বেন্সন, বন্ধু, বিপ্লব

বেন্সন, বন্ধু, বিপ্লব

সস্তা-সিগ্রেট-টানা আমাদের এক বন্ধুর গল্প এইটা। আমরা একলগে চলতাম যারা, তাদের মধ্যে খুব কথাবার্তায় কেতাদুরস্ত ছিল সে, বেশভূষাতেও চোস্ত। সবকিছুতেই একটা ক্যাজুয়্যাল স্মার্টনেস ছিল তার মধ্যে যা আমাদের আকর্ষণ করত। ঠোঁটকাটা আর বিরুদ্ধস্রোত কথাবার্তা বলত বলে তাকে আমরা পছন্দ করতাম সবাই। কিন্তু অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, সে আসলে চমকরাজ ছিল, ছিল সে এম্পিরর অফ বাগাড়ম্বর বস্তুত, প্রতিটি উচ্চারণ প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি-অভিব্যক্তি দিয়ে সে আসলে আমাদের সঙ্গে স্রেফ পার্ফর্ম্যান্স করে যেত। যদিও প্রত্যুত্তরে আমরা বোকার মতো ওর কথাগুলো খুব বিশ্বাস করতাম এবং সিরিয়াসলি তর্কবিতর্ক করতাম। পরিস্থিতি নিজের কব্জায় নিয়ে নিতে সে সাতিশয় পারঙ্গম ছিল।

কথায় কথায় সে আমাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের চর বলে ভ্রৎসনা করত ও পুঁজিবাদের দালাল বলত। বলেই রিলিজ দিলে তো গল্পের কিছু ছিল না, তদুপরি নিখুঁতভাবে আমাদেরই নিত্যদিনের আচরণ থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করত ঘণ্টায় ঘণ্টায়। আমাদের কারোর কারোর তো অপরাধের অন্ত-অবধি ছিল না, আমরা নানাবিধ উল্টাপাল্টা অ্যামেরিকান প্রপ্যাগ্যান্ডাম্যুভি দেখতাম, রোম্যান্সকাব্য পড়তাম ভক্তিভরে, প্রেমের উপন্যাসের জন্য ছোঁক ছোঁক করে বেড়াতাম পাব্লিক লাইব্রেরিতে, লালকালিতে ছাপা বিপ্লবী ব্যুলেটিন কিনছি-কিনব করে কেটে যেতাম ডাইনে কাৎ হয়ে, এবং সর্বোপরি করতাম বড়লোকদের বাড়ির টিউশানি। বিপ্লব ত্বরান্বিত হবার পথে অন্তরায় হিশেবে এসব কর্মকাণ্ডের একটাই এনাফ বলে বিবেচনা করত আমাদের সেই বিপ্লববিমর্ষ বন্ধুটি। নিষ্ঠার সঙ্গে সে রেইনে-উইন্টারে দুপুরে বিকেলে সন্ধ্যায় বাপের পয়সায় মাসের তিরিশ-ঊনতিরিশদিনই রিকশা হাঁকিয়ে যেত দুইকিলো দূরের পার্টিঅফিসে। সে প্ল্যান নিয়া আগাচ্ছিল ফ্যুলটাইমার বিপ্লবী হবে।

খেত সে সস্তা সিগ্রেট, পড়ত কবিতা ঘুরেফিরে তিনচারজন বাংলা বিপ্লবস্বাপ্নিক কবির; সমাজতন্ত্র ছাড়া যাদের আঁখিপল্লবে ঘুম আসত না; যাদের মধ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আর নির্মলেন্দু গুণ আসতেন ঘুরেফিরে এবং বাকি সবাইকে সে খারিজ করে দিত রিয়েকশন্যারি বলে, স্টেজে থেটার বলতে তার কাছে সংগঠনানুমোদিত কয়েকটি স্ক্রিপ্ট বছরঘুরে। এবং করত সে টেবিল-চাপড়ে-বিশ্ববদলানো বৈপ্লবিক সংগঠনের কাজকর্ম খুব জোরেশোরে। তার পার্ফর্ম্যান্সে একেবারেই বিমুগ্ধ ছিলাম আমরা সকলে। এই গল্প আমাদের সেই বন্ধুটিকে নিয়ে নয় পুরোপুরি, কিংবা তার আরও অনেক শানদার কাহিনি আছে যা না-শোনালে তাকে পুরোটা ধরা যাবে না, কিন্তু বেন্সন ও বিপ্লব সংক্রান্ত এই গল্প মূলত ওরই মৌলিক অসংখ্য অবদানের মধ্যে একটি।

সে বলে, অ্যাট-লিস্ট বলত ওইসময়, বেন্সন টেনে কেউ বিপ্লব করেছে বলে শোনা যায় নাই। বিপ্লব যারা করেছে ফ্যুলডান বা হাফডান কিংবা যারা আদৌ বৈপ্লবিক দীর্ঘজীবিতার ফিনিশিং লাইন টাচ করতে পারেনি, তাদের মধ্যে চুরটখোর অঙ্গুলি-অমেয় কিংবা যাকে বলে সীমাসংখ্যা নাই বা কাতারে কাতার। যারা পারে নাই কিন্তু চেষ্টা চালায়ে গেছে বিপ্লবের, কিংবা যারা বরাতজোরে বিপ্লব সফলভাবে সম্পন্ন করেছে, তারা সবাই সস্তা সিগ্রেট খেত বলে ইতিহাসশ্রুতি রয়েছে। অ্যাকর্ডিং টু হিম, এইটা আমাদের হিস্ট্রিজ্ঞান না ইয়াদ রাখতে হবে।

এতদঞ্চলে বিপ্লবীরা, বা যারা অন্তত তাদের মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ছিলেন শ্রেণিচ্যুত। খুব বুলন্দ দরোয়াজার ছিল এই ডিক্লাসড শব্দটি। নিজেদের শ্রেণি থেকে পয়লা পদক্ষেপেই তারা বেরিয়ে এসেছেন, বলা হয়ে থাকে, এবং সেই বেরিয়ে-আসা অধঃ থেকে উর্ধ্বস্তরে নয় বরঞ্চ উল্টা। প্রায় সব বিপ্লবনেতারা ছিলেন ভূস্বামী-শ্রেণির, অথবা স্পষ্ট করে বলতে গেলে জোতদার পরিবারের সন্তান। রাজপুত্র বলবেন না-ইবা কেন? হ্যাঁ, তা-ই। যদিও তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রদ হয়ে গিয়েছে চিরতরে, তবু হাতি কাদায় দাবলেও হাতিই থাকে। পড়ন্ত সেই সামন্ত পরিবারগুলো ছিল, এবং আছে এখনও, হাতির মতোই। কিন্তু সময়ের বিশেষ একটা পর্বে সেইসব হাতিশাল থেকে কিছু হাতি পিঁপড়েদের পক্ষ নিয়েছিল। পিঁপড়ে, যারা পদপিষ্ট হয়ে আসছে যুগ-যুগান্তর ধরিয়া, তাদের পক্ষে কথা বলতে যেয়ে হাতিরা দলিত হয়েছে ভীষণভাবে। ভেস্টেড-ইন্টারেস্টে আঘাত পড়লে হাতিও স্বগোত্রের হাতে প্রহৃত হয়, এই শিক্ষা আমরা পেলাম, যা-ই হোক। কারা এই নৃশংস পদদলনকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের নাম দামি ইতিহাসবইয়ের পাতায় সুলভ।

যাকগে, রেভোল্যুশন্যারি লাইন ছেড়ে এবার ফুর্কানিয়া লাইনে যাই। সিগ্রেট ফোঁকা নিয়া কথা হচ্ছিল। আর্নেস্তো চে গেবারা তো হাভানা চুরট টানতেন। তো? না, মানে, চুরট তো বড়লোকের জিনিশ। বন্ধু সপ্রতিভ উত্তর করে : আরে বাপ, কিউবায় চুরট টানে মজুর-কিষাণেরাই। বিপ্লবের জন্য, বন্ধুটি যোগ করে, সবচেয়ে ফ্রেন্ডলি সিগ্রেট হতে পারত চার্মিনার। কিন্তু ওইটা পশ্চিমে অ্যাভেইলেবল, বাংলার, আমাদের এখানে বিপ্লববান্ধব চুরটের অভাব অত্যন্ত প্রকট। বন্ধুরে জিগাই, দোস্ত, তাইলে বেন্সন যারা খায় তারা কতদূর কী কাজে লাগে মানবসভ্যতার? তদুত্তর : ধুর! ওরা বড়জোর কর্পোরেট জায়ান্ট হয় কিংবা তাদের কোলাবোরেটর কায়ক্লেশে এবং সর্বোচ্চ নোবেল-নাইটহুড পায়া খায়াদায়া মারা যায়। এইবার বহুক্ষণে দোস্তরে বাগে পায়া আমরা ভুল ধরি : দোস্ত, নোবেল-নাইটরাও তো তোমার চুরট-পাইপ খায়। যেমন মনে করো তোমার প্রথমালোর স্যার এফএইচ আবেদ। বন্ধুর সংগঠনে খ্যাতকীর্ত কমরেড কয়েকজন কমন পলিটব্যুরোসদস্যের নামোল্লেখেও ভুলতাম না অবশ্য।

বন্ধু বিরক্ত হয়, কিছু বলে না।

আমাদের সেই চিপ-চুরট-ফোঁকা বাগ্মী বন্ধুটি পরিণত বয়সে অ্যামেরিকা যায়, থিতু হয় স্পাউস্-কিড ও তৎসঙ্গে পেল্লায় একটা ফার্মহাউজ বাগায়ে, এখন সে চেইন-চুরটখোরের শাপমুক্ত হয়ে রেগ্যুলার জিমে যায় এবং উত্তর-দক্ষিণ ছয়টা ব্লক আপ অ্যান্ড ডাউন জগিং করে রবিবার ব্যতীত রোজ সকালে। চুরট ছাড়লেও রোজই বিপ্লব করায় তার উদি নাই। দিনে-দিনান্তরে ফেসবুক-স্ট্যাটাসগুলায় তার বিপ্লবোৎপাত উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কেবল উয়িকেন্ডে ডে-আউট আর রেস্টোরান্টে ফ্যামিলিডিনারের ছবি নিউজফিডে দেখে আমরা তার মেন্টাল হেল্থ নিয়া আশ্বস্ত হই। ইনকাম-রোজগারের দিক থেকে সে যে আমাদের ইম্যাজিনেশনের বাইরে, এইটা আর মেনশন করা নেসেস্যারি নয়। বিপ্লবের আগে নাকি পুঁজির ঘনীভবনটুকু জরুরি।

কী আর বলব দুঃখের কথা, ভাই, বিপ্লব-নোবেল কোনোটাই দেখছি আমরার নসিবে নাই।

[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ  : ধূমপান বিপ্লবী-নির্বিপ্লবী নির্বিশেষে ক্যান্সারের একটা কারণ]

লেখা : জাহেদ আহমদ ২০১৩

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you