সপ্তস্ফুট

সপ্তস্ফুট

নব্বইয়ের দশক থেকে এতাবধি বাংলা কবিতায় নিভৃতিচর্চা করে চলেছেন ফজলুররহমান বাবুল। শব্দজোড়টা জাস্ট বলার জন্য বলা হলো, কথার পিঠে একেকটা কথা আমরা হামেশা যেমন বলিয়া থাকি যে অমুক খুব নিভৃতচারী কবি, মোটেও তা নয়। নিভৃতিচর্চা বাগধারাটা বাবুলের ক্ষেত্রে এখানটায় সচেতন প্রয়োগ করা। বাবুলের কবিতাধাঁচটাই নিভৃতিনীলাভ। পঙক্তিগুলাই নিভৃত কোনো কন্দর থেকে বেরিয়ে এসে যেন নিভৃতিতেই নির্বাণপ্রাপ্ত হতে চায়। এ-পর্যন্ত বাইর-হওয়া বাবুলের পাঁচেরও অধিক যে-কোনো কবিতাবই হাতে নিয়া পাঠক টের পাবেন প্রোক্ত কথাগুলো কতটা হাছা বা মিছা।

বাবুল লিখছেন বাংলাদেশে বসে, এবং লিখছেন বাংলাদেশেরই স্বরে। এইটা আবার কেমন কথা যে বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশের স্বরে লেখা বাংলা কবিতা? তাইলে এমন কেউ কি আছে যে বা যারা বাংলাদেশে বসে লেখে বিদেশের স্বরে? এর রিপ্লাই প্রোক্ত প্রশ্নেই নিহিত বোধহয়। বাংলাদেশের কবিতার একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গের স্বর ও ভঙ্গির অনুসৃতি। নিস্তারহীন অনুসৃতির শুরু ও শেষ নিয়া আলাদা সন্দর্ভ ফাঁদা সম্ভব। তবে পশ্চিমবঙ্গীয় ফর্ম্যাটে কাব্যচর্চা বাংলাদেশে বিগত শতকের আশির দশকে একটা আলাদা আদল পায় এবং বোধহয় নাইন্টিসে এর স্ফূর্তি লক্ষিত হয়। রিসেন্টলি বাংলাদেশের কবিতায় বাংলাদেশের স্বরাগম জোরেশোরে টের পাওয়া যাচ্ছে অবশ্য। ফজলুররহমান বাবুল অনেকটাই নিশ্চেষ্ট স্বভাবস্ফূর্ত নব্বইয়ের সেই বিরলতরদের একজন যার কবিতায় কলকাতা নাই।

কিন্তু ফজলুররহমান বাবুলের যে-কবিতাবইটা আমরা হাতে নিয়া আলাপ করতে লেগেছি, এইটা তার সাম্প্রতিক প্রকাশনা নয়, এইটা তার তৃতীয় কবিতাবই। আর এই বইটা ছাপা হয়ে বেরিয়েছে বেশ আগে, একদশক হতে চলল প্রায়। এইটা পুরনো, ২০১২ সনে বেরোনো, বইটা বাইর হয়েছিল সিলেটের এক প্রকাশনসংস্থা ‘ঘাস’ থেকে। তিনফর্মা, কাগজে অ্যাশ ইম্প্রেশন মারা, হার্ডবাইন্ডিং। অ্যাশ ইম্প্রেশন মারা কাগজের অহেতু অন্ধকারাচ্ছন্নতায় কবিতাগুলো পড়তে বেশ বিঘ্ন ঘটায়। এইসব তো কবিতার বাইরের দিক, তবু কথাপ্রসঙ্গে এসে গেল।

‘সপ্তস্ফুট’ ফজলুররহমান বাবুলের তৃতীয় কবিতাবই। হপ্তার সাতদিন সাতভূতের সনে সাংঘর্ষিক থেকেও কবির কণ্ঠে নেই অভিযোগ, থৈ থৈ অনুযোগও নাই কিংবা খামাখা আচম্বিতে বেদনাবৃষ্টির বান, কবির বাকপরিমিতি পাঠকের দৃষ্টি ও মন দুয়ের জন্যই প্রীতিকর। শব্দের জুয়াড়ি নন এই কবি, তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলিতে কিংবা তার পঙক্তিবিন্যাসে নেই খেলাচ্ছলের লীলাচার, বরঞ্চ শব্দের জহুরি তিনি। বিশ্বাস হয়, এই বইয়ের কবিতাগুলো পড়ে, তিনি আবহমান বাংলা কবিতার এক নির্জন আশ্রমিক। মনে হয়, এই বইয়ের পাতাবিহার করতে যেয়ে, বাংলা কাব্যের তপোবনোপনিষদে এই কবি চিত্রকল্পাপ্লুত আরেক শ্রমণ।

ফজলুররহমান বাবুল তার ব্যক্তিগত মহাভারত মুসাবিদার জন্য অবলোকন ও অনুধ্যান করেন প্রতিদিনকার দুনিয়াকাণ্ড, ঐরাবতপিঠে চেপে দুনিয়া দেখতে তিনি অনিচ্ছ, শতচ্ছিন্ন প্রকৃতিনিসর্গের ক্ষত ও থতমত মনুষ্যমনোজগৎ নীলকণ্ঠস্তব্ধ পরখ করিয়া যাওয়া তার বীক্ষণের অভিপ্রেত পর্ব। কবির স্বর কতটুকু সংহত ও নরম, এর একটা উদাহরণ উঠানো যেতে পারে, দেখি নিচে :

কারো হাতের তালুতে লেখা যাবে তো মহাভারত, শ্রাবণের মেঘে? দু-একটা হালকা ফড়িং উড়ছে মাথার ওপর; আছে মেঘে ঢাকা সুনীল আকাশ। আমি হাতে তুলে নিচ্ছি মাটিতে-জড়ো-করে-রাখা একফালি উজ্জ্বল কাঠ। … বিকেলের রৌদ্র, ঘাসের পাতায় বসে থাকা বিন্দু বিন্দু জল, উড়ন্ত প্রজাপতি — এইসবে হবে তো মহাভারত?

হবে না কেন, খুব হয়, প্রকৃত কবির হাতে একটি তিফিল বিন্দুও হতে পারে অনাদিগন্ত মহাসিন্ধু। ফজলুররহমান বাবুলের মহাভারতাখ্যানে ব্যাসদেবের মতো কুরুক্ষেত্র অর্গ্যানাইজ করা লাগে না। পাৎলা হাওয়াবাতাসের ঔদাস্য, হাল্কা হাসিস্মৃতির হাহাকার আর অনির্বচনীয় কবিজৈবনিকতা বাবুলপ্রণীত মহাভারতের অনিবার্য উপাদান।

ফজলুররহমান বাবুল — ‘শব্দের বীজ, ফুলের সুবাস আর মায়া’ আর আশ্চর্য অতীতস্মৃতিবিধুরতা ‘যার মগজের অলিন্দে’ খেলা করে যায় নিত্য, অন্তর্গত রক্ত ও মুদ্রাদোষের অব্যাখ্যেয় রসায়নে সেইসবের প্রকাশ ঘটান তার কবিতায়। এবং, কথা থামানোর জন্য কথাটা আলগোছে এইখানে রেখে একঝটকায় বেরিয়ে যাই নিবন্ধহ্রস্ব বইবিজ্ঞাপনী চিলতে এই গদ্য থেকে, এবং কথাটা এ-ই যে, ফজলুররহমান বাবুলের কবিতা ডামাডোলের-বাইরে-থাকা কাব্যযশার্থী তরুণরা পাঠ করলে ব্রেক-থ্রু লাভ করতে পারেন।

প্রতিবেদন / আতোয়ার কারিম

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you