বাংলার দর্শনদার ও গানবিচার || আহমদ মিনহাজ

বাংলার দর্শনদার ও গানবিচার || আহমদ মিনহাজ

পপ, রক, হিপহপ, র‌্যাপ (RAP) আর ফিউশন সংগীতে বাড়বাড়ন্ত বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের অন্ধিসন্ধি তালাশে যদি নামা যায় তবে যে-কোনো অনলাইন/অফলাইন পত্রিকার আস্ত একটা সংখ্যাও অপর্যাপ্ত মনে হবে। নব্বই দশকের গোড়ায় ব্যান্ডবাজ রকারদের উত্থানকে অনেকে অপসংস্কৃতি  নামে ডাক পাড়তে আরাম বোধ করতেন। কলিম শরাফীর মতো দু-চারজন যদিও খানিক ব্যতিক্রম ছিলেন। পোলাপানদের চ্যাংড়ামিকে অপসংস্কৃতি খেতাব দিয়া ঢোল না পিটাইলেও জ্ঞানীদের পরশ   তারা এখনো পায় নাই বলে বেশ আক্ষেপটাক্ষেপ করতে শুনছি। রবিঠাকুরের গানের কলি ব্যান্ডধাঁচে গাইবার অপরাধে বেচারা মাকসুদকে কথা শুনতে হয়েছিল। যদিও সুর-লয়-তাল ও গায়কী ঠিক থাকলে একটা গানের একশোটা ভার্শনে ক্ষতির কারণ ঘটে না। যার যেইটা ভালো লাগে তিনি সেইটা নেবেন। যুগের সঙ্গে তাল দিয়া গানের পরিবেশনায় সময়-প্রাসঙ্গিক ভাষা ও নতুনত্বের আমদানিকে বরং বাহবা জানানো উচিত। একশো প্রকারের ভাবনা ও অনুভূতির জায়গা হইতে পুরাতন গানের কলিকে গাইতে না পারলে আখেরে সেই গানের মরণযাত্রা ঠেকানো কঠিন হয়।

নতুন আঙ্গিকে রবি বা নজরুলের পরিবেশনা উনাদের গানে গুঞ্জরিত ভাবশক্তিকে কতটা কী জখম করেছে ইত্যাদি আলোচনায় গমনের গবাক্ষ এই সুবাদে খুলে দিতে পারে। পঞ্চকবির গান দেশের আমজনতার দরবারে আজো পৌঁছানো সম্ভব হয় নাই! এর নেপথ্য কারণ হিসেবে উনাদের সংগীতরসকে মধ্যবিত্ত রুচির উঠানে কয়েদ রাখার অভিযোগ অনেকে করেন। আলোচনায় অভিযোগটার ময়নাতদন্ত জায়গা করে নিলে বেশ হয়। প্রসঙ্গ ধরে বলি, টুনটুন বাউলের কণ্ঠে নজরুলের গানগুলা ইউটিউবে খোঁজ দিলে পাবেন। আহা! কী অসাধারণ প্রাণশক্তি দিয়া নজরুলকে এক বাউল গাইতে আছেন! শুনে প্রাণ জুড়ায়! “আমায় নহে গো / ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান”; — বহুল গীত গানটি গাইবার ক্ষণে কণ্ঠের সঙ্গে বাউলশিল্পীর সহজাত ভঙ্গিতে নিজের দেহকে টুনটুন গানে সমর্পিত করেন। কণ্ঠের সঙ্গে দেহের এই মিলন বা জেশ্চারটার কল্যাণে গানখানা নবজীবনের পরশে সতেজ ও প্রফুল্ল হইতে থাকে। শ্রোতার মনে খুশির পায়রা ওড়ে তখন আর উচ্ছল ফানাফিল্লার বোধ জাগে চিতে।

মনসুর ফকিরের কণ্ঠে রবির বাউলভাবিক গানকে এই পথ ধরে নতুন প্রাণ পাইতে দেখছি আগে। ওস্তাদি ঘরানার গায়কিতে রবিগানের পরিবেশনা বরং অনেক সময় শ্রোতাকে বিড়ম্বনায় নিক্ষেপ করে। গান শুনতে বসে আচমকা বেতাল ভাব জাগে কানে! রাবীন্দ্রিক ঢংয়ে বলতে ইচ্ছা করে, — হা বৎস, মনে হইল কোথায় বুঝি বিচ্ছেদ ঘটিয়া গেল! ওস্তাদি কালোয়াতির বিপক্ষে ধূর্জটিপ্রসাদের সঙ্গে রবির জোর তর্কবিতর্কের ইতিহাস মনে তাৎক্ষণিক ঢেউ দিয়া যায়। তবে হ্যাঁ, ওস্তাদির সঙ্গে রবিগানের ফিউশন কানের পক্ষে মন্দ নয়। কৌশিকী দেশিকান ও শ্রাবণী সেনের যুগল রবিবন্দনায় এর সাক্ষ্য মিলে। একটা পত্রিকার পাতায় এইসব নিয়া আলোচনার ঝড় উঠানো কি যায় না? গান শ্রবণের জিনিস হইলেও মাঝেমধ্যে মগজ দিয়া তার অস্থিচর্ম পাঠ জরুরি, এছাড়া নতুন অঙ্গে গান গাওয়া ও বিচিত্র নিরীক্ষা না সম্ভবে।

ব্যান্ডসংগীতের কথায় আবার ফিরি। চ্যাংড়া পোলাপানদের হাতে বাংলা গানের নতুন এক বিশ্বায়ন সেই সময় ঘটতে শুরু করেছিল। এর গায়ন ও বাদনরীতির সঙ্গে নগরজীবী মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির মুরুব্বিদের কান তখনো অভ্যস্ত হইতে শিখে নাই। পাশ্চাত্য পদ্ধতির বাদন এবং গায়কির সঙ্গে বাংলার স্থানিক অনুষঙ্গ হইতে আহরিত বিষয়বস্তুর মিলনে নবীন নাগরিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে যাচ্ছিল; — আক্কেলজ্ঞানটা জন্ম নিতে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হইসে। বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের ভালোমন্দ, তার অপার সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিরিখ করার পাশাপাশি হালফিল অবস্থাটা তুলে ধরতে একটা-কোনো ক্রোড়পত্রে গমনের ভাবনাটা অবান্তর নয়।

এক্সপোজার পায়নি বিধায় দেশের কুলীন কবি-লেখক ও গানবোদ্ধা আলোচকরা ধারাটাকে হিসাবে নিতে শরম পান। এনারাই আবার বিটলস, পিঙ্ক ফ্লয়েড বা মার্লে-ডিলান-হেনড্রিক্স-মরিসনের নামগান জপ করতে হেভভি  ভালোবাসেন। যা-ই হোক, বিলম্বে হইলেও ছোটকাগজের পাতায় ব্যান্ডগানের কোমল  এবং কঠোর  ধারার গায়নপ্রণালি বিষয়ক কথাবার্তা শুরু করা প্রয়োজন। পরদেশি রকারদের অনেক কুললক্ষণ জেমসের গায়কী ও ব্যক্তিত্বে আপনি পাবেন। অদ্য বেতো ঘোড়ায় পরিণত হইলেও প্রথম কুড়ি বছরের জার্নিতে যেসব গান সে গাইছে তার চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ সময়ের দাবি। গানগুলার পরিবেশনরীতির ভিতর দিয়া আক্ষরিক অর্থে এক রকস্টার বঙ্গে জন্ম নিয়াছিল। এর সমতুল ঘটনা দুই বঙ্গে আজো বিরল।

বাংলা রক সংগীতে জেমসের উত্থান বা তার গায়কিদেহে চাউর ব্যক্তিত্বটা তুলে ধরতে পূর্ণাঙ্গ কাজ বিরল। আইয়ুব বাচ্চু বা মাকসুদও একপ্রকার অবহেলিত বলা যায়। বাচ্চু মারা যাওয়ার পরে অনেকে তাঁরে নিয়া লিখছিলেন। লেখার বড়ো অংশ ভক্তি জ্ঞাপনে নিজেকে নিঃশেষ করেছে। বাচ্চু সহ চাটগাঁ হইতে একঝাঁক গায়কের উত্থান ও বাংলা গানে তাদের জার্নি বা সংগীতবীক্ষণটা সেভাবে আসে নাই সেখানে। বাচ্চুর গিটারবাদন, হামিন-শাফিনের লিরিক্যাল টিউন, সঞ্জীব চৌধুরীর বুদ্ধিদীপ্ত গানের কলিতে উচ্ছল বিষাদ ও মাধুর্য, হাসানের কণ্ঠের গীতলতা, মাকসুদের সংগীতভাবনা এবং এ-রকম অনেকের কাজে আন্তর্জাতিকতার লক্ষণ সদর্পে হাজির থাকলেও পাঠবিশ্লেষণ এখনো অপ্রতুল। না সাহিত্যে, না চলচ্চিত্রে, না গবেষণায়; — বাংলাদেশে ব্যান্ডগায়কীর অলিগলি ঘুরে আসার মতো সোর্সের ঘাটতি আজো মিটে নাই।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: