উদাসীচিত্র || প্রণবেশ দাশ

উদাসীচিত্র || প্রণবেশ দাশ

উদাসীর দৈহিক প্রস্থান ঘটলো জুলাই ১৪, ২০২২। কিন্তু অনন্তকাল টিকে থাকার মতো অনুষঙ্গ তার গানে বিদ্যমান। বিদ্যমান স্ব-মহিমায়। মকদ্দস আলম উদাসী সুনামগঞ্জ/নেত্রকোনার উল্লেখযোগ্য বাউল পদকর্তাদের প্রায় সর্বশেষ প্রতিনিধি (এটা নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা থাকলো)। তার প্রস্থানের মাধ্যমে বোধকরি একটা অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটলো।

উদাসীর বাড়িতে শেষ গিয়েছিলাম ১৮ জুলাই ২০১৬ আর প্রথম গিয়েছিলাম ২০০৮ সালে। উদাসীর সাথে ২০১৬ সালের মোলাকাত নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেবার আমি দু’দিন ছিলাম উদাসীর বাড়িতে। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে উদাসীর সংসার। থাকেন একটা বস্তিতে। ততদিনে বড় ছেলে গত হয়েছে বিনা-চিকিৎসায় আর স্ত্রী গত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। ছোট ছেলেটা রিকশা চালিয়ে কোনোরকমে সংসারের চাকা সচল রেখেছে। উদাসীর সংসারে আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই বিষয়-সম্পত্তিতেও।

সেবার মূলত উদাসীর কিছু ছবি তোলার উদ্দেশ্যেই যাওয়া। প্রায় সকালেই উদাসী হাঁটতে বের হতেন। হাঁটতে-হাঁটতে অনেক কথা বলতেন উদাসী। নতুন ভাবনা নিয়ে, ভাবনার অনুষঙ্গ নিয়ে। সেগুলো যে খুব গোছানো তা না। হয়তো দু’টা লাইন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, সারাদিন ধরে উদাসী সে-দুটি পঙক্তি গুনগুন করতে থাকতেন যতক্ষণ না গানের বাকি লাইনগুলা তৈরি হতে থাকে। সে-যাত্রায় ফেরার দিন সকালবেলা আমরা রাধারমণের জন্মভিটা দেখতে গেলাম। উদাসীর ডেরা থেকে সেটা ১০-১৫ মিনিটের হাঁটাদূরত্ব। [রাধারমণ দত্ত দেহত্যাগ করেন ১৯১৫-তে। গ্রামীণ লোকাচারে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাধারমণ। সিলেট-নেত্রকোনা অঞ্চলে এখনো রাধারমণের ধামাইল গান ছাড়া বিয়ে পূর্ণতা পায় না।]

উদাসী হাঁটতে-হাঁটতে গুনগুন করছেন, একটা লাইনকেই বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইছেন তিনি, —

আমার অভাব দোষে স্বভাব গেল না
আমার স্বভাব দোষে অভাব গেল না রে…

মৃত্যুর কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে ধরে-বেঁধে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বন্ধুবান্ধব আর সুজনদের কল্যাণে চিকিৎসা ভালোই চলছিল, কিন্তু সেখান থেকেও কাউকে না জানিয়ে পালালেন উদাসী। ওষুধ আর হাসপাতালে উদাসীর ভয়/অনীহা আজন্মের, পরিচিতজন মাত্রই জানেন সেটা।

আরেকটি ঘটনা না বললেই নয়। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান তখন কবি ও গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক। [সাদিকভাই যখন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে “সিলেটী নাগরী” নিয়ে তার পিএইচডির অভিসন্দর্ভ তৈরি করছেন, সে-সময় উদাসী নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন সাদিকভাইকে। নাগরী লিপি পড়তে ও লিখতে পারা মানুষ তখন পাওয়া দুষ্কর, উদাসী নাগরী লিখতে ও পড়তে জানতেন। এমনকি নিজের সংগ্রহ থেকে কয়েকটি নাগরী পুঁথি দিয়েও সহায়তা করেছিলেন যতদূর মনে পড়ে]। সাদিকভাই সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যেমে জমি সহ একটি ঘরের ব্যবস্থা করলেন উদাসীর জন্যে। কিন্তু উদাসী তো শুধু নামে না কাজেও উদাসী। কিছুতেই উদাসীকে ধরা যাচ্ছে না। আরেক পরিচিতজন মেহেদি হাসান নুয়েল তখন জগন্নাথপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। অনেক কষ্টে যখন তাকে ধরা গেল তখন উদাসী সেই জমি সহ ঘর গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে বসলেন। বললেন, এসবের তার প্রয়োজন নেই।

উদাসীর সাথে আমার প্রথম দেখা ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরের এক দুপুরে বইপত্রে। লেখক-গবেষক মোস্তাক আহমাদ দীন ও শুভেন্দু ইমামের মালিকানাধীন “বইপত্র” লাইব্রেরিটি তখন সিলেটের লিটলম্যাগকর্মীদের একমাত্র নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। আমার অফিস থেকে লাইব্রেরিটি খুব কাছে থাকায় প্রায় দুপুরেই খাবারটা পাশের রেস্টুরেন্টে সেরে বাকি সময়টা বইপত্রে বসে আড্ডা দেই মোস্তাকভাইয়ের সাথে। ঐদিনও যথারীতি আমি দুপুরে গিয়ে হাজির হই, মোস্তাকভাইয়ের সাথে কথার ফাঁকে-ফাঁকে আমার বারবার চোখ যাচ্ছিল বামপাশে বইয়ের স্তূপের আড়ালে প্রায় ঢেকে যাওয়া মুখের ছোটখাটো মানুষটির দিকে। আমি শুধু তার বামদিকের একটা চোখ আর কপালের কিছু অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম। ঢেউখেলা চুলের লোকটির চোখে আশ্চর্য একধরনের নির্লিপ্ততা। কপালজুড়ে অগুনতি ভাঁজ। খুবই নিচুস্বরে কথা বলছিলেন। খুব মনোযোগ দিয়ে না শুনলে কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না।

মোস্তাকভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি উদাসী। মকদ্দস আলম উদাসী। আমি করমর্দন করতে উঠে দাঁড়ালে তিনিও উঠে দাঁড়ালেন। ছোটখাটো মানুষটি লম্বায় আমার কান ছুঁইছুঁই। হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবির সাথে লুঙ্গি, পায়ে প্লাস্টিকের সস্তা সেন্ডেল। তাতে কাদার দাগ স্পষ্ট। আমি হাত বাড়াতেই তিনি বুকে টেনে নিলেন। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত, কোলাকুলিতে খুব একটা অভ্যস্ত নই। ততক্ষণে তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাসছেন। খেয়াল করলাম আশ্চর্য একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল তার চোখেমুখে। তাতে শিশুর সারল্য।

এই যে উদাসী। টাকা না থাকায় জগন্নাথপুর থেকে টানা ৪৫/৫০ কিলোমিটার হেঁটে সিলেটে চলে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ানো ক্লান্ত উদাসী কিংবা বিনা-চিকিৎসায় অপুষ্টিজনিত রোগে মারা যাওয়া সন্তানের ব্যর্থ পিতা উদাসী কিংবা ভরণপোষণ দিতে না পেরে স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত কুঁকড়ে যাওয়া উদাসী, কেমন ছিলেন তার গানে, জানার জন্যে প্রথম দেখারও ৬ বছর পর ২০০৮-র নভেম্বরের এক পড়ন্ত বিকেলে হাজির হয়েছিলাম তার জগন্নাথপুরের বাড়িতে। সঙ্গী দুই আলোকচিত্রী ফখরুল ইসলাম ও আব্দুল মোনায়েম। এই দু’জনের কল্যাণে আমার ততদিনে ছবি তোলার হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছে। জগন্নাথপুর থেকে আমাদের সঙ্গী হলেন কবি সৈয়দ নীরব। এত স্বল্পভাষী মানুষ আমি খুব একটা দেখিনি। তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন উদাসীর বাড়িতে।

এই দুই ভ্রমণের কিছু স্মৃতি তোলা থাকলো এখানে। উদাসীর সাথে পরিচয়ের প্রায় ২০ বছর পেরোল। ততদিনে প্রথমবারের ভ্রমণসঙ্গী ফখরুলভাই এবং সৈয়দ নীরব গত হয়েছেন অনেকদিন। গত হয়েছেন উদাসীর বড় ছেলে, স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যা। এইসব ভার বইতে বইতে উদাসীও কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

নির্ঝঞ্ঝাট মৃত্যু চেয়েছিলেন উদাসী। সে-রকমই হলো বোধকরি।

বি.দ্র./ রচনার সঙ্গে ব্যবহৃত সমস্ত ছবির শিল্পী প্রণবেশ দাশ


বাউল মকদ্দস আলম উদাসী নিয়া আরও রচনা
প্রণবেশ দাশ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you