একটা পাঠচক্র বা আমরা বলতে পারি একটা বুকক্লাব কেন্দ্র করে এই সিনেমাটা। বানিয়েছেন বিল্ হোল্ডার্ম্যান। রোম্যান্স কমেডি কিসিমের সিনেমা। কাহিনিটা শাদাসিধা, দারুণ মজার, এন্টার্টেইনিং। সংক্ষেপে স্টোরিলাইনটা জানিয়ে এই নিবন্ধ শুরু করা যায়। চার বন্ধুর কাহিনি। সিনিয়র সিটিজেন চারজনই। নিয়ার সিক্সটি, ফিফটি-আপ তো অবশ্যই, প্যুশিং সিক্সটি বলাটাই নিরাপদ। তবে ক্যারেক্টারদেরকে দেখলেই বয়স আন্দাজ করা যায়, তারচেয়েও বড় কথা চারজনেই ইন্ডাস্ট্রির বহুপরিচিত মুখ, অ্যাক্টিং চারজনেরই সেলিব্রেইট করে এসেছি আমরা। অ্যানিওয়ে। এই চার বন্ধু মিলে একটা পাঠচক্রে, একটা বইসংঘের বরাতে, নিয়মিতই মিলিত হন। বন্ধু চারের নাম ডাইয়্যেইন, ভিভিয়্যান, ক্যারল এবং শ্যারন। বলা হয়েছে যে-নামভূমিকায় তারা ছায়াছবিটিতে অ্যাপিয়্যার করেছেন সেগুলো। তবে একজনের ছাড়া বাকিদের আসল নাম, মানে বাস্তব জিন্দেগির নাম, ভিন্নতর। চারজনকেই চিনি আমরা নানান সিনেমার মাধ্যমে বহুকাল ধরে। এদের মধ্যে একজন, প্রথমোক্ত, তথা ডাইয়্যেইন কিটন, অভিনয় করেছেন ডাইয়্যেইন নামেই। কিন্তু অন্য যারা আছেন তারা যথাক্রমে জেইন ফন্ডা, ম্যারি স্টিনবার্গেন এবং ক্যান্ডিস্ বার্গেন।
অলরাইট। ম্যুভির গল্পরেখা বলতে লেগেছিলাম, অন্য আলাপে লেগে পড়েছি। কিসসা হচ্ছে, এই চারবন্ধু তাদের মধ্যবয়স-পারানো অলমোস্ট নিস্তরঙ্গ দৈনন্দিনে বুকক্লাব আশ্রয় করে বেশ সুখে ভোঁতা দিনাতিপাত করছিলেন। বইপত্র পড়ে চারজনের জন্য কনভিনিয়েন্ট সময় এবং জায়গায় তারা জড়ো হয়ে একটা আলোচনা করেন হামেশা খানাখাদ্য সহযোগে। হ্যাপিলি দিন যাচ্ছিল রাত্রি পোহাচ্ছিল। হঠাৎ হাতে এসে পড়ে এমন একটা বই, যেইটা তাদের জিন্দেগিটাকে ফের হাতে নিয়া চাখতে প্ররোচনা জাগায় এবং আমাদের সিনেমার গল্পটাও জমাট বাঁধায়। সেই বইটাও দর্শক হিশেবে আমাদের কাছে খুবই পরিচিত, সম্প্রতি সিনেমাও হয়েছে এই বই নিয়া দুই-দুইটা, অনেকেই পিডিএফও পড়ে ফেলেছেন প্রলুব্ধকর যৌন-ঘনঘটনাঢ্য বইটার। কাজেই, রিস্কি ছিল খুবই যে এমন জনপরিচিত বই সিনেমার আখ্যানভাগে সেন্ট্রাল ভূমিকায় নিয়া আসায়, কাল্পনিক নামের বই নিলে এই রিস্ক ছিল না, কিন্তু গল্পনির্মাতা বা সিনেমাপরিচালক সমস্ত ঝুঁকি উৎরে এসেছেন এবং বাস্তব নামের বইটাই সিনেমাটার কিচ্ছায় ক্যাটালিস্ট হিশেবে প্লে করেছে একটা দারুণ পিভোট্যাল রোল।
বইয়ের নাম ‘ফিফটি শেইডস্ অফ গ্রে’। এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে হবে? এখন বোধহয় পাঠক-দর্শক আঁচ করতে পারবেন ঘটনা আবর্তিত হবে কেমন করে এবং কোনদিকে। সেইটাই। কিন্তু মুনশিয়ানা আছে, এবং চমক, যেটুকু সম্ভব হয় এমন সামাজিক মিলনাত্মক নাট্যাখ্যানের পরিসরে। যে বা যারা আঁচ করে বসবেন ম্যুভি দেখতে বসার আগে, ম্যে বি তারা পুরাপুরি মিল পাবেন না আন্দাজি ইম্যাজিনেশনের সঙ্গে। এই বই পড়ে সেই চার বান্ধবী, ব্যেটার টু স্যে বন্ধু, ভিমরি খেতে খেতে প্রথমত সামলায়, তারপরে আবার মাথা আউলায়, একসময় সিনেমা তার গতি পায়। চারজনেই নিজেদের জীবন নিয়া আরেকবার ভাবতে শুরু করে, গ্যাঁট হয়ে বসে বসে ভাবে যে এমনও নয়, একে একে চারজনেই স্বীকার করে তাদের জীবনে এমন যৌনতা নাই যেইটা তারা বইয়ের কাহিনিবিবরণে সদ্য অবগত হয়েছে, এবং আরও দুঃখের যে সেই কোন ধূসর অতীতে তাদের যৌনবর্ণিল স্বল্পমেয়াদী জিন্দেগি কিছুটা হাতেনাতে পেলেও বহুদিন তা নাগালরহিত। বইটা তাদের লাইফে একটা ট্রাই ফিরসে করবার তাগিদ দেয়। সেক্স-কন্টেন্টে ভরপুর ধুন্দুমার সেই বই তাদের চার বন্ধুর জীবনেই ইন ম্যানি সেন্সেস লাইফ-চেইঞ্জিং ইভেন্ট হিশেবে অবতীর্ণ হয়।
সিনেমার নামটাই কিন্তু বলা হয় নাই এতক্ষণ হলো। ‘বুকক্লাব’ (Book Club) সিনেমার নাম। এইটা সার্টিফায়েড রোম্যান্স কমেডি বা রমকম হলেও অল্পবয়েসী টিনেইজারদের জিনিশ এইটা না; বা, তারুণ্যে তড়বড়ানো যৌবনগাথা না এইটা। আগেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, এইটা ষাটোর্ধ্ব চারজন নারীর বন্ধুত্ব ও জীবন অন্বেষণের কাহিনি। কিন্তু উপভোগ করতে পারবেন তরুণতররাও। চরিত্র চতুষ্টয় সিক্সটি-প্লাস বয়সিনী। জীবনে তারা আরেকবার রোম্যান্স আস্বাদনের মওকা চায়। ‘ফিফটি শেইডস্ অফ গ্রে’ পড়েই তাদের এই বোধোদয়। আজি এ প্রভাতে রবির কর / কেমনে পশিল প্রাণের ’পর … অবস্থা এমনই অনেকটা। যা-হোক, মজার ছলে এমন অনেক বোধোদয় সিনেমার দর্শকদেরও হয় সিনেমাটার সঙ্গে আগাতে আগাতে। সেসব সমঝিয়া পাইবেন যার যার মতো, যদি দেখেন ম্যুভিটা।
পাঠচক্র রূপ নেয় প্যাশনেইট সেক্সের আলাপচক্রে। সেইসব সংলাপ প্যজ্ দিয়া কান সেঁটে শোনার মতো মজাদার। ইএল জেইমসের যৌনোপন্যাস ‘ফিফটি শেইডস্ অফ গ্রে’ গোটা সিনেমায় ছায়ার মতো প্রভাব বিছায়ে রেখে চলে। না, ভয়ের কিছু নাই; ফিফটি শেইডসের সাবমিসিভ বা ডমিনোট্রিক্স সেকশ্যুয়্যাল কন্টেন্ট এইখানে এনে সপরিবার সিনেমা দেখার ব্যাঘাত ঘটানো হয় নাই। ইভেন কান খোলা রেখেও উপভোগ করতে তেমন অসুবিধা হবার কথা না। আজকের দুনিয়ায় বাংলা নাটক দেখতে গেলেও তো উদারতা খানিকটা থাকতে হয় ভিয়্যুয়ারের সিস্টেমে। এবং কলকাতার বাংলা সিনেমা নামধেয় দ্রব্যাদি দেখতে গেলে তো উদারতা সাতচামচ বাড়ন্ত থাকতে হয়। ‘লাস্ট স্টোরিস্’-এর অভিঘাতে কলকাতাবাংলা তো কুত্তাপাগল হয়ে উঠল বলে। আর বাংলার ভাইবেরাদর কোম্প্যানি! ইয়া ইলাহি! বুস্যান ফেস্টের জুরিবোর্ড অচিরে টের পাইবেন বাংলা কার বাপ বা ভায়রা ভাই।
ঠিক আছে। এই সিনেমায় ডাইয়্যেইন এক বিধবা, মাত্রই পতিবিয়োগের ট্রমা কাটায়ে উঠি উঠি করছেন, হাঁসফাঁস করছেন নিয়ন্ত্রণের-বেড়া-না-মানা আত্মজাদেরে নিয়া। ভিভিয়্যান পারিবারিক-সাংসারিক দায়বোধবদ্ধতা নিয়া যারপরনাই পেরেশান। শ্যারন স্বামীবিচ্ছিন্ন, পেশায় একজন ফেডারেল জাজ এবং ক্যারল হচ্ছেন পেশায় শেফ/রন্ধনশিল্পী যিনি তার পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহজীবনে সেক্সলেস লাইফ কাটাইছেন দীর্ঘকাল। অন্যরাই তা-ই, লাস্ট কবে সেক্স নিবৃত্ত করেছেন ইয়াদ হয় না কারোরই। সিচুয়্যেশন গুরুচরণ। সিনেমায় দ্ব্যর্থবোধক সংলাপ দিয়া হাস্যরসের ভিয়েনে এই সিচুয়্যেশনগুলো দুর্দান্ত ফুটায়ে তোলা হয়েছে। সম্ভ্রান্ত সংসারের লক্ষ্মীমন্ত অবয়বের নারীরা প্রায় টিনেইজ আচরণে রূপান্তরিত ভূমিকায় পার্ট নিয়েছেন ব্যাপক প্রশংসাযোগ্য। উপন্যাস পাঠোত্তর তাদের এই রূপান্তর এনাফ বিশ্বস্ত হয়েছে অ্যাক্টিঙে।
গ্রে সাহেবের অভিযানে, মানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্রিশ্চিয়্যান গ্রে সাহেবের সেক্সপ্রমত্ত অভিযানে, যেভাবে যাহা যাহা বর্ণিত ঠিক ঠিক সেইভাবে তাহা তাহা আমাদের সিনেমানায়িকা চারজনের জীবনে না-পাওয়া থাকায় যে-একটা হাহাকার আর অচরিতার্থ রোদন, পুরা ব্যাপারটা ভালোভাবে এসেছে। এবং কৌতুকছলে এসেছে। এরপরও যথেষ্ট চোখ কুঁচকিয়েছে, মানে ভাবিয়েছে। ম্যে বি আপনাকেও ভাবাবে। বাংলা ভাবনাচিন্তা বিষয়ে এরই মধ্যে যদি পিয়েচডি নিয়া সারিয়া থাকেন আপনি, ডিস্কাশন তাহলে এইখানেই খতম।
শুধু নারী অভিনেত্রী চারজনেই নন, পুরুষ অভিনেতাদের অনেকেই হলিউডের হেভিওয়েট একেকজন। বিগতযৌবন নারী-পুরুষ নক্ষত্রসমাবেশ বলতে হবে ‘বুকক্লাব’ সিনেমাটাকে। নারীদের মধ্যে ডাইয়্যেইন কিটন, জেইন ফন্ডা, ম্যারি স্টিনবার্গেন এবং ক্যান্ডিস্ বার্গেন প্রত্যেকেই স্বনামচিহ্নিত হলিউডসেলেব। পুং নক্ষত্রদের মধ্যে অ্যান্ডি গার্সিয়া আর ডন জন্সন প্রমুখের নাম নিতে হয়। রিচার্ড ড্রেইফাস অভিনয় করেছেন একটা ক্যামিয়ো রোলে। এই সমস্তকিছু সমবায়ে এইটা একটা ফান ফিল্ম। শুধুই বিগত দিনের প্রিয় অথচ বয়স্ক অভিনয়শিল্পীদের দেখে নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত হবার ফুরসতই মিলবে না, ফানে-প্রাণে ভরপুর রঙিন রম্যচিত্র। অস্থির অবস্থা।
আফসোসের ব্যাপারটাও ওইখানেই। ভীষণ বলিষ্ঠ চার নারী অভিনয়শিল্পীর ফানমেইকিং থিং ছাড়া আরেকটু অভিনয় দেখতে যারা আশায় চেয়ার টেনে বা বালিশ বুকে চেপে দেখতে বসবেন সিনেমাটা, তারা নিরাশ হবেন। কমেডি সিনেমায় সিরিয়াস অভিনয় এক্সপেক্ট করাটাও বলদের না-হলেও বোকার কারবার। আফসোস এ-ই যে, এদের অভিনয় আর কবে দেখা যায় কি না যায়, আবার কখন কবে এমন সন্ধ্যা হবে, জেইন ফন্ডা আশি ক্রস করলেন বোধহয়, ইত্যাদি। লেট’স্ সি।
Movie Title: Book Club ।। Genre: RomCom ।। Director: Bill Holderman ।। Screenplay: Bill Holderman, Erin Simms ।। Starring: Diane Keaton, Jane Fonda, Mary Steenburgen, Candice Bergen ।। Music by Peter Nashel ।। Runtime: 104 Minutes ।। Released in May 2018 | ||
রিভিয়্যুকারী : বিদিতা গোমেজ
… …
- শৈলিন উডলির কথাগুলি (৭) - August 11, 2019
- কেইটের কথাবাত্রা (১০) - July 25, 2019
- টিল্ডা টোল্ড (২) - May 12, 2019
COMMENTS