মেনে নিতে আপত্তি করেনি। যারপরনাই র‍্যাপকাহনে হিপহপ ইসলামের এইসব লক্ষণ নিয়ে আলোচনার জরুরত অন্তত আমার কাছে অমোঘ।

র‍্যাপকাহন ৩ : বাংলায় হিপহপ
র‍্যাপকাহন ২ : বাংলায় হিপহপ
র‍্যাপকাহন ১ : বাংলায় হিপহপ

বাংলায় হিপহপ ও র‍্যাপ নিয়া গানপারে অন্যান্য রচনা

বাংলায় রিদম অ্যান্ড পোয়েট্রি নিয়া প্রাথমিকা
বাকরুদ্ধ ভুবনের পলিটিক্যাল অ্যান্থেম : স্কিব খানের ‘সব চুপ’
র‍্যাপ, রাজা কুমারী, প্রাচ্য ও পশ্চিম
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: