হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাই
বিসমিল্লার পাগলা সানাই
হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাই
স্মৃতিবিজড়িত পাগলা সানাই
ট্রিবিয়্যুট জানিয়েছিলেন কবীর সুমন উপরোক্ত এপিগ্র্যাফটি দিয়ে, একটা আস্ত গানই তিনি নিয়েছিলেন বেঁধে সেই ট্রিবিয়্যুট জানাইতে যেয়ে, এইভাবে এই লিরিকের পাখায় চেপে এক মিউজিকমায়েস্ত্রোকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন তো অনবদ্য অবশ্যই। ট্রিবিয়্যুটস্যংটা ভারতীয় সংগীতের এক মহান শিল্পী কবীর সুমন গেয়েছিলেন সতীর্থ গুরুজন বিসমিল্লাকে ডেডিকেইট করেই। ঠিক এ-মুহূর্তে ইয়াদ করতে পারছি না গানটা সুমন প্রকাশ করেছিলেন উস্তাদজির জীবদ্দশায়, না সানাইলিজেন্ড বিসমিল্লা খাঁ (Bismillah Khan) পার্থিব কর্মকাণ্ড গুটিয়ে শেষবিদায়ের সময়ে। এইটা ‘পাগলা সানাই’ অ্যালবামে একদম পয়লা গান হিশেবে পাওয়া যায়। বিসমিল্লা সশরীর ছিলেন ২০০৬ পর্যন্ত, উমর নব্বই পুরা করে গেছিলেন, অলমোস্ট লাস্ট দিন তক সংগীতেই ছিলেন মগ্নচৈতন্য। দুনিয়ায় শেষ দম তক সপ্রেম-সদর্দ সেধে গেছেন তার সাধনযন্ত্রখানা। আর বিসমিল্লার নাম বলার পরেও যদি ‘সানাই’ শব্দটা উচ্চারিতে হয়, তাইলে এই রিপোর্ট লেখার কোনো মানে হয় না।
আমার মতে, এই একটিমাত্র যন্ত্র — বাদ্যযন্ত্র — যার থেকে উঠে আসে নিখাদ আনন্দ, নির্ঝর বেদনা; স্ফুরিত হয় আনন্দের শুদ্ধ রূপ, বেদনার শুদ্ধ রূপ। অবশ্য সুরযন্ত্র মাত্রেই হরিষ-বিষাদ, আনন্দ-বেদনা, শোক ও সঞ্জীবনী নির্ঝরের বেদ প্রকাশিতে সক্ষম। নির্ভর করে যন্ত্রীর উপর। উন্নত কলাকৌশলরপ্ত যন্ত্রী, ইন্সট্রুমেন্টে দক্ষ কব্জি ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গের বাদক, ইহবিনোদনভবে বেহতর পাওয়া যায়। কিন্তু সকলেই শিল্পী কি?
বিসমিল্লা প্রসঙ্গে এই কথা পাড়া হচ্ছে না। কারণ সানাই ইজ্ ইক্যুয়্যাল্ টু বিসমিল্লা অ্যান্ড ভাইস্-ভ্যার্সা। আমরা শুনে এসেছি বিসমিল্লার সানাই, স্টিরিয়ো প্লেয়ারে, বিসমিল্লা খাঁর সানাই শিরোনামে হস্তলিখিত কাগজ-সাঁটানো ফিতার ক্যাসেট একখানা থাকতই সেকেলে গেরস্তালিতে। একটা ক্যাসেটেই মোটামুটি জীবন চালানো গিয়েছে। একটাই ক্যাসেট ফিতা ফেঁসে গেলে সযত্ন রোদেও শুকোতে দিত লোকে।
এবং এ-ই একমাত্র যন্ত্র যার বাজনা শুনে সুরমূর্খও এক-লহমায় বলে দিতে পারে সুরটা আনন্দের না বেদনার। শিশু এমনকি পাগলও বলে ওঠে অস্ফুটে : আহা! বলে ওঠে সস্ফুটে : আহ্! অন্যান্য যন্ত্রের ব্যাপারে একাধটু সুরসাক্ষর হওয়া আবশ্যক হলেও সানাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রায় নৈব চ। অধিকন্তু এবং, এই একটি যন্ত্র যা মৃত্যুমুহূর্তে মৃতজনের দারা-পুত্র-পরিবার বেদনা প্রশমনে শুনতে পারে, এবং শোনে, শোক সামাল দিতে শোনে; আবার শোনে বিবাহ কি মিলনমুহূর্ত উদযাপনে। এই বিস্ময়ের বিপন্নতা যার মাধ্যমে ঘটে, যেই যন্ত্রের মাধ্যমে, সেই যন্ত্রের নাম সানাই। সুমন বলেছে ‘পাগলা সানাই’, বলেছে ‘কেউটে সানাই’, বলেছে ‘ক্ষ্যাপাটে সানাই’; সুমন বলতে পেরেছেন অনেক সুন্দর ও যথার্থে, যে-কোনো বিষয়েই তিনি তা পারেন এবং পেরেছেন, তার অধিগত সকল বিষয়েই তিনি ভীষণ সুন্দর বলতে পারেন। মুশকিল হলো, সুমনের মতো অমন ভালো অনেকেও বলতে পারেন আরও — শুধু এই জিনিশটা উনি ঠিক মন থেকে স্বীকার করতে পারেন বলিয়া মনে হয় না; খালি নিজেকেই দেখতে পান, দেখতে চান, ওবভিয়াস্লি নিজেকে দেখাইতে চান বলেও মনে হয়; এবং এই নিজেকে দেখাইতে যেয়ে যেটুকু জরুরি ঠিক ততটুকু অতিশ্রদ্ধায়-বিগলিত দুইচাইরজন পূর্বসূরি স্টলোয়ার্টের প্রতি নিবেদন করেন তার কথাপ্রাচুর্য। রবীন্দ্রনাথ যদি সুমনস্বভাবের হতেন, ভাগ্যিস যে ট্যাগোর তা ছিলেন না, বাংলা সাহিত্যসংগীতের আর-কেউ তাহলে তিষ্ঠোতে পারতেন বলে মনে হয় না।
‘পাগলা সানাই’ গীতিসংকলনের নামভূমিকার গানটায় ভারি সুন্দর পঙক্তিমালা পাওয়া যায়। গীতিকার কবীর সুমনের তুলনা বার করতে বেরোনো সোরাব-রুস্তমের পক্ষেও দুঃসাধ্য। “ছোট্টবেলায় শুনেছি প্রথম / কেউটে সানাইয়ে সুর পঞ্চম / খেয়েছে লোকটা এই মাথাটাই / ধরেছে নেশায় ক্ষ্যাপাটে সানাই” … এছাড়া আছে সেই বুকে-মোচড়-দেয়া লাইনগুলো : “যৌবনে প্রেম যেই-না এল / জানি না কেন-যে কান্না পেলো / সেই কান্নাই তোমায় শোনাই / নাছোড়বান্দা প্রেমিক সানাই” … এবং এরপরে এই বিপন্ন-করা লাইনগুলো : “গেল যৌবন মাঝবয়সে / কান্না ঢাকতে শিখেছি হেসে / হাসিকান্নার এই দোটানাই / শেখাল আমাকে রসিক সানাই” … ইত্যাদি। বিসমিল্লাকে শ্রদ্ধা জানাইতে যেয়ে একটা বাদ্যযন্ত্রের আনুপূর্বিক তাৎপর্য উঠে এসেছে যেন, উঠে এসেছে লিরিসিস্টের এবং আমাদেরও সহৃদয় সর্বস্বান্ত সময়টা।
যা-হোক, কথা এইখানে স্যাটানতাড়ানো আউজুবিল্লা নিয়া না, কথা এইখানে বিসমিল্লা নিয়া। সানাই বললেই লোকে বোঝে বিসমিল্লা খাঁর সানাই, যেমন বাঁশি বললেই আসে চৌরাসিয়া, সেতার বললেই রবিশঙ্কর। যেন আর-কেউ সানাই-বাঁশি-সেতার বাজায় না, বাজায়নি কখনো! — এমনই কিংবদন্তি এরা, সাধনযন্ত্রটিকে নিজেদের নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য করে নিতে পেরেছিলেন একেবারে সূচনাজীবনে, জীবদ্দশাতেই। গুণীজন শব্দটি এদের জন্যই, নিশ্চয়, সর্বার্থে। অ্যানিওয়ে। সেতারিয়া আর-কেউ ভূবাংলায় নাই মনে করানোটা আলোচনার অভিলক্ষ্য মোটেও নয়। এমনটা আপ্তবাক্যে বলবার মধ্য দিয়া আলোচনা কাস্টোমাইজ্ করে এগোনো সহজ হয়। পাঠে-বিঘ্ন-ঘটানো হুদা হাঁউকাঁউ অনভিপ্রেত।
বাঁশি বললেই চৌরাসিয়া মনে পড়লেও যন্ত্রটার সঙ্গে একটা নাম অঙ্গাঙ্গী সাঁটা, বাঙালিরই নাম, পান্নালাল ঘোষ। অরিজিন্যালি বরিশালের লোক। আড়বাঁশি যন্ত্রটাকে ইনিই বৃহত্তর মাইফেলে পরিবেশনের উপযোগী করেছেন সর্বপ্রথম, বাঁশিটা আলগ ও পূর্ণাঙ্গ সুরযন্ত্রের শেইপ্ পেয়েছে পান্নালালের হাতে, এর আগ পর্যন্ত বংশী যন্ত্রটা সাপোর্ট অর্গ্যান্ ছিল বড়জোর। জেনেছি যে পান্নালালের আগে বাংলার বাঁশি ছিল গানের সঙ্গে স্রেফ আবহ তৈরির নিমিত্তে ব্যবহৃত যন্ত্র, স্বকীয় স্বরের কম্পোজিশন্ সম্ভব হতো না তাতে। পান্নালাল পয়লা সাতফুটোর বাঁশি ইন্ট্রোডিউস্ করেন এবং বাঁশি হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যালের মান্যিগণ্যি ইন্সট্রুমেন্ট হয়ে ওঠে তারই হাতবাহিত হয়ে। হরিপ্রসাদজি পিআর বাড়ানোর যুগে স্টেজ্ মাতিয়েছেন যে-বাঁশি ফুঁকে, পান্নালালের আবিষ্কৃত সপ্তছিদ্র বংশী ছাড়া তা আদৌ কল্পনাতেও অসাধ্য ছিল। পান্নালালের সঙ্গে বিসমিল্লার সাদৃশ্যগত তুলনা এইখানেই করা যায় যে, হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যাল্ মিউজিকের সম্ভ্রান্ত উন্নাসিকতাব্যাপ্ত মঞ্চে সানাই ইন্সট্রুমেন্টটাকে ইনিই একহাতে কৌলীন্য ও প্রতিষ্ঠা দান করেছেন।
মনে পড়ছে, মৃত্যুর মাত্র বছর-তিনেক আগে বাংলাদেশে বাজাতে এসেছিলেন খাঁ সাহেব। ঢাকায় এবং আরও কোথায়-কোথায় যেন শো করে গেছেন, পরে টেলিভিশনে দেখেছি টুটাফাটা। বয়স হয়েছে, অশীতিপর বা তদুর্ধ্ব। আগের সেই দম নেই, লম্বা ফুঁ দিতে গেলে বোধহয় ফুসফুস কুলিয়ে-উঠতে পারে না, কেঁদে উঠে কঁকিয়ে উঠে খাঁ সাহেবের কাছে বেচারা শ্বাসধারণযন্ত্রখানা হাতজোড়ে মাফ চায় — মনে হচ্ছিল দেখতে-দেখতে। কিন্তু তবু আলবৎ বোঝা যাচ্ছিল যে যন্ত্র তার যন্ত্রীকে কেমন সমীহ করে, কুর্নিশ করে, কদম-মোবারকে অর্ঘ্য রাখে — সুরের! বোঝা যাচ্ছিল সঙ্গতকারদের আদব দেখে, তমিজ দেখে। সংগীতে একেবারেই উম্মি আমি, আকাট সংগীত-অজ্ঞ মানুষ, আমারই মনে হচ্ছিল : এ-ই তবে জোড়! একে বলে মীড়! জোড়ের কাজ, মীড়ের কাজ নিশ্চয়ই এগুলো! খুব স্বচ্ছ বুঝতে পারছিলাম ‘ধরা’, ‘ছাড়া’; বুঝতে পারছিলাম সমলয়, যুগলবন্দি বাদন! আশ্চর্য বৈকি, রগরগে ব্যান্ডগান/রকগান শুনে কান-তৈরি/বড়-হওয়া বার্ধক্যন্যুব্জ পোলামাইয়া আমরা, আমারও ভালো লাগছিল যে!
কথাগুলো অন্তরঙ্গম্ করবেন তারা, যারা বেসরকারি একটি টেরিস্ট্রিয়্যাল টিভিচ্যানেলে নিতিদিনকার নিউজ্-অ্যাট-টেন্ পরবর্তী প্রায়-প্রাত্যহিক প্রচারিত মিনিট-তিনচারেকের ওই বিসমিল্লাসানাই — বাংলাদেশে-বাজিয়ে-যাওয়া বিসমিল্লা খাঁর সানাই — নিয়মিত শুনতেন/দেখতেন।
প্রতিবেদনপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS