বগ্লি কিতাব

বগ্লি কিতাব

ছোটবেলায় এইটা আশেপাশে দেখতাম বড়রা বলাবলি করত, তখন না-বুঝলেও বড় হয়ে নিজেকে মেপেজুখে বুঝেছি কথাটার মর্মার্থ, কথাটা ছিল ‘বগ্লি কিতাব’। বলাবলি হতো, বকবক করা যার বা যাদের স্বভাব তাদেরে বোঝাতে, “অমুকে তো বগ্লি কিতাব এখবার আরম্ভ খরলে মশামাছিও ইয়াল্লা-ইয়াল্লা খরে”। মানে, একবার বকবক শুরু করলে উনারে আর থামানি যায় না; মানুষ তো ছটফট করেই, মশামাছিও ছটফট করতে থাকে ছাড়া পাবার কাকুতি নিয়া। বগ্লি কিতাবের মেটাফোর এসেছে সেকেলে হুজুরদেরে দেখে, সম্ভবত, একাংশ হুজুরের বগলে সারাক্ষণ সত্যি সত্যি কিতাব ঝোলানো থাকত। তবে যারা হাফিজিয়া অধ্যয়ন করেন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আবশ্যকীয় পড়াশোনার অংশ বটে। অ্যানিওয়ে। ফেসবুক-ব্লগ প্রভৃতি বিভীষণ সমাজবিপ্লবী লিখনঋতুতে ছেলেবেলার বগ্লি কিতাব ফিরে এসেছে দেখতে পাই। নিজেই ফিরিয়ে এনেছি একটা ভার্শন। সবাই যার যার বগ্লি কিতাবের কপিরাইট নিয়া চালাইছি দিনরাত্রি। কিতাব হাতে চলিয়াছি মহাকালের যাত্রী। বকরবকর বাকবাকুম আগডুমবাগডুম। থামাথামি নাই। খোদার তিরিশ দিন। বগলে কিতাব আছে সকলেরই একেকখান। কলামে-কমেন্টে সেই কিতাবের অ্যাভেইলেবল্ প্রমাণ পাবো। তদুপরি ডিজিটাল ডায়েরি। হিয়ার য়্যু গ্য অ্যা শর্ট ওয়ান্, ২০১৬ অব্দের এন্তার এন্ট্রি থেকে পরপর চারটে এন্ট্রি শুধু :

২০১৬ জানুয়ারি ২৩
মনে পড়ে অকালে আমার মনের শান্তি মরে যায়
মনে পড়ে এই মানুষ-নিংড়ানো সংসারে বেঁচে থাকা যে কত দায়

‘আর একমিনিট নীরবতায়’ — এই লাইন দিয়া মাকসুদুল হক খতম দিয়াছিলেন গান। ‘মনে পড়ে তোমায় / মনে পড়ে ভালোবাসায় / মনে পড়ে অপমানে / মনে পড়ে ক্ষমায়।’ এরপরও উনি অবশ্য মনেপড়াপড়ির গান গেয়েছেন, — ‘আমি মনেপড়ার গান ভেবেছি গাইব না / ভুলে যাব তোমায় আমি এমনিতে’ — তবু ‘মনে পড়ে তোমায়’ আমাদের জীবনে একটা স্থায়ী বিপন্নতার বিস্ময় রেখে গিয়েছে। সেই দিনগুলোই ছিল অন্তর্গত রক্তের খেলাধুলা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি ইনডিড। জগতের যত সত্য যত মিথ্যা যত পথ্য যত অভাগিনীর শাক-নালিতা সমস্ত ওই সময়টায় আমি নিজে খেটেখুটে আবিষ্কার করেছিলাম। পুঁজি ওইটুকুনই। কিন্তু ভং ধরি এমন যে ‘এই তো গত হপ্তাতেই ডাস-ক্যাপিট্যালের আটতিরিশটা ডাঁসা-ডাঁসা ডাঁহা গাণিতিক এরর ফাইন্ডআউট করিনু চোখ বুলাইতে যেয়ে’ … হেঃ হেঃ … মাম্মা! আর এই মিথ্যাভাষণে এই মিথ্যাভ্যাসে নিমজ্জিত অকালে আমার মনের শান্তি মরে যায় … এই মানুষ-নিংড়ানো সংসারে বেঁচে থাকা তো মহাদায় … এবং মরে গেলেই আদায়, তাও তো নয় মিঞা, এরপরেও খর্চাপাতি আছে। এইটা আবিষ্কার করেছিল উৎপল, কবি উৎপলকুমার বসু, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খর্চাপাতি কত হয়েছিল উৎপলের জানি না।

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১০
এ গান যেখানে সত্য
 অনন্ত গোধূলিলগ্নে
         সেইখানে
            বহি চলে ধলেশ্বরী …

কিন্তু যদি মিথ্যেও হয়, এ-গান যদি রিয়্যালি বিরাজ না-ও করে, ধলেশ্বরী তবু বইবে। বয়ে যাবে নিরবধি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নদী সুরমা। ঢাকায় ঢোকার মুখে রূপসী শীতলক্ষ্যা। আহা! “গঙ্গাবুড়ি গঙ্গাবুড়ি শোনো / এত সুন্দর নামটি তোমার কে দিয়েছে বলো?” কুড়াগাঙ, কুশিয়ারা, বরাক, খোয়াই। এরা আমার গানের তারানা, তান ও তেহাই। আমার গান মিথ্যে হলেও এরা থাকবেই। কিন্তু নদীগবেষকদের লক্ষটাকা-পকেটে-ঢোকানো গবেষণা মোতাবেক নদী আর বেশিদিন নাই। শিগগিরই হবে উনাদের সলিল সমাধি চিরতরে। একদিন, ধরা যাক, নদীহীন হয়ে গেল গোটা গ্রহ। তখনই ফিরবে আমাদের গানে এবং আমাদের জীবনযাপনে সত্যিকারের নদীর টান। মঙ্গলে এবং চাঁদে যেমনটা মানুষ নদীচিহ্ন খুঁজে ফেরে হন্যে হয়ে, তেরোশ’ নদীর উপকথাবিশ্রুত এই দেশেও লোকে পাগলিনীপ্রায় তালাশিয়া ফিরিবে তার যতনের নদীটিরে। কেননা মানুষই জাতিস্মর। রক্তের ভিতরেই তার প্রকৃত জগৎ। প্রকৃত ধরণী তার সামষ্টিক স্মৃতিচৈতন্যেরই ভিতরে। এবং আজ যারা কবিতায় কোকাকোলার বোতল ছাড়া আর-কিচ্ছুটি নাহি পারে দেখাতে, নাহি চায় দেখাবারে, সেদিনের সেই নির্জলা নদীহীনতার নিথর ভবিষ্যতে কেবলই নদীর গান গাইবে। হে আজিকার কবি, দেখে রাখো সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ, তুমি না-পারো তোমার সন্তান এসে কোকাকোলাবোতল ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে ফেরাবে নদীর কলতান। কুলুকুলু বহাইবে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ঘাঘট-করতোয়া আর সুনয়না সুরমার শরীর বাংলা গানে ও কবিতায়।

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১২
গাও হেলানি দিয়া নাচ রে গোলাপি
চোখ হেলানি দিয়া নাচ রে গোলাপি
গোলাপির ওই নাকের বেশর ঝকমক ঝকমক করে
গোলাপির ওই কোমরবিছা ঝুরমুর ঝুরমুর করে …

ইত্যাদি ইত্যাদি। … ভাবছিলাম, জেমস্ এই গানটা — আমাদের গরিমাঋদ্ধ পল্লিসুরের এই মাতোয়ালা দ্রুতির গানটা — গাইলে কেমন হতো? সন্দেহাতীতভাবে, জেমস্ গাইলে, ফের একবার মাৎলা হাওয়ায় ভেসে যেত বাংলার ত্রস্ত নীলিমা।

কারিনা কাপুর যে এলেন না, আসি আসি বলে জ্যোস্না ফাঁকি দিলেন এই যে আমাদের নায়কেরে, সেই দুঃখ অনন্ত জলিল ভুলতে পারতেন হয়তো জেমসের গানটা শুনে। পেতাম আমরাও পুনরায় ‘দি ইল্যুশনিস্ট’ জেমসের ম্যাজিক্, পেতে পারতাম হয়তো-বা আরেকটা মাতাল রাত্রি, মীরাবাঈ-এফেক্ট।

১৪ ফেব্রু, শুনতে পাচ্ছি, উনি গাইবেন উদাত্ত মুক্ত হাওয়ায় আকাশতলার মঞ্চে, শাহবাগচত্বরে, দেখতে চাই ‘ভিগি ভিগি’ বা ‘আলবিদা’ বা ‘বেবাসি’ না-গেয়ে শো খতম্ করতে পারেন কি না। আমরা ভাই চিনি-হিন্দি, জিগ্রি দোস্তি বা পাৎলা দুশমনি, কিসিম্ যা-ই হোক সুর হইলেই নো অব্জেকশন্। অসুরেও। শুধু রক্-ন্-রল্ হওয়া চাই, দ্যাটস্ অল্। উচ্চাঙ্গ গলাব্যায়াম চাই না। বাংলাও দুইয়েকটা, ফর অ্যা চেইঞ্জ, গাওয়া যাইতে পারে অবশ্য। মর্জি হইলে গাইবেন, না-হইলে না, ব্যাপারটায় আমাদের বিন্দুমাত্র স্যে থাকবে না। আমরা তো গ্লোব্যাল্ সিটিজেন্, বিশ্বভূমণ্ডলের সংগীতসমুজদার, তাই না? বাব্বাঃ! অ্যানিওয়ে। লেট’স্ সি। …

আমি কি ভুলিতে পারি, আমার ঘর আমার দোসর আমার পুত্র আমার কন্যা, আমার ঘরকন্না, আমার গড্ডালিকায়-ভাসা বাণিজ্যবাতাসের তোড়ে ম্রিয়মাণা বাড়ি? বিস্মৃত, চুপসানো, অবহেলায় ন্যাতানো ও অগোছালো।

খোকন খোকন করে মায় / খোকন গেছে কাদের নায় / দুধমাখা ভাত কাকে খায় / খোকন রে তুই ঘরে আয় …

লেট’স্ সি, দেখি, বঙ্গাল এইবার ভ্যালেন্টাইন্ নিয়া আদিখ্যেতা করাটা ছাড়তে পারে কি না।

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১৬
না, আশার গুড়ে বালি। নিউজপেপারগুলো তথৈবচ। মনে হয়েছিল বদখাসলত কিছুটা পাল্টাবে। হয় নাই। ইতিহাসচৈতন্যোদয় বিগ-মিডিয়াগুলোর হয়েছে বলে সেভাবে মনে তো হলো না। এদ্দিনে সেই শ্লোকের ‘ভূসুকু বাঙালি ভইল’ ভরসা হয়েছিল, ভরসায় বসতি গেঁড়ে ফলোআপ্ রেখেছিলাম, সকলি গরলে ভেল। ইয়্যে হ্যায় মিডিয়া অ্যান্ড বিজনেস্ কম্যুনিকেশন্স ম্যেরে ইয়ার! জেমসের মঞ্চারোহণ নয়, এখনও বাংলাদেশের বিগমিডিয়া ফাহমিদা নবীর কাভারভার্শন করাটাকেই বিশাল ঘটনা মনে করে। প্রেতাত্মা বাংলাগানের গোল্ডেনযুগ নিয়া আদিখ্যেতা ছাপে। জেমসের স্টেজকাভারেজ এবং ভুলভ্রান্তি রিভিয়্যু করার হিম্মত হয় নাই লিটল-লিটল ওয়েবমিডিয়ারও। হবে একদিন। বদমাশের মতো তবু আশা নিয়াই সংসারধর্ম পালন করি নিত্য পাঁচওয়াক্ত।

লেখা : জাহেদ আহমদ ২০১৬

… …

পরের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you