ডাহুক ডায়রি

ডাহুক ডায়রি

জানালা খুলতেই একঝাঁক ডাহুক! ভোরবেলা, সাড়ে-পাঁচটার টিশ্যুপেপারনম্র আলো। সর্বসাকুল্যে ছয়-সাতটা হবে, পিনিপিনি বৃষ্টিতে খুঁটতেছিল কচুরিপানা-ছড়ানো পুকুরসংলগ্ন জমিনের কাদাপানি। নিঃশব্দে নয়, একটা খুব চনমনে স্যাঁকা-রুটির আওয়াজ গলায় নিয়ে তুরতুরিয়ে চরে বেড়াচ্ছিল তারা আমার চোখের ও চিবুকের কাছে। মিনিটখানেক দেখলাম, বাতি নেভালাম, শুভরাত্রি ও সুপ্রভাত জানালাম ডাহুকদেরে এবং সেইসঙ্গে একটি দীর্ঘইওয়ালি ঈদমোবারক! ঘুমের ভেতর আদরের মতো অবাক ও চুপিসার বৃষ্টি ঝরিতেছিল। ঘুমের ভেতর তন্দ্রাখাবের ন্যায় আম্মার কুবকুব কথার মৃদু সন্তরণ। ঘুমের ভেতর বোনেদের কামরান্তরে মৃদুশব্দ চরাফেরা। ঘুমের ভেতর যেন বহুকাল-আগে-দেখা মানবীমুখের মতো অস্ফুট ঘুঘু! ঘুমের ভেতর শুধু সব্বে-সত্তা-সুখিতা-ভবন্তু। ঘুম থেকে জেগে উঠে মনে পড়ল, ও আচ্ছা, আজ তো ডাহুকদিন! শুকরিয়া, ডাহুকসখারা, ভালো থাকা হোক আজি তোমাদের তাহাদের আমাদের মেয়েদের পুতেদের নাতিদের পুতিদের সকলের! ঘুরেফিরে বহুবার মনে মনে, কয়েকবার সরব, গেলাম উচ্চারিয়া : ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো । ভালো থেকো কাক, ডাহুকের ডাক, ভালো থেকো । … ভালো থেকো আম, ছায়াঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো । ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো । … ভালো থেকো নাও, মধুমাখা গাঁও, ভালো থেকো । ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো । … ছুঁড়ে দিনু উড়াল-আদর সকালবেলায় বেড়াতে-বেরোনো দূরদেশের নিকটাত্মীয় যত ডাহুকবন্ধুদের প্রতি : হ্যাভ অ্যা গ্যুড ডে … হ্যাভ অ্যা গ্যুড ডে …

২.
ডাহুক রিভিজিটেড! ডাহুক ফিরেছে আবার আমার জানালায়! সেই ভোরের ডাহুকেরা! আজিকার সহর্ষ ও সবিস্ময় সংবাদ এ-ই : ফিরিয়াছে উড়ে-যাওয়া ডাহুক আবার! ফিরেছে এই বৃষ্টিতিরিতিরি আসরের আজানের ওয়াক্তে, বেলা চারটে বেজে ছাপ্পান্ন মিনিটে, এই চৌকো জানালা-লাগোয়া মজা-পুকুরের তলদেশ-দেখা কচুরিপানাজলের শান্তসবুজ ভিজে-চুপচুপ জগতে। ফেরেনি সকলে অবশ্য, ফিরেছে তিনজন তাদের, ফিরেছেন তিনজনা বাচ্চাবয়সিনী ডাহুকপাখিণী। তিনজন কেন, প্রশ্ন নয়, বিস্ময়। এই নিয়া আবুল হাসানের একটা কবিতা মনে পড়ছে, সেইটা ছিল অবশ্য তিনজন শালিকের অন্তর্ধান উপজীব্য করে, এবং মনে পড়ছে সদ্যপ্রয়াত খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’ ইত্যাদি। চট করে মনে পড়া। মনে পড়ে গেল দ্য গ্রেইট ট্রিনিটি বিষয়ক খুচরো কথাবার্তা। তা, এখন নয়, লেট মি রিথিঙ্ক অ্যাবাউট ইট, লেইটার সামটাইম। তবে এইটা আলবৎ প্রমাণিত হইল তো যে, প্রকৃত সারস উড়ে গেলেও ফেরে আবার, সকলে না-ফিরলেও কেউ কেউ ফেরে। না, ঠিক হলো না, সকলেই ফেরে। কেউ আমরা খেয়াল করি, কেউ করি না। সকলেই ফেরে, ফেরাই নিয়তি আমাদের সবার, ক্রমাগত নিরন্তর ফেরা, প্রত্যাবর্তন পুনঃপুনঃ, ফিরে ফিরে আসা বারেবারে, উড়ে-যাওয়া ফের ফিরে আসা, ফিরে ফিরে উড়ে উড়ে যাওয়া আর আসা। বাকিসব ঝুট, বাকিসব ইল্যুশন, বাকিসব মায়া। বা, এভাবেও বলা যায়, প্রকৃত সারস উড়ে যায়, ফেরে ডাহুকেরা। আশ্চর্য কুহক। মজুমদার মশিয়ে, ভেবে দেখবেন ফিরে? লেট মি রিথিঙ্ক অ্যাবাউট ইট, পরে কখনো, আপাতত শুভপ্রত্যাবর্তন জানাই তিন ডাহুকেরে — হ্যাপি কামব্যাক, ডিয়ার ডাহুক্স, প্রিয় হরিণী ডাহুকেরা আমার!

৩.
তারপর সন্ধে হলো, মাগ্রেবের আজান হলো, অপার্থিব অন্তরালের রাহসিক সেই ডাহুকেরা দেখি উড়ে তো যায় না আর! আজব! তারপর রাত্রি হলো, এশার আজান দূরদূরান্তের মসজিদের মাইক বেয়ে এসে একসময় মিইয়ে গেল, অতিপ্রাকৃত বোধের ন্যায় সেই ডাহুকেরা তা-ও দেখি নিশীথসূর্যের দেশ নরওয়ের পানে উড়ে না-যেয়ে এই কদমতলায় রয়ে গেল চরাফেরারত! অদ্ভুত সবুজ-করুণ এই ডাঙা ডাহুকে ডাহুকময় দেখিতেছি আজ! মনে হচ্ছে, এশারের ছবির কুহক নয় তো! অদ্ভুত গোলকধাঁধাডাহুক তবে? এমসি এশারের জ্যামিতিশিল্পীত ছবির সকাল-সন্ধ্যা ঘোরলাগা পাখিরা! আমার সকালে, আমার সন্ধ্যায়, এইসব অনাবিল কুটুম্বপক্ষীর আনাগোনা। বাস্তব, অবাস্তব, অতিবাস্তব, অথবা বাস্তবের কুহক? পরাবাস্তব পৈখ ? উইড়া যায় রে চখুয়ার পঙ্খি, পইড়া থাকে ছায়া … কোন পরানে বিদেশে রইলা ভুলি দেশের মায়া … রে বন্ধু  … এইরকম কোনো গীতল কবিতাক্রান্ত সন্ধ্যাবেগ? সন্ধ্যার আবেগ? হয়তো, হয়তো নয়। এই পাখিদের সঙ্গে আমার মোলাকাত যে হয়েছে, এই জীবনের এক ও একাধিক সকালে ও সন্ধায় ঘুরেফিরে, এইটা আমি ইন্ডাক্টিভ-ডিডাক্টিভ কোনো লজিকেই কী প্রমাণিতে পারিব? তবে এই প্রত্যুষ ও প্রদোষের দৃশ্যে উদ্ভাসিত অপ্রাকৃত ডাহুকেরা মায়াপাখি নয় — এই বিবৃতিবাক্য সত্য যতটা, তারচেয়ে বেশি সত্য এদের ইম্প্যাক্ট। পাখি একবার দেখা দিয়ে উড়ে গেলে তার ইম্প্যাক্ট খুব সুস্থায়ী, দূরসঞ্চারক, ইফেক্ট মর্মস্পর্শক। প্রকৃত প্রস্তাবে উড়ে-যাওয়া পাখি চিরস্থায়ী হৃদিবিভা সমেত বিরাজে এই পৃথিবীপৃথুলা বাস্তবের ভেজা ভাদ্রসন্ধ্যায়। দৃশ্যত উড়ে-যাওয়া মানে নয় প্রকৃত প্রস্থান।

৪. 
সুজিত সরকারের কবিতা মনে পড়ে গেল। ঝরে যায় যত পাতা, যত ফুল  / মরে যায় যত পশু, যত পাখি / মাটি সব ধরে রাখে। / গাওয়া হয়ে গেছে যত গান / সব মিশে আছে হাওয়ায় হাওয়ায়। / কিছুই হারায়নি, কিছুই হারায় না / সব থাকে, থেকে যায়, আকাশে, মাটিতে।  একই কবির অন্য কবিতায় : এই মহাবিশ্বে আমরা সবাই চিরদিন থেকে যাব, / থেকে যাবে এই আলো, এই অন্ধকার, এই হাওয়া, এই জল … / শরীরের মৃত্যু হবে, কিন্তু পুড়িয়ে দিলেও ছাই হয়ে / মাটিতেই থেকে যাব, / মহাবিশ্বের বাইরে কোথাও যাব না। / চিরদিন আছি আমরা সবাই, চিরদিন থেকে যাব।  সুজিত সরকারের সমগ্র কবিতায় এই সুরটাই প্রধান, — নরম, কচুরিপানাতলাকার জলছায়া, আশ্চর্য সুস্মিতবাক, ডাহুকপাখির ন্যায় মায়াময়, কেমন চিরন্তন-চিরন্তন মনে হয় এই কবির স্বরগ্রাম। মনে পড়ছে সেই ভূমিকা পাঠের স্মৃতি — বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিকরুম   নামের সেই বিস্ময়কর কবিতাবইয়ের শুরুতে জুড়ে-দেয়া আটপাতা ভূমিকা, জহর সেনমজুমদার সেই মহাজাগতিক মাতলামিপূর্ণ কবিতাকাজগুলোর কবি, সেখানেও অদ্ভুতভাবে সেলিব্রেইট করা হয়েছে মানুষের অবিনশ্বরতা, মানুষের মৃত্যুর পরে বেশিভাবে সর্বত্র মিশে থাকা, গাওয়া হয়েছে মানুষের রিন্যুয়েবল এনার্জির জয়গান।

৫.
পাখি নিয়ে এ-জীবনে কত কবিতা পড়া হলো, কত কত শোনা হলো গান, পাখি নিয়া কত রূপকথা আর কিচ্ছাকাহিনি শোনা হলো এ-জীবনে আধোঘুমে আধোজাগরণে, জানা হলো কত পাখির স্বভাবচরিত্র! সলিম আলির আত্মজৈবনিক বইটার অনবদ্য অভিজ্ঞতা আজও চমৎকার — চড়াই উৎরাই — সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বঙ্গানুবাদনে পড়া। বা একসময় শিশু অ্যাকাডেমি-র মাসিক শিশু  পত্রিকার সচিত্র প্রচ্ছদরচনাগুলো! শরীফ খান বই করেছেন পরে, একটা ঢাউস, আর শিশুতে প্রকাশিত রচনাগুলো নিয়ে অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়েছিল দুই খণ্ডে মিষ্টি দুটো বই। খরিদ করেছি শেষোক্ত দুটো, সমস্ত পাখিশিশু  প্রতিমাসে নিয়মিত সংগ্রহ করে গিয়েছি, কিন্তু মোটা কলেবর বইটি চিরাচরিত অর্থাভাবে খরিদ করতে পারি নাই আজও। অথবা মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক   পত্রিকার ‘পক্ষী সংখ্যা’ ভুলে যাব? হুমায়ুন আজাদের অনবদ্যরচনা আমার পাখিরা?  পাখিঘেরা আমাদের লালনের আমাদের কত কত বাউলের কত কত মায়েস্ত্রো পদাবলি …

৬.
কী ভালো লাগলো আমার আজ এই সকালবেলায় … কার লাইন? বুদ্ধদেব বসু, চিল্কায় সকাল,  সম্ভবত। বুদ্ধদেব খুব আক্ষেপ করে কোথাও বলেছিলেন, জীবনে কবিতা আর সাহিত্যশিল্প ইত্যাদি ভোগ করতে গিয়া তার মস্ত এক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে এ-ই যে, একটা শ্রাবণদিনের মেঘলা বা ফর্শা আকাশ আর সরাসরি মরমে না-পশে কোনো-না-কোনো কবিতা বা গান বা পঠিত-দর্শিত বস্তুসূত্রে ভেতরে যায়, যেমন আকাশে মেঘ দেখে কালিদাসের চরণ মনে পড়ে গেলে মেঘটাকে নিজের চোখ দিয়া না-দেখে দেখা হয় কালিদাসের চোখে — এইসব কারণে সেই রচনায় তিনি আফসোস করেছিলেন। দুর্দান্ত লেগেছিল ব্যাপারটা। আমাদের সকলের এ-ই নিয়তি ইন-ফ্যাক্ট। ডাহুক দেখা হয় না হায় নিজ নয়ানে, দেখা হয় না আষাঢ়গগন রবীন্দ্র বিহনে, প্রেম ও প্রতিবাদেও আমরা অন্যনির্ভর! কী ডিপেন্ডেসি, অসহায় অন্যনির্ভরতা পদে পদে, অথচ কী দুনিয়াদাপানো বড়াই! নির্লজ্জ নার্সিসিস্টিক অ্যাপ্রোচ সর্বত্র প্রতিদিন! ক্ষমঃ, হে ডাহুক প্রিয়তম!

জাহেদ আহমদ (২০১৩)

… …

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you