বনজুঁই ঘুমিও না ৫ || নিবেদিতা আইচ

বনজুঁই ঘুমিও না ৫ || নিবেদিতা আইচ

উনিশশো অনন্তের কোনো-এক দুপুর। উত্তল ছায়ামেঘের মাঝে বসে ঝিল্লিময় সেই দুপুরটা আচমকা কথা বলে ওঠে। ঠাকুমার মতো মাথা নেড়ে নেড়ে সে আমাকে ‘পরস্তাব’ শোনায়৷ রাজার কন্যাকে বন্দি করে রেখেছে কোনো-এক জাদুবুড়ি। তাকে উদ্ধার করতে ছুটে আসছে আরেক রাজ্যের রাজপুত্তুর। অশ্ববাহিনীর হ্রেষা থেমে যায় আচমকা। ভীষণ বিভ্রান্ত করে দিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে — আমাদের মনে পড়ে তোমার?

এইসব গল্প বা প্রস্তাব ঠাকুমা আমাদের কাছে বেড়াতে এলে শোনাতেন। কারণ গ্রামে গেলে আমার নিজস্ব ব্যস্ততা থাকত। তখন লক্ষ্মী হয়ে বসে ‘পরস্তাব’ শোনার মতো ধৈর্য হতো না আমার। দুপুরগুলো হয়ে উঠত আরো বেশি দুরন্ত। সুযোগ পেলেই আমি এক উঠান থেকে আরেক উঠানে ছুটতাম। মার্বেল, বৌছি, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম আশেপাশের বাচ্চাদের সাথে। খেলা না জমলে কড়ই গাছের ডালে চঞ্চল কাঠবেড়ালির দল কী করছে তা-ই দেখতাম ঘরের দাওয়ায় বসে বসে। নয়তো পুকুরপাড়ে গিয়ে ঢিল ছুঁড়তাম জলে পা ডুবিয়ে দিয়ে।

দুপুরবেলায় লেইসফিতাওয়ালারা আসত জাদুর ঝাঁপি কাঁধে নিয়ে। পাশের বাড়ির ঝুমু পিসি, বন্দনা পিসিরা কানের দুল, টিপের পাতা, আলতা, নেইলপলিশ এইসব কিনত। আমরা ছোটরা ভিড় করে ওদের কেনাকাটা দেখতাম। আরো একজন জাদুর মানুষ আসত মাঝেমাঝে। পুরান বইপত্র, ফেলনা হাড়িপাতিলের বিনিময়ে যার কাছে পাওয়া যেত ‘কটকটি’ নামের মজার জিনিসটি। মা বকাবকি করলেও লুকিয়ে লুকিয়ে কটকটি খাওয়ার মজাই ছিল অন্যরকম। তখন বোধহয় একটাকায় নারকেলের আইসক্রিমও পাওয়া যেত। সেটাও ছিল অমৃতের মতন কিছু।

বিকেলে বন্ধুদের সাথে কানামাছি খেলে বা খড়ের গাদায় লাফঝাঁপ দিয়ে আমার সময় কেটে যেত। খড়ের গাদায় যেদিন খেলতাম সেদিন রাতে ঘুমাতে গিয়ে একটা কাণ্ড হতো। পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অব্দি সে কী জ্বলুনি! ব্যথায় কান্না পেয়ে যেত আমার। ঠাকুমা তার ভাষায় বলতেন — ক্যাঁন লাগের? আর যাবি না খড়র গাদাত?

আমি কান ধরতাম, মাথা নেড়ে বলতাম — কক্ষনো যাব না আর। সবার মনে হতো বুঝি খুব শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। কিন্তু পরেরদিন বিকাল হলেই আবার সেই লাফঝাঁপ!

ঠাকুমা অদ্ভুত সুন্দর নকশি কাঁথা সেলাই করতেন। পড়ন্ত দুপুরে সব কাজ শেষ হলে সুঁই-সুতার বাকশো খুলে বসতেন তিনি। ছানিপড়া চোখে ঘাড় গুঁজে সেলাই করতেন ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতন। শত শত বকুলফুল, শিউলিফুল, কল্কেফুল ফুটে উঠত ক্রমে। মাছের দল চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত কাঁথাফোঁড়ের শরীরে। যখন আলো কমে আসত ঠাকুমা সব দেরাজে তুলে রেখে বেরিয়ে আসতেন উঠানে। তার পোষা হাঁস ছিল কয়েক জোড়া। সন্ধ্যা নামার মুখে ওদের খুঁজে খুঁজে ঘরে তুলতেন তিনি। আমি তার সাথে সাথে ঘুরঘুর করতাম। এদিক ওদিক থেকে ডেকে আনার ভঙ্গিটা দেখলে আমার ছোটবেলার গানটা মনে পড়ত। আমি গাইতাম আর ঠাকুমা হাসতেন।

‘আয় আয় উড়োহাঁস,
তই তই তই,
মোয়া দেবো মুড়ি দেবো
আরো দেবো খই।’

ওদের মাঝে মাঝে পুকুর থেকেও তুলে আনতে হতো। কী দারুণ সাঁতরে বেড়াত ওরা! ততদিনে আমিও জেনে গেছি পুকুরে স্নান করার মজা। ঝুমুপিসি প্রায়ই ডেকে নিয়ে যেত আমাকে। সাঁতার শেখা হয়নি বলে আমাকে জলে একা নামতে দেয়া হতো না। মনে আছে পিসি কেমন দাঁপিয়ে বেড়াত পুকুর জুড়ে, এমাথা থেকে ওমাথা। আমি যেদিন জলে নামতাম কলাগাছের ভেলা থাকত সেদিন। ওটা ধরে ধরে পিসি আমাকে গভীরে নিয়ে যেত। ঘণ্টাখানেক জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে পাড়ে ওঠার পর দেখতাম চারদিক কেমন ঘোলাটে হয়ে আছে। এই উঠে-আসার ব্যাপারটা কখনোই ভদ্রলোকের মতো হতো না। মায়ের হাতে বিছানাঝাড়ু, খুন্তি বা জালিবেত কিছু না কিছু থাকতই। অস্ত্র হাতে নিয়ে যেন স্বয়ং মা দুর্গা অবতীর্ণ হলেন দস্যুদের বধ করতে! মায়ের সেই রূপ দেখে জল থেকে উঠে ঝুমুপিসি চোঁ চোঁ করে দৌড় লাগাত একদিকে আর আমি ছুটতাম আরেকদিকে।

এই পুকুরে বাবা আর কাকা মিলে মাছ ধরেছিল কয়েকবার। আমার মনে পড়ছে সেবারের ঘটনা। দাদুর শ্রাদ্ধ শেষ হয়েছে কদিন আগে। সব আচার-অনুষ্ঠান শেষ হলেও আমার পিসি আর পিসতুতো দাদা-দিদিদের নাইওর শেষ হয়নি তখনো। সেদিন জালে বেশ কিছু মাছ ধরা পড়ল। বাবা পুকুরে নেমে মাছ ধরছে এইসব গল্প শুনেছি কিন্তু সেবার চোখে দেখতে পেয়ে ভীষণ অদ্ভুত লাগছিল আমার। ভাইবোনের দল পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরা দেখলাম। দুপুরে কাকীমা আর মা মিলে সেই মাছ ভাজলো, ঝোল রাঁধলো। রান্নাঘরে আর দাওয়ায় চাটাই পেতে খেলাম সবাই একসাথে। নারকেলের মালায় লবণ দেয়া থাকত থালার পাশে। মনে আছে রাতে খেতে বসলে শেয়ালের ডাক ভেসে আসত দূর থেকে। ঘরটার জন্ডিসরঙের আলো আর ঠিক বেড়ার ওপাশের জঙ্গলে ঝিঁঝির একটানা ডাক। বেশ গা-ছমছম-করা একটা অনুভূতি হতো সব মিলিয়ে।

এই রান্নাঘরের দাওয়ার সাথেই ছিল ঢেঁকিঘর। বরাবরই সেই ঘরের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ ছিল। আমি চোখ বুজলে এখনো দেখতে পাই ঠাকুমা ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছেন, পিঠা বানাবেন বলে চাল কুটছেন। শীতের মৌসুমে প্রচুর পিঠা খাওয়া হতো বাড়ি গেলে। খেজুরের রসে ডোবানো পিঠা খেতে খেতে আমি উঠানে পায়চারি করতাম। আমাকে বাগে পেয়ে খড়ের ছাউনিতে বসে-থাকা অনুসন্ধিৎসু কাকবাহিনী হামলা চালাত। ছোঁ মেরে নিয়ে যেত পিঠা, গুড়মাখা খই কিংবা আর যা-ই থাকুক না কেন হাতে। কলপাড়ে কি পুকুরপাড়ে গায়ের সাবানটাও তাদের দাপটে রাখা যেত না। গায়ে মাখার সাবান দিয়ে ওরা চান করত কি না এই নিয়ে সে-বয়সে আমার মনে বেশ একটা কৌতূহল হতো।

রান্নাঘরের ঠিক সামনে টিউবওয়েল বসিয়েছিল কাকা। সেই জলের নোনা স্বাদটা ভুলতে পারিনি এখনো। মুখে নিলেই মনে হতো সমুদ্রের গল্পটা। বাড়ির পেছনে বহমান প্রবল সমুদ্রটা আমাদের উঠোনকে আদিগন্ত আলিঙ্গনে নিমজ্জিত করে দিয়ে গিয়েছিল কখনো। গল্পটা শুনেছি কতশতবার। সেই প্রকাণ্ড জলরাশির কথা মনে পড়ত নোনাজল মুখে নিলে। এখন ব্যাপারটা নিয়ে কাব্য করলেও আমার মনে আছে জল খাওয়ার ব্যাপারটা যে কী ভোগান্তির মনে হতো তখন!

আমার সমুদ্রের গল্পটা বলি। বাবার সাথে পায়ে হেঁটে আমরা সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। আধঘণ্টার দূরত্বে সমুদ্র। কী রোমাঞ্চকর ব্যাপার! রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সব যখন নিঝুম হয়ে উঠত আমার মনে হতো কান পাতলেই বুঝি সমুদ্রের গান শুনতে পাবো। গায়ে কাঁটা দিত ঐ বয়সে। সেদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর উত্তেজনায় ঘুম আসেনি আমার। বিকেল হতে না হতেই বাবা ডাক দিল আমাদের। তার পিছু পিছু চললাম কিশোরী আমি, মেঝো বোন আর আরো কিছু ছেলেমেয়ে। আমার সমুদ্র দেখার উজ্জ্বলতম স্মৃতি সেটা। মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিলাম সবাই। পথের দু-ধারে খেঁজুরগাছের সারি। আর শিমগাছের ঝাড়। বেগুনি রঙের শিমফুল ফুটে আছে থোকায় থোকায়।

গল্প করতে করতে কিছুটা পথ যেতেই দেখি ঝাউবনের ঝিরিঝিরি পাতাগুলো মাথা দুলিয়ে ডাকছে। কলকল করতে করতে আমরা ছুট লাগালাম সেদিকে। কয়েক মিনিট পর বালুর রাজ্যে পৌঁছে গেলাম। পা দু-খানি জড়িয়ে ধরে বালুকণারা যেন বলছে — এতদিন পর এলি তবে লক্ষ্মীছাড়ার দল!

আমরা সৈকত জুড়ে ছুটলাম দীর্ঘক্ষণ। বালু দিয়ে ঘর বানালাম বেশ কয়েকটা। ঝিনুক আর পাথর কুড়ালাম কোচর ভরে। আমাদের পা ছুঁয়ে যাচ্ছিল ঢেউয়ের দল। খেলিছে জলদেবী, সুনীল সাগরজলে। এই গানের অন্তরাটা, সঞ্চারীটা গুণগুণ করছিলাম আমি।

আকাশের ফ্রেমে রঙ বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। আবির রঙটা ক্রমশ লালচে হয়ে এলে বাবা বলল — দ্যাখ, এবার সূর্য ডুববে। আমরা ছোটাছুটি বাদ দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়ালাম সূর্যদেবের জলে ডুব দেয়া দেখব বলে।

এরপর আমি আরো কয়েকবার সমুদ্র দেখেছি। কিন্তু সেদিনের মতো অভিনব স্মৃতি আমার নিউরনে জমা হয়নি। এই দেখার আমেজটা ছিল ভীষণ অন্যরকম। সেদিন যখন পায়ে পায়ে বাড়ি ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়টা পেরিয়ে গেছে। তিমির নিবিড় রাত নেমেছে পৃথিবীর বুকে। জোনাই জ্বলছে হাওয়ায় আর কোমল ফুলের মতো স্বাতীতারা জেগে উঠে আমাদের দেখছে ওপর থেকে।

রাতে স্বপ্ন দেখলাম। আমি হাঁটছি সৈকতের ধার ঘেঁষে। প্রগাঢ় নীল ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায় আর ঝিনুকের মেখলা কটিতে দুলছে।

প্রচ্ছদ : অসীম দাস

… …

নিবেদিতা আইচ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you