কবি বিবি হায়াতি কিরমানি-র জন্ম হয় আঠারো শতকের পয়লা দিকে, পারস্যের কিরমান প্রদেশে — যা কোনো কোনো সূত্রমাফিক হালজামানার ইরাকের অংশ। তাঁর পরিবারে ছিল সুফিমার্গের নিবিড় চর্চা। শৈশবে বিবি হায়াতির লালনপালনের দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন জৈষ্ঠভ্রাতা, তাঁর হাতে কবি দীক্ষা নেন আধ্যাত্মিক তরিকা মোতাবেক দিনযাপনের রীতিরেওয়াজে।
সে-জামানার মশহুর সুফি নূর আলী শাহ-এর তত্ত্বাবধানে অল্পবয়সী বিবি হায়াতি নিমাতুল্লাহী তরিকার আদবিয়াত বাকায়দা-কানুন অনুসরণের সবক নেন। পরিশেষে একসময় কবি নূর আলী শাহ-এর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে অবদ্ধ হন, তাদের সংসারে একটি সন্তানেরও জন্ম হয়।
যতটা জানা যায়, স্বামীর অনুরোধে বিবি হায়াতি তাঁর মূলত গজল আঙ্গিকে রচিত কবিতাগুলো দিওয়ান (দিওয়ান-ই-হায়াতি) আকারে প্রকাশ করেন। জীবদ্দশায় প্রেমঋদ্ধ অত্যন্ত প্যাশোনেট এবং একইসাথে অতীন্দ্রীয় ভাবধারায় সমৃদ্ধ পদাবলির রচয়িতা হিসাবে কবি লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। আপন কৌমের মানুষজনকে নিজহাতে রান্না করে খাওয়ানোর ব্যাপারেও বিবি হায়াতি খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
এখানে উপস্থাপিত কবিতাতিনটি চয়ন করা হয়েছে ‘সাম্বালা অ্যান্থোলোজি অব উয়োম্যানস্ স্পিরিচ্যুয়েল পোয়েট্রি’ নামক গ্রন্থ থেকে। ফার্সি থেকে ইংরেজিতে কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন আলিকি বার্নস্টোন।
বিবি হায়াতি কিরমানি-র কবিতা
ফার্সি থেকে ইংরেজিতে তর্জমা : আলিকি বার্নস্টোন ।। ভাবতর্জমা : মঈনুস সুলতান
যখন ছিল না সভ্যতার ইশারা–ইঙ্গিত
তখনো মানবসভ্যতার হয়নি শুরুয়াত,
স্মৃতিতে বহন করছিলাম তোমার অলকচূর্ণ —
তৈরি হয়নি জল — ভেতরে আমার বইত প্রপাত,
অবচেতনে তোমার অস্তিত্ব — সৃষ্টি তখনো ছিল অসম্পূর্ণ।
সংসারের অদৃশ্য রাজ্যপাটে,
তোমার মুখশ্রীর আকুল আকাঙ্ক্ষায় —
ভিড়িয়েছি কিশতি নীলিমার প্রতিটি ঘাটে,
খুঁজেছি স্মৃতিতটে —
উদ্ভাসিত হয়েছিল সূর্যস্নাত বিভা হৃদয়ের দৃশ্যপটে;
ঘুরেছি — যতক্ষণ-না সত্তার প্রতিটি নির্দিষ্ট পরমাণু —
ঘূর্ণিত হয়েছিল — কী-এক যাচনায় হয়েছিল নতজানু।
সাক্ষাতে থেমেছিল কাল — রুদ্ধশ্বাসে,
তোমার প্রণয়ে আচ্ছন্ন ছিল আমার আত্মা … দেহমন —
তুমি ছাড়া কারো উপস্থিতি ছিল না নিঃশ্বাসে,
হৃদয়ের গোপন সিন্দুকে রাখা ছিল যখের ধন।
তখনো তৈরি হয়নি অঙ্কুরের সম্ভাবনা গোলাপবাগে,
আমার আত্মার বর্ণাঢ্য পঙ্খি কী-এক অজ্ঞাত অনুরাগে —
পাখা মেলেছিল তোমার তেপান্তরে,
পৌঁছেছিল মঞ্জিলে — প্রাকসৃষ্টির মরমি প্রহরে।
তোমার তারিফে নিমগ্ন আমি অজস্রবার,
দু-চোখের বেদিতে হায়াতি জ্বেলেছে মোম আরাধনার,
ফিরে তাকাও — দাঁড়িয়েছি হাতে নিয়ে পুষ্পের সুচারু সম্ভার।
কীভাবে পর্যবেক্ষণ করি চন্দ্রিমার চারু বৈভব
নিমগ্ন হই কীভাবে চন্দ্রকলায়
বিমুগ্ধ হই জোছনার চারু হাস্যে,
যদি-বা তাঁর মুখশ্রী হৃদয়ে আমার
ঝলসে সতত সৌর-উচ্ছ্বাসে?
হৃৎপিণ্ডে প্রতিফলিত হয়
তাঁর চোখের নীলাভ নজর,
কোঁকড়ানো চুলে খুঁজি বরাভয় —
অবিশ্বাস্য শোভায় ভাঙে আমার বিশ্বাসের ঘর।
তারপরও তিনি যদি মুখমণ্ডল থেকে
সরান সুচারু কিংখাব,
স্বপ্নের রেশম-গিলাফে নক্ষত্র যায় এঁকে —
সরোবরে শুকায় আব,
থেমে যায় ঘূর্ণায়মান বিশ্ব
ঠাঁই পায় নীড়হারা নিঃস্ব।
বাগিচায় হাঁটেন তিনি ঋজু ভঙ্গিতে
পত্রপল্লবে ছড়ায় সুঠাম বৃক্ষের মহিমা —
চরাচর ভরে ওঠে অনুপম সংগীতে,
বিপুল বিশ্বে খুঁজি আমি সৌন্দর্যের সীমা।
সওয়ার হয়ে মরমি অশ্বে
কষে ধরেন বল্গা দুরন্ত সাহসে দুর্বার,
ছুটে যান তিনি — ছাড়িয়ে নশ্বরলোকের দিগন্ত —
সবিস্ময়ে তাকায় হায়াতি — দৃষ্টিতে অনন্ত অপার,
পায় না খুঁজে সে সীমান্তের আদিঅন্ত।
আজ নিশীথে হৃদয়ের সহিষ্ণু সাকি
ইয়াকুত পাথরের লোহিতাভা ছড়ানো ওষ্ঠে
উজাড় করে পেয়ালায় ঢালে শরাব,
দেয়ার আর তেমন-কিছু নেই তার বাকি,
মেটায় সে প্রতিটি অস্থির হৃদয়ের অভাব।
পান করে অবশেষে হায়াতিও
তাঁর মদির ভাবোন্মাদনা,
আত্মা তার ভরে ওঠে দয়িতের নিখাদ প্রেমে,
কীভাবে ভিন্ন কিছু পানে হবে সে ফের উন্মনা?
এই নিশিরাত কী অতীন্দ্রিয় অর্জনের
এই নিশিরাত কী অতীন্দ্রিয় অর্জনের —
নাকি তোমার কেশগুচ্ছ … হাওয়ায় ছড়ায় দগ্ধ চন্দন —
তবে কী হয়েছে প্রভাত,
নাকি — দেখছি তোমার উদ্ভাসিত অনন?
সৌন্দর্যের স্বরলিপিতে
এটা কী মৃত্যুহীন প্রথম চরণ?
নাকি তা তোমার গাঢ় কৃষ্ণাভ ভুরুর
অনুলিপিতে আঁকা একটি বঙ্কিম রেখাবিশেষ?
হৃৎকমলে ছড়ায় অনুরণন,
ফুরিয়ে গিয়েও হয় না সম্পূর্ণ নিঃশেষ।
এটা কী বাগিচার সুঠাম শিরিষ —
নাকি গোলাপবাগানের প্রান্তিকে লাগানো ঝাউগাছ?
হাওয়ায় দোলে দীর্ঘ ঘাসের শিস,
স্বর্গের খর্জুরবৃক্ষ — ভরে আছে সোনারঙ ফলে,
নাকি দাঁড়িয়ে আছো তুমি উদ্ভিদপ্রতিম ঋজু —
ছায়াতলে এসে দাঁড়ানোর
অধিকার পাবে কী হায়াতি — কোনো ছলে?
বাতাসে ভাসে চীনা হরিণীর কস্তুরি গন্ধ —
নাকি গোলাপের সৌরভে হৃৎপিণ্ডে তৈরি হলো দ্বিধাদ্বন্দ্ব?
গোলাপ কী বাতাসে মিশাচ্ছে তার প্রশ্বাস
নাকি মথিত হয়ে আছি তোমার সুগন্ধে,
স্পর্শ করছে আমাকে তোমার উষ্ণ নিঃশ্বাস?
চোখের নিমিষে মেঘনীলিমায়
তৈরি হয় স্বর্ণালী বিদ্যুৎ-বহ্নি,
নাকি চাক্ষুষ করছি সিনাই পর্বতের অনন্ত অগ্নি?
আমার উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস —
নাকি স্পর্শ করছি তোমার অন্তর্গত উদ্ভাস?
স্তেপে চরা সুন্দর জন্তুর গাত্রনিসৃত মেশক্
নাকি পারস্যের খাঁটি আতর?
এটা কী পদ্মের পাপড়িতে বসা ভ্রমর —
নাকি তোমার কোঁকড়ানো কেশদাম?
প্রভাতের মিহি আলোয়
দ্রাক্ষার নিঙড়ানো পরিণাম ….
পেয়ালাভরা লোহিত শিরাজি —
নাকি মসলিনশুভ্র ইন্দ্রজাল?
তাকাই আত্মপ্রেমে মুগ্ধ তোমার চোখের দিকে —
থেকে থেকে হই বেখেয়াল —
নাকি সম্মোহিত হয়েছি আমি তোমার যাদুটোনায়?
এটা কী বেহেস্তের এক বিরল বাগিচা —
নাকি তৈরি হয়েছে পৃথিবীতে স্বর্গের বিভ্রম?
মানুষ যখন নিমগ্ন হয় নিবিড় আরাধনায়,
তখন তাদের সামনে থাকে
কাদামাটিতে গড়া মসজিদের মেহরাব,
হায়াতির হৃদয়ের মসজিদে কেবলই
প্রতিফলিত হয় তোমার উদ্ভাসিত মুখ,
তুমিই তার একমাত্র খোয়াব।
মর্মমুরাকাবা / আগের কিস্তিসমূহ
মঈনুস সুলতান রচনারাশি
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS