অন্তর্দাহসময়ের অনুসন্ধানপত্র

অন্তর্দাহসময়ের অনুসন্ধানপত্র

গৃহদাহ  উপন্যাসের অন্তিম পৃষ্ঠায় যেয়ে মহিম ভাবছিল, মহিমের আত্মোপলব্ধি বলা যাক, শরৎচন্দ্র ব্যাপারটা রেকর্ড করেছেন যেভাবে :

“যে ধর্ম অত্যাচারীর আঘাত হইতে নিজেকে এবং অপরকে রক্ষা করিতে পারে না, বরঞ্চ তাহাকেই মৃত্যু হইতে বাঁচাইতে সমস্ত শক্তি অহরহ উদ্যত রাখিতে হয়, সে কিসের ধর্ম, এবং মানবজীবনে তাহার প্রয়োজনীয়তা কোন্‌খানে? যে ধর্ম স্নেহের মর্যাদা রাখিতে দিল না, নিঃসহায় আর্ত নারীকে মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া যাইতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করিল না, আঘাত খাইয়া যে ধর্ম এতবড় স্নেহশীল বৃদ্ধকেও এমন চঞ্চল প্রতিহিংসায় এরূপ নিষ্ঠুর করিয়া দিল, সে কিসের ধর্ম? ইহাকে যে স্বীকার করিয়াছে, সে কোন্‌ সত্যবস্তু বহন করিতেছে? যাহা ধর্ম সে ত বর্মের মত আঘাত সহিবার জন্যই! সেই ত তার শেষ পরীক্ষা!”

আচ্ছা বাপু, পরে অবসর পাইলে ভাবিও, হোল্ড য়্যুর পেন ফর গড’স্ সেইক রাইট নাও অ্যান্ড লেট মি কিপ মাই জবডুয়িংস্ আপ!


শরৎ কি ক্ল্যাসিক্স গোত্রীয়? শরৎচন্দ্ররচনারাজি কি ক্ল্যাসিক্স ডিগ্নিটির লায়েক বলিয়া গণ্য হয় ক্রিটিকদিগের কাছে? এইটা ভাবছিলাম। ভাবতে যেয়ে দেখি যে ক্ল্যাসিক্সের ডেফিনিশনটাই তো খুঁজে দেখি নাই জিন্দিগিতে। সখি, ক্ল্যাসিক্স কারে কয়? গেলাম সখিগৃহে, দিলাম গ্যুগলসার্চ। দেখি কয়, a work of art of recognized and established value; এইটা নাউন, প্লুরাল নাউন। দুই নাম্বারে দেখি আরেকটা ডেফিনিশন, অলমোস্ট অভিন্নই, দেখাচ্ছে : a subject at school or university which involves the study of ancient Greek and Latin literature, philosophy, and history. তাইলে ব্যাপার কি এ-ই যে কেবল গ্রিক-রোমক দুনিয়াপ্রাচীন থুত্থুরে বুইড়া না-হওয়া অব্দি ক্ল্যাসিক্স হবে না কিচ্ছুটি? কিন্তু ধ্রুপদী সাহিত্য ও সংগীত বলিয়া আমরা যা-কিছু মুখস্থ মায়ের পেট থেকে হেফজ্ হয়ে এসেছি, হিন্দুস্তানি মিউজিক ইত্যাদি, সৃষ্টির বিলয় অব্দি এইগুলা ক্ল্যাসিক্স মর্যাদা পাইতেই থাকবে? এদের মরণ নাই? নাকি মরিলেই ক্ল্যাসিক্স হয়? ক্ল্যাসিক্স কি তবে কাদম্বিনী, যিনি মরিয়াই প্রমাণ করিবেন যে তিনি মরেন নাই? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা আরেকটু আগের বঙ্কিম-মধু রচনারাজির বেশকিছু অধ্যায়কেও তো ধ্রুপদী ডিগ্নিটি নিতে দেখা যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি গৃহদাহ  খতম দিয়া সারলাম শৈশব থেকে এই নিয়া লামসাম সতেরোবারের মতো।


শরৎ কী সাম্প্রদায়িক? ক্রিটিক বলবেন। আমরা পড়ব, হুমড়ি খেয়ে, আর ক্রিটিকদের গ্রুপে সাপোর্টার হিশেবে পঙ্গপালের ন্যায় জয়েন করব আর ক্রিটিকদের কায়দা নকল করে গালিগালাজ গর্জিয়ে ভাবব, আহা, আমিও সমালোচনাসাহিত্য হইনু নয়শ ঊননব্বই কিলোগ্র্যাম!


ঘোর সাম্প্রদায়িক, শরৎ, প্রমাণ করা আদৌ শক্ত নয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও শরৎকালে, শরৎপাঠকালে, এইসব মনে পড়ে না আদৌ। সমগ্র শরৎ পর্যালোচনাকরতঃ অবশ্য সম্প্রদায়চৈতন্যতাড়িত শরতের পরিচয় মিলবে বেশ বহু জমিজিরেতে। এরপরও তো শরতের জরুরতি স্বীকার করি ক্রিটিক-মিমিক্রিটিক নির্বিশেষে। ম্যাজিকটা কোথায়? একই জিনিশ বঙ্কিমপাঠকালেও ভুলিয়া থাকতে বেশিক্ষণ পারবেন না আপনি। কী এমন মহাপ্লাবন হলো দুনিয়ায় যে একজন লেখকের অসাম্প্রদায়িকতা/সাম্প্রদায়িকতা তার শিল্পদর্দ/শিল্পদরদ মিথ্যে করে দেয় এক-লহমায়? চিহ্নিত করে ফেলে তারে এক গলিয়ো-কি ভিলেইন হিশেবে? এইসব ভাবাচ্ছিল। অন্তর্দাহ হচ্ছিল ঘরের ভেতরকার চৈত্রভূমিকাজাত নতুন গরমে কিংবা গৃহদাহ  পাঠপ্রতিক্রিয়ায়।


বঙ্কিম চাটুজ্জে যদি হন শতবর্ষব্যাপী ফিউজিটিভ, তবে শরৎ কত, আর এখনকার গণ্ডায় গণ্ডায় গজানো সগুম্ফ/নির্গোঁফ সম্প্রদায়বন্ধু/সম্প্রদায়শত্রু আস্তিক/নাস্তিক/স্বস্তিকাপূজক কবি-লিখিয়েরা কালান্তে/কালান্তরে কী যে হইবেন, ভেবে হই আকুল।


কূলের খোঁজে নেক্সট সামটাইম নৌকা যাবেনে ভাসানো।

লেখা : জাহেদ আহমদ ২০১৫

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you