একবার সিলেট অডিটোরিয়ামে অরবিট আসবে। মানুষের মুখে মুখে ছিলো ‘ঐ লাল শাড়ি রে’, ‘বেলাশেষে’, ‘সুখেরই প্লাবনে’ গানগুলো। টিকেট কিনছেন মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। আমরা কয়েক বন্ধু বাইরে দাঁড়িয়ে ফন্দি করছি, কীভাবে ভেতরে গিয়ে বিনা টিকেটে গান শুনবো। আয়োজকদের কড়া পাহারা, অন্যদিকে পুলিশ। গান চলছে একের পর এক। ‘ঐ লাল শাড়ি’ গান যখনই শুরু হলো তখন ভেঙে গেল আমাদের অপেক্ষার বাঁধ। আমরা কয়েকজন উপরতলার জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলাম। তারপর আর কে আটকায়।
এর কিছুদির পর আসলো আর্ক। হাসানকে দেখার জন্য সে কী উৎকণ্ঠা! একে একে গাইলেন ‘সুইটি’, ‘একাকী’ সহ জনপ্রিয় সব গান। এভাবে সিলেটে ব্যান্ডের কন্সার্টগুলোয় যারাই এসেছেন গান শুনেছি, তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ অডিটোরিয়ামে প্রায়-সময় দেশের প্রথম শ্রেণির ব্যান্ডদল আনা হতো, বিশেষ অনুষ্ঠানে, উৎসবে। সেবার আনা হলো অবস্কিউরকে। সেখানেও গান শুনেছি, তবে বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে।
‘মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়’, ‘নিঝুম রাতের আঁধারে’, ‘আঁধারঘেরা স্বপ্ন আমার’, ‘ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী’ অথবা ‘তুমি কি এখনো প্রিয়া একাকী আনমনে ভাবো আমাকে’ – এ-রকম বহু গানের জনপ্রিয় ব্যান্ড অবস্কিউর। যে-গানগুলো এখনো গাই, এখনো আনন্দ পাই। যে-গানগুলোর সব-কয়টি লাইন এখনো গাঁথা বুকে। একবার হোটেল পলাশ-এ ক্লোজআপ বাছাইপর্বের অডিশন চলছে। শুনলাম অবস্কিউর ব্যান্ডের ভোকাল, আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ, টিপু আসছেন। তারপর অনেক ছলেবলে দেখা হলো, কথা হলো টিপুভাইয়ের সাথে।
‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’, ‘দৃষ্টিপ্রদীপ জ্বেলে খুঁজেছি তোমায় / ফেলে আসা দিনগুলো মনে পড়ে যায়’ — এই গানগুলো একটা সময়ের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। অনেকে হয়তো ডিফরেন্ট টাচ-এর নাম ভুলে গেছেন, কিন্তু ভুলতে পারবেন না এই আবেগমাখা গানের কথা। তুমুল জনপ্রিয় এ দুটি গান ছাড়া ভালো লাগতো ডিফরেন্ট টাচ-এর ‘কবিতা পড়া হলো না তো আর এলে না যখন তুমি’ অথবা ‘আমার ভালোবাসার তানপুরাতে সুর যে বাজে না’।
আহা, জীবন! সেই দিনগুলো কী একেবারেই হারিয়ে গেল! একটি ভালো গান ছিল আমাদের ইচ্ছের আকাশে অবারিত রোদমাখা দিন। স্কুলজীবন থেকে সেই আনন্দ সংসারজীবনে এসেও একেবারে হারিয়ে যায়নি, কেবল অনুভূতির রঙবদল হয়েছে।
২
সারাজীবনে একটি বই লিখেছেন, সেই বইটি লেখককে নিয়ে গেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। গানের বেলায়ও ঠিক তেমনি হয়েছে অনেক শিল্পীর জীবনে। পুরো ক্যাসেটে দেখা গেছে একটি গান ভালো লাগছে, আর তাতেই হিট। যে-গানগুলোর সাথে বয়সের কোনো সম্পর্ক ছিল না, এখনো নেই। যখনতখন গুনগুনিয়ে গাই, গাওয়ার চেষ্টা করি। বলছিলাম নব্বইয়ের দশকের কথা। তুমুল ব্যান্ডপাগল সময়ের কথা।
যে-সময়ের কথা বলছি সে-সময় জিন্দাবাজারে বেশ কয়েকটি ক্যাসেটের দোকান ছিল। বেশ জনপ্রিয় এবং পরিচিত সেই দোকানগুলোতে সারাদিন স্পিকারে বাজতো সোলসের ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা, কেন এই মৌনতা আমাকে ঘিরে’, ‘সাগরের ঐ প্রান্তরে উঁচু পর্বতচূড়ায় চাঁদ জাগে’, মাইলস-এর ‘চাঁদ-তারা-সূর্য নও তুমি / নও পাহাড়ি ঝর্ণা’, সিম্ফনি ব্যান্ডের ‘অনুভবে কল্পনাতে যে মিশে রও / হাসির ঝলকে তুমি রজনীগন্ধা বিলাও’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, চাইম-এর ‘কালো মাইয়া কালো বইলা কইরো না কেউ হেলা’। তখন জিন্দাবাজারে ক্যাসেটের ব্যবসা রমরমা। স্পিকারে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজতো গান, ব্যান্ডের গান। আর সেই গানগুলো তরুণদের পকেট খালি করছে। আমরা চাররঙের কাভার করা ক্যাসেট কিনে ঘরে সাজিয়ে রাখছি।
সলিড ফিঙ্গার-এর ‘মিষ্টি মেয়ে চোখটি তোলো প্রথম তোমার সাথে দেখা’, আর্ক-এর ‘একাকী’, ‘সুইটি’; ডিজিটাল ব্যান্ডের কামালভাইয়ের কণ্ঠে ‘সূচনা কেমন আছো কোথায় আছ জানি না’ অথবা নোভার ফজলভাইয়ের কণ্ঠে ‘স্কুলপলাতক মেয়ে’, ‘আহা কী বিস্ময়ে দেখছো তুমি আমায়’, কিংবা ‘স্বপ্নরাণী’ গান আজো ভুলতে পারিনি। ভোলা যায়নি পপগুরু আজম খানের ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে জন্মেছিলো একটি ছেলে’, ‘চুপ চুপ চুপ / অনামিকা চুপ / কথা বলো না’ অথবা মিক্সড অ্যালবামগুলোর গানের কথা। মনে হয় এখনো যেন জিন্দাবাজারে বাজছে, ‘হাত বাড়লেই বন্ধু হবো’, ‘আকাশের কথা হলো’ অথবা ‘আগের জনম গেলো বৃথাই তোমারই আশায়’।
৩
সে-সময় সপ্তাহে একদিন ব্যান্ডের গান প্রচার করতো বাংলাদেশ টেলিভিশন। কোনোদিন সেই অনুষ্ঠান মিস করিনি। মাথায় সাদা বেল্ট বাঁধা নোভার ফজলভাই মাতিয়ে রাখতেন পুরো সময়। ছুটাছুটি করে কাঁপাতেন পুরো স্টেজ। একইভাবে গামছাওয়ালা প্রিয় মাকসুদ।
মন ছুঁয়ে যেতো ফিডব্যাক ব্যান্ডের গান। ভুলিনি সেই সুর — ‘মেলায় যাই রে’, ‘মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা’, ‘মনে পড়ে তোমায়’, কিংবা মিক্সড অ্যালবামে ‘স্টার্স’-এর ‘হেসে খেলে এই মনটা আমার কেড়ে নিলে এতো সহজে’। মিক্সড শক্তি অ্যালবামের আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের তুমুল জনপ্রিয় ‘যদি তুমি ভালোবাসো আমায় শুধু এ-কারণে পালাতে চাই’ … এখনও যেন জিন্দাবাজার দিয়ে হেঁটে গেলে কানে ভেসে আসে সেই রোদমাখা দিনগুলো। সেই অ্যালবামে সবগুলো গানই ছিলো জনপ্রিয়। সেখানে রেনেসাঁর নকিবভাইয়ের ‘মেঘটাকে দেখেছো নীলাকাশ কখনো দেখোনি / যাকে ভালোবেসেছ যার নদী ছুঁয়েছ বুঝতে এখনো তাকে পারোনি’ গানটি এখনও ভালো লাগে।
৪
জীবনের এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসে এখনও ভুলতে পারিনি সেই সময়, সেই প্রিয় গান, সেই তারুণ্যভরপুর সময়। তখন সাউন্ডটেক কিংবা সংগীতার ক্যাসেটের দাম ছিলো পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা। সেই টাকাটা সবসময় আমাদের পকেটে থাকতো না। স্কুলের টিফিনের টাকা জমিয়ে আশরাফ, আমি, রানা, রুমেল, ইকবাল, সুয়েব জিন্দাবাজার আসতাম এবং ক্যাসেট কিনতাম। অনেক সময় ক্যাসেটের বারোটা গানের মধ্যে একটি গান ভালো লাগতো, তবু কেনার লোভ সামলাতে পারতাম না। একবার ইভস ব্যান্ডের গান ‘বন্যেরা বনে রয় তুমি এ বুকে’ গান শুনেছি জিন্দাবাজার আনন্দ রেকর্ডিং-এ। কিন্তু পকেট ফাঁকা, টাকা নাই। পরে বই কিনার টাকা দিয়ে ক্যাসেট কিনলাম।
এ-রকম কতশত স্মৃতি, লিখে শেষ করা যাবে না। বাবার পকেটের টাকা মেরেছি, শুধু ক্যাসেট কিনার জন্য, মায়ের সাথে মিথ্যা কথা বলেছি শুধু একটি গান শোনার জন্য।
উইনিং-এর ‘ঐ দূর পাহাড়ের ধারে / দিগন্তেরই কাছে / নিঃসঙ্গ বসে একটি মেয়ে / গাইছে আপন সুরে’ অথবা প্রমিথিউস-এর ‘রাখালিয়া ছন্দে আমি তোরে খুইজা পাই’, নাসিম আলী ভাইয়ের ‘ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর / তাই বলে ভেবো না আমায় স্বার্থপর’, রেনেসাঁর ‘আজ যে-শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে / আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’, সোলস-এর প্রথম অ্যালবামের ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে / ও সে-তো মুখ খুলেনি’ অথবা ‘এই মুখরিত জীবনে চলার বাঁকে’ … এই গানগুলো এখন আর জিন্দাবাজার, আম্বরখানা, বন্দরবাজারের কোনো ক্যাসেটের দোকানে বেজে ওঠে না। এখন আর সেই গানগুলো কোনো পাড়ামহল্লায় ঈদের দিন, পূজার অনুষ্ঠানে বাজে না। শুধু বাজে মনে মনে, একলা আকাশে। রিকশায়, বাথরুমে, খুব মনখারাপে।
৫
তখন ঈদ মানে, পূজা মানে ছিলো নতুন পোশাকের সাথে নতুন ক্যাসেট কিনা। ঈদের দিন সকাল থেকে আমরা পছন্দের গানগুলো এলাকায় বড় স্পিকারে বন্ধুরা জড়ো হয়ে বাজাতাম। গানের সাথে নায়ক নায়ক ভাবের সেই দিনগুলো আজ আর নেই। তখন ঈদের দিন, পূজার দিন, বড় দিবসে, বিশেষ অনুষ্ঠানে, স্কুলকলেজে ব্যান্ড আনা হতো। মনে আছে ঈদের দিন প্রায়ই দেখতাম জিন্দাবাজার লতিফ সেন্টারের সামনে ব্যান্ডের কন্সার্টের আয়োজন করা হতো। আমাদের মতো পাগলরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতেন সেই ড্রাম, গিটার আর কিবোর্ডের সুরের মূর্ছনা। অবশ্য এর অনেক পর আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেন জেমস্।
আমরা তখন শুনতাম একক শিল্পী তপন চৌধুরী, সুমনা হক, শুভ্র দেব, আদনান, জুয়েল, হ্যাপি আখন্দ, শেখ ইশতিয়াক, ডলি সায়ন্তনী, বেবী নাজনীন সহ আরো অনেক জনপ্রিয় শিল্পীর গান। দলছুট-এর সঞ্জীবদা-বাপ্পাদার গানও তরুণদের মন জয় করেছে।
৬
কলেজে পা রেখেই একবার শখের বশে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ব্যান্ড করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বন্ধু রুমেল আমাদের বেশি অনুপ্রাণিত করলো। রুমেল গিটার বাজানো শিখছে, আমি ড্রামস্, আশরাফ কিবোর্ডস্ আর ইকবাল ভোকাল। বেশ কয়েক মাস সিলেটের সুপরিচিত ড্রামার টিটুভাইয়ের কাছে ড্রামস্ শেখার হাতেখড়ি। কিন্তু নানা বাস্তবতায় আমরা বেশিদূর এগোতে পারিনি।
৭
আজকের মতো তখনও পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা হতো। তবে বেশিরভাগ আড্ডার প্রসঙ্গ ব্যান্ডের গান। কোন গান সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, কার গানটি বেশি চলছে — এসব নিয়ে তুমুল আলোচনা আড্ডায়। তখন পড়ালেখার পাশাপাশি তরুণরা অবসর সময় গিটার, ড্রামস্, কিবোর্ডস্ শিখতো। কারণ প্রতিটি পাড়াতেই ব্যান্ডের বাতাস বহমান ছিলো। সেসময় ব্লু ওশান, ফেন্সি ফায়ার, টাফ বয়েজ, ইভা, ফ্লেমিং, অংকুর, পিজিয়ন, ইয়াং ফ্লেমিং, বেদুইন, ব্লু-স্কাই সহ বেশ কয়েকটি ব্যান্ডদল সিলেটে ছিলো। এই মুহূর্তে অনেকের নামও মনে পড়ছে না। তারা নিয়মিত প্রোগ্রাম করতেন। সেই প্রোগ্রামগুলোতে তরুণদের থাকতো উপচে-পড়া ভিড়।
৮
সেই সময় আজ আর নেই, সেই ব্যান্ডগুলোও হারিয়ে গেছে। তবে ব্যান্ড ভেঙে গেলেও অনেকে এখনো পুরনো ঠিকানায় রয়ে গেছেন। অনেকে প্রতিষ্ঠিত। ঢাকায় নিয়মিত গান করছেন আমাদের বন্ধু শাহীন আহমেদ। দেশের নামিদামি শিল্পীদের সাথে তার বেশ কয়েকটি অ্যালবাম বের হয়েছে। তার ব্যান্ড ছিলো পিজিয়ন। ভালো ড্রামার হিসেবে খ্যাতি রয়েছে ফ্লেমিং ব্যান্ডের টিটুভাইয়ের। জুনিয়ারদের মধ্যে ইয়াং ফ্লেমিং-এর ভোকাল জাহিদ তো এখন স্টার। এখনও সরব গানে। দেশবিদেশ মাতিয়ে রাখছে সিলেটের ড্রামার তুষার। সে দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস-এর ড্রামার ছিলো।
৯
মনে পড়ে, মধ্যপ্রাচ্যে আমার দুলাভাই থাকতেন। তিনি সময় নিয়ে চিঠি লিখতে পারতেন না। আমি বোনকে নিয়ে তালতলায় জীবিকা এন্টারপ্রাইজ-এ যেতাম, ফোনে কথা বলার জন্য। তখন প্রতিমিনিট কথার মূল্য ছিলো ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। মাঝেমধ্যে দুলাভাই ক্যাসেটে দরকারি কথা রেকর্ড করে আমার ঠিকানায় পাঠাতেন। আমার লোভ থাকতো সেই ক্যাসেটের দিকে। শোনা হয়ে গেলে আমি সেই ক্যাসেটে বাছাই-করা পছন্দের গান রেকর্ড করাতাম। ভালো রেকর্ডের দোকান ছিলো লন্ডন ম্যানশন-এর দোতলায়, ইদ্রিস মার্কেট এবং জিন্দাবাজার পয়েন্টসংলগ্ন দুটি দোকানে। এখন পুরো শহর ঘুরে একটি ক্যাসেটের দোকান খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই ক্যাসেট, সেই ব্যান্ড, সেই সময় গিলে ফেলেছে প্রযুক্তি। সেই ক্যাসেটগুলো এখন চলে গেছে যাদুঘরে। শুধু আমরা স্মৃতি কুড়াই বকুলফুলের বনে।
আহমাদ সেলিম ।। কবি, সাংবাদিক, প্রকাশক ।। জন্মনিবাস সিলেট
বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত নিয়া গানপারে পূর্বপ্রকাশিত কিছু রচনার হদিস
- অক্টোবর নয় || তুহিন কান্তি দাস - October 9, 2025
- মায়ের চরণে মেমোয়ার - October 7, 2025
- সাধুসঙ্গ ও সাধনসংগীত || বিমান তালুকদার - October 3, 2025
COMMENTS