বাঙালির দীনচর্চা, আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক বিনিময়, সম্প্রীতি ও সহাবস্থান || আহমদ মিনহাজ

বাঙালির দীনচর্চা, আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক বিনিময়, সম্প্রীতি ও সহাবস্থান || আহমদ মিনহাজ

বাঙালি মুসলমানের ঘরে পয়দা হওয়ার সুবাদে আমার-আপনার জীবনে ইসলামি দীনচর্চার সদর-অন্দর নিয়া জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল সহজাত ঘটনা হইলেও তারা কখনো গুরুভার হয়ে মাথায় পেইন উঠায় নাই। লোকে সহজ অভ্যাসে যেমন দাঁতে ব্রাশ ঘষে, মুসলমান পরিচয়ে ইসলামি দীন আমলের ঘটনা মোটের ওপর জীবনে সেরকম ছিল। চ্যাংড়া বয়সে আল্লাখোদার সাধনায় নিমগ্ন থেকে দীনদার বা বুজুর্গির রাস্তা খোঁজার মেজাজ থাকে না। আমারও ছিল না। ওই বয়সে অনেককিছু মাথার ওপর দিয়া যাইতে চায় এবং সেইভাবে তাকে যাইতে দিতেও মন চায়। যাই হোক, জামানা বদল গায়া! প্রতি ঘরে বুড়োহাবড়া থেকে আরম্ভ করে পিচ্চি পোলামাইয়ার নিজেকে দীনদার প্রমাণের চেষ্টা ও সে-নিয়া এলাহি কাজকারবার দেখলে চোখ কপালে ওঠে! মরমে ভাবি, ‘হায়! জেবনটা আঘাটায় ঘুরে মরে পয়মাল হলো বটে!’ যেসব চিহ্ন আর অভিজ্ঞতার ছাপ্পা বুকে লয়ে আমরা বালেগ হইছি তার অল্পই বোধহয় যুগের সঙ্গে মিশ খায়। দুর্ভেদ্য এক মনবিরোধ মনে তাই সদা বহে। সে হয়তো বলতে চায়, — ‘আমাদের বালেগ হওয়ার যুগে নিজের পরিচয় অনুসন্ধানের তরিকা আর জানাবোঝায় ফাঁকি থাকলেও নিঃশ্বাস নেওয়ার আরাম ছিল সেখানে। টেকনোদুরস্ত ইহকালে জিনিসখান মনে হয় দুর্লভ হওয়ার পথে!’

মিথ্যে নয়, আমাদের শিশু ও যুবাকাল অন্যরকম ছিল। বালেগ হওয়ার পথ পাড়ি দেওয়ার ক্ষণে চাপা ক্ষোভ আর মানসিক দূরত্বের ফেউ ধরে হিন্দু-মুসলমানকে বিবাদে লিপ্ত থাকতে দেখলেও চোখরাঙানিয়া বা খুনখারাবিতুল্য ওইসব ঘটনা মনে থিতু হওয়ার চান্স পায় নাই। বালেগ হওয়ার রাস্তায় হাঁটার সময় বিচিত্র পরিচয়ে নিজেকে রঙিন ভাবার সুখে ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিব্রত বোধ করার জটিল কারণ বিদ্যমান ছিল। তা-বলে অতি-প্রগতিশীলতা জাহিরের জোশ হইতে তাকে নিরোধ বা ইনহিবিশনের পক্ষে যারা সেই সময় আওয়াজ-টাওয়াজ দিতেন তাদের কথায় সায় দিতে মন ইতস্তত বোধ করছে। মনে হইত এক গাড্ডা থেকে বাঁচতে আরেক গাড্ডায় পড়ছি! কথা সঠিক, দীনচর্চার মামলায় লোকের বাড়াবাড়ি বিরক্তির জন্ম দিলেও সে-জন্য তাকে তাচ্ছিল্য করা অথবা মাথা ব্যথার দাওয়াই খুঁজতে মাথা কেটে ফেলার ভাবনা আজকের মতো দুর্বার ছিল না। দীনের অনুশীলনে বিশ্বাসীর বাড়াবাড়ি আর ওদিকে ধরা থেকে তাকে উচ্ছেদের সংকল্পে মরিয়া অবিশ্বাসীর তালছাড়া উত্তেজনার চক্করে কাণ্ডজ্ঞান খোয়ানোর ঘটনা ব্যাপক হইতে দেখি নাই। সকলে সেই প্রাণবস্তুকে খোঁজার চেষ্টা করছে যার ওপর ভর করে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।

ছেলেবেলার দিনগুলায় কোরানশিক্ষা থেকে শুরু করে দোয়াকুনুত লবজ করা বালেগ হওয়ার নিয়মে আমাদের ঘাড়ে চাপানো হইত। অন্যদিকে কারণবশত সেখানে বিলম্ব বা অবহেলা ঘটলে ‘গেল গেল’ রবে হল্লা মাচানো আজকালের ন্যায় সাংঘাতিক ছিল না। নামাজ-রোজা-শবেবরাত-ঈদ কিংবা মহররম বড়ো অনায়াস ছিল জীবনে! কাসিদা-গজল-কাওয়ালি, বাহারি খানাপিনা ও লেবাসের সঙ্গে ইসলামি আদব-লেহাজ থেকে শুরু করে যত কালচার রক্তে ছিল সেগুলাকে মুসলমানের সম্পত্তি জাহির করার খায়েশে ফ্রেনজি হওয়ার ভূত খুব কম লোকের মাথায় চাপতে দেখছি। ধর্মীয় পরিচয়ের চিহ্ন রক্তে ধরে ‘লাগা বাড়ি’-র হিন্দু পরিবারের সঙ্গে দিলখুশ মিলামিশা সংগত কি না এমতো ভাবনায় পতিত লোকের সংখ্যা তখনো গৌণ ছিল। দুই সম্প্রদায়ের মিলমিশের জগতে একে অন্যের অন্দরমহলে উঁকি দেওয়ার স্মৃতিগুলা মনে তাই বুদ্বুদ উঠায়! পরস্পরের অন্তঃপুরে বিচরণের ঘটনায় যুগবাহক সংস্কার বারবার রক্তচক্ষু নিয়া সামনে হাজির হইছে, তবে ঢোকার মানত যদিন কেউ করছে তাকে ঠেকানোর জন্য লোকের যুদ্ধংদেহী রূপ ধারণ (*আমি অন্তত) দেখি নাই।

অন্দরমহলে উঁকি দেওয়ার সময় কোনো লোক হয়তো সেখানে সংগত সীমা অতিক্রম করে হামলে পড়তে চাইছিল। তাকে নিয়া অসন্তোষ ঘনীভূত হওয়ার সময় ক্ষমাঘেন্না আর নিরুপায় প্রশ্রয়ের স্পেস তৈরি হইতেও দেখছি। ধর্মীয় পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করানোর সময় একালের অতি-সঠিক বুঝদার লোকের তুলনায় সেকালের কম-সঠিক ‘বেবুঝ’ লোককে মাঝেমধ্যে তাই খুবসুরত মনে হয়। অনুভবখান মোটের ওপর সেখানে সবসময় জারি থাকতে চাইছে, — ধর্মীয় পরিচয়ের কিনারে জাতি-দেশ-অঞ্চল আর জীবিকা ভিত্তিক পরিচয়গুলাও মানুষের জীবনে সহজাত। আরো আগে বাড়লে তামাম জাহানে সচল মুনষ্যত্ব বা ইনসানিয়াতের বর্গে ফেলে মানুর পরিচয়ের কিনারা করা সম্ভব। এইসব পরিচয় হইতে টপাটপ একটাকে তুলে এনে লোকের দোষগুণ বিচারে বসা গোনাহর শামিল। ধর্মীয় পরিচয়ের সারবত্তা শেষতক্ ইনসানিয়াতে নিহিত এবং তার স্বরূপ বিস্মৃত হওয়া অধর্ম। ধর্মের বিচারে এইটা হইছে ভ্রষ্টাচার! — উক্ত মনোভাবের সপক্ষে আওয়াজ তোলা লোকজন দেশবিদেশে আজো বিচরণ করেন, যদিও তাদের দিল ফুড়ে সেই ঝলক বাহির হইতে দেখি না যেইটা আমাদের বালেগ হওয়ার দিনকালে আত্মমর্যাদা ধরে রাখতে পারছিল।

গানপার’-এ ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর আপাত সমাপ্তির ইমেইলবার্তায় নজর বোলানোর ক্ষণে নোনাধরা স্মৃতিরা মনে ঘাই তুলতে শুরু করছে। ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর উৎপত্তির সঙ্গে তাদের সহবত নিবিড় নয় জানি, কিন্তুক নেপথ্য সংযোগকে সেখানে অস্বীকার যাই কেমনে! হালফিল দুনিয়ায় চাগিয়ে ওঠা ধর্মবাতিকের লক্ষণ মনকে সোয়াস্তি দিতে বিফল হওয়ার কারণে জঙধরা অতীতে কুড়িয়ে পাওয়া বাতিকগুলাকে কিউট  ভাবতে মন চায়। ‘ইসলামবীক্ষণ’র জগতে ঘোরাফিরার নিট মুনাফার কথা যদিন উঠে তবে এই বোধনের সহায় মেগে নিজেকে খালাস করতে চাই, — আত্মপরিচয় তালাশে নেমে ধর্মীয় পরিচয়কে বদখোয়াব ভেবে পাশ কাটানো বাঙালি জাতির দেহমনের গতিক বিবেচনায় আকাশকুসুম কল্পনার নামান্তর। অতএব, অন্যান্য পরিচয়ের সঙ্গে তাকেও সযতনে বিবেচনায় রাখা আকলদার ব্যক্তির লক্ষণ। সঙ্গে এই ‘কিন্তু’ সংযুক্ত রাখা আবশ্যক, — পরিচয় মীমাংসায় বঙ্গীয় সমাজের পুরোহিতরা গেল দুই দশকে সুরতাল কেটে যাওয়া যেসব ঘটনা জন্ম দিয়াছেন যেগুলার কথা যেন এইবেলা না ভুলি।

সে-এক সময় ছিল যখন ধর্মের ভূমিকা সংস্কৃতি উদযাপনের সুখকে ছেড়ে অন্য মাত্রায় কথা বলতে সহজে রাজি হয় নাই। হাঙ্গামা বাধার আশঙ্কায় খামোশ থাকা অনেকে উত্তম মনে করছেন। ধর্মীয় পরিচয়ের মাঝে ধরা খাওয়া আত্মঅভিমান ছাপিয়ে সম্প্রীতির সুর বুকে টানার মধ্যে আমি-আপনি সুখ খোঁজার চেষ্টা করছি। হিন্দু বাবাগণ আর মুসলমান ওয়াজি হুজুরদের কল্যাণে সেখানে এখন অতিকায় গর্ত সৃষ্টি হইছে। কলকাতায় দুর্গা মায়ের পূজায় হাজির থাকার অপরাধে সাকিব আল হাসানকে আজহারি হুজুরের ঝাড়ি খাইতে শুনি! হুজুর যখন সাকিবকে হাদিস ঝেড়ে ইসলাম শেখান তখন গা শিউরায় বটে! সাকিবের কাণ্ডজ্ঞানকে বলিহারি মানতে হয়! হুজুরের ঝাড়ি খাওয়ার পর মনে হইল ওর কলিজায় কাঁপুনি উঠছে। সুড়সুড় করে মাফ চাইতে একসেকেন্ড দেরি করে নাই। হুজুরের হু-হুংকারের ওপর রোজহাশরের ময়দানে কারো জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ভরশীল নয়, এই কথাখান সাকিবের দিমাগে পৌঁছানোর শক্তিতে ব্যাপক ভাটা পড়ছে তাতে সন্দেহ না-রাখাটা সুবুদ্ধির পরিচয়।


দীনচর্চার নজির সুফি-দরবেশ-আউলিয়া-মাশায়েখরা উপমহাদেশে চিরকাল রেখে গেছেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ থেকে স্যার সৈয়দ আহমদ অবধি সচল সংস্কারের ধারা বজায় থাকা স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের জনক শিখা গোষ্ঠী এক সময় বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করছেন, যদিও সময়ের সঙ্গে উজ্জ্বল হওয়ার পরিবর্তে সেই বাতি নিভু-নিভু দশায় উপনীত হইছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ফসল পাকিস্তানে প্রথানুগ ইসলামচর্চার ধারায় উপদ্রব বিবেচিত প্রয়াত গোলাম আহমেদ পারভেজ কিংবা ড. ফজলুর রহমানের মতো মনস্বী রেনেসাঁর আলোয় মুসলমানি দীনের স্বরূপ ব্যাখ্যার কোশেশ করলেও কামিয়াব হইতে পারেন নাই। পারভেজ ও ফজলুর রহমানের ইসলামবীক্ষণকে আইয়ুব খান রাজনৈতিক সংস্কারের জায়গা থেকে সেই সময় কদর করার কথা চিন্তা করছিলেন; কিন্তু প্রয়োগ ঘটানোর যজ্ঞে নেমে বিফল হইতে হইছিল।

আইয়ুবের জামানা খতম হওয়ার পরে যাঁরা একে-একে পাকিস্তানের হাল ধরলেন তাঁদের মধ্যে মিলিটোক্রেসি  অর্থাৎ সামরিকতন্ত্রের বাইরে দ্বিতীয় কোনো মেধাতন্ত্র বা মেরিটোক্রেসির নমুনা প্রকাশ পায় নাই। জুলফিকার আলী ভুট্টো কতটা ইসলামের খেদমতগার ছিলেন সে একমাত্র আল্লা জানেন! তবে বিলক্ষণ চালবাজ ও ধুরন্ধর লোক ছিলেন বলে ইতিহাসে লেখে। শেষরক্ষা অবশ্য হয় নাই। ভারতে নেহেরু পরিবারের ন্যায় ভুট্টো পরিবারের জেল্লাও অস্তদশায় উপনীত। কোর্ট ট্রায়ালের চেনা ছকে ভুট্টোর ফাঁসি নিশ্চিত করতে জিয়াউল হককে বিশেষ বেগ পোহাতে হয় নাই। ভুট্টো কন্যা বেনজির, পুত্র মুর্তজা ও শাহনেওয়াজ একে-একে গুপ্তহত্যার শিকারে পরিণত হইছিলেন। সবেধন নীলমণি বেনজির পুত্র বিলাওয়াল ছাড়া কালের ধারায় ভুট্টো পরিবারে বাতি জ্বালানোর লোক খুঁজে পাওয়া ভার! মোল্লা, ভূস্বামী, জেনারেল ও আমলার চতুর্ভুজ সহযোগে গঠিত পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবারের উত্থান-পতনের ইতিহাস থ্রিল-সাসপেন্স-ট্রাজেডি এবং একইসঙ্গে কমেডি অফ এররস’-এর দ্যোতক!

ওদিকে ভুট্টো ডাইন্যাস্টির পয়লা রাজাকে খতম করে গদিতে বসা জিয়াউল হকের মাঝে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছায়া নজরে ভাসে। মসনদ ধরে রাখার শঠযন্ত্র-এ আওরঙ্গজেবের কূটবুদ্ধির ঝিলিক সেখানে বিরল নয়। জিয়াউল হকের জামানায় পাকিস্তান পুনরায় সেই লাইন ফেরত গিয়াছিল যেখান থেকে বের হওয়ার ভাবনা আইয়ুব খানের মগজে ক্ষণিকের তরঙ্গ তুলেছিল। পারভেজ বা ফজলুর রহমানের মতো উপদ্রবকে তিনি মিত্র হয়তো ভাবেন নাই কিন্তু তাঁদের বাত শোনার প্রয়োজনীয়তাকে আমলে নিয়াছিলেন। জিয়াউল হক সেই পথে হাঁটার লোক ছিলেন না। তাঁর মেধাতন্ত্রের ছাঁচ মোল্লাতন্ত্রের ‘জেব’ থেকে বিকশিত ইসলামি সংস্কৃতির চিরাচরিত ব্যবহারের বৃত্ত থেকে বাহির হইতে চেষ্টা করেনি। খাদ্য-লেবাস ও আচার-অভ্যাসে আপাদমস্তক পশ্চিমা আর ওদিকে গদি ধরে রাখার ক্ষণে মোল্লা; — জিন্নাহর আমল থেকে চলে আসা প্রথায় আইয়ুব খান বাদে বাকিরা কমবেশি পুরানা পথে হাঁটছেন! ইন্তেকাল লাভের পর জিয়াউল হকের জামানা কেমন ছিল তার বিশ্লেষণে পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ‘ডন’ ‘…a most toxic, enduring, and tamper-proof legacy’ বাক্যবন্ধ চয়ন করেছিল। পরে যাঁরা গদিতে বসছিলেন তাঁরা সকলে কমবেশি ওই toxic, enduring আর tamper-proof-এর মিলনে গঠিত ত্রিভূজ বসবাস করে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিরূপণে ভূমিকা রাখছেন, যেখানে পারভেজ বা ফজলুর রহমানের মতো লোকের জায়গা সংকীর্ণ হইতে বাধ্য ছিল।

এহেন কারণে ইসলামি দীনের চেতনা বুকে ধরে আত্মপরিচয় সুরাহার মামলায় পাকিস্তান তার শত্রু-মিত্র মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার জন্য ভালো নজির হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হইছে। আফগানরা তাকে মিত্র ভাবায় তালেবানের খপ্পরে মরতে বসেছিল। বাংলাদেশে জিয়া-এরশাদ বা খালেদার জামানাও তথৈবচ ছিল। হিন্দু-মুসলমান-পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মিলমিশ থেকে সৃষ্ট জনপদের Multi Layered বাঙালিয়ানার মধ্যে পাকিস্তান শুরু থেকে বেমানান প্রশ্নবোধক  ছিল এবং আজো অবস্থা পাল্টায় নাই। এই বিবেচনা বাংলাদেশের মসনদকে ঘিরে সক্রিয় রাজনীতির ছকে বারবার লংঘিত হওয়ার দোষে সেই দিনগুলা অস্তগামী যখন মাগরিবের আজান আর উলুধ্বনি একসঙ্গে পাল্লা দিয়া শুরু হইত। ইনসানের কলব হইতে নির্গত ভিন্ন দুই আওয়াজে সেই সুর তরঙ্গিত ছিল লোকে যাকে ‘সহাবস্থান, সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতি’ নামে পুকারে। বাবা আর হুজুর কবলিত উপমহাদেশে শব্দগুলার নতুন ব্যাখ্যা অহরহ কানে আসে, যার সঙ্গে অতীত অভিজ্ঞতায় ধার করা ব্যাখ্যার দূরত্ব সুদূর! ইয়াসুজিরো ওজো, আন্দ্রেই তারকোভস্কি বা এডওয়ার্ড ইয়ংয়ের সিনেমা যেমন স্মৃতিকাতর সব সৌন্দর্য একে-একে খোয়া যাওয়ার বিষাদে ডুব দেয় ও জখম হইতে থাকে, — আমাদের অবস্থা হইছে সেইরকম! খোয়া যাওয়া সৌন্দর্যকে মৈথুন করা ছাড়া আমার-আপনার জীবনে বেশি কিছু পড়ে নাই! বুক তাই ভেঙে আসে; জীবনানন্দের মতো বলতে সাধ জাগে, — ‘ব্যুবনিক প্লেগের মতন / সকল আচ্ছন্ন শান্ত স্নিগ্ধতারে নষ্ট ক’রে ফেলিতেছে মানুষের মন।’

জানি না এ কোন আকাল চারদিকে ঝলকায়! পরিচয় তালাশের মামলায় বাবা আর হুজুর ছাড়া বাদবাকি স্মৃতিগুলা জীবিত নাই। উনাদের নিদান ও হু-হুংকারকে সংস্কৃতিমনা বাঙালি নিজের একমাত্র পাথেয় করে নিয়েছেন! আল্লা/ভগবানের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সংযোগ, জীবনচক্রে মানুষের উদ্দেশ্য ও পরিণতির মহিমা বোঝানোর ঘটনায় হুজুরগো সহায়ক মানতে আপত্তির কারণ নাই, কিন্তু কেম্বে  তাঁরা অন্তিম মাপকাঠি হইতে পারেন? — এই জিজ্ঞাসার সপক্ষে দিমাগ খাটানোর তাড়া থেকে ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর সূত্রপাত ঘটেছিল। অন্যথায় ওদিকে না গেলে ক্ষতিবৃদ্ধির কারণ ছিল না। এক ধর্মের অনুসারী অন্য ধর্মের অনুসারীকে নিজের বিশ্বাস প্রসূত জীবনধারায় কীভাবে এলাউ  করবেন তার শান ব্যাখ্যায় বাবা ও হুজুররা যেসব রেফ্রেন্স দিবারাতি ঝাড়েন সেগুলার সারসত্য নিয়ে ভাবনার চল কি আগের মতো জীবনে ঝলকায়?  বাঙালি জাতির দীনচর্চায় একে অন্যকে এলাউ  করার ঘটনা রিলিজিয়াস  নাকি কালচারাল কনফ্লিক্ট  থেকে ছিটকে বাহির হয় তার সংবেদি বিশ্লেষণ ছাড়া সম্প্রীতির অতীতস্মৃতি রিকভারির পথ খোলা নাই। ক্রিটিক্যাল রিডিংথিংকিং  বাঙালি আমজনতার কাছে মাথাধরানো ঘটনা হইতে পারে, তবে সময় প্রতিকূল হওয়ার কারণে সে-পথে গমন ছাড়া উপায় দেখি না। অন্যথায় বাবা আর হুজুরদের ঝাড়ির উপরে সচল বাঙালি সংকীর্ণ যেসব খোপে ঢুকছেন সেখান থেকে বাহির হওয়া কঠিন। দীন ও ইনসানিয়াতের পায়রাকে আকাশে মনের সুখে উড়তে দেখার মনোবাসনা সেক্ষেত্রে অধরাই থেকে যাবে চিরদিন।

এইসব কার্যকারণে ছেলেবেলার দিনকাল নষ্ট স্মৃতিকাতরতায় মনকে উন্মনা করে যায়। চালিবন্দর-কাষ্টঘর-ছড়ারপার তো বটেই, আশপাশের আরো বহু এলাকা হিন্দু প্রতিবেশীগণে সেই সময় গিজগিজ করতে দেখছি। সংখ্যার বিচারে উনাদের পাল্লা অত্র এলাকায় বেশ ভারী ছিল। পরিসংখ্যানটা তখন ম্যাটার করে নাই। মুসলমানের বাড়িতে উনাদের যাওয়া-আসা মোটের ওপর অবাধ ছিল। মুসলমানরাও স্বচ্ছন্দে হিন্দু বাড়িতে ঢুকছেন। প্রতিবেশী মাসি-কাকি আর আম্মা-খালাম্মারা মিলে সই পাতানো বা বৈকালে পাড়া বেড়ানোকে সেদিনকার ঘটনা মনে হয়! হিন্দুদের পেঁয়াজে শুচিবাই, সবজি বা নিরামিষ পাকের ওস্তাদি, ব্রত-উপবাস, সয়াবিন ও ডালের বড়ি রান্নার পদ্ধতি কিংবা মেথি সহযোগে ডালে সম্বর দেওয়ার ঘটনা, সেইসঙ্গে বিখ্যাত মাছের ঝোল রান্নার কদর মুসলমান জেনানা মহলে রঙ্গরস ও কৌতূহলের যোগান দিয়া যাইত। ওদিকে মুরগির মাংস রান্নার আঞ্জামে মুসলমানের কামিয়াবির খবর নিতে মাসিমা ও বৌদিদের উদগ্রিব থাকতে দেখছি মনে পড়ে। হিন্দু বাড়ির মাছের ঝোল, ডালের বড়ি বা বেগুন ভাজি মুসলমান বাড়িতে পাঠানো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। মুসলমানরাও মুরগির কারি বা পোলাও-কোরমা পাঠাইতেন। একে অন্যের রান্নার স্বাদ পরখের বেলায় কিছু লোকের শুচিবায় ও বাতিক দ্রষ্টব্য ঘটনা হয়ে দাঁড়াইতে পারে নাই। গেল কয়েক দশকে না-হয় হিন্দু বিয়েবাড়িতে মুসলমানি ধাঁচে চাইনিজ সবজি, খাসির রেজালা বা চিকেন বিরিয়ানির চল হইছে, ছেলেবেলায় হিন্দু পদ্ধতিতে পাক করা সবজি, মাছের ঝোল, সুক্তো আর দধি-মিষ্টি সাবাড় করতে মনে বিকার জাগে নাই। পৌষ সংক্রান্তির পিঠাপুলি ও ঘুড়ি উড়ানোর মহোৎসবের কথা এখনো মনে ভাসে।

হিন্দুবাড়ির অন্দরমহলে চলাচলের সেইসব দিন বোধহয় আজকের চেয়ে সহজ আর লঘু ছিল! রমজানে মুসলমানবাড়ি থেকে হিন্দুবাড়িতে ইফতার যাইতে কত দেখছি! ঈদে হিন্দু প্রতিবেশীদের সেমাই-ফিরনি বা কোর্মা-পরোটা দিয়া আপ্যায়ন দুর্লভ ঘটনা ছিল না। দুর্গা ও কালী পূজা, শিবের গাজন আর চরকা, পৌষ সংক্রান্তি বা সরস্বতী পূজার হুল্লোড়ে শামিল হওয়ার ঘটনাকে অপরাধ বলে দাগানোর চেষ্টা সেকালে কিছু লোকের মাঝে হয়তো প্রকট ছিল, কিন্তু তাদেরকে পাত্তা দেওয়ার ঠেকা বাকিদের কাছে গুরুত্ব পায় নাই। দেবী দুর্গাকে জলে ভাসিয়ে বিদায়ের ক্ষণে হিন্দুর চেয়ে মুসলমান দর্শকের আধিক্য কম ছিল না। দীনভক্ত লোকজনের মধ্য হইতে দু-চার জন কটুবাক্য ও উপদেশ খয়রাতে তখন উতলা বোধ করতেন। তাদের কথায় নেচে ওঠার বিগার ওঠে নাই। সোজা কথায়, নিষেধের মাঝে নিষেধ ভাঙার সহজ চল ছিল তখন।

মুসলমানবাড়ির বিয়েতে পানদান সাজানোর ঘটনায় হিন্দুবাড়ির মাসিবৌদিরা শরিক থাকতেন। সকলে মিলে বিয়ের গীত গাওয়ার রেওয়াজ আজো কানে ঘাই দিয়া যায়। সিলেট বেতারে সপ্তাহে একদিন বিয়ার গীত বাজানো হইত। আম্মা ও মাসিমারা মিলে সেগুলাই গাইতেন। ইয়ারুন্নেসার কণ্ঠে ‘আইলারে নয়া দামান’ তখন ফেনোমেনাল ছিল মনে পড়ে। আর হিন্দু বিয়াতে ধামাইল অনেক দেখছি। লগ্ন ও সাতপাকের মুহূর্ত ঘিরে যে-উত্তেজনা তৈরি হইত সেইটা খালি হিন্দু পরিবারের একচেটে বিষয় ছিল না, প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের বালক থেকে গুরুজন অশেষ কৌতূহল নিয়ে ঘটনা নিরিখ করতেন।

দুই পক্ষের সহজ ইয়ারানার মাঝে ধর্মীয় সমস্যার উপদ্রব সেকালেও মাথাচাড়া দিয়া উঠত। দেশ বা বৈদেশে সংঘটিত ঘটনার জের ধরে হাওয়া বেসুরো হইত মাঝেমধ্যে। মানসিক বিরোধ আগল ভেঙে বেরিয়ে আসতে ছটফট করত তখন। আবার কী করে যেন সব জোড়া লেগে যেত! মিলমিশ জারি থাকতে দেখে স্বস্তি পাইত মন। গলির মোড়ে, চায়ের দোকান বা রাতের বৈঠকখানায় আব্বা ও মেসো-কাকারা মিলে তাস পেটানোর অভ্যাসে ছেদ পড়তে দেখছি বলে ইয়াদ হয় না। ধর্মীয় আত্মঅভিমান নিয়া দুই পক্ষে স্থূল-সূক্ষ্ম হরকিসিম সংস্কার, মতবিরোধ ও দূরত্ব থাকলেও মিলমিশ আর বিনিময়ের প্রথায় সকলে কমবেশি বহাল থাকার চেষ্টা করছেন। শঙ্কার মেঘ জন্ম নিয়েছে এবং ভ্যানিশ হইতেও সময় লাগে নাই। একাত্তরের স্মৃতি টাটকা থাকায় অগ্রজদের প্রজন্মে সংবেদনের আধিক্য ছিল মানতে হয়। ধর্মীয় পরিচয়ে দাগানো চিহ্নের প্রভাবে তাদের মিলমিশের জগতে যেসব অচলায়তন তৈরি হইত সেগুলা ওই সংবেদনের তোড়ে কিছুদিন বাদ্ কর্পূরের মতো উবে যেতে দেখছি। সহজিয়া সেইসব দিন এখন অবিশ্বাস্য আর পরাবাস্তব লাগে নিজেরই কাছে!

আদি সিলেট যেমন ধরেন আম্বরখানা, চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার হয়ে বন্দর ও চারপাশ ঘিরে যে-এলাকা সেখানে একাত্তরের ঝাপটা ভীষণ তীব্র ছিল। আম্মার মুখে শুনছি চাকরির সুবাদে আব্বার পক্ষে যুদ্ধের নয় মাস লম্বা সময় গ্রামে থাকা সম্ভব হয় নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব ও আওয়ামি লীগে আস্থা হারাইলেও মুক্তিযুদ্ধের দিনকালে আব্বার মুজিবভক্তিতে ভাটা পড়ার কারণ ছিল না। এলাকায় আর পাঁচ-দশটা পরিবারের মতো আমাদের পরিবার যুদ্ধের তীব্রতা বুঝে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের ভাড়া বাড়িতে অনিশ্চয় আসা-যাওয়ার মাঝে দিন পার করছে। ভাড়া বাড়িতে রেখে যাওয়া মালামাল তখন লুট হইছিল। কুশিঘাটকে হাব বানিয়ে সুরমার দুই পার ঘিরে সচল মুক্তিসেনাদের দেশ স্বাধীনের যজ্ঞে পাড়ার অনেকে গোপনে শামিল হইতে শুরু করছিলেন। সড়কে মিলিশিয়ার টহল ভীতির জন্ম দিলেও একসময় গা-সহা ঘটনায় পরিণত হইতে থাকে। পাড়াতুতো বিহারি জনগোষ্ঠীর কাজকারবার মোটের ওপর পাকবান্ধব ছিল বলতে হবে। ইস্টার্ন রেল, মোটর মেরামত ও কারবারি কাজে সুখ্যাতি বিহারিদের পূর্ব পাকিস্তানে টেনে আনছিল। চাপাটি-পরোটা-বিরিয়ানি আর গরুর মাংস পাকে তাদের ওস্তাদির কদর ছিল শহরে। যদিও তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের সখ্য অতীত দিনের ন্যায় উষ্ণ ছিল না। সন্দেহ দানা বাঁধছিল তখন। আমাদের বাড়ির সামান লুট হওয়ার ঘটনায় বিহারি পরিবারের ভূমিকা ছিল বলে আম্মার কাছে শুনছি। ওদিকে পাকিস্তানের পতাকা জিপে সেঁটে তল্লাট জুড়ে ফুলতলি হুজুরের নারকীয় কাজকারবার ও পাকসেনা ক্যাম্পে ঘনঘন যাতায়াত তুচ্ছ বিষয় ছিল না। ফুলতলি মুক্তিসেনাদের টার্গেটে ছিল। সত্যিমিথ্যা জানি না, তবে বড়ো ভাইদের কাছে শোনা, দেশ স্বাধীন হওয়ার অনতি মুহূর্তে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকে ধরে সে নাকি ভারতে পালাইছিল।

এইসব ঘটনার সঙ্গে তাল দিয়ে মেট্রিকুলেশন শেষ করা বড়আপার বিয়ের এন্তেজামটা চলছিল। সোমত্ত মেয়েকে আব্বা ঘরে রাখার সাহস হারায়া ফেলছিলেন। আপার কলেজ-ভার্সিটি অবধি পড়ালেখার স্বপ্নে ইতি ঘটেছিল। বিয়ে আর লন্ডন গমনের ঘটনা পাকসেনাদের নাকের ডগায় ঘটানো ছাড়া আব্বার হাতে অপশন ছিল না। মুজিবভক্ত ও মনের গহিনে মুক্তিবান্ধব আব্বার জীবনে ক্রাইসিসটা তীব্র ছিল, — মেয়ের বিয়া দিতে হইলে পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়া তাকে অনুমতি নিয়া আসতে হবে। কিছুদিন পরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর পাকি পরিকল্পনার সুযোগ আব্বা নিতে বাধ্য ছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কোরানপাঠ তার জীবনে সহজাত ছিল। পাক সেনাক্যাম্পের মেজর সায়েব আর টহলদার সেনারা সেইটা জানত। আব্বাকে হয়তো নির্বিষ ভেবে বিয়ের এন্তেজামে বাধা দেয় নাই। ছোটখাটো ঘরোয়া আয়োজনে সম্পন্ন বিবাহ আসরে ভোজনরসিক পাঞ্জাবি সেনারা লুটের শাড়ি নিয়া দাওয়াত খাইতে হাজির ছিল! আপার লন্ডনযাত্রার মাঝে বিমান থেকে যখন-তখন শেলিং বা বোমাবর্ষণ, ঘনঘন ব্ল্যাকআউট, আর কানে ট্রানজিস্টর চেপে স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘চরমপত্র’ ও বিবিসি শ্রবণের শিহরণ আব্বার জীবনে যথারীতি বহমান থাকছে।

এইগুলা ছিল জনযুদ্ধের দিনক্ষণে আব্বার মতো অগণিত অতি সাধারণ মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই। উনারা মুক্তিযুদ্ধটা করেন নাই কিন্তু মনেপ্রাণে স্বাধীন দেশে সংসার পেতে থিতু হওয়ার স্বপ্ন ধরতে মরিয়া ছিলেন। সুবিধাবাদ কি না জানি না তবে এ-কথা সত্য তাদের মনের গহিন কোণে মুজিবর স্বাপ্নিক আশার প্রতীকে পরিণত হইছিলেন। মূসা পয়গম্বরের মতো গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করার স্বপ্নবীজ জাতির হৃদয়ে তিনি বুনে দিতে পারছিলেন। মাটি কামড়ে টিকে থাকার এইসব খণ্ড কাহানির মধ্যে বেদনার ছিল একে-একে সেইসব হিন্দু পরিবারকে নিকাশ ও সীমান্তে নিরুদ্দেশ হইতে দেখা যাদের সঙ্গে জড়াজড়ি করে আব্বারা দিন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ইতোমধ্যে মৃত অথবা সীমান্ত পাড়ি দিয়া শিলং-কাছাড়-করিমগঞ্জ আর কলকাতায় নিরুদ্দেশ সেইসব পরিবারের কাহানি বর্ণনার ক্ষণে আব্বাকে স্মৃতিকাতর হইতে দেখছি। যুগপ্রভাবে আব্বাদের প্রজন্ম বা পাড়াতুতো অগ্রজদের মানসিকতায় পরে অনেক পরিবর্তন অবশ্য ঘটেছিল। একাত্তর পরবর্তী নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের ধাক্কায় মেজর জিয়া ও বিএনপির উত্থান সেই পরিবর্তনে অবদান রেখেছিল সন্দেহ নাই।

উক্ত প্রভাব দোষে পরিচয় অনুসন্ধানের মামলায় আব্বাদের প্রজন্মের প্রচুর মুরব্বিকে ধর্মীয় আত্মঅভিমানে পরে ফুলতে দেখছি। ঘটনা পীড়াদায়ক হইলেও অলক্ষ্যে কমনীয়তার চোরাস্রোত কিন্তু নিঃশেষ হয় নাই। আত্মঅভিমানে ফুলে ওঠার মুহূর্তে নিহত বা নিরুদ্দেশ হিন্দু প্রতিবেশীদের নিয়ে উনারা মায়াবি স্মৃতিকাতরতায় ভুগতেন। পুরানা দিনের মিলমিশের গল্প ফাঁদার ক্ষণে আব্বার মুখে বিষাদ জমা থাকতে দেখছি! যেন মনে হইত মুসলমানের ভিড়ে তিনি সেইসব পুরানা মুখের তালাশ করেন যাদের ছাড়া তাশ পেটানো, এয়ারগান কান্ধে ঝুলিয়ে পাখি শিকার, রাধারমণ দত্তের গানের সুরে হিন্দু রমণীগো ধামাইল দিতে দেখার অভিজ্ঞতা আর তাশের আড্ডায় রাজা-উজির মারার সুখ কোনোদিন ফেরত আসবে না। মানুষ খালি ধর্মে বাঁচে না, সে বাঁচে সঙ্গে; — হিন্দুর গীতা কিংবা মুসলমানের কোরানে এই ইনসানিয়াতের সন্ধান মোটেও দুর্লভ বস্তু নয়, তবে আব্বার ক্ষেত্রে অতদূর যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে নাই, নিজের জীবন থেকে ইনসানিয়াতের সেই রস তিনি শুষে নিতে পেরেছিলেন মনে হয়।

আব্বার মতো প্রবীণ আর একাত্তরে বালেগ হওয়া তরুণ প্রজন্মের মনোসংকটের কারণ জটিল হইলেও দুর্বোধ্য কিছু না। উপমহাদেশ জুড়ে সংঘটিত ঐতিহাসিক বিভাজনের প্রভাব সেখানে আছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের অমোচনীয় ছাপ বুকের অলিন্দে ধারণ করতে তারা মজবুর ছিলেন। ধর্মীয় পরিচয়কে সদম্ভে জাহিরের ক্ষেত্রে পুরাতন ছাপগুলা সম্ভবত বদহজমের আকারে তাদের দেহ থেকে বাহির হইত, যেখানে সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে প্রতিপক্ষে পরিণত সম্প্রদায়ের প্রতি অভিযোগ আর আত্মঅভিমানের অন্ত ছিল না। সঙ্গে এই সত্য কবুল করা প্রয়োজন, ধর্মীয় পরিচয়ে স্বীকৃত মানদণ্ডকে সামাজিক বিনিময়ের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগের মানসিকতা তীব্র হইলেও ‘সাম্প্রদায়িক ঘৃণা’ নামের চিজ তাদের দিলে স্থায়ী আসন নিতে পারে নাই। কত গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত তারা একসাথে পার করছেন! একসঙ্গে উঠবস আর একে অন্যের ঘরে যাতায়াতের সুবাদে সেই সুরে তারা অভ্যস্ত ছিলেন যেটি ‘মানুষ’ শব্দের আড়ালে যত বিশেষণ ঘুম যায় সেগুলাকে ছুড়ে ফেলার বদলে যত্নে বুকে ধরে রাখে। চায়ের স্টল থেকে বৈঠকখানা হয়ে হেঁসেল অবধি উভয় পক্ষের মিলমিশের চিহ্ন তাদের আত্মপরিচয়ের অংশে পরিণত হইছিল, যার ছায়া ও আলিঙ্গনে বালেগ হওয়ার ভাগ্য নব্বই দশকের আগে অবধি বাড়তে থাকা প্রজন্মের জীবনে কমবেশি ঘটছে। নব্বই ও পরবর্তী দশকে বালেগ হওয়া তরুণদের সেদিক দিয়ে অভাগা মানতে হয়। মিলমিশের সংস্কৃতি উদযাপনের সুযোগ তারা সেভাবে উপভোগের সুযোগ পায় নাই, যেইটা শতেক মনবিরোধ ও দূরত্ব সত্ত্বেও নব্বই পূর্ববর্তী প্রজন্মের জীবনধারায় বিদ্যমান ছিল।

ধর্মীয় পরিচয়ের বৃত্তে কয়েদ আব্বা ও নিকট-অগ্রজদের প্রজন্ম দেশকালের হাজার দুর্বিপাকে জবুথবু হওয়ার কারণে বিচিত্র আত্মঅভিমান বুকে পুষলেও হেটার্স  হওয়ার ঘোর থেকে তাদেরকে পিছলে বেরিয়ে আসতে দেখছি। হেটার্স রূপে নিজেকে জাহিরের চাপ আব্বাদের প্রজন্মের সিংহভাগ লোকজন নিতে পারে নাই, কারণ নিতে তাদের বুকে লেগেছে। এই অভিজ্ঞতায় বালেগ হওয়ার দোষে একটি পরিচয়কে কুর্নিশ ঠুকতে যেয়ে অন্যটিকে ডিনাই করতে আজো বুকে লাগে! অথচ এখন ডিনাই  করার ফুটানিকে ফ্যাশনে পরিণত করা হইছে! এছাড়া নাকি ইসলামের পরীক্ষায় মুমিন মুসলমানের পাশ যাওয়া কঠিন! গেল তিন দশকের বাংলাদেশে কট্টরপন্থী বাবা ও হুজুরদের উত্থানের সঙ্গে তাল দিয়ে নষ্টভ্রষ্ট নেতা আর মতলবি পাতি বুদ্ধিজীবীর পাল্লায় পড়া বাঙালি সম্ভবত অতীত দিনের ন্যায় পরস্পরের সঙ্গে মিলামিশায় সহজাত ও আন্তরিক নয়।


বাংলাদেশের জনগণের সৌভাগ্য তার আত্মপরিচয়ে বৈচিত্র্য ব্যাপক। তার দুর্ভাগ্য, বৈচিত্র্যে লুকানো স্বাতন্ত্র্যকে সুরক্ষা দেওয়ার কাজে সে বিফলকাম। ‘বাঙালি জাতি’ — উক্ত পরিচয়ের সঙ্গে অবশিষ্ট পরিচয়ের সমন্বয় ঘটানোর যজ্ঞে রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা ছিল ‘কারণ’, এর জের ধরে আব্বাদের প্রজন্ম ও নিকট অগ্রজদের অনেককে পরে ধর্মীয় আত্মঅভিমানে ফুলতে দেখছি। এর পেছনে আওয়ামী লীগের দায় সর্বাধিক মানতে হবে। কেন সে-কথাগুলা শাহবাগ আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী দিনে ‘বাঙালির অনুভূতি সিনড্রোম’ নিয়া বিরচিত খসড়া রচনায় খানিক বলার চেষ্টা করেছিলাম। সেখান থেকে আধভাঙা কিছু পরিচ্ছেদ (*ভাষিক বয়ানে পরিমার্জিত।) এখানে কোট্ করাটা বোধহয় গোনাহ হবে না :—

ইতিহাসে লেখে বাংলাদেশী পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার লক্ষ্যে রাজনীতির ময়দানে বিএনপির উদয় হইছিল। বাঙালি পরিচয় যে-চেতনা জাহির করে তাকে ড্যামেজ করার এজেন্ডা নিয়া বিএনপি সেই সময় ময়দানে হাজির হয়। মুসলমান কওমের অনুভূতি সুরক্ষার দাবিকে সমন্বয়ের চেষ্টা হইতে বাঙালি জাতির সংজ্ঞা নির্ধারণ বিষয়ক বিরোধের উৎপত্তি ঘটেছিল, মেজর জিয়াউর রহমান যার অন্যতম রাজনৈতিক নকশাকার ছিলেন। আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করার উপায় খুঁজতে নেমে বাহাত্তরের সংবিধানকে তিনি লেবেলিং করছিলেন। … কাজটি মেজর জিয়া পলিটিক্যাল কারণে করলেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভারত ইস্যু জিন্দা রাখার অভিসন্ধি থেকে করলেন। ভারতের ভূগোল বা জিওগ্রাফিতে সচল বাঙালি জাতিসত্তা থেকে বাংলাদেশী জাতিসত্তাকে পৃথক প্রমাণের ভাবনা থেকেও করলেন। উনার ধারণা হইছিল বাঙালি পরিচয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের ইমানি চেতনা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে না। এর ভিতরে যে-সংস্কৃতি উপচায় সেইটা সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মীয় বিশ্বাস আর অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অনুভূতি ক্ষুণ্ণকারী চেতনা জাতির পরিচয় হইতে পারে না। যদিও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম নিজেকে বাঙালি ভাবার চেতনা থেকে সেই সময় গতি লাভ করছিল! মেজর জিয়া নিজে সেখানে শামিল ছিলেন। বাঙালি পরিচয়ের সুরক্ষায় অস্ত্র হাতে নিতে দ্বিধা করেন নাই। কিন্তু ক্ষমতার পলিটিক্স মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে সাফারি ও সানগ্লাস পরিহিত জিয়াউর রহমানের দিকে নিয়া গেল। বাঙালি পরিচয়ের গর্ভে লুকানো চেতনা ও অনুভূতিকে তিনি এইবার ইগনোর করলেন। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভক্তি জন্ম নিলো। বিয়াল্লিশ বছরেও যার নিরসন ঘটে নাই! …

মুজিব নিহত হওয়া পর জাতীয় জীবনে শূন্যতা সৃষ্টি হইছিল। ইতিহাস জিয়াকে দিয়া সেইটা ভরাট করছে। কর্নেল তাহেরকে দিয়া শূন্যতা ভরাট হইতে পারত। খালেদ মোশাররফ বা অন্য কেউ সেখানে নায়ক হিসেবে দেখা দেওয়া বিচিত্র ছিল না। কিন্তু ইতিহাস জিয়াকেই পছন্দ করছিল।… অকম্পিত কাঠিন্য দিয়া বিএনপিকে তিনি সম্ভব করলেন। পাবলিকের মনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠায় বিএনপি সফল ছিল দীর্ঘদিন,—সাত নভেম্বরের সেনা বিদ্রোহ খালি সৈন্যদের বিষয় না। এই বিদ্রোহে জনতার সায় ছিল। সিপাহী-জনতার মিলিত চেষ্টায় দেশ ভারতের মুঠোবন্দি হওয়ার ঝুঁকি থেকে সেদিন রক্ষা পায় ইত্যাদি। সুতরাং সিপাহী-জনতার বিদ্রোহকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা প্রয়োজন। মেজর জিয়াকে যেখানে ত্রাতা ও অগ্রনায়ক হিসেবে সকলের বন্দনা করা উচিত! …

ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলমানের মনবিরোধ বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভারতকে এমনিতেও সবসময় জারি থাকতে বাধ্য রাখে। আত্মপরিচয়ের থিয়োরি খাড়া করার ক্ষণে মেজর জিয়া সুযোগটা নিয়াছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের চেতনায় ভারত নিয়া হাজার বছরের বিরোধ ও বিচ্ছেদকে ব্যবহারের সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা পিছুটান তাঁকে উতলা করে নাই। একটা একাত্তর সেই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ট ছিল না। একাত্তরে স্বাধিকারের চেতনা এত ব্যাপক ছিল খুঁটিনাটি বিবাদ বড়ো হওয়ার চান্স পায় নাই। ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি। বাঙালি — এই আওয়াজের তরঙ্গে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-পাহাড়ি একাকার হইছিল। জাতীয় জীবনে এমন হইতেই পারে। বৃহৎ চেতনার তরঙ্গে ক্ষুদ্র চেতনার ঢেউ দিশা হারায়। কিন্তু বৃহৎকে একসময় স্থির হইতে হয়। ছোট তরঙ্গগুলা তখন আবার মাথা চাড়া দিয়া ওঠে। বাহাত্তরের সংবিধান রচনার দিনে মুজিব সরকার মুক্তিযুদ্ধের টাটকা স্মৃতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার কারণে মাল্টিক্লাস সোসাইটির এইসব তরঙ্গ বিবেচনায় নিতে বাধ্য ছিলেন। লীগের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জটিলতা আর বৈশ্বিক বৈরিতার চাপে পাবলিকের কাছে সেইটা তারা তুলে ধরতে বিফল হয়। শেখ মুজিবকে জীবন দিয়ে যার মূল্য দিতে হইছিল। …

নিজেকে ক্লিয়ার করার ব্যর্থতা আজো লীগের জন্য সমস্যা রূপে বিরাজিত। বাংলাদেশের ক্ষমতাছকে টিকে থাকার স্বার্থে ধর্মীয় চেতনা ও অনুভূতির সঙ্গে তাকে বারবার আপস করতে হইছে। ইসলামি আত্মপরিচয় খোঁজার বাহানায় আরব জাতীয়তাবাদ কায়েমে স্বপ্নবিভোর এজেন্টদের সঙ্গেও লটরপটর করতে হইছিল কিছুদিন। এতকিছুর পরেও একাত্তর তার পিছু ছাড়ে নাই। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ক্ষতিকর ভূমিকা পালনের অপরাধে একাত্তর জামাতকে আজো তাড়া করে ফিরে। স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দানের কারণে লীগেকেও সে সমানে ভোগায়। যারপরনাই লীগের মধ্যে দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটেনি। টিকে থাকার প্রশ্নে জিয়া, এরশাদ ও খালেদার জামানায় সৃষ্ট বাস্তবতাকে ইগনোর করার মতো শক্ত জনভিত্তি সে নিজের দোষে হারায়া ফেলছে। অন্যদিকে একাত্তরে ফেরত যাওয়ার দায় তাকে পিছু ছাড়ে না। বিএনপির জন্য যে-কাজ পানির মতো সহজ, লীগের জন্য সেইটা এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহনের চেয়েও কঠিন। এদিক থেকে জিয়াউর রহমানকে বাহবা দিতে হয়। লীগকে তিনি আত্মদ্বন্দ্বে নিমজ্জিত করতে পারছিলেন। বাংলাদেশের আমজনতাকে বাহাসমুক্ত পরিচয় উপহার দেওয়ার কাজে আওয়ামী লীগ এ-কারণে কামিয়াব হইতে পারে নাই। উল্টো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আজো তাকে দিশেহারা বেকুব দেখায়। ঘটনাখান লীগের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যায় বৈকি! …

ইতিহাস কাউকে নায়কের মহিমা দিতে চাইলে তাকে ঠেকানো মুশকিল হয়। জাতিকে সে বাকশালের পরিবর্তে বিএনপি উপহার দিয়াছিল।… আবারো বলি, মেজর জিয়া নিজের স্পেস বজায় রাখার স্বার্থে জামাত ও ইসলামপন্থী দুষ্টচক্রকে স্পেস দিয়া গেছেন। এই এজেন্টগণ আত্মপরিচয়ের ইস্যুকে জটিল করার কাজে উনার হয়ে নিরন্তর প্রক্সি দেওয়ার কামলা খাটছিল। ফাঁকতালে আখের গুছাইতে ভুল করে নাই। ইসলামকে দাবার গুটি রূপে ব্যবহার করে বাঙালির পরিচয় মেরামতের ব্রান্ডিং তারাই দেশে অধিক হারে ঘটাইছে। বাঙালি পরিচয়ের বয়ান রাখার সময় আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ ইসলামি বিশ্বাস ও আকিদা উপস্থাপনের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রয়োজনে সৃষ্ট বিশ্বাসকে জাতীয় জীবনে তারা ক্রমশ প্রাসঙ্গিক ও অকাট্য করে তুলেছিল এবং এখনো সেই কাজ হইতে পিছু হটে নাই। পরিচয় নির্ধারণের প্রশ্নে জটিল তর্ক খাড়া করতে তাদের কামিয়াবি জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করার ক্ষেত্রে যে-ভূমিকা পালন করে সেইটার ঐতিহাসিক তাৎপর্য অসীম। বাংলাদেশী জনমনের বৃহৎ অংশের জীবনে অগত্যা এই ধারণা এখন মোটের ওপর প্রতিষ্ঠিত,—সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বহাল রেখে লীগ প্রমাণ করছে নামে মুসলমান হইলেও কামের বেলায় সে হিন্দুর গলিভাই। রক্তমাংসে ভারতপন্থী বর্ণচোরা বটে। সুতরাং তার পক্ষে বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর সঠিক প্রতিনিধিত্ব করা ইহকালে সম্ভব না।

অগ্রজ প্রজন্মের আত্মঅভিমানে স্ফিত হওয়ার পেছনে এইসব মতিচ্ছন্ন কাণ্ডকীর্তির দায় কম নয়। একাত্তর বা প্রাকপর্বে বাঙালি ও মুসলমান পরিচয়ে বড়ো কোনো স্ববিরোধের ভাবনা উনাদের মনে জাগে নাই। স্ববিরোধ প্রমাণের চেষ্টায় পাকিস্তানি শাসক ও চরদের বিচিত্র কিসিমের কাজকারবার ইগনোর করে যৌথসঙ্গে তাদের দিন কাটছে। বাংলা হরফকে আরবি ও উর্দু আদল দানের প্রস্তাবনা, লাগাতার রবীন্দ্র বিদ্বেষ ও বিরোধিতা, সহজাত বাঙালি প্রথাচারকে হিন্দুয়ানী দাগানোর কসরত…এইসব উৎপাত সঙ্গে নিয়া ‘সঙ্গে বাঁচার’ অভ্যাস তারা ছাড়েন নাই। গলির মোড়ে আর বৈঠকখানায় তাস পেটানোর মুহূর্ত সেই সম্প্রীতির জন্ম দিয়া গেছে যার রেশ ধর্মীয় পরিচয়ে দাগানো মানুষকে সদয়-সহিষ্ণু হওয়ার মন্ত্রে সুস্থির রাখে। অধমের বিবেচনায় এইটা ছিল তাদের ব্রহ্মাস্থ। উনারা একই অঙ্গে দীনদার ও দিলদার হওয়ার এলেম রপ্ত করেছিলেন!

হালফিল বাংলাদেশের তুলনায় সেই সময়ের বাংলাদেশটা হয়তো অধিক প্রগ্রেসিভ ছিল। ভাবী-বৌদিদের স্লিভলেস ব্লাউজ পরে যত্রতত্র ঘুরতে দেখলেও সেইটা নিয়া ‘ছিঃ ছিঃ’ রব তখন কানে উৎকট হয়ে বাজে নাই। অথচ এখন! — জয়া আহসানের পোশাকের রুচি খারাপ; শবনম ফারিয়া বেগানা-বেশরম; আশনা হাবিব ভাবনা স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ক্যান ছবি দিছে ইত্যাদি নিয়া লোকে কটুক্তির বন্যায় ফেসবুক ভাসায়! রুচিবাগিশ দীনদারদের সময় নাই অঙ্গ ও যৌনাঙ্গ সম্পর্কে কোরানের বিধান পাতা খুলে দেখার। অঙ্গ হেফাজতের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লা কী বিধান ও উপদেশ স্বয়ং তাঁর রসুলের নিকট সেই সময় প্রেরণ করছিলেন সেগুলা চেকরি-চেক  করার দায়িত্ব হুজুরদের জিম্মা তুলে দিয়া রুচিবাগিশ মুসলমান হওয়ার চেষ্টায় সকলে লিপ্ত বটে! সুতরাং আজকের সবজান্তা টেকেনো মানুদের দেহমনের কলকব্জা কোন দীনের তাঁবে চলে সেইটা ভেবে মন বিমূঢ় হয়!

বিরানব্বইয়ে বাবরি মসজিদ ঘিরে যে-উত্তেজনা দেশে তৈরি হয় সেই ঘটনাটা এইবেলা মনে দোলা দিয়া যায়। আত্মপরিচয়রে বহুমুখী উৎসের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের সহবত ঘটাতে না পারলে মানুষ বিপন্ন ও অসহায় বোধ করে। তার জীবনের সুরতাল কেটে যায়। বয়স তখন কত হবে? একুশ-বাইশ এরকম। শাহী ঈদগাহ এলাকায় আমাদের পরিবার ততদিনে স্থায়ী হয়ে উঠছে। এলাকায় হিন্দু জনগোষ্ঠী এখন হাতে-গোনা, তখনো তা-ই ছিল। বাবরি মসজিদ শিবসেনারা তখন অবধি ভাঙে নাই, ভাঙার তোড়জোর চলছিল। এর মাঝে মাওলানা মান্নানের ‘ইনকিলাব’ মসজিদ ভাঙার খবর ছেপে দিল! পত্রিকাটি ততদিনে জনপ্রিয়তায় ইত্তেফাককে পেছনে ফেলে দিয়েছে। মসজিদ ভাঙার খবরে পরিস্থিতি গুরুতর রূপ ধারণের শঙ্কা তৈরি হইছিল। আজো মনে পড়ে, পাড়ার দোস্তরা মিলে এলাকার পরিচিত কাকার ফার্মেসির পাশ দিয়া যাওয়ার সময় তার চোখে ভয় আর মৃত্যুর আতঙ্ক জমা হইতে দেখছিলাম। আদাবের উত্তরে সন্দেহ, কাতরতা ও অবিশ্বাসকে পড়তে বেশিখন লাগে নাই। মনে হইছিল আমাদের কাউকে তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। ভারতের কোনো মুসলমান হয়তো অবিকল সেই মুহূর্তে পরিচিত হিন্দু যুবকের দিকে এভাবে তাকায়া ছিল! একাত্তর ফেরত আসতে যাচ্ছিল বাংলায়। বাংলার মাটিকে পূতপবিত্র রাখতে হিন্দু নিধনের মিশন নিয়ে টিক্কা খানরা সেদিন পাকসেনাদের এখানে নামতে বলেছিল।

পরিচিত কাকার ঘটনাটি সামান্য বা তাৎক্ষণিক হয়তো, কিন্তু কুড়ি পার করা যুবার জন্য মর্মান্তিক ছিল। বয়সকালে পা রাখার পর এই উপলব্ধি তাই সঙ্গে রাখা জরুরি মানি :—

আত্মপরিচয়ের মামলায় খারিজ/বাতিল কামে দেয় না। সেই সংস্কৃতির চাষাবাদ বরং উত্তম যেটি মানুর প্রতি অঙ্গে লেপ্টে থাকা পরিচয়গুলাকে পড়তে জানে; তাদের সহাবস্থান ক্যামনে ঘটানো যায় সেই সংবেদি ভাবনায় গমনের হ্যাডম রাখে; আর এই অনুভবকে মানুষের অন্তরে পৌঁছানোর জন্য নিরলস খেটে মরে

জনান্তিকে বলি, উক্ত ঘটনা আপনি জাহেদ আহমদকে অন্তরে লালন করতে ও ‘গানপার’-এ সযত্নে জায়গা দিতে দেখেছি। ‘গানপার’-এর পাঠকরা কতটা খেয়াল করেন সে অবশ্য মোর জানা নাই। বাহুবলের আস্ফালনের যুগে মানুষ কোন খেয়ালে চলে আর কী মিস  করে যায় … এইসব এখন আর আকলে ধরে না। ইনসানিয়াতের সারসত্যে স্রষ্টা সদা বিরাজেন। কোরান জানায় উদ্দেশ্যহীন খেয়ালের বশে স্রষ্টা এই জগৎ-সংসার সৃজন করেন নাই। সৃষ্টির মধ্য দিয়া তাঁকে উপলব্ধির সুযোগ তিনি মানুষকে দান করছেন। তামাম জাহান তাই নিছক দুর্ঘটনার ফসল নয়, বরং স্রষ্টার পক্ষ হইতে প্রদত্ত উপহার বা নিয়ামত। যে-লোক বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করে সে হইছে মুমিন মুসলমান। যে বুঝে না ও বুঝতে চায় না অথবা উল্টা বোঝার দোষে স্রষ্টা প্রণীত সৃষ্টির সহজ বিধানের বিপরীতে অনাচারে মত্ত থাকে সে-লোক হইছে ‘কাফির’। কোরানের স্রষ্টা সাত আসমান ছাড়ায় আরশে বিরাজ করলেও সমগ্র সৃষ্টির উদ্দেশ্য, সংযোগ, গতি আর পরিণামকে সম্যক অবধান করতে না পারলে তাঁকে উপলব্ধি করা সম্ভব নহে। স্রষ্টার তালাশে মানুদের কারবার দেখে মনে-মনে তাই গুনগুনাই, ‘আমি কোন পথে যে চলি/কোন কথা যে বলি/তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই/মনের চোরাগলি।’ কিশোর কুমারের দরাজ কণ্ঠের সঙ্গে উত্তম কুমারের সাবলীল অভিনয় ও অঙ্গ সঞ্চালনায় গীত চপল রসের রোমান্টিক গানের কলি অন্য অর্থ নিয়ে জীবনে ধরা দিতে পারে, ইমানে কই, কথাটি কখনো ভাবি নাই!


এক-একটা অনুভূতির মাঝে লুকানো এইসব ক্ষত-জখম আর সেখানে মলম লাগানোর কাহিনি বুকে ধরতে মানুষকে কত পথ পাড়ি দিতে হয় সে-কথা একবার খালি ভাবেন! নিজের কথাই বলি, সেদিন অবধি ধর্মীয় পরিচয় ঘিরে তৈরি দ্বন্দ্ব সুরাহার ভাবনা একরৈখিক ছিল। সাংস্কৃতিক উদযাপনের বাইরে এর প্রাসঙ্গিকতাকে ছেটে ফেলার আওয়াজ যারা দিতেন তাদের যুক্তিকে প্রশ্রয় দিতে মন উন্মুখ ছিল। যুবাকালের বিচ্ছিন্ন লেখাপত্রে সেই রেশ ছড়ানো-ছিটানো আছে বোধহয়। গেল দশ বছরে চুলে পাক ধরেছে, দন্ত নড়বড়ে, গতরে জোয়ানকির তাকত কমি হওয়ার পথে, তাই হয়তো খানিক বুঝি, — এইভাবে ছেটে ফেলা যায় না, ছাটাই সম্ভব না! মানুষের জীবনে যত চিহ্ন নিজের পরিচয় রেখে যায় তার একটাও দিনের শেষে ফেলনা বা বাতিলের বিষয় হইতে পারে না। প্রত্যেকের নিজস্বতা রয়েছে, যাকে দিল দিয়া অনুভবের নাম হইছে জ্ঞান ও মনুষ্যত্ব। সক্রেটিস, শাক্যমুনি হইতে দেরিদা তক্ … সকলে দেখি সেখানে এক বুলি ঝাড়ে, — ‘রে নাদান! যত গভীরে ডুব দিবি নিজেকে মূর্খ মনে হবে আর সেইটা হইছে দিব্যজ্ঞান। এছাড়া মোহনার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়।’

ইসলামবীক্ষণকে ওইসব পরিচয়ের একটি বলা যাইতে পারে। বাদবাকি যত পরিচয় দেহে দাগ হয়ে বিরাজে তাদের সঙ্গে মিলন-বিচ্ছেদের কারণ বোঝার বিগার মনে উঠায় ধর্মীয় পরিচয়কে অধম হয়তো বিবেচনায় নিতে বাধ্য ছিলাম। কবুল করা ফরজ মানি, — ‘গানপার’ প্রশ্রয় না দিলে রচনাখান আলোর মুখ দেখত না। হার্ডডিস্কে অবহেলে পড়ে থাকত এবং একসময় ডিলিট দরকারি মনে হইত। আপনাদের মতো দু-চারজন পাঠক ও প্রদায়ক বঙ্গভাষায় বিরাজ করেন বলে দুকলম লিখতে মন চায়। ছাতামাথা যাই লিখি-না-কেন প্রস্তুতিমূলক ‘বীক্ষণ’কে ‘গানপার’ মূল্য ও মর্যাদা দিয়াছেন, অধমের কাছে সেইটা সুখের ঘটনা। অন্তে পৌঁছে জানায়া রাখি, ‘ইসলামপাঠ’ খতম হয় নাই। ফজলুর রহমানের Major themes of the Quran কিতাবখানা পাঠের আগ্রহ ছিল। অবশেষে সন্ধান পাইছি। পড়তে গিয়া টাকরায় স্বাদ টের পাইতেছি। আফসোস, আগে সন্ধান পাইলে চিন্তাভাবনার জায়গাগুলা খানিক মজবুত করা সম্ভব হইত। যেহেতু উনার বক্তব্যের সঙ্গে ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর মৌল সুরের দূরত্ব সুদূর নয়। সময়-সুযোগে এইসব নিয়ে আপনাকে মেইলের বাসনা রেখে অন্য কথায় যাই।


আহমদ মিনহাজ তাৎক্ষণিকারাশি
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you