একটা প্রাচীন বইয়ের চেহারা

একটা প্রাচীন বইয়ের চেহারা

বাংলাদেশে কেউ বইপত্র পড়ে না, নাকি বিস্তর পড়ুয়ায় ভেসে যেতে লেগেছে দেশের দাউদাউ বল্দামি, আপাতত সেই ডিবেইটে ডাকছি না আপনারে। একটা বইয়ের খবর দিতে নেমেছি, দিয়াই বিদায় হই। কিন্তু খবরটা আপনি এতদিনে হয়তো জানেন, পড়ে সারা হয়তো গোটা বইটাই রিভিশন সমেত ছয়-সাতবার, অর্ধযুগেরও অধিক কাল হয়ে গেছে বইটা বাজারে বেরোনোর বয়স। খবরটা যাদের কাছে অ্যানশিয়েন্ট তারা আগাইবেন না তাইলে এই নিবন্ধের নেক্সট প্যারাগ্র্যাফগুলায়। মিনোয়াইল, দেশে মেলা স্টার্ট হয়েছে। কিসের মেলা? প্রাণের। দুঁদে স্যাটান তরুণটারেও দেখি ফেব্রুয়ারি ফার্স্টের আগের রাইতে প্রাণের মেলা বাগাড়ম্বর দিয়া স্ট্যাটাস ঠাপাইতে। দুনিয়ার বেবাক নিয়া তারে ট্রল করতে দেখি, কিন্তু বইমেলা আইলেই তার আবেগের ডিব্বা সামলায়া রাখতে পারে না সে। একটা লাউনির্যাস-দিয়া-বানানো জ্যুসের কোম্প্যানির নামে সে ফেব্রুয়ারিজুড়ে মাতম করতে থাকে ফ্রম ডন টু ডাস্ক, প্রাণের মেলা … প্রাণের মেলা …

মাতম চলতে থাকুক ম্যাঙ্গো জ্যুস নিয়া, আমরা মন দিই একটা প্রাচীন বইয়ের খবর শ্রবণে। যে-দেশে লেখকদের বইলেখা বইছাপা চলে ফেব্রুয়ারি এলে, এবং বছর বছর বই বিয়োতে হয় লেখকদেরে লেখক থাকতে গেলে যে-দেশে, সেই মুল্লুকে ২০১২ অব্দে বেরোনো বই নিশ্চয় তিতপুরানা সাব্যস্ত হবে। সেইটা হইলে না-হক হয়েছে বলা যাবে না। কাজেই, পুরানা বইয়ের খবরে প্রাণ আনচান করবে না আপনার তা জেনেও বইটার মলাটের পানে একটাবার নেত্রপাতের সনির্বন্ধ অনুরোধটুকু রইল। সচিত্র খবরের সম্পূর্ণটুকু পড়বার দরকারও অতটা নাই ইন-ফ্যাক্ট। তবু, তরুণ ও নবযুবা যারা তাদের কাছে এই বই কীভাবে অ্যাপিলিং হবে সেই মর্মে একটু ভাবছিলাম উপরোক্ত অনুচ্ছেদ লিখতে যেয়ে থেমে থেমে। বেশি ভাবতে পারলাম না, আর যেটুকু ভাবলাম তাতে কোনো কূলকিনারা পাইলাম না। আজকাল দেখি বাংলা কবিতায় বিভিন্ন বিদেশি মেটাল ব্যান্ড আর রকারদের নাম ক্যাটালগিঙের কায়দায় ঠেঁসে লেখা বানাইবার চল শুরু হয়েছে, অ্যাক্লেইম পাইতেও দেখি ফেবুসমাজে দেশদেশান্তরে, এক তরুণের বই নিয়া ভালোমতো খুঁটিয়ে দেখে বুঝলাম যে টেক্নিক হিশেবে এইটা আদ্দিকালের রদ্দিই। তালিকায়ন প্রক্রিয়া, নাথিং বেশিকিছু। কয়েকজনের গদ্য পড়ে দেখলাম, রক-রক ফোক-ফোক আর ইংরেজি কিছু গোলাপি-কালো দলের নামজপমালা ছাড়া আল্লার কিরা আর-কিচ্ছুটি নাই। বুঝলাম যে এই পথেই আমাদের ক্রমমুক্তি আসবে। নব্বইয়ের দশকের কবিদের ন্যাকামির শুরুর দিকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন পদশব্দবন্ধ উপর্যুপরি তুলিয়া দিয়া বাংলায় কবিতা লেখার এবং গদ্য মুসাবিদার একটা আজিব ট্রেন্ড এসেছিল, উহারও ক্রমমুক্তি হেরিয়াছি আমরা টাইমলিই। কিন্তু, ভাবছিলাম, এই যে এত উদ্যম, এত রক-রক বকবকানি, বাছারা কি তাদের গোত্রের পূর্বজদের নজির স্মরণ করে না? তালিকায়নের তুবড়ি দিয়া পাঠক ভোলানো কস্মিনকালেও সম্ভব হয় নাই, তারা কি এই তথ্য জানে না?

পাঠকেরে বোকা ভাবতে নাই, রিডার ইজ্ ওয়াচিং য়্যু, পাঠক সব জানে। ইজ্ ইট? সত্যিই কি পাঠক সব জানে? দেখে কি পাঠক সবকিছু? সর্বদ্রষ্টা পাঠক তো গোল্ডের পাথরবাটি; কিন্তু জরুরি জিনিশটাও নজর করিয়া পাঠক দেখে কি? ইভেন যে-কাজের সুবাদে এই নাম তার, — পড়া — পাঠক কি সেই কাজটায় মেহনত করে আজ আর, পাঠক কি পড়ে আজ আর? পড়ত কি বিগতকালে? হ্যাঁ, বিগতকালে একাধটু উতরচাপানির গরজে হলেও পড়ত, হতো পড়তে, এখন না-পড়েও দুনিয়া তামা-তামা করে ফেলা যায়। এখন না-পড়েই বিলকুল খারিজ করার বরাতে ব্যাপকতর পণ্ডিতির কালচার অতিশয় ট্রেন্ডি এই বিদ্যাবিধৌতা বাংলায়। যেমন দুইফোঁটা কাজের-কথা না কয়েও বর্তমানকালে প্যারার পরে প্যারা দশাসই প্রিফেইস্ রচে ফেলা যায়। এভিডেন্স অলরেডি হাজির; সো, গেট গ্যয়িং টু দ্য পরবর্তী প্যারা।

আচ্ছা। তাইলে, এইবার, আর বেশি দিরং না করে পাড়া যাক কাজের কথাটা। ‘রাস্তাফারাই, রেগে ও বব মার্লি’ শিরোনামে একটা বই আছে বাংলায়; কেউ কি দেখেছেন বইটা? কাজী মুনতাসির বিল্লাহ বইটার অথার। নিশ্চয় দেখেছেন, অন্তত কেউ কেউ, অথচ টুঁ-শব্দটা নাই। বিতিকিচ্ছিরি বিষয়াদি নিয়া ফাঁদা গাদাগুচ্ছের বইরিভিয়্যু গোচরীভূত হয় ইহলোকে হররোজ, দুর্ধর্ষ এই বইটা গাদাগুচ্ছের সেই বিতিকিচ্ছিরিতার বেনিয়া হাওয়ায় অ্যাবসেন্ট। অবশ্য একদিক থেকে এইটা কাজটার দুর্ধর্ষতারই ইঙ্গিতবহ। দুনিয়াভরতি মিডিয়োক্যরদের ভিড়ে এহেন গরহাজিরা আখেরে একশবিরাশি রিমার্ক আর সাতশপঁয়তাল্লিশ মুখগ্রন্থমন্তব্যের চেয়েও মূল্যবান, মর্মবত্তাবাহী, সিগ্নিফিক্যান্ট। তবু, মন মানে না বাদলিবৃষ্টির এই ছিঁচকাদুনি ক্রিটিকের দেশে, দুর্দান্ত বয়ন ও বয়ানের একটা বই আমার ভায়ের বড়াইয়ে ভাসানো মহান বইমেলাকালীন কোনো গ্রন্থপ্রেমী টিভিতে-ফেবুতে লাইভে নিয়া আইলো না! কাজী বিল্লাহ-র তাতে একছটাকও মুনাফা বাড়ত না জানি, কিন্তু বইলিখিয়ে বেদম বেহদ্দ তরুণদের সামনে একটা আইডল বই অন্তত থাকত। কয়জন দেখেছে, কে জানে! যে দেখে, যে দেখবার কথা, সে তো সিনের বাইরেই বিরাজে, সে তো নাইই সিনে বা নাই বিতিকিচ্ছা আরাধনাপুণ্যে।

এই বইটা বাইর হয়েছে ২০১২ অব্দে। একশ চল্লিশ টাকা গাত্রমূল্য লয়ে। কেমন বিকিসিকি হয়েছে, এইটা আপাতত অনুমেয়। গ্রন্থমণ্ডপে এইসব বই বিক্রেতা রাখেন না, পাঠকর্তা/ক্রেতাও খোঁজেন না। বাংলায় বার্থসার্টিফিকেটধারীরা দিনরাত কবিতায় হাবিল-কাবিল, কবিতায় মারাকাটা কাউকাউ, গসিপে আর গল্পোপন্যাসে হালুমহুলুম। ফলে বব মার্লি নোবেল না-পাওয়া পর্যন্ত বইটা ভারত-বাংলা সাধু ও চোর পরস্পর কারোরই নেক নজরে আসবে না ধরে নেয়া যায়। একদিক থেকে বাঁচোয়া বটে। এহেন চুরিপরস্পরির দেশে এইসব নজরদারদের নন্দিত সংঘাশ্রয় হইতে নিজেরে বাঁচিয়ে না-রাখতে পারলে অভিপ্রেত কাজকাম শিকেয় উঠবে।

এইটা আদৌ তথ্যচয়নিকা না। মার্লি (Bob Marley) নিয়া আংরেজিতে হাজার হাজার পাতা আছে নেটে, একক্লিকেই নিংড়ে এনে আখাম্বা বাংলায় বেহদ্দ অনুবাদে একটা মাল খালাস দিয়া কালারফ্যুল কোনো কবিতাসাহিত্যের সাইটে নিজনামে দস্তখত করে ছেপে দিতে পারেন আপনি নিশি অবসানের আগেই, কিন্তু এই বই সে-রকম উপরটপকা নাম-কা-ওয়াস্তে বেহুদা পাণ্ডিত্যফাটানো তথ্যতছরুপি কিছু না। ব্যাখ্যা আছে, বিশ্লেষ আছে, সংশ্লেষ আছে বাংলার গান-প্রাণ-রাজনীতিবিশ্বের সঙ্গে, এই বইয়ের পত্তরে পত্তরে, এবং সর্বোপরি আছে ড্রয়িঙরুম আর ড্যান্সফ্লোরের বাইরেকার বব মার্লি।

ছিপছিপে একটা বই। বিটকেলে পেটমোটা সাহিত্যরসালো বইপত্র বড়াইয়ের ভিড়ে প্যাঁচপেঁচে কাদার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এই চিলকাউয়ার দেশে এহেন চুপচাপ প্রচ্ছদ ও অনাড়ম্বর অঙ্গভঙ্গির বই নিশ্চয় কারো কারো চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আজও। ফলে একটা পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া না হোক, বইরিভিয়্যু না হোক, প্রোমো টাইপের কিছু রচিতে হৃদয়ে ইচ্ছা জাগে। স্রেফ বইপরিচিতি কিসিমের কিছু। শুধু বইয়ের নামঠিকানা। তা করতে যেয়েও করা যাচ্ছে না এই বইটার কারণেই। সিচ্যুয়েশনটা পাড়ার বারোয়ারি দিবস-উদযাপনের মঞ্চে বেশ পাওয়া যাইত আগে, এখনও দুর্লভ নয় নিশ্চয়, “আমার পূর্ববর্তী বক্তা যা-কিছু বলার গিয়েছেন বলে, কাজেই আমি আর আমার বক্তব্য দীর্ঘায়িত করব না” ইত্যাদি। স্বীকার্য যে এইটা রাস্তাফারাইশিষ্য বব মার্লির শিল্পীজীবনের প্রশস্তিগাথা না, নাক্ষত্রিক যাপন ও মরণোত্তর মহানীহারিকা মার্লি নিয়া চাল্লু মুগ্ধতাচারণও নয় এই বইয়ের উপজীব্য, আরও অন্যতর কোনোকিছুর তালাশে এই বইয়ের পত্তনি। নিবন্ধে সেসবের কিছুই ধরিয়ে দেয়া যাচ্ছে না; তা দিতে গেলে তো গোটাটাই দিতে হবে পেইস্ট করে এখানে, এই বই থেকেই টুক্লি মেরে, এতটা টাইপস্কিল বা টাইম নাই। নিছক বইরিভিয়্যুয়ের প্রিফেইস বলা যায় এই নিবন্ধটি। প্রিফেইসারের মুরদ ছিল না মার্লি নিয়া কাজী মুনতাসির বিল্লাহ যেভাবে এগিয়েছেন, যে-চেতনায় মার্লি রিডিস্কাভার করেছেন কাজী বিল্লাহ ছয়ফর্মাদীর্ঘ তার পেপারব্যাক বইটায়, যাপনের অনুবর্তী না-হলে এই কায়দায় মার্লি নিয়া আলাপ চালানো তথ্যপণ্ডিত ও বঙ্গপ্রভাষকদের বোকাহাবা সাহস দিয়াই সম্ভব, এই নিবন্ধকারের নাদানি দিয়া বাংলায় তিনচাইরপৃষ্ঠা তালিবালি নিবন্ধ পয়দানো হয়তো সম্ভব হতেও পারে।

এরপরও ম্যে বি ইনফোটেইনমেন্টের একটা আয়োজন করা সাধ্যাতীত ছিল না, আপকামিং একটা আয়োজনে সেই চেষ্টাটা তেড়েফুঁড়ে করবার মতলবও রয়েছে ষোলোআনা, আপাতত দুর্ধর্ষ ওই বইটার তরফদারি করেই নিপাত যাইছি। টিভিতে সেকেন্ডের একটা বাইট পাইলে যেই বিজ্ঞাপনী লক্ষ্য অর্জন করা যায়, হাতের লেখায় সাতাইশপাতায় সেই টার্গেট ম্যে বি রিচ করা যায়। তাছাড়া, এই বইয়ের কমার্শিয়্যাল প্রোমো দরকার আছে কি? বিয়াল্লিশপৃষ্ঠা লেখা যাবে না কেন, খুব যায়, এই বই নিয়া বাইশ/বিয়াল্লিশপৃষ্ঠা লেখা যায়ই। কিন্তু উইকিকেরানি হব কি না, খানিক দ্বিধা আছে এখনও। বর্তমান বাংলায় এত অবৈতনিক উইকিকেরানি, এত তাদিগের প্রবন্ধনিবন্ধপণ্ডিতি, প্লীহা প্রায় বিকল হইবার পথে বাংলা-মায়ের। ও হ্যাঁ, আরেকটা বইয়েরও খবর গুঁজে রাখি এই সুযোগে, ‘বব মার্লে : রক রেগ্যে রাস্তা আর শিকড়ের গান’ সেই বইয়ের নাম, ভাষান্তরিত সাতটা সাক্ষাৎকারের সংকলন এবং সঙ্গে গোটা-পনেরো গানের ইংরেজি লিরিক, তৎসঙ্গে একটা আড়াইপৃষ্ঠা মার্লিদিনপঞ্জি। দ্বিতীয় বইটি বিন্যাস, সংকলন ও সম্পাদনায় সন্দীপন ভট্টাচার্য। প্রথমোক্ত বইটা বাইর হয়েছে বাংলাদেশ থেকে, প্রকাশনালোগো যুগ্মযৌথ ‘সমগীত’ ও ‘সংহতি’; দ্বিতীয় বইটা ভারতের, ‘মনফকিরা’ প্রকাশন থেকে বেরোনো। বব মার্লি নিয়া আর-কোনো গ্রন্থপুস্তকবইকিতাবের খবর জানা নাই। বিপুলা ভুবন, সুপ্রিয়া বাংলা আরও বিপুলা, সাহিত্যরসাঢ্য কবিলিখিয়েরা তো উত্তমসুচিত্রা যুগলাঙ্গ, অগোচরে থেকে যেতেও পারে এমন কত কত মণিমাণিক্য।

মুনতাসির বিল্লাহ রচিত বইটার ব্যাপারস্যাপার কেমন, যদি একটা বার্ডস্-আই-ভিয়্যু দিতেই হয় তাইলে এর কন্টেন্টের উপশিরোনামাগুলো উঠিয়ে এনে এইখানে রেখে গেলে একটা আন্দাজ পাবেন আকেলমান্দ গ্রন্থানুসন্ধিৎসুরা। না, বাজারের বড় বড় বইপত্রকারের অনুসরণে এই বইয়ের কোনো সুসংবদ্ধ সূচি/ইন্ডেক্স নাই; আছে একটানা গোটা বইটাই বিভিন্ন সাবহেডে মেলান করিয়া রাখা। খাব্লা খাব্লা যে-কোনো জায়গা থেকে যে-কোনো সময়ে পড়ে নিলেও হয়, আবার একটানা পড়ে গেলেও বুরা লাগবে না। সাবহেডগুলো কয়েকটা পাতা উল্টে যেভাবে পাওয়া যাচ্ছে, যেমন : ‘ছোট দ্বীপের কালো উপকথা’, ‘প্রতিরোধ : রাস্তাফারাই’, ‘শত্রুর নাম ব্যবিলন’, ‘পাল্টা সংস্কৃতি : সফেদ ধোলাইয়ের বিপক্ষে’, ‘অস্ত্রের নাম ভাষা’, ‘বব মার্লির শৈশব’, ‘ট্রেঞ্চটাউনের Rude Boy বব মার্লি’, ‘রকের রাজ্যে রেগে’, ‘Politricks’, ‘পণ্যায়িত সেলিব্রিটি’, ‘আমার চেতনার রঙে’, পুনরুপনিবেশিকিকরণের কালে প্রতিরোধময় রেগে’, ‘রাস্তাদের ওয়ালিভাই, ওয়াল্টার রুডনি ও তার জরুরৎ’, ‘আমাদের বব মার্লি’ ইত্যাদি। বইয়ের শুরুতে লেখকের মুখবন্ধ রয়েছে একটা, নাতিদীর্ঘ, আছে ‘কিছু প্রশ্ন’ শীর্ষক আরেকটা চ্যাপ্টার যা কাজী বিল্লাহ-র অভিপ্রেত বব মার্লি ইনভেস্টিগেশন কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছে এর সম্ভাব্য পাঠকযাত্রীদেরে, এক-লহমায় তা দেখিয়ে দেয়। এরপরে দেখা যাবে লেখকের মার্লিপ্রীতি, প্রকারান্তরে যা আদি ও আস্লি পৃথিবীপ্রীতি বা মানুষপ্রেমই, দেখা যাবে লেখকের রাজনীতিপ্রাখর্য ও দর্শনচৈতন্য তথা তার গদ্যগমকের তুজুর্বা। লাস্টের পাতায় লিখনকালিক ‘সহায়ক বইপত্তর’ শীর্ষক একটা তালিকা অ্যাড করে রাখা, যা মার্লিবিষয়ক বাজারি ডিস্কো বইয়ের ভিড়ের বাইরেকার বেশকিছু অফবিট বইয়ের সন্ধান দেবে অনুসন্ধিৎসুদেরে, এই রিভিয়্যুয়ারকে দিয়েছিল বলতে পারি।

ইচ্ছে করছে প্রোক্ত উপাধ্যায়গুলো থেকে এক্সট্র্যাক্ট তুলে এনে এইখানে রেখে যেতে। সেই হিম্মতের বলে বলীয়ান হয়ে দেড়-দুইটুকরো নজির শুধু পত্রস্থ করতে পারি এ-যাত্রা। আজ থেকে বহু বহু ধূসর বছর আগে, আমাদের ছোটবেলায়, কিছু জনপ্রিয় ইংলিশ ব্যান্ড যেমন ‘বনি-এম’ প্রভৃতির পরিবেশনায় মার্লির গানগুলোর ডিস্কো ফর্মে প্রেজেন্টেশন আমরা হাতে পেয়েছিলাম। ড্যান্সফ্লোরে ব্যবহার্য বব মার্লি, রিমেইড, নাচাকুঁদা পার্টিস্যং। পরে এবং এখন পর্যন্ত বব মার্লির দুর্ধর্ষ দুঃখক্বাসিদা আর রাগরক্তগাথাগুলো ওই ফর্ম্যাটেই ফিরে ফিরে এসেছে দেখা যায়। কাজী বিল্লাহ তার বইয়ের শুরুতেই লিখছেন, “নাচ তুলতেই পারে বব মার্লির গান। এই মুহূর্তেই হয়তো বার্লিন-আমস্টারডাম-ব্রিসবেন-হারারে-ভ্যানকুভার-কিংস্টন কিংবা অন্য কোথাও ড্যান্সক্লাবের বোকা-নাচের আসরকে, হয়তো ঢাকাতেই কোনো ডিজে ড্যান্সপার্টি বা কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদিগের কর্পোরেট কেরানির চাকুরি বা অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানোর আগ মুহূর্তটাকে একটু wild করার তাগিদে আয়োজিত সমাপনী উৎসবকে মাতিয়ে তুলছে মার্লির ‘Exodus’। (…) কিন্তু এটা কোন বব মার্লি? এটা কোন Exodus তথা হিজরত? আরেক বব মার্লি আছেন যাকে জাতিসংঘ, বিবিসি, টাইমস কি বিশালাকার কোনো আন্তর্জাতিক এনজিও খুব পিঠ চাপড়ে মুক্তির দূত, শান্তির দিশারি ধরনের খেতাবটেট্যাব দেয়। (…) কোন মার্লিকে খুঁজছি আমরা? কোন মার্লিকে দরকার আমাদের?” এই প্রিফেইস দিয়া যার শুরু, তারে তো বঙ্গীয় নবরসোদ্বেল কবিতাসাহিত্যাবেগী ইয়াঙ্গিশ নায়্যিভ বইলেখক ভাবলে আপনে যে একটা হাবা তা আর অগোচর থাকে না। হাবা যুবকের হাসি নিয়া আপনি যদি উৎপলপড়া স্মার্ট কলকাতাকাব্যিক চৈতন্য নিয়া আহ্লাদ দেখাইয়াই দিনাতিপাত করে যেতে চান তো কথা নাই। কিন্তু বইটা হাতে নেবার আগে একটা কাজ আপনার অবশ্যকর্তব্য; কাজটা হচ্ছে, কথায় কথায় মেটাল-রক-রেগে-সাইকাডেলিয়া মারানো যৌবনবাউলিয়ানামার্কা তাগড়া হাবাগোবা ফ্যাশনটা আপনায় খানিক পাছাপকেটে রেখে বইটা হাতে নিতে হবে। এবং একবার যদি বইটায় বিসমিল্লা বলিয়া আগাইতে থাকেন, বইটাই অধিকার করে নেবে আপনারে, ইনশাল্লা আর বারবার পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। যাবতীয় ভোঁতা বাংলা ফ্যাশনচেতনাগ্রস্ত রকগদ্য লিখিবার দুর্মর বাসনাও বোধহয় কিছুটা বাও করে নিতে পারবে এই সময়ের চাল্লু বোলতোলা তারুণ্য।

বক্তব্য দীর্ঘায়িত করব না বলেও বক্তব্য চালাইয়া যাওয়াই কিন্তু দস্তুর। দুইটা বাক্যালাপ পরিশেষে। দেখেন, এই বই পড়ে এমন কোন আমড়াটা আছে যে আপনে জানতে পারবেন? কোন জলপাইটা আছে এখানে যা আপনে আগে জানতেন না? আজকের দুনিয়ায় জানোয়ারির জন্য পড়ে এমন ভ্যাদামাছটা আছে কোন পুকুরে প্যাঁককাদায়? না, জ্ঞানগম্যি নয়, কাজী বিল্লাহ-র এই বই থেকে আপনি নিজের অস্তিত্বটারে একটা আলগ আতশকাচের তলায় রেখে দেখতে পারবেন বোধহয়। আর গান যে খালি মিস্টিক মুস্কুরানি বা তারুণ্যের বড়াইনিশান নয়, গানই যে আসলে অস্তিত্ব ডিফাইন-রিডিফাইন করবার হাতিয়ার, এবং গানই তো গোটা হাতটাই, কিংবা গান মস্তিষ্ক ও হৃদিপিণ্ডের মর্মমজ্জাটাই, জিনিশগুলা লাইনে লাইনে টের পাবেন আপনি। কিন্তু রকদর্শন ঢুঁন্ডবার মনোবাঞ্ছা নিয়া আল্লার দোহাই এই বই পড়তে যাইয়েন না। আজকের চলতি হাওয়ার পন্থীরা চাদ্দিকে হন্যে হয়ে রকদর্শন খুঁজে বেড়ায়, আগে যেমন তরুণরা বাপের ছাপড়ায় ভাত খেয়ে বেলা বারোটা থেকে ভোররাইত তিনটা পর্যন্ত হুদা বাউলদর্শন খুঁজে বেড়াইত।

তবে, এইটা ঠিক, ম্যাঙ্গো জ্যুসের এই মেলায় বাউলদর্শনের বই বেশুমার বেরিয়েছে এতে একবিন্দু সন্দেহ করি না। আল্লার কুদরতে এইবার রকদর্শনও পেয়ে যাবেন না তা-ও বলছি না। পাবেন। খোঁজেন। তবে এই বই আপনারে সোজাসাপ্টা একটা আদি ও আস্লি হিউম্যানের দেখা পাইয়ে দিতে পারে। না, আমার মতো চিংড়িশিরদাঁড়া স্যাপিয়েন্স নয়, ঋজু, শালপ্রাংশু, গনগনে আগুনের আর টলটলা পানির মানুষ। যদি এই বইয়ের লগে দেখা হয়ে যায় আপনার, আমার একটা লাভ হবে তাতে, আমার লাভটা আদ্যোপান্ত পরিবেশবাদী ইশ্যুসেন্ট্রিক। রক-রক বকবকানি করে যারা, কাব্যে এবং কথায়, তারা আরেকটু অ্যাডাল্ট হতে পারবে। এতে করে আমাদের পরিচিত পরিবেশের ফেবুসমাজে, এবং পরিণামে ফেব্রুকালীন ছাপানো গ্রন্থসমাজে, রকাবেগী ঝিকুমিকু তরুণ পোয়েট-অথারেরা আবেগের উদরাময় থেকে আমাদিগেরে রেহাই দিবে। একটু হলেও পরিণতমনস্ক রচনাপত্র পাবো আমরা আহ্লাদী ইয়াং জেনের কাছ থেকে — খাস করে রকমিউজিকের আম্ব্রেলার অন্তর্গত বহুবিধ অধ্যায়-উপাধ্যায় নিয়া তারা তাদের রক্তজারিত রচনাটা বাইর করে আনতে পারবে, এবং বুঝবে যে যে-কোনো রচনার আড়াই-তিন লাইন পড়েই রিডাররা ডিটেক্ট করে ফ্যালে এই কবি বা এই গদ্যকার ঠাঠা মুখস্থ অথবা খালি উইকি-গ্যুগল ঝাড়ছে।

হ্যাঁ, এই বইয়ের কাছে যাবার আগে গাদাগুচ্ছের বই নিয়া আপনার মরার আবেগ সামলাইয়া যাবেন। জানেন তো, আবেগ এমন মাল যা মাথায় উঠলে আপনার প্রজননস্বাস্থ্যেরই অপূরণীয় ক্ষতি। ফি-বছর প্রাণের মেলায় বেরোনো বইগুলার গা-গতর থেকে এই নিভৃত বাণীটাই পাই। বেচারা প্রাণ! যায় যায় অবস্থা। গেলুম।

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you